বাংলা ভাষার জন্ম কথা ও ইতিহাস
আজ এই আর্টিকেলটিতে বাংলা ভাষা, বাংলা ভাষার জন্ম কোথা থেকে হয়েছে এবং বাংলা ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
আরো পড়ুন ঃ ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের মজার গল্প যদু মাস্টার
কোথা থেকে এসেছে আমাদের বাংলা? ভাষা কি জন্নে নেই মানুষের মত? বা যেমন বীজ থেকে গাছ জন্মে তেমন ভাবে জন্ম নেই ভাষা? না, ভাষা মানুষ বা তরুর মতো জন্ম নেয় না। বাংলা ভাষা ও মানুষ বা তরুর মত জন্ম নেয়নি, কোনো কল্পিত স্বর্গ থেকেও আসেনি। এখন আমরা যে বাংলা ভাষা বলি ১০০০ বছর আগে তা ঠিক এমন ছিল না। এক হাজার বছর পরও ঠিক এমন থাকবে না। ভাষার ধর্মই বদলে যাওয়া। বাংলা ভাষার আগেও এ দেশে ভাষা ছিল। সে ভাষায় এদেশের মানুষের কথা বলত, গান গায়ত, কবিতা বানাত। মানুষের মুখে মুখে বদলে যায় ভাষার ধ্বনি। রূপ বদলে যায় শব্দের বদল ঘটে অর্থের। অনেকদিন কেটে গেলে মনে হয় ভাষাটি একটি নতুন ভাষা হয়ে উঠেছে। আর সে ভাষার বদল ঘটেই জন্ম হয়েছে বাংলা ভাষার।
আজ থেকে একশ বছর আগেও কারো কোন স্পষ্ট ধারণা ছিল না বাংলা ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে। কেউ জানতো না কত বয়স এ ভাষার । সংস্কৃত ভাষার অনেক শব্দ ব্যবহৃত হয় বাংলা ভাষায়। একদল লোক মনে করতেন ওই সংস্কৃত ভাষায় বাংলার জননী। বাংলা সংস্কৃতের মেয়ে। তবে দুষ্টু মেয়ে , যে মায়ের কথা মতো চলেনি। না চলে চলে অন্যরকম হয়ে গেছে। তবে উনিশ শতকেই আরেক দল লোক ছিলেন, যারা মনে করতেন বাংলার সাথে সংস্কৃতের সম্পর্ক বেশ দূরের। তাঁদের মতে, বাংলা ঠিক সংস্কৃতের কন্যা নয়। অর্থাৎ সরাসরি সংস্কৃত ভাষা থেকে উৎপত্তি ঘটেনি বাংলার। ঘটেছে অন্য কোন ভাষা থেকে। সংস্কৃত ছিল সমাজের উঁচু শ্রেণীর মানুষের লেখার ভাষা। তা কথ্য ছিল না। কথা বলত মানুষেরা নানারকম 'প্রাকৃত' ভাষায়। প্রাকৃত ভাষা হচ্ছে সাধারণ মানুষের দৈনন্দন জীবনের কত্য ভাষা। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, সংস্কৃত থেকে নয়, প্রাকৃত ষন্তভাষা থেকে উদ্ভব ঘটেছে বাংলা ভাষায়।
আরো পড়ুন ঃ ছোট বাবুদের মজার গল্প নীল বেড়াল
কিন্তু নানা রকম প্রাকৃত ছিল ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে । তাহলে কোন প্রাকৃত থেকে উদ্ভব ঘটেছিল বাংলার? এ সম্পর্কে প্রথম স্পষ্ট মত প্রকাশ করেন জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন। বহু প্রাকৃতের একটি নাম মাগধী প্রাকৃত । তাঁর মতে মাগধী প্রাকৃতের কোন পূর্বাঞ্চলীয় রূপ থেকে জন্ম নেয় বাংলা ভাষা। পরে বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বিকাশের বিস্তৃত ইতিহাস রচনা করেন ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং আমাদের চোখে স্পষ্ট ধরা দেয় বাংলা ভাষার ইতিহাস। যে ইতিহাস বলার জন্য আমাদের একটু পিছিয়ে যেতে হবে। পিছিয়ে যেতে হবে অন্তত কয়েক হাজার বছর।
ইউরোপ ও এশিয়ার বেশ কিছু ভাষার ধ্বনিতে, শব্দে লক্ষ্য করা যায় গভীর মিল। এ ভাষাগুলো যেসব অঞ্চলে ছিল ও এখনো আছে,তার সবচেয়ে পশ্চিমে ইউরোপ আর সবচেয়ে পূর্বে ভারত ও বাংলাদেশ। ভাষাতান্ত্রিকেরা এ ভাষাগুলোকে একটি ভাষাবংশের সদস্য বলে মনে করেন। ওই ভাষাবংশটির নাম ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষাবংশ বা ভারতীয় ইউরোপীয় ভাষাবংশ। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশে আছে অনেকগুলো ভাষা শাখা যার একটি হচ্ছে ভারতীয় আর্যভাষা। ভারতীয় আর্যভাষার প্রাচীন ভাষাগুলোকে বলা হয় প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার প্রাচীন রূপ পাওয়া যায় ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলোতে। এগুলো সম্ভবত লিখিত হয়েছিল যিশুখ্রিস্টের জন্মের ও ১০০০ বছর আগে, অর্থাৎ ১০০০ খ্রিস্টাপূর্বাব্দে। বেদের শ্লোকগুলো পবিত্র বিবেচনা করে তার অনুসারীরা সেগুলো মুখস্থ করে রাখত। শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে যেতে থাকে। মানুষ দৈনন্দিন জীবনে যে ভাষা ব্যবহার করত বদলে যেত যেতে থাকে সে ভাষা। একসময় সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে বেদের ভাষা বা বৈদিক ভাষা। তখন ব্যাকরণবিদরা নানা নিয়ম বিধিবদ্ধ করে একটি মানসম্পন্ন ভাষা সৃষ্টি করেন। এই ভাষার নাম 'সংস্কৃত' অর্থাৎ বিধিবদ্ধ, পরিশীলিত, শুদ্ধ ভাষা।। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দের আগেই এ ভাষা বিধিবদ্ধ হয়েছিল।
আরো পড়ুন ঃ শিশুদের মজার গল্প ফুলপরী
যীশুর জন্মের আগেই পাওয়া যায় ভারতীয় আর্যভাষার তিনটি স্তর। প্রথম স্তর টির নাম বৈদিক বা বৈদিক সংস্কৃত। খ্রিস্টে পূর্ব ১২০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দ এ ভাষার কাল। তারপর পাওয়া যায় সংস্কৃত। খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দের দিকে এটি সম্ভবত বিধিবদ্ধ হতে থাকে এবং খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দের দিকে ব্যাকরণবিদ পাণিনির হাতেই এটি চূড়ান্তভাবে বিধিবদ্ধ হয়। বৈদিক ও সংস্কৃত কে বলা হয় প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা। প্রাকৃত ভাষা গুলোকে বলা হয় মধ্য ভারতীয় আর্যভাষা। মোটামুটি ভাবে খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ অব্দ থেকে ১০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ ভাষাগুলো কথ্য লিখিত ভাষা রূপে ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রচলিত থাকে। এ প্রাকৃত ভাষা গুলোর শেষ স্তরের নাম অপভ্রংশ অর্থাৎ যা খুব বিকৃত হয়ে গেছে। বিভিন্ন অপভ্রংশ থেকেই উৎপন্ন হয়েছে নানান আধুনিক ও ভারতীয় আর্যভাষা বাংলা, হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠি , পাঞ্জাবি প্রভূতি ভাষা।
ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, পূর্ব মাদক মগধী অপভ্রংশ থেকে উদ্ভূত হয়েছে বাংলা; আর আসামি ও ওড়িয়া ভাষা। তাই বাংলার সাথে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আসামি ওড়িয়ার। আর কয়েক কয়েকটি ভাষার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা রয়েছে বাংলার সঙ্গে; কেননা সেগুলো জন্মেছিল মাগধী অপভ্রংশের অন্য দুটি শাখা থেকে। ওই ভাষাগুলো হচ্ছে মৈথিলা, মাগধী, ভোজপুরিয়া। ডক্টর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে অবশ্য একটু ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি একটি প্রাকৃতের নাম বলেই গৌরী প্রাকৃত। তিনি মনে করেন, গৌরী প্রাকৃতেরই পরিণত অবস্থা গৌরী অপবংশ থেকে উৎপত্তি ঘটে বাংলা ভাষার।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url