একজন সুখী মানুষের গল্প
মোড়লের অসুখ। বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে। কবিরাজ মোড়লের নারী পরীক্ষা করছে । মোড়লের আত্মীয় হাসু মিয়া আর মোড়লের বিশ্বাসী চাকর রহমত আলী অসুখ নিয়ে কথা বলছে।
হাসু: রহমত ও রহমত আলী।
রহমত: শুনছি।
হাসু: ভালো করে শোনো, ওই কবিরাজ যতই নারী দেখুক, তোমার মোড়লের নিস্তার নাই।
রহমত: অমন ভয় দেখাবেন না। তাহলে আমি হাউমাউ করে কাঁদতে লেগে যাব।
হাসু: কাঁদো, মন উজাড় করে কাঁদো। তোমার মোড়ল একটা কঠিন লোক। আমাদের সুবর্ণ পুরের মানুষকে বড় জ্বালিয়েছে। এর গরু কেড়ে, তার ধান লুট করে তোমার মোড়ল আজ ধনী। মানুষের কান্না দেখলে হাসে।
রহমত: তাই বলে মোড়লের ব্যারাম ভালো হবে না কেন?
হাসু: হবেই না তো । মোড়ল যে অত্যাচারী, পাপী। মনের মধ্যে অশান্তি থাকলে ঔষুধে কাজ হয় না। দেখে নিও মোড়ল মরবে।
রহমত: আর আজে-বাজে কথা বলবেন না। আপনি বাড়ি যান!
কবিরাজ: এত কোলাহল করো না। আমি রোগীর নারী পরীক্ষা করছি।
রহমত: ও কবিরাজ, নাড়ি কি বলছে! মোড়ল বাঁচবে তো!
কবিরাজ: মূর্খের মতো কথা বলো না। মানুষ এবং পানি অমর নয় আমি যা বলি মনোযোগ দিয়ে তাই শ্রবণ কর।
হাসু: আমাকে বলুন। মোড়ল আমার মামাতো ভাই।
রহমত : মোড়ল আমার মনিব।
কবিরাজ : এই নিষ্ঠুর মোড়ল কে যদি বাঁচাতে চাও, তাহলে একটি কঠিন কর্ম করতে হবে।
হাসু : বাঘের চোখ আনতে হবে?
কবিরাজ : আরো কঠিন কাজ।
রহমত : হিমালয় পাহাড় তুলে আনব?
আরো পড়ুন ঃ ছোট বাবুদের মজার গল্প নীল বেড়াল
কবিরাজ: পাহাড়, সমুদ্র, চন্দ্র, নক্ষত্র কিছুই আনতে হবে না।
মোড়ল : আর সহ্য করতে পারছি না। জ্বলে গেল। হাড় ভেঙ্গে গেল। আমাকে বাঁচাও।
কবিরাজ: শান্ত হও। ও রহমত মোড়লের মুখে শরবত ঢেলে দাও (রহমত মোড়ল কে শরবত গেলে দিচ্ছে)
হাসু : ঐ মোড়ল জোর করে আমার মুরগি জবাই করে খেয়েছে । আমি আজ মুরগির দাম নিয়ে ছাড়ব।
মোড়ল : ভাই হাসু এদিকে এসো, আমি সব দিয়ে দেব। আমাকে শান্তি এনে দাও।
কবিরাজ : মোড়ল তুমি কি আর কোনদিন মিথ্যা কথা বলবে?
মোড়ল : আর বলবো না। এই তোমার মাথায় হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করছি, আর কোনদিন মানুষের উপর জবরদস্তি করব না। আমাকে ভালো করে দাও।
কবিরাজ : লোভে পাপ পাপে মৃত্যু আর কোনদিন লোভ করবে?
মোড়ল : না । লোভ করব না, অত্যাচার করব না। আমাকে শান্তি দাও। সুখ দাও।
কবিরাজ : তাহলে মনের সুখে শুয়ে থাকো, আমি ওষুধের কথা চিন্তা করি।
মোড়ল : সুখ কোথায় পাবো? আমাকে সুখ এনে দাও।
হাসু : অন্যের মনে দুঃখ দিলে কোনদিন সুখ পাবে না।
মোড়ল : আর আর কত টাকা, কত বড় বাড়ি! আমার মনে দুঃখ কেন?
কবিরাজ : চুপ কর। যত কোলাহল করবে তত দুঃখ বাড়বে। হাসু এদিকে এসো, আমার কথা শ্রবণ কর। মোড়লের ব্যারাম ভালো হতে পারে যদি।
রহমত : যদি কি?
কবিরাজ : যদি আজ রাত্রির মধ্যেই--
হাসু : কি করতে হবে?
আরো পড়ুন ঃ শিশুদের ছোট ছোট ২০টি ছড়ার মেলা
কবিরাজ : যদি একটি ফতুয়া সংগ্রহ করতে পারো।
রহমত : ফতুয়া?
কবিরাজ : হ্যাঁ, জামা। এই জামা হবে একজন সুখী মানুষের। তার জামাটা মোড়লের গায়ে দিলে, তৎক্ষণাৎ তার হাড় মড় মড় রোগ ভালো হবে।
রহমত : এ তো খুব সোজা ওষুধ।
কবিরাজ : সোজা নয়, খুব কঠিন কাজ। যাও সুখী মানুষকে খুঁজে দেখো সুখী মানুষের জামা না হলে অসুখী মোড় বাঁচবে না।
মোড়ল : আমি বাঁচব। জামা এনে দাও, হাজার টাকা বকশিশ দেবো।
(বনের ধারে অন্ধকার রাত। চাঁদের প্রদান আলো। ছোট একটি কুঁড়েঘরের সামনে হাসু মিয়া ও রহমত গালে হাত দিয়ে ভাবছে।)
রহমত : কি তাজ্জব কথা, পাঁচ গ্রামে একজনও সুখী মানুষ পেলাম না। যাকেই ধরি সে বলে না ভাই আমি সুখী নই।
হাসু : আর তো সময় নাই ভাই, এখন বারোটা। সুখী মানুষ নাই সুখী মানুষের জামা ও নাই। মোড়ল তো তাহলে এবার মরবে।
রহমত : আহা রে আমরা এখন কি করব! কোথায় একটা মানুষ পাব যে কিনা-
হাসু : পাওয়া যাবে না। সুখী মানুষ পাওয়া যাবে না । সুখ বড় কঠিন জিনিস। এ দুনিয়াতে ধনী বলছে, আরো ধন দাও ; ভিখারি বলছে, আরো ভিক্ষা দাও; পেটুক বলছে, আরও খাবার দাও; শুধু দেও আর দাও; সবাই অসুখী। কারো সুখ নেই।
রহমত : আমরা বলছি, মোড়লের জন্য জামা দাও, আমাদের বকশিশ দাও। আমরাও অসুখী।
হাসু : চুপ চুপ! ঘরের মধ্য কে যেন কথা বলছে।
রহমত : ভুত নাকি? চলেন পালিয়ে যাই । ধরতে পারলে মাছ ভাজা করে খাবে।
হাসু : এই যে, ভাই । ঘরের মধ্যে কে কথা বলছ, বেরিয়ে এসো।
রহমত : ভুত কে ডাকবেন না।
(ঘর থেকে একজন লোক বেরিয়ে এলো)
লোক : তোমরা কে ভাই? কি চাও?
হাসু : আমরা খুব দুঃখী মানুষ। তুমি কে?
লোক ,: আমি একজন সুখী মানুষ।
হাসু : আঁ! তোমার কোন দুঃখ নাই?
আরো পড়ুন ঃ বাংলা ভাষার জন্ম কথা ও ইতিহাস
লোক : না সারাদিন বনে বনে কাঠ কাটি। সে কাঠ বাজারে বেচি । যা পাই , তাই দিয়ে চাল কিনি, ডাল কিনি মনের সুখে খেয়ে-দেয়ে গান গাইতে গাইতে শুয়ে পড়ি । এক ঘুমে রাত কাভার।
হাসু : বনের মধ্যে একলা ঘরে তোমার ভয় করে না? যদি চোর আসে?
লোক : চোর আমার কি চুরি করবে?
হাসু : তোমার সোনাদানা, জামা জুতো?
(লোকটি প্রাণ খোলা হাসি হাসছে)
রহমত : হা হা করে পাগলের মত হাসছে কেন ভাই!
লোক: তোমাদের কথা শুনে হাসছি। চোরকে তখন বলব নিয়ে যাও, আমার যা কিছু আছে তাই নিয়ে যাও।
হাসু : তুমি তাহলে সত্যিই সুখী মানুষ।
লোক : দুনিয়াতে আমার মত সুখী কে? আমি সুখের রাজা। আমি মস্ত বড় বাদশা।
রহমত : ও বাদশা ভাই, তোমার গায়ের জামা কোথায়? ঘরের মধ্যে রেখেছ? তোমাকে ১০০ টাকা দেব। জামাটা নিয়ে এসো।
লোক : জামা।
রহমত : জামা মানে জামা! এই যে আমাদের এই জামার মত জিনিস। তোমাকে ৫০০ টাকা দেব জামাটাঅঅ নিয়ে এসো, মোড়লের খুব কষ্ট হচ্ছে।
লোক : আমার তো কোনো জামা নাই ভাই!
হাসু: মিছে কথা বল না ভাই।
লোক : মিছে বলব কেন? আমার ঘরে কিছু নাই। সেই জন্যই তো আমি সুখী মানুষ।
ধন্যবাদ***
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url