বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ কিভাবে পালিত হয় এবং ইতিহাস
পহেলা বৈশাখ
বাংলা সনের প্রথম মাসের নাম বৈশাখ। পহেলা বৈশাখে বাঙালির নববর্ষ উৎসব। নববর্ষ সকল দেশের সকল জাতিরই আনন্দ উৎসবের দিন। শুধু আনন্দ উচ্ছ্বাসই না, সকল মানুষের জন্য কল্যাণ কামনার ও দিন। আমরা সুখ-শান্তি সমৃদ্ধ ও কল্যাণের প্রত্যাশা নিয়েই মহা ধুমধামের সঙ্গে আমাদের নববর্ষ উৎসব উদযাপন করি। একে অন্যকে বলি শুভ নববর্ষ।
বাংলা নববর্ষ এখন আমাদের প্রধান জাতীয় উৎসব। প্রতি বছরই উৎসব বিপুল মানুষের অংশগ্রহণের বিশাল থেকে বিশাল তর হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে যে এতটা প্রাণের আবেগে এবং গভীর ভালোবাসায় এ উৎসব উদযাপিত হয় তার কারণ পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলার বাঙালিকে এ উৎসব পালন করতে দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে এটা পাকিস্তানি আদর্শের পরিপন্থী । সে বক্তব্য ছিল বাঙালির সংস্কৃতির উপর এক চরম আঘাত। বাঙালি তার সংস্কৃতির উপর এই আঘাত সহ্য করেনি, তারা এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে ধর্ম বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে সকল বাঙালির এ উৎসবকে জাতীয় ছুটির দিন ঘোষণার দাবি জানিয়েছে। কিন্তু সে দাবি অগ্রহ হয়েছে। ফলে পূর্ব বাংলার বাঙালি ফুটে উঠেছে। সোচ্চার হয়ে উঠেছে প্রতিবাদে। এভাবেই পূর্ব বাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং বাঙালি জাতিসত্তা গঠনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় বাংলা নববর্ষ এবং তার উদযাপনের আয়োজন।।
১৯৫৪ সালের পূর্ব বাংলার সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ সরকারকে বিপুলভাবে পরাজিত করে যুক্তফ্রন্টের সরকার গঠিত হলে মুখ্যমন্ত্রী ও বাঙালিদের জনপ্রিয় নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের সরকার বাংলা নববর্ষের ছুটি ঘোষণা করেন এবং দেশবাসীকে শুভ নববর্ষের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। এটা ছিল বাঙালির এক তাৎপর্যপূর্ণ বিজয়ের দিন।
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস ১৯৭১ সাল
কিন্তু সে বিজয় স্থায়ী হয়নি। যুক্তফ্রন্ট ভেঙ্গে দিয়ে এবং সামরিক শাসন জারি করে তা সাময়িকভাবে রুখে দিয়েছে স্বৈরাচারী পাকিস্তানি সরকার । তবে পূর্ব বাংলার বাঙালি, পিছু হটেনি। সরকারিভাবে আর নববর্ষ উদযাপিত হয়নি পাকিস্তান আমলে, কিন্তু বেসরকারিভাবে উদযাপিত হয়েছে প্রবল আগ্রহ ও গভীরতর উৎসব গভীরতর উৎসাহ উদ্দীপনায়। এরমধ্যে সবচেয়ে সুসংঘটিত এবং সুপরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট (১৯৬১) । ১৯৬৭ সাল থেকে রমনার পাকুড়মূলে ছায়ানট নববর্ষের যে উৎসব শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ জাতীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। রাজধানী ঢাকার নববর্ষ উৎসবের দ্বিতীয় প্রধান আকর্ষণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ছাত্র-ছাত্রীদের বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা। এই শোভাযাত্রায় মুখোশ কার্টুন সহ যেসব সংস্কৃতি ঐতিহ্যের প্রতিকধর্মী চিত্র বহন করা হয় তাতে আবহমান বাঙালি দের পরিচয় এবং সমকালীন সমাজ রাজনীতির সমালোচনাও থাকে।
এবার আমরা বাংলা সন ও নববর্ষ উদযাপনের কথা বলি বাংলা সনের ইতিহাস এখনো সু্পষ্টভাবে জানা যায়নি তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও পন্ডিত মনে করেন মোগল সম্রাট আকবর চান্দ্র হিজরী সনের সঙ্গে ভারতবর্ষের সৌর সনের সমন্বয় সাধন করে ১৫৫৬ সাল বা ৯৯২ হিজরিতে বাংলা সন চালু করেন। আধুনিক গবেষকদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন মহামতি আকবর সর্বভারতীয় যে ইলাহী সন প্রবর্তন করেছিলেন তার ভিত্তিতে এই বাংলায় আকবরের কোন প্রতিনিধি বা মুসলমান সুলতান বা নবাব বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সেজন্য একে 'সন' বা 'সাল' বলে উল্লেখ করা হয়। 'সন' কথাটি আরবি আর 'সাল' হলো ফারসি । এখন সন বা সাল ব্যাপকভাবে চালু তবে বঙ্গাব্দ বলে কেউ কেউ।
বাংলা সন চালু হবার পর নববর্ষ উদযাপনে নানা আনুষ্ঠানিকতা যুক্ত হয়। নবাব এবং জমিদাররা চালু করেন পূন্যাহ অনুষ্ঠান পহেলা বৈশাখে প্রজারা নবাব বা জমিদার বাড়িতে আমন্ত্রিত হতেন। তাদের মিষ্টিমুখ ও করানো হতো পান সুপারির ও আয়োজন থাকত। তবে তার মূল উদ্দেশ্য ছিল খাজনা আদায়। মুর্শিদাবাদের নবাবেরা এ অনুষ্ঠান করতেন । বাংলার জমিদারেরাও করতেন এই অনুষ্ঠান জমিদারি উঠে যাওয়াই এই অনুষ্ঠান এখন বিলুপ্ত হয়েছে।
পহেলা বৈশাখের দ্বিতীয় বৃহৎ অনুষ্ঠান ছিল হালখাতা। এ অনুষ্ঠানটি করতেন ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ কৃষি প্রধান তাই ফসলের মৌসুমে ফসল বিক্রির টাকা হাতে না এলে কৃষক সহ প্রায় কেউই নগদ টাকার মুখ খুব একটা দেখতে পেত না। ফলে সারা বছর বাকিতে প্রয়োজনীয় জিনিস না কিনে তাদের উপায় ছিল না পহেলা বৈশাখের হালখাতা অনুষ্ঠানে তারা দোকানিদের বাকির টাকা মিটিয়ে দিতেন । অন্তত আংশিক পরিশোধ করেও নতুন বছরের খাতা খুলতেন। হালখাতা উপলক্ষে দোকানিরা ঝালর কাটা লাল নীল সবুজ বেগুনি কাগজ দিয়ে দোকান সাজাতেন । ধুপধুনা জালাতেন। মিষ্টিমুখ করানো হতো গ্রাহক খরিদ্দারদের। হাসি ঠাট্টা গল্প গুজবের মধ্যে বকেয়া আদায় এবং উৎসবের আনন্দ উপভোগ দুই সম্পন্ন হতো। হালখাতা ও এখন আর তেমন সাড়ম্বরে উদযাপিত হয় না । এখন মানুষের হাতে নগদ পয়সা আছে বাকিতে বিক্রি এখন আর আগের মতো ব্যাপক আকারে হয় না।
আরো পড়ুনঃ উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তে অতিমাত্রায় কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ, সুস্থ থাকার অন্যতম উপায়
বৈশাখী মেলা
বাংলা নববর্ষের আর একটি প্রধান অনুষ্ঠান হল বৈশাখী মেলা । দেশের বিভিন্ন স্থানে বৈশাখের প্রথম দিনে বার্ষিক মেলা বসে । আশে পাশে এসব মেলাগুলোই বেশ পুরনো । এই মেলা গুলোর মধ্যে খুব প্রাচীন ঠাকুরগাঁ জেলার রানীশংকৈল উপজেলার নেকমরদের মেলা এবং চট্টগ্রামের মহামূনির বৌদ্ধ পূর্ণিমা মেলা। এক সময়ে এসব মেলা খুব ধুম ধামের মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠিত হতো। সে মেলা এখন বসে তবে আগের সেই জৌলুস এখন আর নেই।
আগে গ্রাম বাংলার এই বার্ষিক মেলা গুলোর গুরুত্ব ছিল অসাধারণ । কারণ তখনও সারাদেশে বিস্তৃত যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ফলে মানুষের জীবনযাত্রা ছিল স্থবির। এখন যেমন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে একদিনের বেশি সময় লাগে না। আগে তা সম্ভব ছিল না নৌকা ঘোড়ার গাড়ি, গরুর মহিষের গাড়িতে মানুষ বা পূর্ণ পরিবহনে বহু সময় বা কয়েক দিন লেগে যেত। এখন নতুন নতুন পাকা রাস্তা ও দ্রুতগতির যানবাহন চালু হওয়ায় সে সমস্যা আর নেই। আগে এসব আঞ্চলিক মেলা থেকে মানুষ সারা বছরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে রাখত। তাছাড়া এসব মেলা অঞ্চল বিশেষের মানুষের মিলন মেলায় ও পরিণত হতো। নানা সংবাদ আদান-প্রদান নানা বিষয়ে মতবিনিময়ের ও আদর্শ স্থান ছিল এইসব মেলা আবার বাৎসরিক বিনোদনের জায়গাও ছিল মেলা। মেলায় থাকতো কবিগান, কীর্তন , যাত্রা গম্ভীরা গান, পুতুল নাচ, নাগরদোলা সহ নানা আনন্দ আয়োজন।
নববর্ষের ওই তিনটি প্রধান সর্বজনীন উৎসব ছাড়াও বহু আঞ্চলিক উৎসব আছে । এদের মধ্যে চট্টগ্রামের লাল দীঘি ময়দানে অনুষ্ঠিত বলি খেলা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ১৯০৭ সাল থেকে কক্সবাজারসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের নানা স্থানে এই খেলার প্রচলন আছে । এই বিখ্যাত কুস্তি খেলা কে বলা হয় বলি খেলা। আব্দুল জব্বার নামে এক ব্যক্তি এ খেলার প্রবর্তন করেন বলে একে জব্বারের বলির খেলা ও বলা হয়।
আমানি ও নববর্ষের একটি প্রাচীন আঞ্চলিক মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান। এটি প্রধানত কৃষকের পারিবারিক অনুষ্ঠান। চৈত্র মাসের শেষ দিনের সন্ধ্যারাতে গৃহকর্ত্রী এক হাড়ি পানিতে স্বল্প পরিমাণ অপক্ব চাল ছেড়ে দিয়ে সারা রাত ভিজতে দেন এবং তার মধ্যে একটি কচি আমের পাতা যুক্ত ডাল বসিয়ে রাখেন। পয়লা বৈশাখের সূর্য ওঠার আগে ঘর ঝাড়ু দিয়ে গৃহকর্ত্রী সেই হাঁড়ির পানি সারা ঘরে ছিটিয়ে দেন। পরে সেই ভেজা চাল সকলকে খেতে দিয়ে আমের ডালের কচি পাতা হাঁড়ির পানিতে ভিজিয়ে বাড়ির সকলের গায়ে ছিটিয়ে দেন। তাদের বিশ্বাস এতে বাড়ির সকলের কল্যাণ হবে । নতুন বছর হবে সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধির । এ অনুষ্ঠান এখন আর খুব একটা দেখা যায় না। তবে এই অনুষ্ঠান পালন না করায় সঠিক। ইসলামের মতে এগুলা পালন করা জায়েজ না।
নববর্ষের এ ধরনের আরো নানা অনুষ্ঠান আছে। তোমরা নিজ নিজ এলাকায় খোঁজ নিলে তার সন্ধান পাবে তোমাদের সঙ্গে পরিচয় ঘটবে নানা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বৈচিত্রের। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় ও নববর্ষের উৎসব হয়ে হয় নানা আনন্দময় কিরা কৌতুকের মধ্য দিয়ে এরা বৈসুব , সাংগ্রাই ও বিজু তিনটিকে একত্রে করে বৈসাবি নামে উৎসব করে। গ্রাম বাংলায় নববর্ষে নানা খেলাধুলার ও আয়োজন করা হয়। মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ হত গরুর দৌড়, হা-ডু-ডু খেলা, বাহ্মনবাড়িয়ায় মোড়গের লড়াই কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, নড়াইলে ষাঁড়ের লড়াই প্রভূতি।
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্থানসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত
আধুনিক কালের নব আঙ্গিকের বর্ষবরণ উৎসবের সূচনা হয় কলকাতার ঠাকুর পরিবারে এবং শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে। সেই ধারা ধীরে ধীরে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে । আমাদের নববর্ষ উৎসব ৫২ সনের ভাষা আন্দোলনের পর নতুন গুরুত্ব ও তাৎপর্য লাভ করে। আগে সংস্কৃতি সংগঠন ছায়ানটের আয়োজনের কথা বলেছি। এছাড়া বাংলা একাডেমিতে বৈশাখী ও কারুপূন্য মেলা এবং গোটা বিশ্ববিদ্যালয় ও রমনা এলাকা পহেলা বৈশাখের দিনে লক্ষ্য মানুষের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে। নতুন পাজামা পাঞ্জাবি পরে ছেলেরা এবং নানা রঙ্গের শাড়ি পরে নারীরা এই অনুষ্ঠানকে বর্ণিল করে তোলে। রবীন্দ্র সংগীত নজরুলের গান লোকসংগীত এবং বাশির সুরে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে সমবেত আবাল বৃদ্ধ বনিতা। আনন্দময় ও সৌহার্দ্যপূর্ণ এই পরিবেশ আধুনিক বাঙালি জীবনের এই গৌরবময় বিষয়।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url