চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও রাহাজানির পরিণতি সংক্রান্ত হাদীস সম্পর্কে বিস্তারিত
চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও রাহাজানী একটি জঘন্যতম অপরাধ। এ সমস্ত অপরাধ যে ব্যক্তি করে থাকেন। কোন ব্যক্তি তাকে পছন্দ করেনা। আল্লাহপাক ও এ সমস্ত ব্যক্তিদের পছন্দ করেনা এবং তাদের জন্য কঠিন শাস্তির বিধান রেখেছেন।
ভূমিকা:
যে ব্যক্তি, কোন ব্যক্তির দখল হইতে কোন অস্থাবর সম্পত্তি উক্ত ব্যক্তির সম্মতি ব্যতিরেকে অসাধুভাবে গ্রহণ করিবার অভিপ্রায়ে অনুরূপ গ্রহণের উদ্দেশ্যে উক্ত সম্পত্তি স্থানান্তর করে, সেই ব্যক্তি চুরি করে বলিয়া গণ্য হইবে।
যে ক্ষেত্রে পাঁচ বা ততোধিক ব্যক্তি মিলিতভাবে কোন দস্যুতা অনুষ্ঠান করে বা করিবার উদ্যোগ করে কিংবা যে ক্ষেত্রে মিলিতভাবে দস্যুতাকারী বা দস্যুতা অনুষ্ঠান করিবার উদ্যোগকারী ব্যক্তিগণের এবং উপস্থিত ও অনুরূপ দস্যুতা অনুষ্ঠানে বা উহার উদ্যোগে সাহায্যকারী ব্যক্তিগণের মোট সংখ্যা পাঁচ বা ততোধিক হয়, সেইক্ষেত্রে অনুরূপ অনুষ্ঠানকারী প্রত্যেক ব্যক্তি 'ডাকাতি' করে বলিয়া গণ্য হইবে।
যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে অন্য কোন ব্যক্তিকে, উক্ত ব্যক্তি বা অন্য কাহারও প্রতি ক্ষতির ভয় দেখায় এবং তদ্বারা উক্ত ভয় প্রদর্শিত ব্যক্তিকে কোন ব্যক্তির নিকট দান করিতে বা যেকোন প্রকার চাঁদা দিতে অথবা কোন সম্পত্তি বা মূল্যবান জামানত, কিংবা স্বাক্ষরিত বা সীলমোহরকৃত কোন কিছু-যাহা মূল্যবান জামানতে রূপান্তরিত হইতে পারে- হস্তান্তর করিতে প্রবৃত্ত করে, সেই ব্যক্তি 'বলপূর্বক গ্রহণ বা ছিনতাই করে।
চুরি করলে চোরের হাত কাটার বিধান
হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (সা) এক দীনারের চারভাগের এক অংশ বা এর অধিক মূল্যের জিনিস চুরি করলে হাত কাটার নির্দেশ দিতেন।
ব্যাখ্যা
দীনার বলা হয় স্বর্ণ মুদ্রাকে এবং দিরহাম বলা হয় রৌপ্য মুদ্রাকে। তৎকালে ১২ দিরহাম সমান ছিল এক দীনার। সে হিসেবে তিন দিরহাম অর্থাৎ চারভাগের এক দীনার মূল্যের মাল চুরি করার কারণে নবী করীম (সা) চোরের হাত কাটার নির্দেশ দেন। বর্তমান বিশ্বের মুদ্রামানের দৃষ্টিতে দীনারের মূল্য স্থির করে-এর ভিত্তিতে শরীয়াতে হাত-কাটার বিধান চালু করা সম্ভব। হাদীসটি হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ নবী করীম (সা) এক দীনারের চারভাগে এক অংশ বা এর অধিক মাল চুরি করলে চোরের হাত কাটার নির্দেশ দিতেন। রাবী আহমদ ইবন সালিহ (র.) বলেনঃ এক দীনারের চারভাগের এক অংশ বা এর অধিক চুরি করলে হাত কাটা যাবে। হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসলামা (র.) ইবন উমার (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: একদা রাসূলুল্লাহ (সা) তিন দিরহাম মূল্যের ঢাল চুরি করার কারণে এক বক্তির হাত কাটার নির্দেশ দেন।
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (সা) একজন চোরের হাত কাটেন, যে স্ত্রী লোকদের সারি থেকে তিন দিরহাম মূল্যের একটি ঢাল চুরি করেছিল।
আরো পড়ুন: হজ্জ করা জীবনে একবার ফরজ হজ্জের ব্যাখ্যা ও হজ্জের পারিভাষিক অর্থ এবং হজ্জ কখন ফরজ হয়
চোরের হাতকাটার বিধান
আবদুর রহমান ইবনে মুহায়রীয (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ফুযালা ইবন উবায়দুল্লাহ (রা.)-কে চোরের হাত কেটে তার গলায় ঝুলানো সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন: একবার রাসূলুল্লাহ (সা) এর নিকট একজন চোরকে হাযির করা হলে, তার হাত কাটা হয়। এরপর তিনি তার কর্তিত হাত চোরের গলায় ঝুলিয়ে দিতে বলেন।
(আবু দাউদ)
ব্যাখ্যা
আভিধানিক অর্থে চুরি বলতে অন্যের মাল সম্পদ গোপনে নিয়ে যাওয়া বোঝায়। শরীয়াতের বিধানে এর অর্থ হল, অন্যের নির্দিষ্ট পরিমাণ সুরক্ষিত মাল গোপনে নিয়ে যাওয়া। চুরির শাস্তি হল চোরের হাত কবজী পর্যন্ত কেটে দেয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন- 'পুরুষ চোর এবং নারী চোর তাদের উভয়ের হাত কেটে দাও। এটা তাদের কৃতকর্মের ফল এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে চুরির প্রতিবিধান। আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (সূরা আল-মায়িদা। ৩৮) আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেন- 'ব্যভিচারী যখন ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তখন সে মুমিন থাকে না এবং চোর যখন চুরি করে তখন সেও মুমিন থাকে না।
চুরি করা জঘন্য অপরাধ। যে সমাজে চুরি ব্যাপকভাবে সংঘটিত হয়, সেখানে শান্তি থাকতে পারে না।
কি পরিমাণ জিনিস চুরি করলে চোরের হাত কাটা হবে, এ ব্যাপারে আলিমগণের একাধিক মত রয়েছে। ইমাম মালিক, ইমাম আহমাদ ও ইমাম শাফিঈ (র.)-এর মতে এক-চতুর্থাংশ দিনার বা তিন দিরহামের কম চুরি করলে হাত কাটা যাবে না। কিন্তু ইমাম আযম আবু হানীফা (র.)-এর মতে, দশ দিরহামের কম চুরি করলে হাত কাটা যাবে না। হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। বনু মাখযুম গোত্রীয় এক মহিলা চুরি করেছিল। এতে কুরায়শগণ উদ্ভিগ্ন হয়ে পড়ে। তারা বলাবলি করে যে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট এ ব্যাপারে অভিযোগ উত্থাপন করবে? উসামা (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে এ ব্যাপারে আলোচনা করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন- তুমি কি আল্লাহর দন্ড-বিধিসমূহ থেকে এক দণ্ডের ব্যাপারে সুপারিশ করছ? তারপর তিনি দাঁড়িয়ে ভাষণ দিতে গিয়ে বললেন- নিশ্চয়ই তোমাদের পূর্বেকার লোকদের নীতি ছিল যে, যখন কোন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি চুরি করত, তখন তারা তাকে ছেড়ে দিত। আর যখন তাদের মধ্যে কোন দুর্বল ব্যক্তি চুরি করত, তখন তার উপর দন্ড প্রয়োগ করত। আল্লাহর কসম। যদি মুহাম্মদ (সা)- এর কন্যা ফাতিমাও চুরি করে, তাহলে আমি অবশ্যই তার হাত কেটে দেব। পরে ঐ মহিলার হাত কেটে দেওয়া হল। এর দ্বারা বোঝা যায়, চুরি করা বড় অপরাধ এবং এর শাস্তি যত কঠিন হোক তা রদ করা যাবে না।
আরো পড়ুন: সূরা আল-ইমরানের শেষ এগারোটি আয়াত বাংলা উচ্চারণ অর্থ সহ বিস্তারিত
পাগলের চুরি বা অন্য কোন অপরাধের শাস্তি
হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন। তিন ব্যক্তি থেকে কলম উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে (অর্থাৎ যাদের ভাল-মন্দ লেখা হয় না)। এরা হলোঃ (১) নিদ্রিত ব্যক্তি-যতক্ষণ না সে জাগরিত হয়। (২) পাগল ব্যক্তি-যতক্ষণ না সুস্থ হয় এবং (৩) নাবালক ছেলে-মেয়ে যতক্ষণ না তারা বয়োপ্রাপ্ত হয়।
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। একদা উমর (রা.)-এর নিকট একজন পাগলীকে উপস্থিত করা হয়, যে যিনা- ব্যভিচার করেছিল। তিনি (রাসূলুল্লাহ স) সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে, তাকে পাথর মেরে হত্যা করার নির্দেশ দেন। এ সময় আলী (রা.) সেখানে উপস্থিত হয়ে সে মহিলা সম্পর্কে জানতে চান। তখন তাকে বলা হয়। সে অমুক গোত্রের একজন পাগল মহিলা। সে যিনা-ব্যাভিচার করায়, তাকে পাথর মেরে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তখন আলী (রা.) বলেনঃ তাকে ফিরিয়ে আন। উক্ত মহিলাকে ফিরিয়ে আনা হলে আলী (রা.) উমর (রা) এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলেনঃ হে আমীরুল মুমিনিন। আপনি কি অবগত নন যে, তিন ধরনের ব্যক্তি থেকে কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে? তারা হলোঃ (১) পাগল-যতক্ষণ না সে সুস্থ হয় (২) নিদ্রিত ব্যক্তি-যতক্ষণ না সে জাগ্রত হয় এবং (৩) নাবালেগ ছেলে-মেয়ে-যতক্ষণ না তারা বয়োপ্রাপ্ত হয়। তখন উমর (রা.) বলেন: হ্যাঁ। আলী (রা.) বলেনঃ এখন আর এরূপ করা হবে না। আলী (রা.) বলেনঃ আপনি তাকে ছেড়ে দিন। তখন উমর (রা.) তাকে ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ প্রদান করেন এবং তাকবীর পাঠ করতে থাকেন।
উপরোক্ত হাদীস দ্বারা একথা প্রমাণিত হয় যে, পাগল ব্যক্তি জ্ঞান ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত, ঘুমন্ত ব্যক্তি জাগ্রত না হওয়া পর্যন্ত এবং নাবালেগ বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি প্রাপ্ত বয়স্ক বা বালেগ না হওয়া পর্যন্ত শরীআতের বিধান তার উপর আরোপিত হবে না। কারো উপর শরীআতের বিধান জারি করার জন্য তাকে মুকাল্লাফ থেকে হবে অর্থাৎ শরীআতের বিধান পালন করার শর্তাবলী তার মধ্যে পাওয়া যেতে হবে। চুরির শাস্তি অত্যন্ত কঠোর, তাই এ বিধান প্রয়োগের ব্যাপারেও কঠোরতা অবলম্বন করতে হবে। ঘুমের মধ্যে মানুষের কোন জ্ঞান থাকে না, ফলে ঘুমন্ত ব্যক্তি ঘুমের মধ্যে কোন অপরাধ করলে তা শাস্তিযোগ্য বলে বিবেচিত নয়। এমনিভাবে পাগল ব্যক্তির উপরও কোন শান্তির বিধান আরোপ করা যাবে না। কেননা পাগল ব্যক্তির হিতাহিত বা ভালমন্দ বোঝার কোন শক্তি নেই। তাই তার উপরও ইসলামী শরীআত কোন শাস্তির বিধান বা শরীআতের কোন বিধান প্রয়োগ করে না। এমনিভাবে নাবালেগ ছেলে-মেয়ে বালেগ না হওয়া পর্যন্ত শরীআত পালনের ব্যাপারে বাধ্য নয়। তারা কোন অপরাধ করলেও শান্তির যোগ্য বলে বিবেচিত হবে না। কেননা তারা অবুঝ, হিতাহিত জ্ঞান শূন্য এবং ভালমন্দ পার্থক্য করার যোগ্যতা নেই। সুতরাং এ ধরনের ব্যক্তির বেলায় ইসলাম যে দন্ড মওকুফ করেছে তা যুক্তি সংগত এবং মানবিক। যারা চুরির শান্তিতে হাত কাটাকে অমানবিক বলে ধারণা করে থাকে তারা ইসলামী শরীআতের দর্শন বুঝতে সক্ষম নয়। তাই তারা অজ্ঞতাবশত এরূপ উক্তি করে থাকে।
ছিনতাই ও আত্মসাৎকারীর শাস্তি সম্পর্কে
হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ ছিনতাইকারীর হাত কাটা যাবে না। আর যে ব্যক্তি অন্যের মাল ছিনতাই করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।
এ সনদে আরো বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, খিয়ানতকারীর হাতও কাটা যাবে না।
হযরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে উপরোক্ত হাদীসের অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে। তবে এখানে অতিরিক্ত হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, পকেটমারের শাস্তি হাত কাটা নয়। কেননা সে প্রকাশ্যে মাল চুরি করে।
শাস্তির ব্যাপারে পার্থক্য করা যাবে না
রাসূলুল্লাহ (সা) অপরাধীর শাস্তির ব্যাপারে ছোট বড় বা অভিজাত, নিচু জাতে কোন পার্থক্য করতেন না। একজন চোরকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে আনা হলে তিনি তার হাত কাটার নির্দেশ দিলেন। সাহাবীগণ বললেন- "আমরা ভাবিনি, তাকে এ শান্তি দেবেন। তিনি বললেন- আমার কন্যা ফাতিমা ও যদি চুরি করত নিশ্চয়ই আমি তার হাত কাটার নির্দেশ দিতাম।" চুরি করলে চোরের প্রতি স্বজন প্রীতি বা আভিজাত্যের কারণে শাস্তি লঘু করার বা শান্তি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কোন বিধান ইসলামে নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে শান্তি সকল অপরাধীর জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। ঘুষ খেয়ে শাস্তি হালকা করে দেয়া যেমন অপরাধ তেমনিভাবে আত্মীয় বা উচচ বংশীয় বলে শান্তি লঘু করা ও জঘন্য অপরাধ। বিচার কার্য পরিচালনার ব্যাপারে বিচারককে সব সময় নিরপেক্ষ থেকে হবে। পক্ষপাতিত্ব করা কখনো বিচারে নিরপেক্ষতা বজায় থাকে না। এখানে আরেকটি বিষয় জেনে রাখা দরকার- কোন পিতা-মাতা যদি ক্ষুধার বা অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়ে সন্তানের সম্পদ চুরি করে তবে এ জন্য পিতা-মাতার উপর শাস্তি আরোপিত হবে না। কেননা, সন্তানের সম্পদ পিতা-মাতার সম্পদের মতই। হাদীসের মধ্যে আছে, রাসূল (সা) বলেন- তুমিও তোমার ধন-সম্পদ সবই তোমার পিতার।
রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা থাকলে তার পরই চোরের প্রতি উল্লিখিত শান্তি প্রয়োগ করা যাবে অন্যথায় তা করা যাবে না। আর শান্তি কেবল সরকারই দেবে। অন্য কেউ নয়। কেননা আইন প্রয়োগের বৈধতা একমাত্র সরকার বা তার প্রতিনিধির উপর বর্তায়। গ্রামের মাতব্বর, ইমাম সাহেব, আলিম-উলামা বা গণ্যমান্য ব্যক্তি কারো উপর শান্তি প্রয়োগ করার ক্ষমতা রাখেন না। এরূপ করলে তারা রাষ্ট্রীয় অপরাধে দন্ডিত হবেন।
আরো পড়ুন: সূরা তাওবার শেষের দুই আয়াত বাংলা উচ্চারণ সহ অর্থ ও ফযিলত
ডাকাতি
ডাকাতি অর্থ প্রকাশ্য দস্যুবৃত্তি। শক্তি ও বল খাটিয়ে প্রকাশ্যে ভীতি প্রদর্শন করে বা অস্ত্র দেখিয়ে কারও টাকা-পয়সা, সহায়-সম্পদ জোরপূর্বক অপহরণ করাকে ডাকাতি বলে। ডাকাতরা অনেক সময় শুধু ধন-সম্পদ, সোনা-দানাই নিয়ে যায় না, মারধোর, নির্যাতন এবং খুন-যখমও করে। ডাকাতি মারাত্মক যুলুম। অত্যাচার করে অন্যের সম্পদ হরণ করা মহাপাপ। রাসূলুল্লাহ (সা) এ ব্যাপারে সাবধান করে বলেন-
সাবধান। তোমরা অত্যাচার করবে না। সাবধান। স্বতঃস্ফূর্ত অনুমতি ছাড়া অন্যের সম্পদ (গ্রহণ করা) হালাল নয়। (মিশকাত, বায়হাকী, দারেকুতনী) কেউ যদি জোর খাটিয়ে অন্যায়ভাবে কারও সম্পদ নিয়ে নেয়, তা হলে কিয়ামতের দিন ঐ সম্পদ ফেরৎ দিতে হবে। আর এটা নিশ্চিত যে, সেদিন ফেরৎ দেয়া সম্ভব নয়। তখন ঐ পাওনাদারকে তার পুণ্য দিয়ে দিতে হবে। আর পুণ্য না থাকলে যার সম্পদ নেয়া হয়েছে তার পাপের বোঝা ঐ ব্যক্তির ওপর চাপিয়ে দেয়া হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
তোমরা একে অপরের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না।
(সূরা আল-বাকারা: ১৮৮)
ডাকাতি বা ছিনতাইকৃত অর্থ-সম্পদ কোন ভাল কাজে ব্যবহার করা বৈধ নয়, কেউ ভাল কাজে ব্যয় করলে সাওয়াবের পরিবর্তে পাপী হবে। অন্যায়ভাবে অর্জিত সম্পদ অন্যায়, অপরাধ ও অসামাজিক কাজেই ব্যয়িত হয়। এতে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়।
ডাকাতি ছিনতাই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের জন্ম দেয়। বর্তমানে বিমান ছিনতাই করা এবং অস্ত্রের মুখে কাউকে জিম্মি করে অর্থ আদায় করা জঘন্য অপরাধ। বিমান ছিনতাইয়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস সংঘটিত হয়। ছিনতাইয়ের ফলে অনেক জান-মালের ক্ষতি হয়, এতে দেশ-বিদেশের বহু জীবন ও সম্পদ বিনষ্ট হয়।
কোন কোন সময় ধনী ব্যবসায়ী বা সম্পদশালী ব্যক্তিকে বা তাদের সন্তানকে অপহরণ করা হয়, অজ্ঞাত স্থান থেকে পরিবার বা আত্মীয়-স্বজনের কাছে টেলিফোনে বা পত্রে পণ দাবি করা হয়। কখনো কখনো পণ দিয়ে অপহৃত ব্যক্তিকে উদ্ধার করা হয়। এটা জঘন্য অপরাধ। এ ধরনের অপরাধে সহায়তা করা গর্হিত কাজ।
কোন মুমিন মুসলমান ছিনতাই করতে পারে না। কেননা হাইজ্যাক বা ছিনতাই ঈমানের পরিপন্থী কাজ। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন-
যখন কোন ব্যক্তি কোন মূল্যবান বস্তু ছিনিয়ে নেয় আর লোকেরা এ সময় তার দিকে চোখ তুলে দেখতে থাকে, তখন সে ব্যক্তি মুমিন থাকে না। (মুসলিম)
ডাকাতি ও ছিনতাই
ডাকাতি, ছিনতাই, লুট-পাট ইত্যাদি চুরি অপেক্ষা গুরুতর অপরাধ। চুরি হয় গোপনে, আর ডাকাতি, ছিনতাই, লুটপাট হয় প্রকাশ্যে। এর সাথে কখনও কখনও খুন জখমও হয়ে যায়। এর শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে ঘোষণা করেনঃ "যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায়, তাদের শাস্তি এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা ক্রুশবিদ্ধ করা হবে অথবা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদেরকে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে। দুনিয়ায় এটাই তাদের লাঞ্ছনা ও পরকালে তাদের জন্য মহাশাস্তি রয়েছে।"
(সূরা আল-মায়িদা: ৩৩)
আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার অর্থ হল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা। পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ানোর অর্থ বুঝতে হবে সম্পদ নিয়ে যাওয়া ও হত্যার মাধ্যমে অরাজকতা সৃষ্টি করা। এ আয়াতে ডাকাতি, ছিনতাই ও অন্যান্য বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কার্যকলাপ সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কঠোর সতর্কবাণী রয়েছে।
এখানে হত্যা করা, শূলে চড়ানো, হাত ও পা কাটা এবং দেশ থেকে বহিষ্কার করা এ চার প্রকার শাস্তির কথা বলা হয়েছে। বিচারক অপরাধের মাত্রানুযায়ী তা প্রয়োগ করবেন। যে ডাকাত হত্যা ও সম্পদ হরণ এ দু' অপরাধ করবে তাকে হত্যা করা হবে। তারপর শূলে চড়ানো হবে। যে ডাকাত শুধু হত্যা করে কিন্তু মাল না নেয় তাকে হত্যা করা হবে। যে ব্যক্তি হত্যা ও সম্পদ হরণ কোনটাই করে না, কিন্তু অস্ত্র বা অন্য কোন মাধ্যমে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে তাকে দেশ থেকে বিতাড়িত করা হবে।
ছিনতাই, লুট-পাট ও আত্মসাতের জন্য হাত কাটা যাবে না। হযরত জাবির (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ছিনতাইকারীর হাত কাটা যাবে না। আর যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে ছিনতাই করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। এ হাদীস অনুযায়ী ছিনতাইকারীর হাত না কেটে বিচারক সামাজিক শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য অন্য যে কোন শাস্তি দিতে পারেন।
আরো পড়ুন: সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত বাংলা উচ্চারণ অর্থ সহ ফজিলত
বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কার্যকলাপ
সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কার্যকলাপের পরিধি ব্যাপক। যেমন: হত্যা, ষড়যন্ত্র, সম্পদ আত্মসাত, গোলমাল, নিপীড়ন, নির্যাতন ইত্যাদি সন্ত্রাসী তৎপরতা। যে সমাজে এসব কার্যকলাপ অবাধে চলতে থাকে সেখানে শান্তির আশা করা যায় না। মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্র এমন গর্হিত কাজের প্রশ্রয় দিতে পারে না। ইসলামে এ সব কিছুর কোন অবকাশ নেই।
প্রতিটি মানুষ সমাজে শান্তিতে বসবাস করতে চায়। সমাজের কোন মানুষ যেন অপরাধ করে সামাজিক শান্তি ও শৃঙ্খলা নষ্ট না করে এটাই সকলের কাম্য। তবুও সমাজের কিছু মানুষ অন্যের অধিকার খর্ব করে অপরাধ করে বসে। ফলে সামাজিক শান্তি বিঘ্নিত হয়। সমাজে যাতে অপরাধ সংঘটিত না হয় সে লক্ষ্যে ইসলাম সমাজকে কলুষমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন রাখতে চায়। সমাজ তথা রাষ্ট্রের দায়িত্ব হল, যেসব পরিস্থিতিতে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তা থেকে সমাজকে মুক্ত রাখা। যেমন সম্পদের ইনসাফ সম্মত বণ্টন, যাতে অভাবের তাড়নায় কাউকে চুরি, ডাকাতি করতে না হয়। প্রতিটি নাগরিক যাতে নিজ পরিশ্রমলব্ধ আয়ের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতে সক্ষম হয় এবং প্রয়োজনীয় নাগরিক অধিকার ভোগ করতে পারে, সেরূপ ব্যবস্থা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। দেশে নারী-পুরুষের অবাধ মিলন ও যৌন উত্তেজনা উদ্দীপক সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার রোধ করে ব্যভিচারের পথ রুদ্ধ করা প্রয়োজন। খুনখারাবি রোধে সামাজিক দ্বন্দ্ব কলহের অবসান ঘটাতে হবে। সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের ধারা জারী রাখতে হবে। পরনিন্দা, পরচর্চা বন্ধ করার লক্ষ্যে মানুষের নৈতিক চরিত্রের উন্নয়ন করতে হবে।
অপরপক্ষে ইসলাম ব্যক্তির মন-মানসিকতায় আল্লাহর প্রগাঢ় বিশ্বাস ও পরকালের জবাবদিহিতার প্রত্যয় সৃষ্টি করে। তাকে এ কথা পরিষ্কারভাবে অনুধাবন করার সুযোগ দেয় যে, যত সংগোপনেই সে অপরাধ করুক না কেন আল্লাহ তা দেখেন। পরকালে আল্লাহর নিকট এ জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে। পরকালের শাস্তি ইহকালের শাস্তি অপেক্ষা অনেক কঠিন ও স্থায়ী। এ বোধ সৃষ্টি করার মাধ্যমেই কেবল অপরাধের মাত্রা ন্যূনতম পর্যায়ে কমিয়ে আনা সম্ভব। একাধারে সমাজ থেকে অপরাধ সংঘটনের সকল সম্ভাবনা দূরীভূত ও ব্যক্তি চরিত্রের উন্নয়ন সাধনের মাধ্যমেই অপরাধ দমন করা যেতে পারে। এতসব ব্যবস্থা গ্রহণের পরও যদি কোন ব্যক্তি অপরাধ করে বসে, তবে ইসলাম তাকে দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তি দেয়ার পক্ষপাতী।
ধন্যবাদ**
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url