সুদ, ঘুষ ও জুয়া সংক্রান্ত নিষিদ্ধ হাদিস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

 সুদ কী সুদের আদান-প্রদান ঘুষ কি ঘুষের আদান-প্রদান সংক্রান্ত ইসলামী বিধান এবং জুয়া এর বিধান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো 


ভূমিকা 

সুদ এর আরবি প্রতিশব্দ রিবা (৮) এর অর্থ হচেছ বৃদ্ধি পাওয়া বা অতিরিক্ত হওয়া। অর্থাৎ প্রদত্ত পরিমাণের চেয়ে অতিরিক্ত আদায় করাকে সুদ বলে। 

ঘুষ চাওয়া, ঘুষ লওয়ার চেষ্টা করা, না দিলে বিপদ হবে এরূপ হুমকি বা ধমক দেয়াও ঘুষ গ্রহণের শামিল। এছাড়া যারা ঘুষ দিবে এবং যারা ঘুষের আদান প্রদানে কোনরূপ সাহায্য সহযোগিতা করবে তারাও ঘুষদাতা ও ঘুষ গ্রহীতার ন্যায় সমান অপরাধী বলে গণ্য হবে। কেননা হারাম কাজ করা যেমন অন্যায়, তদরূপ হারাম কাজে সাহায্য সহযোগিতা করাও অন্যায়।

জুয়া জঘন্যতম সামাজিক অনাচার। জুয়াকে কুরআন মাজীদের ভাষায় মাইসির বলা হয়েছে। মাইসির অর্থ- সহজ উপার্জন। অন্যায়ভাবে প্রতারণার মাধ্যমে অপরকে বঞ্চিত করে যে অর্থ উপার্জিত হয় তাকে জুয়া বলা হয়।

সুদ কি?

সুদ এর আরবি প্রতিশব্দ রিবা (৮) এর অর্থ হচেছ বৃদ্ধি পাওয়া বা অতিরিক্ত হওয়া। অর্থাৎ প্রদত্ত পরিমাণের চেয়ে অতিরিক্ত আদায় করাকে সুদ বলে। একই শ্রেণীর জিনিসের ক্ষেত্রে এ সুদ প্রযোজ্য এবং সুদ সাধারণত বাকী বিক্রির বেলায়ই হয়ে থাকে। যেমন কেউ এক কেজি আটার বিনিময়ে এক কেজি আটাই গ্রহণ করতে পারে। এর বেশি গ্রহণ করলে সুদ হিসেবে গণ্য হবে। অনুরূপভাবে এক কেজি আটার বিনিময়ে এক কেজি আটা এবং এর অতিরিক্ত অন্য যে কোন জিনিস বা অর্থ গ্রহণ করলে সুদ গ্রহণ করা হয়। সুদের পরিচয় প্রসঙ্গে মহানবী (সা) বলেন- সোনার বিনিময়ে সোনা, রূপার বিনিময়ে রূপা, যবের বিনিময়ে যব, আটার বিনিময়ে আটা, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর, লবণের বিনিময়ে লবণ-একই প্রকার দ্রব্যের বিনিময়ে একই প্রকার দ্রব্য নগদ (আদান-প্রদান) আর অতিরিক্ত হলেই সুদ অর্থাৎ কেউ বেশি দিলে বা বেশি নিলে উভয়েই সুদের মধ্যে লিপ্ত হবে। (মুসলিম )

আরো পড়ুন: চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও রাহাজানির পরিণতি সংক্রান্ত হাদীস সম্পর্কে বিস্তারিত 

ইসলামে সুদ নিষিদ্ধ

ইসলামে সুদ সম্পূর্ণরূপে হারাম অর্থাৎ নিষিদ্ধ। এটা মারাত্মক গুনাহের কাজ। সুদ খাওয়া আল্লাহর সাথে যুদ্ধ করার নামান্তর। পবিত্র কুরআনের মোট ৭টি আয়াত, ৪০টিরও অধিক হাদীস এবং ইজমা দ্বারা সুদ হারাম প্রমাণীত। সুদের অবৈধতা এবং সুদের সাথে সংশ্লিষ্টদের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কিত মাত্র কয়েকটি হাদীসের বাণী নিম্নে তুলে ধরা হলো:

হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল (সা) সুদদাতা, সুদগ্রহীতা, সুদের লেখক এবং সুদের লেনদেনের সাক্ষীদ্বয়ের প্রতি অভিশম্পাত করেছেন। তিনি বলেছেন, তারা সকলেই সমান (অপরাধী)। (বুখারী ও মুসলিম)

সুদ হচ্ছে জুলম ও শোষণের একটি হাতিয়ার। এ জন্য ইসলাম সুদকে চিরতরে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। সমাজ বিজ্ঞানী, দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ ও ইসলামী চিন্তাবিদদের অনেকেই সুদের কুফল আলোচনা করেছেন। সুদের অনিষ্ট শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয় বরং নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও এর প্রভাব সুদূর প্রসারী। সুদের ব্যাপক অনিষ্টকারিতার কারণে মহানবী (সা) সুদ ও সুদখোর এবং সুদী কারবারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। সুদের ফলে সমাজ জীবনের উপর যে বিপদ ঘনীভূত হয়ে আসে, সে সম্পর্কে হাদীসে সতর্কবাণী উল্লেখিত হয়েছে। মহানবী (সা) বলেন-

সুদ ও ব্যভিচার-যেনা যখন কোন দেশে-শহরে বা গ্রামে ব্যাপকতা লাভ করে, তখন তাদের উপর আল্লাহর আযাব আসা অনিবার্য হয়ে পড়ে। (হাকিম)

ইসলাম সুদের ব্যাপারে খুবই কঠোরতা অবলম্বন করেছে এবং অকাট্যভাবে হারাম করে দিয়েছে। এতে করে সামগ্রিকভাবে মানুষের কল্যাণ সাধন করেছে। তাদের নৈতিকতা, সমাজ ও অর্থনীতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছে।

ধনী লোকেরাই সুদ খায় ও সুদের ভিত্তিতে ঋণ দেয়। সুদখোর ব্যক্তি গরীবকে ঋণ দেয় এবং মূলধনের উপর সে বাড়তি টাকা ফেরত নেয়। এরূপ ব্যক্তি আল্লাহর কাছেও যেমন অভিশপ্ত হয়ে থাকে, তেমনি জনগণের কাছেও অভিশপ্ত। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে কেবল সুদ-খোররাই অপরাধী হয় না, যারা সুদ দেয়, সুদ খাওয়ায়, তারাও এ অপরাধে শরীক রয়েছে। সুদের দলিল যারা লিখে এবং তাতে যারা সাক্ষী হয়, তারাও কোন অংশে কম অপরাধী নয়। হাদীসে বলা হয়েছে

 যে সুদ খায়, সুদ খাওয়ায়, তার সাক্ষী হয় এবং তার দলিল লিখে তাদের সকলের উপর আল্লাহ তাআলা অভিশাপ করেছেন। (মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ)


সমাজে যখন করযে হাসানার প্রবর্তন না থাকে এবং সুদের ভিত্তিতে ঋণ গ্রহণ করার যদি তীব্র প্রয়োজন দেখা দেয়, তা হলে শুধু সুদখোরই গুনাহগার হবে। সুদের ভিত্তিতে ঋণ না করাই উত্তম। তাই সুদ থেকে মুক্তি লাভের জন্য সকলকেই প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে হবে। একান্ত কঠিন সমস্যায় পড়া ছাড়া সুদ গ্রহণ করা ঠিক নয়। আর সমস্যায় পড়ে একাজ করতে হলে অত্যন্ত ঘৃণা সহকারে একাজ করতে হবে। এ ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করা চলবে না। এরূপ অবস্থা হলে আল্লাহ তাকে মাফ করে দেবেন।

সূদের পরিণাম সম্পর্কে মহানবী (সা) আরো বলেন-

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, সুদের মধ্যে তিহাত্তরটি গুনাহ রয়েছে। আর সর্বনিম্ন গুনাহটি হল- নিজের মাতাকে বিবাহ করার সমতুল্য। (মুসতাদরাকে হাকিম)

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন- সুদের ভিতর তিহাত্তর প্রকার গুনাহ রয়েছে-এর মধ্যে সর্বনিম্ন গুনাহ হল নিজের মায়ের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হবার সমতুল্য। 

(বায়হাকী ও ইবনে মাজা)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হানযালা (রা.) থেকে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল (সা) বলেছেন, জেনে শুনে সুদের এক দিরহাম গ্রহণ করা ছত্রিশ বার যিনা করা অপেক্ষা মারাত্মক অপরাধ। 

(মুসনাদে আহমদ ও তাবারানী)

হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা যখন কোন জাতিকে ধ্বংস করার ইচ্ছা পোষণ করেন তখন সে সমাজে সুদের প্রচলন বৃদ্ধি করে দেন।

রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, যে ঋণ মুনাফা টানে তা সুদ। (কানযুল উম্মাল)

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ক্ষতিকর সাতটি বিষয় থেকে তোমরা বিরত থাকবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা)। সে সাতটি বিষয় কী? জবাবে তিনি বললেন, (১) আল্লাহর সাথে শরীক করা, (২) যাদু বিদ্যা শিক্ষা ও প্রদর্শন করা, (৩) অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা (৪) সুদ ভক্ষণ করা, (৫) ইয়াতীমের মাল ভক্ষণ করা, (৬) ধর্ম যুদ্ধ থেকে পলায়ন করা এবং (৭) কোন স্বতী-সাধবী রমণীকে অপবাদ দেয়া। 

(বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ ও নাসাঈ) 

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। বিশ্বনবী (সা) বলেছেন, সুদখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (হাকিম)

আরো পড়ুন: উমরাহ হজ্জ কি ওমরাহ হজ্জের গুরুত্ব ও তাৎপর্য 

সুদ খাওয়ার অর্থ

পবিত্র কুরআন ও হাদীসে সুদ খাওয়া এবং খাওয়ানোকে হারাম অর্থাৎ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সুদ সম্পর্কে যে আরবী শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তার অর্থ হচ্ছে খাওয়া। যেমন- 

الذين يأكلون الربوا )যারা সুদ খায়(, لا تأكلو الربوا ) তোমরা সুদ খেয়ো না (, اكل الربا و موکله ) সুদ যে খায় এবং যে দেয়) ইত্যাদি।

বর্তমান যুগে সুদখোর এবং এক শ্রেণীর স্বার্থপর লোক যাদের ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান নেই তারা সুদকে হালাল করার জন্যে ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তারা বলেন- কুরআনে সুদ খাওয়াকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে কিন্তু এর ব্যবহারকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। তাদের এ দাবীর প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পবিত্র কুরআন ও হাদীসে সুদ খাওয়ার নিষিদ্ধতা সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা অসত্য নয়। কিন্তু সুদ খাওয়া অর্থ হচ্ছে সুদ ব্যবহার করা বা গ্রহণ করা বা সুদের আদান-প্রদান করা।

আর তা খাওয়ার জন্যে ব্যবহার করা হোক বা ঘরবাড়ি নির্মাণের জন্যে ব্যবহার করা হোক বা আসবাব পত্র ক্রয়ের জন্যে ব্যবহার করা হোক বা পোষাক পরিচ্ছদের জন্যে ব্যবহার করা হোক। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে সুদ ব্যবহার শব্দটি উল্লেখ না করে সুদ খাওয়া শব্দ ব্যবহার করার কারণ হচ্ছে এই যে, অন্যায়ভাবে কারো কোন জিনিস ব্যবহার করার পর সে সম্বন্ধে জ্ঞাত হবার পরে তা মালিকের নিকট ফেরত দেয়া যায়। কিন্তু কোন জিনিস খেয়ে ফেলা হলে তা আর ফেরত দেয়া যায় না। সুদের ব্যাপারটি ঠিক অনুরূপ। সুতরাং সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করার কথা বোঝাতে গিয়ে কুরআন ও হাদীসে খাওয়া শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে। এটি ভাষার একটি সাধারণ বাকপদ্ধতি। সুতরাং সুদ খাওয়া অর্থাৎ সুদের সর্বপ্রকার ব্যবহার তথা আসবাবপত্র ক্রয়, ঘরবাড়ি নির্মাণ, পোষাক পরিচ্ছদ ক্রয়, সুদ দেয়া নেয়া, সুদের সাক্ষ্য দেয়া, সুদের দলিল লেখা, সরল সুদ, চক্রবৃদ্ধি সুদ, বাণিজ্যিক সুদ এবং সর্বপ্রকার সুদী লেনদেন ইসলামে সম্পূর্ণরূপে হারাম। কেউ যদি সুদের নাম পরিবর্তন করে সুদকে অন্য কোন নতুন নামে আখ্যায়িত করে তাহলে সুদ হালাল হবে না বরং হারামই থাকবে। হারামকে হারামই মনে করতে হবে। সুদকে কোন অবস্থাতেই বৈধ বা হালাল হিসেবে চিন্তা করা যাবে না। এটা ঈমানের দাবী।

ঘুষ সংক্রান্ত হাদীস

হাদীস শরীফে আল্লাহর রাসূল (সা) ঘুষদাতা ও ঘুষ গ্রহীতাকে অভিশপ্ত বলে আখ্যায়িত করেছেন 

والمرتشى হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহীতা উভয়কেই অভিশম্পাত করেছেন। (তিরমিযী)

ঘুষ চাওয়া, ঘুষ লওয়ার চেষ্টা করা, না দিলে বিপদ হবে এরূপ হুমকি বা ধমক দেয়াও ঘুষ গ্রহণের শামিল। এছাড়া যারা ঘুষ দিবে এবং যারা ঘুষের আদান প্রদানে কোনরূপ সাহায্য সহযোগিতা করবে তারাও ঘুষদাতা ও ঘুষ গ্রহীতার ন্যায় সমান অপরাধী বলে গণ্য হবে। কেননা হারাম কাজ করা যেমন অন্যায়, তদরূপ হারাম কাজে সাহায্য সহযোগিতা করাও অন্যায়।

এ বিষযে হযরত উমর ফারুক (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসকে দলিল হিসেবে পেশ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর যুগে একদল লোক সাদাকার অর্থ পাবার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জড়িয়ে ধরত। তারা সাদাকার অর্থ না নিয়ে ফিরে যেতে রাজি হত না। অথচ তারা এর হকদার ছিল না। তথাপি তাদের পিড়াপিড়িতে রাসুলুল্লাহ (সা) তাদেরকে কিছু দিয়ে দিতেন। এ সম্পর্কে হযরত উমর (রা) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন 

তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ এমন আছে, যারা আমার নিকট থেকে সাদাকার মাল নিয়ে বগলে চেপে বের হয়ে যায় অথচ উহা তার জন্য আগুনের ন্যায়। হযরত উমর (রা.) বললেন, আপনি যখন জানেনই যে সেটা তার জন্য আগুনের ন্যায় তখন আপনি তাকে দেন কেন? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, আমি কি করব? ওরা এমনভাবে আবদার করে বসে যে, ওদেরকে ফিরানোই যায় না। মহিমান্বিত আল্লাহ চান না যে, আমি কৃপণতা করি। (মুসনাদে আহমাদ)

ব্যাখ্যা ও শিক্ষা

উপরোক্ত হাদীস থেকে জানা যায়, সাদাকার অর্থ তাদের ন্যায্য প্রাপ্য না হওয়া সত্ত্বেও এবং তা তাদের জন্য অগ্নি এটা জেনেও তাদের চেপে ধরার কারণে রাসুলুল্লাহ (সা) তাদেরকে কিছু মাল দিয়ে দিতেন। সুতরাং ঘুষ দেয়া এবং তা গ্রহণ করা হারাম জেনেও যারা ঘুষ ব্যতীত কাজ করতে চায় না, ঘুষ না দিলে যারা ফাইল পত্র লুকিয়ে রাখে, কিংবা দিনের পর দিন টেবিলে ফাইল ধরে রাখে তাদেরকে যদি নিজের ন্যায্য হক আদায়ের জন্য কিংবা তাদের জুলম থেকে রক্ষা পাবার জন্য নিরুপায় হয়ে শেষ প্রচেষ্টায় ঘুষ দেয়া হয় তাহলে গুনাহ এবং হারাম হবার কথা নয়। অন্যদিকে ঘুষ দাতা ও ঘুষ গ্রহীতা এবং ঘুষের আদান প্রদানে যারা সহযোগিতা করবে তারাও অভিশপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। কেননা পাপ কাজ করা বা পাপ কাজে সহযোগিতা করা উভয়ই সমান অপরাধ। তবে তৃতীয় ব্যক্তি অর্থাৎ সাহায্যকারী যদি ঘুষদাতা কর্তৃক নিযুক্ত হয় এবং ন্যায্য অধিকার আদায় বা জুলম থেকে বাঁচার জন্য নিরুপায় হয়ে ঘুষের আদান প্রদানে সহযোগিতা করে তাহলে তার অবস্থা ঘুষদাতার মতোই হবে অর্থাৎ সে অভিশপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে না। আর যদি অবৈধ ও নিয়ম বহির্ভুতভাবে সুযোগ সুবিধা লাভের জন্য ঘুষ প্রদানে সহযোগিতা করে তাহলে সে ঘুষদাতার ন্যায় অভিশপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। অপরদিকে তৃতীয় ব্যক্তি অর্থাৎ সাহায্যকারী যদি ঘুষ গ্রহণকারী কর্তৃক নিযুক্ত হয় এবং ঘুষের আদান প্রদানে সহযোগিতা করে যায় তাহলে সে ঘুষ গ্রহীতার ন্যায় অভিশপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। কারণ তাকে তো ঘুষ খেতে কেউ বাধ্য করেনি। ঘুষ খাওয়া বা গ্রহণ করা সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছার উপরই নির্ভর করে। এছাড়া শাসককে ঘুষ দেয়া সর্বাবস্থায় হারাম, তা কারো কোন প্রকার জুলম থেকে বাঁচার জন্য হোক বা ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য হোক।

আরো পড়ুন: কোরবানি কি কোরবানির পশু জবাইয়ের নিয়ম ও পশু জবাইয়ের দোয়া 

জুয়া কি?

জুয়া জঘন্যতম সামাজিক অনাচার। জুয়াকে কুরআন মাজীদের ভাষায় মাইসির বলা হয়েছে। মাইসির অর্থ- সহজ উপার্জন। অন্যায়ভাবে প্রতারণার মাধ্যমে অপরকে বঞ্চিত করে যে অর্থ উপার্জিত হয় তাকে জুয়া বলা হয়। জুয়ার মালিকানা বা লাভ ঘটনাক্রমের ওপর নির্ভরশীল। এক ব্যক্তির সম্পদ অন্য ব্যক্তির হস্তগত হওয়ার ভাগ্যক্রমে বা দৈব চক্রের সব কাজই জুয়ার অন্তর্ভুক্ত। এটি একটি শয়তানী, অত্যন্ত ঘৃণ্য ও প্রতারণামূলক কাজ। জুয়া সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন

হে মুমিনগণ। মদ, জুয়া, মূর্তি পূজার বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জ কর-যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো। (সূরা আল-মায়িদা: ৯০)

জুয়া ও লটারি সামাজিক অনাচার ও অপরাধের মধ্যে একটি মারাত্মক অপরাধ। মানুষ বহু প্রাচীনকাল থেকে এ পাপাচার ও পাপানুষ্ঠানে আসক্ত হয়ে আছে। সমাজের বহু অন্যায় এ জুয়ার পাপাচার থেকে ছড়িয়ে পড়ে। ইসলাম তাই জুয়াকে চিরতরে নিষিদ্ধ ও হারাম ঘোষণা করেছে।

জাহেলী যুগে জুয়া

আরবের জাহিলী যুগের লোকেরা নানাভাবে জুয়া খেলত। তার মধ্যে একটি হচেছ- আযলাম। আযলাম এমন শরকে বলা হয়, যা দ্বারা আরবে ভাগ্য নির্ধারণী জুয়া খেলার প্রথা প্রচলিত ছিল। দশ ব্যক্তি শরীক হয়ে একটি উট যবাহ করত। কিন্তু সমান অংশে মাংস ভাগ না করে তা দ্বারা জুয়া খেলা হত। দশটি শরের সাতটিতে বিভিন্ন অংশ অঙ্কিত থাকত। আর তিনটি শর অংশবিহীন সাদা থাকত। যার নামে যে অংশ বিশিষ্ট শর ওঠত সে তত অংশ মাংস পেত। আর যার নামে অংশবিহীন শর ওঠত, সে কিছুই পেত না। ইসলামে এ ধরনের কাজকে হারাম করা হয়েছে। কেননা, এতে প্রকৃত মালিক বঞ্চিত হয়। সুরা মায়িদায় বলা হয়েছে- "শয়তান চায় মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে তোমাদের বিরত রাখতে। অতএব তোমরা এখনও কি নিবৃত হবে না।" (সুরা-মায়িদাঃ ৯১)

আধুনিক কালে জুয়া

আধুনিক বিশ্বে নানাভাবে নানা উপায়ে এ জুয়ার আসর জমজমাট করে রেখেছে। বিভিন্ন নামে চলছে জুয়ার আড্ডা। লটারিও এক রকম একটি জুয়া। ইসলাম সব ধরনের জুয়াকে হারাম করেছে।

জুয়া ও লটারীর কুফল

জুয়া একটি শয়তানী কাজ। আল্লাহ বলেন: এটি ঘৃণ্য বস্তু ও শয়তানের কাজ। (সূরা আল-মায়িদা ৯০)

ও মদ ইত্যাদির মাধ্যমে শয়তান মানুষের পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করে। জুয়ার দ্বারা হয় অন্যজন হয় নিঃস্ব। ফলে একে অপরের মধ্যে ভীষণ শত্রুতা শুরু হয়।

জুয়া একজন লাভবান জুয়া সম্পদ অর্জনের কোন মাধ্যম নয়। এটা বিনা শ্রমে অন্যকে বঞ্চিত করে সম্পদ অর্জনের অপকৌশল। কাজেই বন্টনের এ ব্যবস্থাটি ন্যায়নীতি বিহীন, নির্যাতন ও প্রবঞ্চনামূলক। তাই একাজের মাধ্যমে অর্থোপার্জন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।

জুয়া সকলের জন্য খারাপ। এতে কোনো কল্যাণ নেই। এজন্য যে সব বস্তু বা কাজ আমাদের জন্য কল্যাণকর আল্লাহ তাআলা তা আমাদের জন্য হালাল করেছেন। আর যা অকল্যাণকর তা হারাম করে দিয়েছেন।

জুয়া একটি প্রতারণামূলক অর্থোপার্জনের মাধ্যম। প্রতারণামূলকভাবে এতে অন্যের অধিকার কুক্ষিগত করা হয়। মহানবী (সা) বলেন- যে প্রতারণা করে সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। (মুসলিম)

জুয়ার দ্বারা আপাত লাভ হলেও এর দীর্ঘ মেয়াদী ফল হচ্ছে এক সময় জুয়াড়ী সর্বশান্ত হয়ে পড়ে।

বিনা শ্রমে জুয়ার মাধ্যমে অর্জিত টাকা পেয়ে তা খরচ করার জন্য জুয়াড়ী নানা পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে। জুয়াড়ী যিনা-ব্যভিচার ও মাদকাসক্ত হয়।

জুয়ার টাকা সংগ্রহের জন্য জুয়ারী নানা ফন্দি-ফিকির করে। নিজের সম্পদ নষ্ট করে। অপরের টাকা লুট করে, চুরি- ডাকাতি, ছিনতাই-রাহাজানি ও সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ে।

জুয়া অনেক অপকর্মের জন্ম দেয়। সমাজকে কলুষিত করে। জুয়ার দ্বারা সংক্রমিত ব্যক্তি ও সমাজ মানবতার ঘৃণ্য শত্রু। এজন্য কুরআনে একে শয়তানী কাজ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

জুয়া একটি সামাজিক অনাচার। অনেক পাপাচারের উৎসাহদাতা। জুয়া সংক্রমণ ব্যাধির মত। এ ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে ব্যক্তি, সমাজ, সভ্যতা কলুষিত হয় এবং নিঃশেষে ফাংস প্রাপ্ত হয়। এ কারণে ইসলাম জুয়াকে চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাই জুয়ার ন্যায় প্রতারণামূলক উপায়ে অর্থ উপার্জন থেকে প্রতিটি উম্মতকে নিরাপদ থাকতে হবে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url