যাকাত কি যাকাত না দেওয়ার পরিনতি যাকাত ফরজ হওয়ার কারণ স্বর্ণ ও রৌপ্যের যাকাত
ঋণগ্রস্ত এবং নাবালেগ শিশুদের যাকাতের বিধানযাকাত দিতে অস্বীকারকারীর বিরুদ্ধে হযরত আবু বকর (রা)-এর গৃহীত পদক্ষেপ,যাকাত না দেয়ার পরিণতি সম্পর্কে আলোকপাত করতে পারবেন যাকাত ফরয হওয়ার কারণ নির্ণয় করতে পারবেন যাকাত ফরয হওয়ার ন্যূনতম পরিমাণ ও স্বর্ণ রৌপ্যের যাকাতের বিধান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো
ভূমিকা
যাকাত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি, যা মুসলমানদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কর্তব্য। যাকাত হচ্ছে সম্পদের একাংশ গরীবদের এবং সমাজের অন্যান্য প্রয়োজনমন্দ লোকদের দেওয়া। এটি সাধারণত বার্ষিক আয়ের ২.৫% পরিমাণে নির্ধারিত হয়। যাকাতের উদ্দেশ্য হলো সমাজে সম্পদের সমতা আনা এবং দরিদ্রদের সহায়তা করা।
যাকাত কি
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। নবী করীম (সা) যখন হযরত মুআয (রা)-কে ইয়েমেন পাঠিয়েছিলেন, তখন তাঁকে বলেছেন: তুমি আহলি কিতাবদের এক জাতির নিকট পৌঁছবে। আর তাঁদেরকে এ কথার সাক্ষ্য দিতে আহ্বান জানাবে যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই এবং আমি আল্লাহ তাআলার রাসূল। তারা যদি তোমার এ কথা মেনে নেয়, তারপর তাদেরকে জানিয়ে দাও যে, আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি দিনরাতের মধ্যে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয করে দিয়েছেন। তোমার এ কথাও যদি তারা স্বীকার করে নেয়, তবে তাদেরকে জানিয়ে দাও যে, আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি তাদের ধনসম্পত্তির উপর যাকাত ফরয করে দিয়েছেন। তাদের ধনী লোকদের নিকট থেকে গ্রহণ করা হবে ও তাদেরই গরীব-ফকীর লোকদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। তোমার এ কথাও যদি তারা মেনে নেয় তবে তাদের উত্তম মালই যেন তুমি যাকাত বাবদ আদায় করে না নাও। আর তুমি মজলুমের দোয়াকে সব সময় ভয় করে চলবে। কেননা মজলুমের দোয়া ও আল্লাহর মাঝখানে কোন আবরণ-অন্তরাল বর্তমান নেই। (বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমদ)
আরো পড়ুন: চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও রাহাজানির পরিণতি সংক্রান্ত হাদীস সম্পর্কে বিস্তারিত
যাকাত ইসলামের পঞ্চ বুনিয়াদের অন্যতম একটি বুনিয়াদ। সালাতের পরই যাকাতের বিষয় আলোচিত হয়েছে। সাহেবে নিসাবের অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেক মুসলিমের উপর যাকাত আদায় করা ফরয। রাসূলে করীম (সা) দশম হিজরী সনে বিদায় হজ্জে গমনের পূর্বে হযরত মুআয (রা)-কে ইয়েমেনে পাঠিয়ে ছিলেন। অবশ্য কারো মতে নবম হিজরী সনে তাবুক যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনের সময়ে হযরত মুআযকে ইয়েমেনে পাঠানো হয়েছিল। আবার কেউ বলেছেন যে, অষ্টম হিজরী সনে মক্কা বিজয়ের বৎসর তাঁকে পাঠানো হয়। (সারহুল মুসনাদ, ৮ম খন্ড, পৃ-১৮৯)
অতঃপর হযরত মুআয (রা) ইয়েমেনেই অবস্থান করছিলেন। তিনি তথা থেকে হযরত আবু বকরের (রা) খিলাফতকালে ফিরে আসেন। তাঁকে ইয়েমেনে শাসনকর্তা হিসেবে পাঠানো হয়েছিল, কি বিচারপতি হিসেবে, এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক মুহাদ্দিসগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ইবনে আবদুল বার দ্বিতীয় মত পোষণ করেন, আল- কাসানী প্রথম মত সমর্থন করেন। যে
মহানবী হযরত রাসূল (সা) মুআয (রা) কে ইয়েমেনে প্রেরণের সময় যে উপদেশ বা নির্দেশ প্রদান করেছিলেন আলোচ্য হাদীসে তাই বর্ণনা করা হয়েছে।
হযরত মুআযকে আহলি কিতাবদের সম্মুখে সর্বপ্রথম আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত পেশ করতে বলা হয়। কেননা ইসলাম ও ঈমানের মূল ভিত্তিই হচ্ছে এ দুটি। এ দুটি বিষয়ে ঈমান সর্বপ্রথম আনা না হলে ইসলামের অপর কোন কাজই শুদ্ধ থেকে পারে না। আর আহলি কিতাবদের মধ্যে কিছু লোক তাওহীদ বিশ্বাসী থাকলেও প্রথমত তাদের ঈমান সুস্পষ্ট ও দৃঢ়ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না এবং আল্লাহকে বিশ্বাস করলেও হযরত মুহাম্মদ (সা)-কে আল্লাহর রাসূলরূপে মেনে না নিলে সে তাওহীদ বিশ্বাসের কোনই মূল্য হয় না। এ কারণে আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত সর্বপ্রথম দেওয়ার কথা শিক্ষা দেওয়া হয়। বস্তুত যে কোন সময়ে, যে কোন যুগে যে কোন সমাজের লোকদের সম্মুখে ইসলামের এটাই প্রথম দাওয়াত। তারপরই তদনুযায়ী আমল করা, শরীঅতের হুকুম আহকাম মেনে নেয়া ও পালন করার নির্দেশ দেয়া যেতে পারে, তার পূর্বে নয়। এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, ঈমানের পরই যেমন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত পড়া ফরয তেমনি ঈমানদার ধনী লোকদের উপর নিয়মিত যাকাত আদায় করা ফরয এবং ইসলামী সরকার, হয় নিজস্ব ক্ষমতায় সরাসরিভাবে কিংবা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধির মাধ্যমে এ যাকাত আদায় করার অধিকারী হয়। এমতাবস্থায় কোন মুসলিম ধনী ব্যক্তি যদি যাকাত আদায় না করে কিংবা যাকাত আদায় করতে রাযী না হয়, তবে ইসলামী সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রয়োগ করে এটা আদায় করতে পারবেন।
এখানে মূল হাদীসে 'সাদকা' (১৩) শব্দটি উল্লেখিত হয়েছে। এখানে 'সাদকা' অর্থ যাকাত, যা আদায় করা ফরয, সাধারণ দান-খয়রাত নয়। কেননা কুরআন মাজীদেও 'সাদকা' এ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। আর দ্বিতীয়ত সাধারণ দান খয়রাত কখনো ফরয নয় এবং তা জোর প্রয়োগে আদায় করার নিয়ম নেই। অথচ এখানে বলা হয়েছে আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি 'সাদকা' ফরয করে দিয়েছেন।
কুরআন মাজীদে 'সাদাকা' অর্থাৎ যাকাত ব্যয়ের আটটি খাত ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু আলোচ্য হাদীসে তন্মধ্যে মাত্র একটি খাতেরই উল্লেখ করা হয়েছে। এটা থেকে ইমাম মালিক এ মত গ্রহণ করেছেন যে, আটটি খাতের যে কোন একটি খাতে যাকাত ব্যয় করলে তা অবশ্যই জায়েয ও যথেষ্ট হবে। তবে ইবনে দাকীকুল-ঈদ এখানে একটি মাত্র খাতের উল্লেখ করার কারণ দর্শায়ে বলেছেন যে, প্রধানত ও সাধারণত ফকীর-গরীব লোকদেরকেই যাকাত দেয়া হয় বলে এখানে তারই উল্লেখ করা হয়েছে। নতুবা এর অর্থ কখনো এই নয় যে, একটি খাতে যাকাত ব্যয় করলেই তা যথেষ্ট হবে।
ইমাম খাত্তাবী এ হাদীসের ভিত্তিতেই বলেছেন যে, ঋণগ্রস্ত লোকদের উপর যাকাত ফরয নয়। কেননা এ ঋণ পরিমাণ সম্পদ বাদ দিলে যাকাত ফরয হওয়ার পরিমাণ সম্পদ তার নিকট অবশিষ্ট থাকে না। ফলে সে ধনী বলে গণ্য থেকে পারে না। তবে ঋণ আদায় করা বা ঋণ পরিমাণ সম্পদ বাদ দেওয়ার পর যে পরিমাণ সম্পদ অবশিষ্ট্য থাকবে, তা যদি যাকাত ফরয হওয়ার পরিমাণ )نصاب( হয়, তবে তার উপর অবশ্যই যাকাত ফরয এবং তা অবশ্যই আদায় করতে হবে।
না-বালেগদের উপরও যাকাত ফরয। কেননা যাকাত আদায়ের কথা সাধারণভাবে সর্ব শ্রেণীর ধনীদেরই শামিল করে। শাফেয়ী মাযহাব মতে বালকদের উপর নয়, তাদের ধন-সম্পদ থাকলে তার উপর যাকাত ফরয হবে। পাগল ও বুদ্ধিহীন লোকদের সম্পর্কেও এ কথা প্রযোজ্য। দলীল হিসেবে একটি হাদীস এখানে উদ্ধৃত করা হয়েছে। নবী করীম (সা) বলেছেনঃ
তোমরা জেনে রেখে, যে লোক কোন ইয়াতীমের অভিভবক হয়ে বসে, সে যেন সে ইয়াতীমের ধন-মাল মুনাফাজনক কাজে নিয়োগ করে এবং তা যেন যাকাত দিয়ে শেষ হয়ে যাওয়ার জন্য ফেলে না রাখে।
বস্তুত ইয়াতীমের ধন-সম্পদ থেকে যে যাকাত দিতে হয়-তা কোন লাভজনক কাজে নিয়োজিত করা হোক বা না হোক, যাকাত দিতে দিতে মূল সম্পদ নিঃশেষ হোক বা না হোক একথা এ হাদীস থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠে। কিন্তু হানাফী মাযহাবে একথা স্বীকৃত হয়নি। তাঁরা বলেছেন, যাকাত ফরয হওয়ার জন্য ধন-সম্পদের মালিকের সুস্থ জন- বুদ্ধি-সম্পন্ন ও পূর্ণ বয়স্ক হওয়া অনিবার্য শর্ত। অতএব না-বালেগ ও অসুস্থ মস্তিস্ক ব্যক্তির ধন-মালে যাকাত ফরয নয়,।
আরো পড়ুন: সুদ, ঘুষ ও জুয়া সংক্রান্ত নিষিদ্ধ হাদিস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
যাকাত অস্বীকারকারীর বিরুদ্ধে হযরত আবু বকর (রা) এর যুদ্ধ ঘোষণা-
হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন। নবী করীম (সা) যখন ইন্তিকাল করলেন ও তাঁর পর হযরত আবু বকর (রা) খলীফা (নির্বাচিত) হলেন, আর আরবদেশের কিছু লোক 'কাফির' হয়ে গেল, তখন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) হযরত আবু বকর (রা)-কে বললেন, আপনি এ লোকদের বিরুদ্ধে কিভাবে লড়াই করতে পারেন, অথচ নবী করীম (সা) তো বলেছেন: 'লোকেরা যতক্ষণ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, (এক আল্লাহ ছাড়া আর কেউ মাবুদ নেই) মেনে না নিবে, ততক্ষণ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আমি আদিষ্ট হয়েছে। যদি কেউ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, স্বীকার করে, তবে তার ধন-সম্পদ ও জানপ্রাণ আমার নিকট পূর্ণ নিরাপত্তা লাভ করবে। অবশ্য এর হিসাব গ্রহণের দায়িত্ব আল্লাহর উপর ন্যস্ত। তখন হযরত আবু বকর (রা) বললেনঃ আল্লাহর শপথ, যে লোকই সালাতহ ও যাকাতের মাঝে পার্থক্য সৃষ্টি করবে, তার বিরুদ্ধে আমি অবশ্যই যুদ্ধ করব। কেননা যাকাত হচ্ছে মালের হক। আল্লাহর শপথ, তারা যদি রাসূলের সময় যাকাত বাবদ দিত এমন এক গাছি রশিও দেয়া বন্ধ করে, তবে অবশ্যই আমি তা দেয়া বন্ধ করার কারণে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করব। তখন উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) বললেনঃ আল্লাহর শপথ করে বলছি, এটা আর কিছু নয়। আমার মনে হল, আল্লাহ যেন আবু বকরের অন্তর যুদ্ধের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন এবং বুঝতে পারলাম যে, এটাই ঠিক (তিনি নির্ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন)। (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ, আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদ)
এ হাদীসটি দ্বীন ইসলামের এক ভিত্তি বিশেষ। এতে কয়েক প্রকারের জরুরী ইলম সন্নিবেশিত হয়েছে। ফিকহের কয়েকটি জরুরী মাসআলাও এ হাদীস থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
প্রথমত হাদীসটির ঐতিহাসিক পটভূমি বিশ্লেষণ প্রয়োজন। রাসূলে করীম (সা)-এর ইন্তিকালের পর আরবের কয়েকটি গোত্র মুর্তাদ হয়ে যায়। এরা প্রধানত দু-ধরনের লোক ছিল। এক ধরনের লোক, যারা মূল দ্বীন ইসলাম ত্যাগ করে পুরোপুরি কাফির হয়ে গিয়েছিল এবং সম্পূর্ণ কুফরী সমাজের সাথে মিলিত হয়েছিল। আলোচ্য হাদীসে হযরত আবু হুরায়রা (রা) আরবের কিছু লোক কাফির হয়ে গেল বলে এদের কথাই বুঝিয়েছেন। আর মুসনাদে আহমদে বর্ণিত হাদীসের ভাষা হল- وارتد من ارتد কিছু লোক মুর্তাদ হয়ে গেল। এ লোকগুলো আবার দু দলে বিভক্ত ছিল। একটি দল মুসায়লিমাতুল কায্যাব ও আসওয়াদুল আনাসীর মিথ্যা নবুওয়াতের দাবীকে সত্য বলে মেনে নিয়েছিল। এরা সকলেই হযরত মুহাম্মদের (সা) নবুওয়াত অমান্য করেছিল এবং তাঁর বিরোধী ব্যক্তিদের নবুওয়াত দাবী সত্য বলে বিশ্বাস করে নিয়েছিল। হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) এদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। এ যুদ্ধের ফলে মুসায়লিমা ও আসওয়াদ উভয়ই নিহত হয় এবং তাদের দলবল নির্মূল হয়ে যায়।
আর দ্বিতীয় দলে ছিল সেসব লোক, যারা দ্বীন ইসলামের আইন বিধান পালন করতে অস্বীকার করে। তারা সালাত ও যাকাত ইত্যাদি শরীঅতের যাবতীয় হুকুম-আহকাম অমান্য করে ও জাহিলিয়াত যুগের মতই সম্পূর্ণ বে-দ্বীন হয়ে জীবন যাপন করতে শুরু করে। এর দরুন তখনকার সময়ে পৃথিবীর বুকে মক্কার মসজিদ, মদীনার মসজিদ ও বাহরাইনের 'জাওয়াসাই' নামক গ্রামে অবস্থিত 'মসজিদে আবদুল কাইস'-এ তিনটিই একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদা করার জন্য অবশিষ্ট্য থাকে।
দ্বিতীয় ধরনের লোক ছিল তারা, যারা সালাত ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করত। তারা সালাতকে ফরয হিসেবে মানত। কিন্তু যাকাত আদায় করা ও তা বায়তুলমালে জমা করানো ফরয মনে করত না। আসলে এরাই ছিল বিদ্রোহী দল। কিন্তু সেকালে তাদেরকে 'বিদ্রোহী' নামে আখ্যায়িত করা হয়নি। কেননা তখন এরা সাধারণ মুর্তাদের মধ্যেই গণ্য হত। এদের মধ্যে এমন লোকও অবশ্য ছিল, যারা যাকাত দিতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু তাদের নেতৃস্থানীয় লোকেরা এজন্য তাদেরকে বাধা দান করেছিল।
যে বিদ্রোহী লোকেরা যাকাত দিতে অস্বীকার করত, তাদের মনে একটা ভুল একটি আয়াতকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছিল। আয়াতটি এইঃ ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল। তারা কুরআনের একটি আয়াতকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছিল। আয়াতটি এই
হে নবী। তাদের ধন-মাল থেকে যাকাত গ্রহণ করুন। এর সাহায্যে আপনি তাদেরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করুন। (সূরা আত-তাওবা: ১০৩)
বস্তুত যাকাত দেয়া যে কত বড় ফরয এবং তা না দিলে বা দিতে অস্বীকার করা হলে ইসলামী রাষ্ট্রকে যে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হয়, এ হাদীস থেকে তা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
যাকাত না দেওয়ার পরিণতি
হাদীসটি হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত রাসূলে করীম (সা) বলেছেন: আল্লাহ তাআলা যাকে ধন-সম্পদ দান করেছেন, সে যদি যাকাত আদায় না করে, তাহলে কিয়ামতের দিন তার ধন-মাল তার জন্য অধিক বিষধর সর্পের আকার ও রূপ ধারণ করবে। এর কপালের উপর দুটি কালো নমুনা কিংবা দুটি দাঁত বা দুটি শৃঙ্গ থাকবে। কিয়ামতের দিন তা তার গলায় পেচিয়ে দেওয়া হবে। অতপর তা তার মুখের দুপাশ, দুগাল কিংবা দু কর্ণলগ্ন মাংসপিন্ডের গোশত খাবে ও বলতে থাকবে- আমিই তোমার ধন-সম্পদ, আমিই তোমার সঞ্চিত বিত্ত- সম্পত্তি। অতপর নবী করীম (সা) এ আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন- (এর অর্থ) যারা কার্পণ্য করে তাদের সম্পর্কে ধারণা করিও না। (বুখারী, নাসাঈ)
ব্যাখ্যা
হাদীসটির সর্বপ্রথম প্রতিপাদ্য বিষয় হল, দুনিয়ায় যার নিকট যতটুকু ধন-সম্পদ রয়েছে তা সবই আল্লাহর দান। আল্লাহ তাআলা তাকে তা দিয়েছেন বলেই সে তা পেরেছে। আল্লাহ তাআলা না দিলে কারো পক্ষে কিছু পাওয়া সম্ভবপর হত না। অতএব ধন-সম্পত্তির যে কেউ মালিক হবে তারই প্রথম কর্তব্য হল ওটাকে আল্লাহর দান মনে করা।
দ্বিতীয়ত যে আল্লাহ তা দিয়েছেন, তিনিই এর প্রকৃত মালিক। যার নিকট ধন-সম্পদ আছে, সে ওটার প্রকৃত মালিক নয়। কেননা সে ওটা সৃষ্টি করেনি। আর যে যা সৃষ্টি করেনি, সে তার প্রকৃত মালিক থেকে পারে না। অতএব আল্লাহর এ মালিকানায় আল্লাহরই মর্ষী চলবে। আল্লাহর আইন বিধান অনুযায়ীই এর বণ্টন ও ব্যয় থেকে হবে। এর উপর অন্য কারো নিরংকুশ কর্তৃত্ব চলতে পারে না।
আল্লাহ মানুষকে ধন-সম্পত্তি দান করেছেন অতপর তিনি এর উপর সর্বপ্রথম যাকাত ধার্য করেছেন।
আরো পড়ুন: উমরাহ হজ্জ কি ওমরাহ হজ্জের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
যাকাত শব্দের অর্থ-
زكوة শব্দটির আভিধানিক অর্থ- الماء বৃদ্ধি। ক্ষেতের ফসল যখন সবুজ শ্যামল সতেজ হয়ে উঠে তখন আরবী ভাষায় বলা হয় : زكا الررع কৃষি ফসল শ্রী-বৃদ্ধি লাভ করেছে। এর আর একটি অর্থ হচেছ- الطهارة পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা, পরিশুদ্ধতা।
কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
"সে ব্যক্তি নিশ্চিত সাফল্য লাভ করবে, যে পবিত্রতা অর্জন করে।" (সূরা আল-আলা: ১৪) এ পবিত্রতা অর্জনকেই যাকাত বলা হয়। এর নাম 'যাকাত' রাখা হয়েছে এজন্য যে-
যাকাত আদায়কারী আল্লাহর কাছে পরিশুদ্ধতা লাভ করে অর্থাৎ নেক ও কল্যাণকর কাজের সাহায্যে সে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে।
আর যে লোক কল্যাণকর কাজের সাহায্যে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে, সে আসলে আল্লাহর দিকেই পরিশুদ্ধতা পায়। ধন-সম্পদের যাকাত দেওয়ার ফলে উহাতে যে শ্রী-বৃদ্ধি ঘটে, যে বরকত পরিদৃষ্ট হয়, সে দৃষ্টিতেই এ নামকরণ করা হয়েছে।
শরীঅতের পরিভাষায় 'যাকাত' বলতে বোঝায়
সম্পদের বাৎসরিক পরিমাণের একটা অংশ গরিব-মিসকীন এমন ব্যক্তিকে আদায় করে দেওয়া। এ দেওয়ার মূল কথা হল ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা সহকারে কেবল আল্লাহর জন্য আল্লাহর সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যে-আল্লাহর বিধান অনুযায়ী দেওয়া।
যাকাত ফরয হয় এমন পরিমাণ ধন-সম্পদ নিরবচ্ছিন্নভাবে একটি বৎসরকাল যার মালিকানাধীন থাকবে, তাকেই যাকাত আদায় করতে হবে।
যাকাত দানের লক্ষ্য
দুনিয়ার বুকে আবশ্যিক কর্তব্য পালন এবং পরকালে প্রতিফল লাভ। এ যাকাত নিয়মিত আদায় করা আল্লাহ তাআলার দেয়া ফরয-অবশ্য করণীয় কর্তব্য। কুরআন মাজীদে বহুবার ৩। الركوة 'যাকাত দাও' বলে প্রত্যক্ষভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাসূলে করীম (সা) যাকাত দেওয়ার বাধ্যবাধকতা ও অপরিহার্য কর্তব্য ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ নানাভাবে এবং বহুবিধ ভাষায় করেছেন।
ধন-সম্পদ প পুঞ্জীভূত করা যাবে না
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) রাসূলে করীম (সা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেনঃ যে ব্যক্তি তার ধন- সম্পদের যাকাত আদায় করবে না, তার সম্পদ কিয়ামতের দিন বিষধর স্বর্ণের রূপ পরিগ্রহ করবে। শেষ পর্যন্ত সে সর্পটি তার গলায় পেঁচিয়ে দেয়া হবে। (ইবনে মাজাহ)
ব্যাখ্যা
উপরে উল্লিখিত কয়টি হাদীস থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, যাকাত ফরয। তা যথাযথভাবে আদায় না করার পরিণাম সালাত আদায় না করার পরিণতি থেকেও অধিক ভয়াবহ ও সাংঘাতিক। কেননা যাকাত আদায় না করার যে কঠিন, কঠোর ও নির্মম পরিণতির কথা কুরআন ও হাদীসে স্পষ্ট-বলিষ্ঠ ভাষায় ঘোষিত হয়েছে, তা সালাত আদায় না করা পর্যায়ে ঘোষিত হয়নি। এ পর্যায়ে কুরআনের নিম্নোদ্ভূত আয়াতটি স্মরণীয়। আল্লাহ তাআলা বলেন-
যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদের কঠোর আযাবের সংবাদ শুনিয়ে দাও। সেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে এবং সেদিন বলা হবে, এগুলো তা তোমরা যা নিজেদের জন্য জমা করেছিলে। সুতরাং তোমরা জমা করেছিল তা আস্বাদন করো। (সূরা আত-তাওবা: ৩৪-৩৫)
যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র হয়
হযরত খালিদ ইবনে আসলাম থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা একদা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা)-এর সঙ্গে বের হলাম। তখন এক আরব বেদুঈন আল্লাহর বাণী 'যারা স্বর্ণ ও রোপ্য সঞ্চয় করে রাখে এবং আল্লাহর পথে খরচ করে না এর প্রকৃত তাৎপর্য কি, তা আমাকে বলুন। তখন ইবনে উমর বললেন- যে লোক তা সঞ্চয় করে রাখে এবং এর যাকাত আদায় করে না, তার জন্য বড়ই দুর্ভোগ। আসলে একথা প্রযোজ্য ছিল যাকাতের হুকুম নাযিল হওয়ার পূর্বে। পরে যখন যাকাত সম্পর্কিত বিধান নাযিল হল তখন আল্লাহ তাআলা তা ধন-সম্পদকে পবিত্রকরণের মাধ্যম বানিয়ে দিলেন। (বুখারী, নাসাঈ)
ব্যাখ্যা
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা)-এর নিকট জনৈক বেদুঈন কুরআনের উল্লেখিত আয়াতটির তাৎপর্য বুঝতে চাচ্ছিলেন। এর জবাবে তিনি তিনটি কথা বলেছেন। একটি হল, কুরআনে ব্যবহৃত এ শব্দটির প্রয়োগ ও ব্যবহারিক অর্থ। দ্বিতীয়টি হল, এ আয়াতটির প্রয়োগক্ষেত্র বা সময়সীমা এবং তৃতীয় হল, যাকাতের ব্যবহারিক মূল্য। হযরত ইবনে উমর প্রথমত যাকাত না-দেয়া লোকদের জন্য ویل 'অয়লুন' শব্দ ব্যবহার করেছেন। এর অর্থঃ দুঃখ, ধ্বংস, আযাবের জ্বালা-যন্ত্রণা-কষ্ট। আর তাঁর কথা অনুযায়ী আয়াতটির অর্থ হলঃ 'যারা স্বর্ণ-রৌপ্য সঞ্চয় করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদের জন্য দুঃখ-ধ্বংস, আযাবের জ্বালা-যন্ত্রণা ও কষ্ট রয়েছে অর্থাৎ যাকাত না- দেয়া সঞ্চিত সম্পদকে আরবি পরিভাষায় এ বলা হয়।
বস্তুত যাকাতের কল্যাণ ও উপকারিতার তিনটি দিক অত্যন্ত সুস্পষ্ট। প্রথমত এই যে, মু'মিন বান্দা সালাতে দাঁড়িয়ে ও রুকু সিজদা করে আল্লাহর সম্পর্কে নিজের দাসত্ব বন্দেগী ও বিনয়াবনত ভাবের বাস্তব প্রকাশ ঘটায়। আল্লাহর সন্তোষ, রহমত ও নৈকট্য লাভের জন্য মন-মানসিকতা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা আকুল আকুতি জানায়। যাকাত আদায় করে বান্দা ঠিক অনুরূপভাবে আল্লাহর দরবারে নিজের ধন-সম্পদের অর্ঘ্য পেশ করে। সেসঙ্গে একথারও বাস্তব প্রমাণ উপস্থাপিত করে যে, যেসব ধন-সম্পদ তার করায়ত্ত তার প্রকৃত মালিক সে নিজে নয়, স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। যাকাত এ হিসেবেই ইসলামের মৌল ইবাদতের মধ্যে গণ্য।
যাকাতের দ্বিতীয় দিক হল, এর সাহায্যে অভাবগ্রস্ত ও দরিদ্র লোকদের অর্থনৈতিক কল্যাণ সাধন করা হয়। কেননা আসলে এটা ধনীর ইচ্ছা বা মর্মীর উপর নির্ভরশীল কোন ব্যক্তিগত দান-খয়রাতের ব্যাপার নয়। ধন-সম্পদ সঞ্চিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাতে আল্লাহর হকও পুঞ্জীভূত হয়ে উঠে। সম্পদের এ অংশ ধনীর হাতে থাকলেও আসলে সে এর মালিক বা অধিকারী নয়। সে যখন এ অংশ মূল সম্পদ থেকে আলাদা করে নির্দিষ্ট উপায়ে আদায় করে দেবে তখনই সে সেই মূল সম্পদ হালালভাবে ব্যয় এবং ব্যবহার করার অধিকারী হবে, তার পূর্বে নয়। এদিক দিয়ে যাকাত মানুষের নৈতিকতার একটা বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
তৃতীয় দিক হল, যাকাতদাতার মন-মানসিকতার মৌলিক পরিবর্তন ও সংশোধন। ধন-সম্পদকেই উপাস্যের উচ্চ মর্যাদায় সংস্থাপন করে। অপরদিকে তা মানুষকে বানায় হাড়-কৃপণ। আর এ দুটিই ব্যক্তির ঈমানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী- ঈমানের পবিত্র ভাবধারার পক্ষে এটা অত্যন্ত মারাত্মক। এটা ব্যক্তির মন-মানসিকতা ও চরিত্রকে কঠিন রোগে আক্রান্ত করে। মানুষকে যেমন বানায় অর্থলোভী তেমনি বানায় দয়ামায়াহীন কৃপণ। অর্থ তার চরিত্রকে চরমভাবে পংকিল ও কলুষিত করে দেয়। নিয়মিত যাকাত আদায় একদিকে তার মনের যাবতীয় রোগের চিকিৎসা করে। অপরদিকে গন্ধময় বিষাক্ত প্রভাব থেকে ব্যক্তির প্রবৃত্তি ও মানসিকতাকে পরিচ্ছন্ন পবিত্র ও মহান করে তোলে।
আরো পড়ুন: কোরবানি কি কোরবানির পশু জবাইয়ের নিয়ম ও পশু জবাইয়ের দোয়া
যাকাত ফরয হওয়ার কারণ
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, কুরআনের আয়াত- 'যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য সঞ্চয় করে রাখে ও তা আল্লাহর পথে খরচ করে না'- যখন নাযিল হল, (-এতে ধন-সম্পদ সঞ্চয়কারীদের পরকালে কঠিন শাস্তি হওয়ার কথা বলা হয়েছে), এ কারণে সাহাবায়ে কিরামের মনের উপর ভীষণ চাপ পড়ল এবং তাঁরা চিন্তা- ভারাক্রান্ত হয়ে পড়লেন। হযরত উমর (রা) তা বুঝতে পেরে বললেনঃ আমি তোমাদের এ চিন্তা ও উদ্বেগ দূর করতে চেষ্টা করব। অতঃপর তিনি রাসূলে করীম (সা)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)। এ আয়াতটির কারণে আপনার সাহাবীগণ বিশেষ চিন্তা-ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। রাসূলে করীম (সা) বললেনঃ আল্লাহ তাআলা যাকাত এ উদ্দেশ্যে ফরয করেছেন যে, এটা আদায় করার পর অবশিষ্ট ধন-সম্পদ যেন পবিত্র হয়ে যায়। অনুরূপভাবে উত্তরাধিকার আইন জারী করেছেন- এ উদ্দেশ্যে যে, এর দরুন তোমাদের পরবর্তী লোকদের জন্য সম্পদের নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা হবে। হযরত উমর (রা) রাসূলে করীম (সা)-এর এ ব্যাখ্যা শুনে আনন্দে আল্লাহু আকবার বলে উঠলেন। এরপর রাসূলে করীম (সা) বললেন- আমি কি তোমাদেরকে এটা অপেক্ষাও উত্তম সঞ্চয়ের কথা বলব? তা হল কোন ব্যক্তির পবিত্র স্বভাব-চরিত্রের স্ত্রী, যার দিকে সে যখন তাকাবে, সে তাকে সন্তুষ্ট করে দিবে, যখন তাকে কোন কাজের আদেশ করবে, সে তা পালন করবে। আর যখন সে তার সম্পদের নিকট থেকে অনুপস্থিত থাকবে তখন সে তার সংরক্ষণ করবে।
(আবু দাউদ)
যাকাত ফরয হওয়ার ন্যূনতম পরিমাণ
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলে করীম (সা) বলেছেনঃ পাঁচ অসক-এর কম পরিমাণ খেজুরে যাকাত নেই। পাঁচ 'আওকিয়া'র কম পরিমাণ রৌপ্যে যাকাত নেই এবং পাঁচটি উষ্ট্রের কম সংখ্যায় যাকাত নেই। (বুখারী ও আবূ দাউদ)
ব্যাখ্যা
নবী করীম (সা)-এর সময়ে মদীনা ও আশেপাশের যে লোক স্বচ্ছল ও ধনশালী ছিল, তাদের নিকট সাধারণত তিন প্রকারের মধ্যে যে কোন এক প্রকারের সম্পদ থাকত ৪ (১) তাদের বাগানের খেজুর (২) রৌপ্য এবং (৩) উষ্ট্র। রাসূলে করীম (সা) উপরিউক্ত হাদীসে এ তিন প্রকারের সম্পদের উপরই যাকাত ধার্য হওয়ার ন্যূনতম পরিমাণের কথা উল্লেখ করেছেন। হাদীসে প্রত্যেকটি জিনিসের যে পরিমাণ বা সংখ্যার উল্লেখ হয়েছে, তা কারো নিকট থাকলে তাতে যাকাত ফরয হবে। সে পরিমাণ বা সংখ্যার কম সম্পদ কারো নিকট থাকলে তাতে যাকাত ফরয হবে না। খেজুর সম্পর্কে রাসূলে করীম (সা) বলেছেন, উহা পাঁচ অসক-এর কম পরিমাণ হলে যাকাত দিতে হবে না। এক 'অসক' প্রায় ছয় মণ। এ হিসেবে পাঁচ 'অসক' ত্রিশ মণের কাছাকাছি। রৌপ্য সম্পর্কে তিনি বলেছেন ও পাঁচ 'আওকিয়ার' কম পরিমাণে যাকাত নেই। এক 'আওকিয়া' পাঁচ 'দিরহাম' সমান। এ হিসেবে পাঁচ আওকিয়া দুইশত দিরহামের সমান। আমাদের দেশে চলতি ওযন হিসেবে এতে সাড়ে বায়ান্ন তোলা হয় অর্থাৎ কারো নিকট সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য থাকলে এবং এ মালিকানায় এক বৎসর কাল অতিক্রান্ত হলে এর চল্লিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত বাবদ দিতে হবে, এটাই ফরয।
আর উষ্ট্র সম্পর্কে নবী করীম (সা) বলেছেন, পাঁচটির কমে যাকাত হয় না। সেকালে ত্রিশ মণ খেজুর একটা ছোট- খাটো পরিবারে পূর্ণ বছরের খরচের জন্য যথেষ্ট হত। অনুরূপভাবে দুইশত দিরহাম পরিমাণের নগদ অর্থে বছরের খরচ চলে যেত। এ মূল্যমানের দৃষ্টিতে পাঁচটি উষ্ট্রের মালিককেও সচ্ছল অবস্থায় যাকাত দিতে সক্ষম ব্যক্তি মনে করা হত।
যাকাত দেয়ার নির্দিষ্ট তারিখে যে লোক ৮৭.৫ গ্রাম স্বর্ণ কিংবা ৬১২.৫ গ্রাম রৌপ্যের কিংবা সম পরিমাণ মূল্যের নগদ অর্থ থাকবে, কিংবা বিক্রয়ার্থে প্রস্তুত পণ্য দ্রব্যের মালিক থাকবে, তার উপরই যাকাত ফরয, সে নিসাব পরিমাণের মালিক।
স্বর্ণ ও রৌপ্যের যাকাত
হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (সা) বলেছেন: তোমার যখন দু'শত দিরহামের সম্পদ হবে এবং এর এ অবস্থায় একটি বৎসর কাল অতিবাহিত হবে তখন এর যাকাত হবে পাঁচ দিরহাম। আর স্বর্ণে কোনই যাকাত হবে না যতক্ষণ না এর অর্থমূল্য বিশ দীনার হবে। তাই তোমার সম্পদ যখন বিশ দীনার হবে ও এ অবস্থায় একটি বৎসর অতিবাহিত হয়ে যাবে, তখন এতে অর্ধ দীনার যাকাত ফরয হবে। (আবু দাউদ)
ব্যাখ্যা
দু'শত দিরহামের মালিকানা এক বৎসরকাল পর্যন্ত থাকলে তা থেকে পাঁচ দিরহাম যাকাত বাবদ দিতে হবে। এটা সর্বসম্মত মতামত। আর অধিকাংশ ফিকাহবিদের মতে স্বর্ণের নিসাব-যাকাত ফরয হওয়ার নিতম পরিমাণ 'বিশ দীনার' অর্থ ২০ মিসকাল। কেননা এক দীনার স্বর্ণমুদ্রার ওযন এক মিসকাল। এ হিসেবে ২০ দীনারের ওযন বিশ মিসকাল হবে। এক মিসকাল সাড়ে চার মাশা। আর মিসকালে সাড়ে সাত তোলা ওযন হবে। এ হিসেবে কোন দ্বিমত নেই। আর আড়াই ভাগ যাকাত তথা ৪০ ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ কারো মালিকানায় সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ এক বছর কাল অতিবাহিত হলে এর চল্লিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত বাবদ আদায় করা ফরয।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url