চোগলখোরি জঘন্য অপরাধ কবরে আযাব ও চোগলখোরির প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত

আরেকটি মারাত্মক গোনাহের নাম'চোগলখোরি।' এটি গিবত থেকেও জঘন্য। আরবি ভাষায় এর নাম 'নামিমাহ' نَمِيْمَة। অর্থ, চোগলখোরি। পরিভাষায়, দুই ব্যক্তির মাঝে ঝগড়া বাধানোর উদ্দেশ্যে একজনের কথা অপরজনের কাছে গিয়ে বলাকেই চোগলখোরি বলা হয়।


চোগলখোরি একটি জঘন্য গোনাহ

অর্থাৎ নিজের আত্মিক আনন্দের জন্য অন্যের ক্ষতি সাধনের লক্ষে তার দোষ অন্যের কাছে বর্ণনা করার নাম চোগলখোরি। শ্রবণকারী শ্রবণের পর তার ক্ষতি করতে চেষ্টা করবে। আর যখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ক্ষতি সাধিত হয়, তখন চোগলখোর বেশ খুশি হয়। উল্লেখ্য, বর্ণনাকৃত দোষটি বাস্তবেই ওই ব্যক্তির মাঝে পাওয়া যাক বা না যাক-শ্রবণকারী যেনো তাকে কষ্ট দেয়। বিষয়টি এভাবেও বোঝা যেতে পারে, কেউ আপনার ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে। আপনার দোষ-ত্রুটি আপনার শত্রুর কাছে বর্ণনা করলো। বর্ণনা শুনে আপনার শত্রু আপনার ক্ষতি সাধনে উঠে পড়ে লাগলো। ক্ষতি যখন সাধিত হলো, চোগলখোরের উদ্দেশ্য হাসিল হলো, তখন সে আনন্দিত হলো। এটাই হলো চোগলখোরি। পক্ষান্তরে গিবত বলা হয়, কারো ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্য ছাড়াই যে কারো কাছে কারো দোষচর্চা করা।

মোদ্দাকথা হলো, উভয়টির মধ্যে পার্থক্য হলো, গিবত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো কাউকে অন্যের নিকট মন্দরূপে উপস্থাপন করা। পক্ষান্তরে চোগলখোরি দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, কাউকে কারো সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা ও তার প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করা, তার ক্ষতি করা।

আরো পড়ুন: পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের গুরুত্ব সালাত আদায় না করার পরিণতি ও ফরজ হওয়ার ইতিহাস 

গিবতের চেয়েও বড়ো গোনাহ

কুরআন ও হাদিসে চোগলখোরির অনেক নিন্দাবাদ। বর্ণিত হয়েছে। এটা গিবতের চেয়েও মারাত্মক। কারণ, গিবতের মধ্যে খারাপ নিয়ত থাকে না, যার দোষচর্চা করা হয় তার অনিষ্ট সাধনের নিয়ত থাকে না। পক্ষান্তরে চোগলখোরির মাঝে খারাপ নিয়ত থাকে। যার দোষচর্চা করা হচ্ছে, তার ক্ষতিসাধনের নিয়ত থাকে। সুতরাং এটি দুটি গোনাহের সমষ্টি। একটি হলো গিবত। দ্বিতীয়টি। হলো মুসলমান ভাইকে কষ্ট দেয়ার নিয়ত। তাই কুরআন ও হাদিসে এর ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে কঠোরভাবে হুঁশিয়ারী করা হয়েছে। কুরআনে কারিমে চোগলখোরির পরিচয় বর্ণনান্তে বলা হয়েছে-

অর্থাৎ যে একজনের কথা আরেকজনের কাছে বর্ণনা করে।'

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন।

'চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না।'

এহয়াউ উলুম গ্রন্থে রয়েছে-

তিন কারণে কবরে আযাব হয় এক তৃতীয়াংশ গিবতের কারণে, এক তৃতীয়াংশ চোগলখোরির কারণে, এক তৃতীয়াংশ প্রস্রাব থেকে আত্মরক্ষা না করার কারণে।

(বুখারি শরিফ, কিতাবুল আদব)

দু'টি কারণে কবরের আযাব

একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়েকেরামদের সঙ্গে নিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে দু'টি কবর দেখতে পেয়ে বললেন, 'এ কবরবাসীদের উপর আযাব হচ্ছে।' অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সাহাবায়েকেরামদের জিজ্ঞাসা করলেন, 'তোমরা কী জানো এ কবরে কেনো আযাব হচ্ছে?' তারপর তিনি নিজেই বলেন, 'এদের একজন প্রস্রাবেরছেটা থেকে নিজের কাপড় ও নিজেকে বাঁচাতো না। তাই তার উপর আযাব হচ্ছে। আরেকজন চোগলখোরি করতো। তাই তার উপর আযাব হচ্ছে।

আরো পড়ুন: পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ অঙ্গ, কীভাবে পবিত্রতা অর্জন করবেন সেই সম্পর্কে ব্যাখ্যাসহ বিস্তারিত

গিবত, চোগলখোরি ও মিথ্যার কারণে শাস্তি

নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মিরাজের রাতে আমি জাহান্নামে একব্যক্তিকে দেখলাম, যার চেহারা শুকরের ন্যায় এবং তার দেহ গাধার ন্যায়। সে নারী হওয়া সত্তেও তার দেহের ত্বক গাধার দেহতুল্য হয়ে গেছে। আর চেহারা শুকরের চেহারায় পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ তার আকার সম্পূর্ণরূপে বিকৃত হয়ে গেছে। এভাবেই তাকে শাস্তি দেয়া হচ্ছিল। রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এ হলো সেই নারী যে মিথ্যা কথা বলতো, গিবত তথা পরনিন্দা করতো এবং চোগলখোরি করতো।

সুতরাং এখন চিন্তা করুন, এ অভ্যাসগুলো আমাদের মধ্যে সচরাচর দেখা যায়। পুত্রবধূ চায় চোগলখোরির মাধ্যমে স্বামীকে নিজের অনুগত করে রাখতে। আর শাশুড়ি চায় পুত্রবধুর চোগলখোরি করে পুত্রকে নিজের আয়ত্বে রাখতে। এভাবে বৌ-শাশুড়ির মধ্যে একপ্রকার শীতল যুদ্ধ চলতে থাকে। এভাবেই এরা উভয়েই একে অপরের চোগলখোরির মাধ্যমে নিজের পরকাল বরবাদ করে দেয়। আল্লাহ তাআলা পরনিন্দার শাস্তিস্বরূপ তার চেহারাকে বিকৃত করে দিবেন। কেননা চোগলখোর কথা বাড়িয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে বলে; বা মূলকথা বললেও এমনভঙ্গিতে অন্যের নিকট বর্ণনা করে, এতে সেই ব্যক্তির অন্তরে ভীষণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং যার ব্যাপারে বলে তার সম্পর্কে এ ব্যক্তির মনে চরম ক্রোধ ও ক্ষোভের উদ্রেক ঘটে। সে যেহেতু কথা পরিবর্তন করে বলতো সেহেতু আল্লাহ তাআলা তার চেহারাকে বিকৃত করে শুকরের ন্যায় চেহারা করে দিবেন। আর অবশিষ্ট দেহ গাধার ন্যায় করে দিবেন।

চোগলখোরি থেকে বেঁচে থাকা

হাদিসে বর্ণিত অপর ব্যক্তির আযাবের কারণ ছিলো, 'চোগলখোরি।' কারণ, সে চোগলখোরি করে বেড়াত। বোঝা গেলো, চোগলখোরির কারণে আযাব হয়। চোগলখোরি তো গিবতের চেয়েও জঘন্য। যেহেতু এর মধ্যে অপর মুসলমানরে ক্ষতি করারও নিয়ত থাকে।

চোগলখোরির দ্বারা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়

চোগলখোরির দ্বারা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়: বন্ধুত্ব নষ্ট হয়। ফলে আল্লাহ তাআলা চোগলখোর ব্যক্তিকে মোটেও পছন্দ করেন না। এরূপ নারীকে জাহান্নামে শাস্তি প্রদান করা হবে।

মনে রাখা দরকার, এসকল পাপ শুধু নারীদের দ্বারাই সংঘটিত হয় এমনটি নয়; বরং পুরুষদের দ্বারাও সংঘটিত হয়। কোনো পুরুষ যদি এরূপ পাপে লিপ্ত হয় তাহলে সেও উক্ত নারীর ন্যায় অনুরূপ শাস্তির সম্মুখীন হবে। তবে আল্লাহ তাআলা হাদিসে নারীদের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু যদি কোনো পুরুষও অনুরূপ পাপে লিপ্ত হয় সেও এর আওতাভুক্ত হবে। তাকেও অনুরূপ শাস্তি দেয়া হবে।

হিংসার কারণে জাহান্নামের শাস্তি

নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ষষ্ঠ যে নারীকে আমি জাহান্নামে দেখেছি, তাকে কুকুরের আকৃতিতে দেখেছি। কুকুরের ন্যায় সে ঘেউ ঘেউ করছিল। আর তার মুখ দিয়ে অগ্নি প্রবেশ করাচ্ছিলো ও পশ্চাত দ্বারা বের হচ্ছিলো। আর আমি দেখলাম, ফেরেশতা তাকে লৌহদণ্ড দ্বারা আঘাত করছে। সাহাবায়েকিরাম জিজ্ঞাসা করলেন, 'ইয়া রাসুলাল্লাহ, কোন অপরাধের কারণে তাকে এরূপ শাস্তি প্রদান করা হচ্ছে?' তিনি বললেন, 'তার অন্তর হিংসায় পরিপূর্ণ ছিলো। সে মানুষকে হিংসা করতো।'

বর্তমানে মহিলাদের মধ্যে হিংসার ব্যাধি খুবই গুরুতরভাবে দেখা দিয়েছে। পুরুষদের মধ্যেও এ ব্যাধি রয়েছে। কিন্তু পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে তা অধিকহারে রয়েছে। এরা অন্যদের ধন- সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, স্ত্রী-পরিজন, রূপ-সৌন্দর্য ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে হিংসা করে। তারা অন্যদের কোনো কল্যাণ ও মঙ্গল সহ্য করতে পারে না। ফলে তারা অন্যের মঙ্গল দেখে ভেতরে ভেতরে জ্বলতে থাকে। কেউ কোনো নিয়ামত লাভ করলে তা তার কাছে বোঝার ন্যায় মনে হয়। এটিই হলো হিংসা।

হিংসা মানুষের নেক আমলকে তেমনিভাবে ধ্বংস করে দেয় যেমনিভাবে অগ্নি কাষ্ঠখণ্ডকে জ্বালিয়ে দেয়। এব্যাপারেই নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তাকে জাহান্নামে এরূপ শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।

সুতরাং চিন্তা করুন, আপনি এ ধরণের কোনো গুনাহে লিপ্ত কিনা। আমরা এ সকল পাপের ব্যাপারে চিন্তা করবো ও আল্লাহ তাআলার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবো, তাঁর সাথে মীমাংসা করে। নিবো। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ক্ষমা করে। দিবেন। এখন যদি আমরা ক্ষমা প্রার্থনা না করি, তাহলে কিয়ামত দিবসে যতই কাঁদি আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ করবেন না। কোনো কথাই বলবেন না।

আরো পড়ুন: যাকাত কি যাকাত না দেওয়ার পরিনতি যাকাত ফরজ হওয়ার কারণ স্বর্ণ ও রৌপ্যের যাকাত

গোপন কথা প্রকাশ করাও চোগলখোরি

ইমাম গাযযালি রহ. এহয়াউল উলুম গ্রন্থে লিখেছেন, কারো গোপন কথা বা তথ্য ফাঁস করে। দেয়াও চোগলখোরির অন্তর্ভুক্ত। যেমন: কারো এমন কিছু কথা আছে অথবা এমন কোনো বিষয় আছে, ভালো কিংবা মন্দ যা সে প্রকাশ করতে চায় না। মনে করুন, একজনের ধন-সম্পদ আছে। মানুষ জেনে ফেলুক সে এটা চায় না। অথচ আপনি বলে বেড়ালেন, 'অমুকের এই এই সম্পদ। আছে।' তাহলে এটাও চোগলখোরি, যেটা সম্পূর্ণ হারাম।


অথবা কেউ কোনো পারিবারিক পরিকল্পনা করেছে, আপনি কোনোভাবে সেটা জেনে ফেলেছেন। আর তা বলে বেড়াচ্ছেন, তাহলে এটাও চোগলখোরির শামিল। অনুরূপভাবে কারো গোপন তথ্য প্রকাশ করে দেয়াও চোগলখোরির অন্তর্ভুক্ত। হাদিস শরিফে এসেছে-

মজলিসের কথাবার্তা আমানত।

যেমন, কেউ আপনাকে বিশ্বস্ত মনে করে মজলিসে আপনার সামনে আলোচনা করলো, তাহলে এটা আমানত। আপনি যদি অন্যের কাছে তা বলে দেন, তাহলে আমানতের খেয়ানত করা হবে, যেটা হবে চোগলখোরি ও মুনাফিকি।

এক চোগলখোরি নারীর শাস্তি

এক আনসারির বোন মৃত্যুবরণ করে। বোনকে দাফন শেষে ঘরে ফিরে আসলে তার স্মরণ হলো, তিনি কবরে একটি থলিয়া ফেলে এসেছেন। তিনি কবর খুঁড়ে নিজের ফেলে আসা থলিয়া বের করে নিতে চাইলেন। কবরের পার্শ্ব খুঁড়তেই তিনি দেখতে পেলেন কবর আগুনে ভর্তি হয়ে আছে। তাঁর বোনের খুবই কষ্ট হচ্ছে। তিনি অনতিবিলম্বে কবর বন্ধ করে ঘরে এসে মায়ের কাছে এ ঘটনা বর্ণনা করেন এবং তাঁকে বোনের আমল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। মা বললেন, 'তোমার বোনের এমন কোনো দোষ ছিলো না, তবে সে চোগলখোরিতে অভ্যস্ত ছিলো, নামায শেষ ওয়াক্তে পড়তো এবং পবিত্রতা লাভে বিলম্ব করতো। সম্ভবত এ কারণেই তার উপর আযাব হচ্ছে।

আরো পড়ুন: হজ্জ করা জীবনে একবার ফরজ হজ্জের ব্যাখ্যা ও হজ্জের পারিভাষিক অর্থ এবং হজ্জ কখন ফরজ হয়

চোগলখোরির কুফল

একব্যক্তি নিজের গোলামকে বিক্রি করবে। বাজারে গেলো। বিক্রির সময় বিক্রেতা ক্রেতাকে বললো, 'এ গোলামের মাঝে তেমন কোনো বদঅভ্যাস। নেই। তবে চোগলখোরি ও দোষচর্চার বদঅভ্যাস তার মাঝে রয়েছে। ক্রেতা বললো, 'এতে কোনো সমস্যা নেই।' সে যথারীতি গোলাম ক্রয় করলো। বাড়িতে নিয়ে গেলো। বাড়িতে যাওয়ার পর গোলাম সুযোগ বুঝে মনিবের স্ত্রীর কাছে গিয়ে বললো, 'আপনার স্বামী আপনাকে ভালোবাসেনা অন্য কাউকে বিয়ে করতে চায়। তবে এ সমস্যার সমাধান আপনাকেই করতে হবে। তা এভাবে যে, যখন আপনার স্বামী ঘুমিয়ে থাকবে, তখন আপনি ক্ষুর দ্বারা তার মাথার কিছু চুল কেটে নিবেন। তখন এটাই হবে এ সমস্যার প্রতিকার। এগিকে গোলাম মনিবকে গিয়ে বললো, 'আপনার স্ত্রী আপনার চরম শত্রু। সে আপনাকে হত্যা করতে চায়।' পরের দিন স্বামী ঘুমের ভান করে শুয়ে আছে। আর স্ত্রী সুযোগ বুঝে ক্ষুর নিয়ে চুল কাটতে প্রস্তুত হলো। স্বামী মাথা ঘুরিয়ে দেখে ঘটনা সত্যা। গোলামের কথাই তো ঠিক। তৎক্ষণাৎ সে স্ত্রীকে হত্যা করে ফেললো। স্ত্রীর আত্মীয়স্বজনরা ঘটনা জানতে পেরে স্বামীকেও হত্যা করে ফেললো। 

চোগলখোরি মারাত্মক গোনাহ

ইবাদতের চাইতে গোনাহ পরিহার করা উত্তম। তাই কেউ ইবাদত করে না বটে, কিন্তু শরিয়ত নিষিদ্ধ গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে, সে এমন ব্যক্তি থেকে উত্তম যে সদা সর্বদা ইবাদত করে এবং সাথে সাথে সর্বপ্রকার সগিরা-কবিরা গোনাহেও লিপ্ত হয়। বিশেষত গিবত ও চোগলখোরির মতো জঘন্য গোনাহে লিপ্ত হয়। সুতরাং এ মূলনীতি যখন প্রত্যেক গোনাহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তখন গিবত ও চোগলখোরির ক্ষেত্রে আরো উত্তমরূপে প্রযোজ্য। অতএব, অত্র মূলনীতির আলোকে গিবত- চোগলখোরি থেকে বেঁচে থাকা ইবাদতের চাইতে। উত্তম। সাহাবায়েকেরামও গিবত-চোগলখুরিকে নফল নামায-রোযার চাইতে উত্তম মনে করতেন। জনৈক ব্যক্তি হযরত ইবনে আব্বাস রাদি.-কে প্রশ্ন করলো, যে ইবাদত বেশি করে এবং গোনাহও বেশি করে, সে উত্তম নাকি যে ইবাদত কম করে কিন্তু গোনাহ কম করে সে উত্তম। হযরত ইবনে আব্বাস রাদি, জবাব দিলেন-

যে ইবাদত কম করে এবং গোনাহ কম করে, সে- ই উত্তম এবং সে নিরাপদও বটে। কেননা ইবাদতের চাইতে গোনাহ পরিহারে সওয়াব বেশি। 

গিবত ও চোগলখোরির কারণ ও প্রতিকার

গিবত পরিত্রাণের উপায়

হযরত আশরাফ আলি থানবি রহ. বলেছেন, মাঝে-মধ্যে কেউ আমার নিকট এসে বলতো, 'হুযুর! আমি আপনার গিবত করেছি, আমাকে মাফ করে দিন।' আমি তাদেরকে বলতাম, 'এক শর্তে মাফ করবো। প্রথমে বলতে হবে আমার কী গিবত করেছো, যাতে আমি জানতে পারি মানুষ আমার সম্পর্কে কী বলে। যদি আমার সামনে বলতে পারো, মাফ পেয়ে যাবে।'


থানবি রহ. বলেন, আমার এরূপ করার পিছনে। একটা কারণ আছে। তাহলো, হতে পারে, যে দোষ আলোচনা করা হয়েছে, বাস্তবেই তা আমার মধ্যে আছে। হয়তো আমার থেকে সে কষ্ট পেয়েছে। সুতরা, দোষটি আমার জানা হয়ে গেলে আমি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে মাফ চেয়ে নিতে পারবো এবং তা থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবো। আর হতে পারে আল্লাহ তাআলা তা থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করবেন।

এটাই হলো গিবতের প্রকৃত চিকিৎসা। এ প্রক্রিয়ায় চেষ্টা করলে গিবত থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব। তবে চিকিৎসা গ্রহণ করা যদিও কষ্টকর, যদিও মনের উপর ছুরি চালিয়ে তারপর অন্যকে বলতে হবে, 'আমাকে মাফ করে দিন, আমি আপনার গিবত করেছি।' তবুও এটাই আসল চিকিৎসা।

কষ্ট হলেও কয়েকবার এমন করে দেখুন, ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা হয়ে যাবে। অবশ্য উলামায়েকিরাম গিবত থেকে বেঁচে থাকার অন্য ব্যবস্থাপত্রও দিয়েছেন। যেমন হযরত হাসান বসরি রহ. বলেছেন, যখন অন্যের লোষচর্চার কথা মনে উর্কি দেবে, তখনই নিজের পোষগুলোর কল্য চিন্তা করবে। ভাববে, কোনো মানুষই তো দোষমুক্ত নয়। আমার মধ্যেও তো এ লোগ আছে, ওই দোষ আছে...। সুতরাং অন্যের দোষচর্চা আমি কীভাবে করি। সাথে সাথে গিবতের শাস্তির কথাও চিন্তা করুন। আল্লাহর নিকট দৃজা করুন যে, 'হে আল্লাহ! আমাকে এ ভয়াবহ শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।' মজলিসে দোষচর্চা হতে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর কথা স্মরণ করুন। দূগা করুন, 'হে আল্লাহ। এ মজলিসে গিবত শুরু হয়ে গেছে আমাকে হিফাযত করুন। এ জঘন্য পাপ থেকে আমাকে রক্ষা করুন।'

একটি মূলনীতি

ইসলামের মূলনীতি সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, 'ইমানের দাবি

হলো নিজের জন্য যা পছন্দ, অন্যের জন্যও ওই জিনিস পছন্দ করা। অনুরূপভাবে নিজে যেটাকে অপছন্দ করবে, অন্যের জন্যও তা অপছন্দ করা। এখন চিন্তা করুন, আপনার অনুপস্থিতিতে কেউ আপনার গিবত ও নিন্দা করলে আপনার অন্তরে ব্যথা লাগবে কী? আপনি তাকে কী বলবেন ভালো না খারাপ? অবশ্যই আপনি তাকে খারাপ ভাববেন। বিষয়টি অপছন্দ করবেন। আর যদি তাকে খারাপ ভাবেন, যদি আপনি এটি অপছন্দ করেন, তাহলে আপনি এ কাজটিই অন্যের জন্য কীভাবে করতে পারেন? অধিকন্তু যদি আপনি অভ্যাসের বিপরীত কাজ করেন, অর্থাৎ নিজের যেটা অপছন্দ সেটাই যদি অন্যের ক্ষেত্রে করেন, তাহলে এটি হবে মুনাফিকি। গিবতের মধ্যে মুনাফিকিও শামিল আছে। এ কথাগুলো গভীরভাবে চিন্তা করুন। গিবতের শাস্তির কথা ভাবুন। তাহলে ইনশাআল্লাহ গিবত করার উৎসাহ কমে যাবে।

আরো পড়ুন: হালাল ও হারাম উপার্জন হারাম উপার্জন থেকে দান করা ও অপরের অধিকার হরণ

গিবত থেকে বেঁচে থাকার আরেকটি সহজ পদ্ধতি

হাকিমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত হযরত মাওলানা আশরাফ আলি থানবি রহ, গিবত থেকে বেঁচে থাকার বাতলে আরেকটি দিয়েছেন, তাহলো-তাহলো, অপরের আলোচনাই না করা। ভালো-মন্দ সকল আলোচনা থেকে বিরত থাকা কারণ, শয়তান খুব ধূর্ত। যখন কারো প্রশংসা শুরু করবেন এবং তার গুণ ও উত্তম অভ্যাসগুলো আলোচনা করবেন, তখন শয়তান আপনার বিরুদ্ধে। সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবে। সে কোনো না কোনো ফাঁকে আপনার মগজে ঢুকিয়ে দেবে যে, আমি তো শুধু প্রশংসাই করে যাচ্ছি। তার ওই দোষও তো আছে; সেটা বলি না কেনো? তখন আপনার কথার ধরণ পাল্টে যাবে। বলবেন, সে তো ভালো; কিন্তু একটি দোষও আছে তার মধ্যে। এভাবে 'কিন্তু' শব্দটিই আপনার সব শেষ করে দিবে। পুরো আলোচনাটা গিবতে পরিণত করে দেবে। তাই থানবি রহ. বলেন, 'যথাসম্ভব অপরের আলোচনা থেকে বিরত থাকবে। ভালো-মন্দ কোনো মন্তব্যেরই প্রয়োজন নেই। হ্যাঁ, একান্তই যদি করতে হয়, তাহলে ভালো আলোচনা করার জন্যই কোমর বেঁধে বসবে। আর সতর্ক থাকবে, শয়তান যেনো ভুল পথে নিয়ে না যায়।'

ক্রোধ সংবরণ

গিবত থেকে বেঁচে থাকতে হলে, ক্রোধ সংবরণ করতে হবে। কারণ, মানুষ কারণবশতঃ কারো উপর ক্রুদ্ধ হলে তার গিবতে লিপ্ত হয়। যেমন কেউ যদি শুনতে পায় অমুক ব্যক্তি আমাকে গালিগালাজ করেছে অথবা আমার গিবত। করেছে, তখন সে তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়। শয়তানও তাকে উত্তেজিত করে। ফলে সেও গালিদাতার ও গিবতকারীর গিবতে লিপ্ত হয়। সে অনুসন্ধান করে দেখে না, উক্ত লোক আসলেই তাকে গালি দিয়েছে। কিনা বা আদৌ গিবত করেছে কিনা।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

'সাহসিকতা-বীরত্বের ভিত্তি কুস্তি' লড়াইয়ের উপর নয়; বরং ক্রোধের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখাই প্রকৃত বীরত্ব।"

ইমাম আবু বকর ওয়াররাক রহ. বলেন, আল্লাহ তায়ালা মানুষের থেকে ছয়টি জিনিস আশা করেন। মানুষের উচিত সেগুলো পূরণ করা। যথা-

১. আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলা।

২. আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টির সম্মান।

৩. আল্লাহ তায়ালার একত্ব স্বীকৃতি প্রদান করা।

৪. সৃষ্টিকুলের সাথে নম্রতা অবলম্বন করা।

৫. আল্লাহর নির্দেশের উপর ধৈর্যধারন করা।

৬. সহিষ্ণুতা অবলম্বন করা।

এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যে নিজের জবান হিফাযত করে চলবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তার দোষ ত্রুটি গোপন রাখবেন এবং তাকে লাঞ্ছিত করবেন না। আর যে নিজের ক্রোধ দমন করে চলবে, ক্রোধ অনুযায়ী কাজ করবে না, আল্লাহ তায়ালা তাকে কবরের আযাব থেকে মুক্তি দান করবেন। সে আল্লাহর দরবারে গোনাহ মাফ চাইলে আল্লাহ তায়ালা তার তওবা কবুল করবেন।

এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, ধরুন। আপনার কাছে সংবাদ পৌছলো আপনাকে কেউ গালি দিয়েছে, বা কেউ গিবত করেছে। এখন আপনি তার সংবাদ গ্রহণ করে ওই ব্যক্তির গিবতে লিপ্ত না হয়ে বরং সংবাদদাতাকে মিথ্যাবাদী মনে করুন। কারণ, সে চোগলখোর। সুতরাং তার সংবাদ অগ্রহণীয়। যদি আপনি বিষয়টি এভাবে নেন, তাহলে ওই ব্যক্তির ব্যাপারে আপনার মনে সাধারণ ক্রোধ তৈরি হবে না। আর আপনিও তার গিবতে লিপ্ত হবেন না।

ফকিহ আবুল লাইস বলেন কেউ যদি তোমাকে বলে, অমুক ব্যক্তি তোমার সম্পর্কে এরূপ এরূপ বলেছে। এরূপ অবস্থায় তোমার উপর ছয়টি বিষয় আবশ্যক।


১. এ চোগলখোরের কথা অন্যকারো নিকট বর্ণনা করবে না এবং সে তোমার নিকট চোগলখোরি করেছে, একথাও কারো নিকট বর্ণনা করবে না। তাহলে গিবত হয়ে যাবে।

২. যে ব্যক্তি সম্পর্কে তোমাকে বলা হয়েছে অমুক তোমাকে গালিগালাজ করে, মন্দ বলে, তার দোষত্রুটি অন্বেষণে লেগে পড়বে না। কেননা, কুরআনুল কারিমে অন্যের দোষ অন্বেষণ করতে নিষেধ করা হয়েছে।

৩. যে ব্যক্তি তোমাকে গালি দেয় বা মন্দ বলে তার সম্পর্কে মন্দ ধারণা পোষণ করবে না। কেননা কারো সম্পর্কে মন্দ ধারণা পোষণ খুবই দূষণীয়।

৪. যে তোমাকে বলেছে অমুক তোমাকে গালি দেয়, মন্দ বলে, সে চোগলখোর। সুতরাং আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তার প্রতি মনে অসন্তুষ্টি পোষণ করবে। কেননা, চোগলখোরি একটা জঘন্য গোনাহ। আর গোনাহগারের প্রতি অসন্তুষ্টি পোষণ করা ওয়াজিব। তার থেকে দূরত্ব অবলম্বন জরুরি।

৫. সংবাদবাহককে পরবর্তীতে এ ধরনের সংবাদ দিতে নিষেধ করবে।

৬. উক্ত চোগলখোরকে মিথ্যাবাদী মনে করবে। কেননা, চোগলখোর ফাসিক, পাপাচারী। তার সংবাদের কোনো গুরুত্ব বা গ্রহণযোগ্যতা নেই।

আল্লাহ হাফেজ**

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url