রোযার গুরুত্ব ও তাৎপর্য রোযা রাখার ফলাফল এবং রোযা কাযা করা না করার অনুমতি

 

রমযানের আগমন সম্পর্কিত হাদীসের বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা রমযান শব্দের ব্যাখ্যা করতে পারবেন রমযানের তাৎপর্য সম্পর্কে আলোকপাত রোযা রাখা এবং রোযা ভঙ্গ করা চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল- রমযানের রোযা রাখার পরকালীন ফলাফল কা'দের জন্য রমযানের রোযা কাযা করার ও না রাখার অনুমতি রয়েছে তার বিবরণ সর্ম্পকে আজ এই আর্টিকেলটিতে বিস্তারিত জানতে পারবেন।


ভূমিকা

হযরত সালমান আল-ফারসী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (সা) শাবান মাসের শেষ দিন আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। তাতে তিনি বলেন, হে মানব মন্ডলী। এক মহাপবিত্র ও বরকতের মাস তোমাদের উপর ছায়া বিস্তার করতে চলছে। এ মাসের একটি রাত বরকত ও ফযীলত- মাহাত্ম্য ও মর্যাদার দিক দিয়ে সহস্র মাস অপেক্ষাও উত্তম। এ মাসের রোযা আল্লাহ তাআলা ফরয করেছেন এবং এর রাতগুলো আল্লাহর সম্মুখে দাঁড়ানোকে নফল ইবাদতরূপে নির্দিষ্ট করেছেন। যে ব্যক্তি এ রাতে আল্লাহর সন্তোষ ও তাঁর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে কোন অ- ফরয ইবাদত-সুন্নাত বা নফল আদায় করবে, তাকে এর জন্য অন্যান্য সময়ের ফরয ইবাদতের সমান সওয়াব দেয়া হবে। আর যে ব্যক্তি এ মাসে ফরয আদায় করবে, সে অন্যান্য সময়ের সত্তরটি ফরযের সমান সওয়াব লাভ করাবের এটা সবর, ধৈর্য ও ত্যাগের মাস। আর সবরের প্রতিফল হিসেবে আল্লাহর নিকট জান্নাত পাওয়া যাবে। এটা পরস্পর সহৃদয়তা, সহমর্মীতা ও সৌজন্য প্রদর্শনের মাস। এ মাসে মু'মিনের রিষক প্রশস্ত করে দেয়া হয়। এ মাসে যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে ইফতার করাবে, তার   ফলস্বরূপ তার অনাই ক্ষমা করে দেওয়া হবে জাহান্নাম থেকে তাকে নিষ্কৃতি দান করা হবে। আর তাকে আসল রোযাদারের সমান সওয়াব দেয়া হবে। কিন্তু সেজন্য আসল রোযাদারের সওয়াব কিছুমাত্র কম করা হবে না। আমরা নিবেদন করলাম- হে আল্লাহর রাসূল। আমাদের মধ্যে প্রত্যেকেই রোযাদারকে ইফতার করানোর সামর্থ্য রাখে না। এ দরিদ্র লোকেরা এ সওয়াব কিভাবে পেতে পারে? তখন রাসূলে করীম (সা) বললেন- যে ব্যক্তি রোযাদারকে একটা খেজুর, দুধ বা এক গদ্বাস সাদা পানি দ্বারাও ইফতার করাবে, সে লোককেও আল্লাহতাআলা এ সওয়াবই দান করবেন। আর যে ব্যক্তি একজন রোজাদারকে পূর্ণ মাত্রায় পরিতৃপ্ত করে খাওয়াবে, আল্লাহ তাআলা তাকে আমার হাওয' থেকে এমন পানীয় পান করাবেন, যার ফলে জান্নাতে প্রবেশ না করা পর্যন্ত সে কখনো পিপাসার্ত হবে না।

এটা এমন এক মাস যে, এর প্রথম দশদিন রহমতের বারিধারায় পরিপূর্ণ, দ্বিতীয় দশদিন ক্ষমা ও মার্জনার জন্য এবং শেষ দশদিন জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের উপায়রূপে নির্দিষ্ট।

আর যে ব্যক্তি এ মাসে নিজের অধীনস্ত লোকদের শ্রম-মেহনত হাল্কা বা হ্রাস করে দেবে, আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা দান করবেন এবং তাকে জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতি ও মুক্তি দান করবেন। 

(বায়হাকী-শুআবিল ঈমান)

আরো পড়ুন: জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

ব্যাখ্যা

হাদীসটি হযরত রাসূলে করীম (সা)-এর একটি দীর্ঘ ভাষণ। ভাষণটিতে রমযান মাস আগমনের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে। একে এ মাসটির সম্বর্ধনা বললেও অত্যুক্তি হয় না। রমযান মুসলিম জাহানের জন্য এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাস। এ মাসের আগমনে মুসলিম জীবন ও সমাজে একটা বিরাট চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এ দৃষ্টিতেই রাসুলে করীম (সা)-এর এ মূল্যবান ভাষণটি বিবেচ্য।

ভাষণটি অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও সাবলিল ভাষায় দেয়া হয়েছে। হাদীসটি বুঝতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এটা সত্ত্বেও এখানে কয়েকটি অংশের ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে। 

এ ভাষণে সর্বপ্রথম রমযান মাসকে একটি বিরাট মর্যাদাপূর্ণ মাস বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা নিজেই পবিত্র কুরআনে বলেন-

রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল হয়েছে। (সূরা আল-বাকারা ১৮৫) 

কুরআনের এ বাক্য থেকেই রমযান মাসের গুরুত্ব ও মহাত্ম স্পষ্ট হয়ে উঠে। এ মাসে কেবল যে কুরআন মাজীদ নাযিল হয়েছে তাই নয়, অন্যান্য বহু আসমানী কিতাবও এ মাসেই অবতীর্ণ হয়েছে। রাসূলে করীম (সা) বলেছেন-

হযরত ইবরাহীম (আ)-এর সহীফাসমূহ রমযান মাসের প্রথম রাত্রিতে নাযিল হয়েছে। তাওরাত কিতাব রমযানের ছয় তারিখ দিবাগত রাত্রে, ইঞ্জীল এ মাসের তের তারিখে এবং কুরআন মাজীদ রমযান মাসের চব্বিশ তারিখে নাযিলকরা হয়েছে। 

(মুসনাদে আহমাদ ও তাবারানী)

বস্তুত আল্লাহর কিতাবসমূহ নাযিল হওয়ার সাথে রমযান মাসের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। এ কারণে এ মাসে রোযা থাকাও ফরয করে দেয়া হয়েছে। কুরআনের পূর্বোদ্ধৃত আয়াতের পরবর্তী বাক্যে বলা হয়েছেঃ

"তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে তারা যেন এ মাসে রোযা রাখে।" (সূরা আল-বাকারা ১৮৫)

এ আয়াত ও অপর এক আয়াতে মুসলমানদের প্রতি রমযান মাসের রোযা রাখা ফরয করে দেওয়া হয়েছে। এটা দ্বিতীয় হিজরী সনের কথা। মুসলমানগণ ইসলামী আকীদা বিশ্বাস ও আল্লাহর হুকুম-আহকাম পালনে দৃঢ় এবং আল্লাহর আনুগত্যে অপরিসীম নিষ্ঠাবান হয়ে গড়ে ওঠার পরই রোযার মত একটি কষ্টসাধ্য ফরয পালনের নির্দেশ দেয়া হয়। এতে আল্লাহর বিজ্ঞানসম্মত কর্মনীতির মাহাত্ম্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

বর্ণিত হাদীসে রমযান মাসের মাহাত্ম্য ও মর্যাদা সম্পর্কে প্রথম যে কথাটি বলা হয়েছে, তা হলো: এ মাসে এমন একটি রাত আসে, যা হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম। এ রাত্রিটি হল 'কদর' এর রাত্রি। এ সম্পর্কে কুরআন মাজীদে বলা হয়েছেঃষ কদর রাত্রি হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। (সূরা আল-ক্বদর-৩) 

কদর রাত্রিটি হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম হওয়ার অর্থ এই যে, আল্লাহর অনুগত ও আল্লাহর পড়েল লারে উৎসারী লোকেরা এ একটি মাত্র রাত্রিতে আল্লাহর নৈকট্য লাভের দূরত্ব এত সহজে অতিক্রম করতে পারে, যা প্রাটিনকাংে শত শত রাত্রিতে অতিক্রম করা সম্ভব হত না। এটা সর্বজনজ্ঞাত। অনুরূপভাবে 'কদর' রাত্রিতে আল্লাহর সন্তোষ ও তাঁর নৈকট্য লাভ এতটা সহজ ও দ্রুত সম্ভব হয় যা সত্যানুসন্ধিৎসুরা শত শত মাসেও লাভ করতে পারে না। এ দৃষ্টিতে রাসূলে করীম (সা)-এর এ কথাটির তাৎপর্যও অনুধাবন করার মতো যে, তিনি বলেছেন, এ মাসে সে লোক কোনরূপ নফল ইবাদত করবে, সে এ নফল ইবাদতে অন্যান্য সময়ের ফরয আদায়ের সমান সওয়াব লাভ করবে। আর এ মাসের একটি ফরয আদায় করার সওয়াব অন্যান্য সময়ের সত্তরটি ফরয আদায়ের সমান হয়ে থাকে। এটা যে কত বড় কথা তা অবশ্যই লক্ষ্মণীয়।

মহানবী (সা)-এর এ ভাষণে রমযান মাস সম্পর্কে বলা হয়েছে- 'এ মাস সবর-এর মাস'। অর্থাৎ এ মাসের করণীয়-রোযা পালন-'সবর' অর্থাৎ ধৈর্য, সহনশীলতা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার মাস। বস্তুত 'সবর' না হলে রোযা পালন কিছুতেই সম্ভব নয়। লোভ সংবরণ না করলে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহার থেকে নিজেকে বিরত রাখা অসম্ভব। ত্যাগ-তিতিক্ষা ও ধৈর্য না থাকলে ক্ষুৎ-পিপাসার জ্বালা-যন্ত্রণা কেউ সহ্য করতে পারে না। অনুরূপভাবে এ মাসের একটানা দীর্ঘ সময়ের রোযা পালন মানুষকে ধৈর্য শিক্ষা দেয়, সহনশীলতার গুণ উজ্জীবিত ও সমৃদ্ধ করে। ক্ষুৎ পিপাসা মানুষকে কতখানি কষ্ট দেয় তা রোযা পালনের মাধ্যমে হাড়ে হাড়ে অনুভব করা যায়। সমাজের সাধারণ দরিদ্র লোকদেরকে খাদ্যের অভাবে যে কি কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করতে হয়, সে বিষয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ পাওয়া যায় রোযা রাখার মাধ্যমে। ফলে দরিদ্র ও ক্ষুধা-কাতর মানুষের প্রতি অকৃত্রিম সহানুভূতি ও সহৃদয়তা জাগ্রত হওয়া রোযা পালনের প্রত্যক্ষ ফলশ্রুতি। রোযার সামাজিক কল্যাণের এটা একটি দিক মাত্র।

এ বরকতের মাসে ঈমানদার লোকদের রিযক্ বৃদ্ধি করে দেয়া হয়- রাসূলে করীম (সা) একথা ঘোষণা করেছেন। বস্তুত রিযক দান এক আল্লাহর নিজস্ব ক্ষমতা- ইখতিয়ারের ব্যাপার। কুরআন মাজীদে আল্লাহ বলেন-

আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তার রিযিক প্রশস্ত করে দেন। (সূরা আর-রাদ। ২৬) কাজেই তিনি যদি কারও রিষক প্রশস্ত করে দেন, তবে তাতে বাধাদানের ক্ষমতা কারো থাকতে পারে না। প্রত্যেক ঈমানদার ব্যক্তি বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এ কথার সত্যতা যাচাই করতে পারেন। বস্তুতঃ রোযার মাসে খাওয়া- দাওয়ার ব্যাপারে যতটা প্রশস্ততা আসে, ততটা অন্যান্য সময় কল্পনাও করা যায় না। এ মাসে একে অন্যকে উদারভাবে খাদ্য দান করে এবং একজন অপরজনের জন্য অকুন্ঠ চিত্তে অর্থ ব্যয় করে। এর ফলে সাধারণ সচ্ছলতা সর্বত্র পরিলক্ষিত থেকে থাকে। আর গোটা সমাজও এ প্রাচুর্যে বিশেষভাবে লাভবান হয়। এটা দ্বারা জনগণকে এ শিক্ষা দেওয়া হয় যে, ধন-সম্পদ আটক ও পুঞ্জীভূত করে না রেখে সমাজে যত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়া যাবে, উহার সাধারণ কল্যাণ ততই ব্যাপক হবে এবং প্রত্যেকের সচ্ছলতাও বিপুলভাবে বৃদ্ধি পাবে। আল্লাহরই সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যে রোযা পালনকারীদের প্রতি এটা যে তার একটা বিশেষ অনুগ্রহমূলক ব্যবস্থা, তা স্বতঃসিদ্ধ।

ভাষণটির শেষভাগে বলা হয়েছে- রমযান মাসের প্রথম অংশ রহমতে পরিপূর্ণ, মধ্যম অংশ মাগফিরাত লাভের অবকাশ এবং তৃতীয় অংশ জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময়।

এ কথাটির মোটামুটি তাৎপর্য এ থেকে পারে যে, রমযান মাসের বরকত ও মর্যাদা লাভে আগ্রহী লোক তিন প্রকারের থেকে পারে। এক শ্রেণীর লোক, যারা স্বতঃই তাকওয়া-পরহেযগারী সম্পন্ন এবং গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার জন্য প্রতি মুহূর্ত যত্নবান হয়ে থাকে। তারা কোন ভুলত্রটটি করলে চেতনা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাওবা ইস্তিগফার করে নিজেদেরকে সংশোধন ও এট্রটিমুক্ত করে নেয়। এ ধরনের লোকদের প্রতি রমযান মাস শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রমযানের প্রথম রাত্রিতেই রহমতের বারিবর্ষণ শুরু হয়ে যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে সে সব লোক, যারা প্রথম শ্রেণীর লোকদের মত উচ্চমানের তাকওয়া-পরহেযগারী সম্পন্ন না হলেও একেবারে খারাপ লোক নয়। তারা রমযান মাসের প্রথম ভাগে রোযা পালন, তাওবা-ইতিস্তগফার, কুরআন তিলাওয়াত ও অন্যান্য ইবাদতের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থা উন্নত এবং নিজেদেরকে আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত পাওয়ার যোগ্য করে নেয়। তখন এ মাসের মধ্যম অংশে এদেরও ক্ষমা করে দেয়া হয়। তৃতীয় পর্যায়ে সেসব লোক, যারা সাধারণত গুনাহের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে থাকে এবং নিজেদের অব্যাহত পাপ কার্যের দরুন জাহান্নামে যাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হয়। তারাও যখন রমযান মাসের প্রথম ও দ্বিতীয় অংশে অন্যান্য মুসলমানের সঙ্গে রোযা রেখে, তাওবা ইস্তিগফার করে নিজেদের পাপ মোচন করে নেয় তখন শেষ দশদিন আল্লাহর রহমত যখন সর্বাত্মক হয়ে বর্ষিত হয়- তাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দানের ব্যবস্থা করা হয়।

এ ব্যাখ্যা অনুযায়ী রমযান মাসের প্রথমাংশের রহমত, দ্বিতীয়াংশের মাগফিরাত এবং শেষাংশের জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ উপরোল্লিখিত লোকদের সাথেই সংশ্লিষ্ট বলে মনে করতে হবে। 

(তাফসীরে কুরতুবী ও মাআরিফুল হাদীস)

এ মাসে চারটি কাজ গুরুত্ব সহকারে করা আবশ্যক- আল্লাহর ইলাহ্ তাওহীদ ও মা'বুদ (দাস) হওয়ার কথা বারবার স্বীকার্য ও ঘোষণা করা, তাঁর নিকট ক্ষমা ও মাগফিরাতের প্রার্থনা করা, জান্নাত পাওয়ার জন্য দোয়া করা এবং জাহান্নাম থেকে বেশি বেশি মুক্তি চাওয়া। অন্য কথায়, আল্লাহর আল্লাহ হওয়া ও এর মুকাবিলায় নিজের বান্দা হওয়ার অনুভূতি বেশী প্রকাশ করা এবং নিজের জীবনের সমস্যাবলী বারবার আল্লাহর সামনে পেশ করা আবশ্যক।

আরো পড়ুন: পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ অঙ্গ, কীভাবে পবিত্রতা অর্জন করবেন সেই সম্পর্কে ব্যাখ্যাসহ বিস্তারিত 

রমযান মাসের গুরুত্ব

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সা) বলেছেন। তোমাদের নিকট রমযান মাস ‌সমুপস্থিত। এটা এক অত্যন্ত বরকতময় মাস। আল্লাহ তাআলা এ মাসের রোযা তোমাদের প্রতি ফরয করেছেন। এ মাসে আকাশের দরজাসমূহ উন্মুক্ত হয়ে যায়, এ মাসে জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় এবং এ মাসে বড় বড় ও সেরা শয়তানগুলো আটক করে রাখা হয়। আল্লাহরই জন্য এ মাসে একটি রাত আছে, যা হাজার মাস অপেক্ষা অনেক উত্তম। যে লোক এ রাত্রির মহাকল্যাণ লাভ থেকে বঞ্চিত থাকল, সে সত্যই বঞ্চিত ব্যক্তি। 

(নাসাঈ, মুসনাদে আহমদ ও বায়হাকী)

এ হাদীস হযরত সালমান (রা) বর্ণিত হাদীসের মতই রমযান মাসের অসীম মাহাত্ম্যের ঘোষণা করেছে। এ পর্যায়ে 'রমযান' শব্দটির ব্যাখ্যা এখানে আলোচনা করা হয়েছে।

'রমযান )رمضان( শব্দটি رمض শব্দমূল থেকে গৃহীত। এর অর্থ 'দহন', বা 'জ্বলন'। রোযা রাখার দরুন ক্ষুৎ-পিপাসার তীব্রতায় রোযাদারের পেট জ্বলতে থাকে। এ অবস্থা বোঝানোর জন্য আরবী ভাষায় বলা হয় الصائم يرمض রোযাদার দগ্ধ হয়। এটা থেকে গঠিত হয়, الرمضاء উত্তাপের তীব্রতা'। এ অর্থই প্রকাশ করে নিম্নের হাদীসে-

 সূর্যোদয়ের পর সূর্যতাপে প্রাচীর যখন জ্বলে উঠে, তখনি আওয়্যাবীন সালাত পড়ার সময়। (মুসলিম)

আর সূর্যতাপের তীব্রতা পায়ে জ্বলন ধরিয়ে দেয় এবং ক্রমে সূর্যতাপ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠে। মোটকথা رمضان অর্থ দহন, তীব্রতা এবং জ্বলে উঠা। এ অর্থের দিক দিয়ে 'রামযান' মাসটি হল অব্যাহত তীব্র দহনের সমষ্টি।

আরবী মাসের নাম নির্ধারণকালে যে সময়টি সূর্যতাপ তীব্র হওয়ার দরুন দহন বেশী মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছিল, সে সময়টিরই তীব্রতার সাথে এ নামকরণের পূর্ণমাত্রায় সামঞ্জস্য রয়েছে। এটা এক শ্রেণীর ভাষাবিদের ব্যাখ্যা।

অন্য লোকদের মতে এ মাসটির 'রমযান' নামকরণের কারণ হল:

এ মাসে যেসব নেক আমল করা হয়, তার বিনিময়ে সমস্ত পাপ-কর্ম জ্বালিয়ে ছাই করে দেয়া হয়। অপর লোকদের মতে এ নামকরণের কারণ-

এ জন্য যে, এ মাসে লোকদের হৃদয় ওয়ায-নসীহত ও পরকাল চিন্তার দরুন বিশেষভাবে উত্তাপ গ্রহণ করে থাকে- যেমন সূর্যতাপে বালুরাশি ও প্রস্তরসমূহ উত্তপ্ত হয়ে থাকে।

আর একটি মত হল, আরব জাতির লোকেরা রমযান মাসে তাদের অস্ত্রশস্ত্র শাণিত করে নিত, যেন শাওয়াল মাসে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারে। কেননা যেসব মাসে যুদ্ধ করা হারাম, তার পূর্ববর্তী মাস হল শাওয়াল-আর এটাই রমযান মাসের পরবর্তী মাস। এ খানে রমযান নামকরণের যে ৪টি মত পেশ করা হল তার মধ্যে দ্বিতীয় মতটি সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য।

মাসটি সম্পর্কে রাসূলে করীম (সা) বলেন: شهر مبارك এটা অত্যন্ত 'বরকতময়' মাস। 'বরকত' শব্দের অর্থ আধিক্য, প্রাচুর্য। আর 'রমযান' মাসকে 'মুবারক' মাস বলা হয়েছে এজন্য যে, এ মাসে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের প্রতি অশেষ কল্যাণ এবং অপরিমেয় সওয়াব ও রহমত নাযিল করেন এজন্য যে, বান্দা এ মাসেই আল্লাহর ইবাদতে সর্বাধিক কষ্টভোগ করে। ক্ষুধা ও পিপাসার মত জ্বালা এবং কষ্ট আর কিছুই থেকে পারে না। আর এ কষ্ট ও জ্বালা অকাতরে ভোগ করাই হল রমযান মাসের বড় কাজ। রমযান মাসের রোযার ন্যায় আল্লাহর নির্দিষ্ট করা অন্য কোন ইবাদতে এত কষ্ট ও জ্বালা ভোগ করতে হয় না। এজন্য আল্লাহর অনুগ্রহ ও সওয়াব এ মাসের ইবাদতে অনেক বেশী। আসমানের দুয়ার খুলে যাওয়ার কথাটি দুই দিক দিয়েই তাৎপর্যপূর্ণ। আল্লাহর তরফ থেকে দুনিয়ার রোযাদার বান্দাদের প্রতি রহমত ও অনুগ্রহের অজস্র ধারা বর্ষণের দিক দিয়ে এবং বান্দার দোয়া ও ইবাদত- বন্দেগীসমূহ উর্ধ্ব লোকে আরোহণ ও আল্লাহর দরবারে গৃহীত হওয়ার দিক দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। আর যেসব বড় বড় শয়তান আল্লাহর উর্ধ্বলোকের গোপন তথ্য সংগ্রহের জন্য নিরন্তর চেষ্টারত থাকে, এ মাসে তারা বন্দী হয়ে থাকে। তাদের উর্ধ্বগমণ রুদ্ধ হয়ে যায়। অথবা বলা যায়- প্রকৃত নিষ্ঠাবান সচেতন সতর্ক রোযাদারের উপর শয়তানের প্রতারণা-প্ররোচনা নিষ্ফল হয়ে যায়। 

এ মাসেই কদর-রাত্রি। যে রাত্রিটি একান্তভাবে আল্লাহর জন্য উৎসর্গীত হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ রাত্রিতে আল্লাহর তরফ থেকে এত অধিক কল্যাণ বর্ষিত হয়, যার সাথে হাজার মাসের রাত্রিগুলোরও কোন তুলনা হয় না এবং এ রাত্রির এ অফুরন্ত ও অপরিমেয় কল্যাণের কোন অংশই যে লোক লাভ করতে পারল না, তার মত বঞ্চিত ও হতভাগ্য আর কেউ থেকে পারে না। এ ধরনের লোক সকল প্রকার কল্যাণ ও আল্লাহর রহমত থেকে চিরকালই বঞ্চিত থেকে যাবে। হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসেও এ কথাই প্রতি ধ্বনিত হয়েছে। রাসূলে করীম (স) বলেছেন- 

রমযান মাসের মধ্যে একটি রাত্রি আছে, যা হাজার মাসের তুলনায় উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাত্রির কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে, সে সমগ্র কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হয়ে যাবে। আর এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয় কেবল সে ব্যক্তি, যে সবকিছু থেকে বঞ্চিত হয়ে গিয়েছে। (ইবনে মাজাহ)

হযরত আবু উমামা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললাম: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে এমন এক কাজের কথা বলে দিন, যা দ্বারা আল্লাহ আমাকে কল্যাণ দেবেন। জবাবে নবী করীম (সা) বললেন, তোমার রোযা পালন করা কর্তব্য। কেননা রোযার কোন তুলনা নেই। (নাসাঈ)

ব্যাখ্যা

হাদীসের বক্তব্য অনুসারে, রোযা এক অতুলনীয় ইবাদত। অতএব রীতিমত রোযা পালন এমন এক কাজ, যা বাস্তবিকই মানুষকে কল্যাণ দান করে। বস্তুত রোযা যে এক তুলনাহীন ইবাদত, কুরআন ও হাদীসের ঘোষণাসমূহ থেকে তা স্পষ্টভাবে জানা যায়। তার কারণ রোযার কোন বাহ্যিক ও দৃশ্যমান রূপ নেই। এটা সঠিকরূপে পালন করা হচ্ছে কিনা, তা রোযাদার নিজে এবং আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানতে পারে না। এ জন্যই আল্লাহ তাআলা বলেছেন- 'এটা কেবল আমারই জন্য' অতএব আমি এর প্রতিফল দিব। ইমাম কুরতুবী উল্লেখ করেন- 

রোযা নফসের লোভ-লালসা ও স্বাদ-আস্বাদন প্রবৃত্তি দমন করে, যা অন্য সব ইবাদত এরূপ করে না।

আরো পড়ুন: যাকাত কি যাকাত না দেওয়ার পরিনতি যাকাত ফরজ হওয়ার কারণ স্বর্ণ ও রৌপ্যের যাকাত

চাঁদ দেখে রোযা রাখা-চাঁদ দেখে রোযা ভঙ্গ

আবদুর রহমান ইবনু যায়দ ইবনুল খাত্তাব (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি সে দিন ভাষণ দিলেন, যে দিন রোযা রাখা হবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ হচ্ছিল। তিনি বললেন- তোমরা জেনে রেখে, আমি রাসূলে করীম (স)-এর সাহাবীদের মজলিসে বসেছি এবং এ ধরনের বিষয়ে আমি তাঁদের নিকট জিজ্ঞেস করেছি। এ ব্যাপারে তোমরা সতর্ক হও। তাঁরা আমাকে বলেছেন যে, নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেন- তোমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখতে শুরু কর এবং চাঁদ দেখেই রোযা ভঙ্গ কর। আর এভাবে কুরবানী ও হজ্জের অনুষ্ঠানাদি পালন কর। (উনত্রিশ তারিখে) আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হলে (ও চাঁদ দেখা না গেলে) তোমরা সে মাসের ত্রিশ দিন পূর্ণ কর। আর যদি দু'জন মুসলমান সাক্ষী সাক্ষ্য দেয় তবে তোমরা তদনুযায়ী রোযা রাখ ও রোযা ভঙ্গ কর। 

(মুসনাদে আহমাদ ও নাসাঈ)

ব্যাখ্যা

চাঁদ দেখে রোযা রাখতে শুরু করা ও চাঁদ দেখে রোযা ভঙ্গ করা অর্থাৎ ঈদ করা অসংখ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এ সমস্ত হাদীসের মূল কথা হল, চাঁদ দেখে রোযা রাখা বন্ধ করে ঈদুল-ফিতর পালন করতে হবে। তাতে শাবান মাস ও রমযান মাস ত্রিশ দিন পূর্ণ হোক, অথবা উনত্রিশ দিনের অপূর্ণ মাসই হোক না কেন। রাসূলের বাণীঃ 'চন্দ্রের উদয় দেখে রোযা থাক, চন্দ্রের উদয় দেখে রোযা ভঙ্গ করাও থেকে এ কথা স্পষ্ট ও অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়। এটা হল ইতিবাচক কথা। এ পর্যায়ে হযরত ইবনে আব্বাস (রা) ও হযরত ইবনে উমর (রা) বর্ণিত হাদীসে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে-

তোমরা রোযা রাখবে না যতক্ষণ চাঁদ দেখতে পাবে না এবং রোযা ভাঙ্গবে না যতক্ষণ চাঁদ দেখতে পাবে না। (২৯ তারিখ) আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে সে মাসের দিন পূর্ণ করে লও। (বুখারী ও মুসলিম)

হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে অনুরূপ একটি হাদীস বর্ণিত আছে।

চাঁদ দেখে রোযা রাখ এবং চাঁদ দেখে রোযা ভঙ্গ কর। যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে তাহলে শাবান মাসের দিনের সংখ্যা ত্রিশ পূর্ণ কর। (বুখারী ও মুসলিম)

এর স্পষ্ট অর্থ হলঃ রমযানের রোযা রাখতে হবে যখন চাঁদ দেখা যাবে এবং রোযা ভাঙ্গতে হবে যখন শাওয়ালের চাঁদ দেখা যাবে।

রোযার নিয়াত

 হযরত হাফসা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি নবী করীম (স) সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, যে লোক ফজরের পূর্বেই রোযার নিয়াত করল না, তার রোযা হয়নি। 

(আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমদ)

ব্যাখ্যা

এ হাদীসে রোযার নিয়াত করার গুরুত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে। হাদীসের ভাষা থেকে দু'টি কথা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। একটি হল, রোযার নিয়াত অবশ্যই করতে হবে। নিয়াত করা না হলে রোযাই হবে না। আর দ্বিতীয় কথা হল- ফযরের পূর্বে নিয়াত করতে হবে। উভয় বিষয়ে ফিকাহ বিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।

উপরে যে হাদীসটি উদ্ধৃত হয়েছে, ইবনে খুযায়মা ও ইবনে হিব্বান হাদীস সংগ্রহকারীদ্বয় এটা নিজ নিজ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। তাঁরা হাদীসটিকে নবী করীম (স)-এরই বাণীরূপে সহীহ সনদে উল্লেখ করেছেন। ইমাম দারে কুতনীও নিজ গ্রন্থে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। ইমাম আবু দাউদ হাদীসটি উদ্ধৃত করে বলেছেন, একে নবী করীম (স)-এর কথা মনে করা ঠিক নয়। আর ইমাম তিরমিযী বলেছেন, হাদীসটিকে হযরত ইবনে উমরের কথা মনে করাই যথার্থ। মুয়াত্তা ইমাম মালিক গ্রন্থে হযরত ইবনে উমর (রা) থেকে হাদীসটি সহীহ সনদে উদ্ধৃত হয়েছে।

তিনি বলেন, যে লোক ফজরের পূর্বে নিয়াত করেছে, সে ছাড়া অন্য কেউ (যেন) রোযা না রাখে।

মোটকথা, বহু সনদে হাদীসটি বর্ণিত হলেও কেবল একটি সনদ থেকেই এটাকে রাসূল কারীম (স)-এর কথা বলে জানা যায়। কিন্তু এটা সত্ত্বেও মুহাদ্দিসগণ একে নবী করীম (সা)-এর কথা ও অবশ্য গ্রহণীয় বলে মত প্রকাশ করেছেন। ইমাম মালিক, শাফেয়ী, আহমদ ইবনে হাম্বল ও সকল মুহাদ্দিসীনের এটাই মত। কেননা সাহাবীরা মনগড়া কথা বলেন না, রাসূলের নিকট থেকে শোনা কথাই বলেন, এটা হাদীসশাস্ত্রের একটি মূলনীতি বিশেষ। 

ইমাম যুহরী, আতা ও যুফার-এর মতে রমযান মাসের রোযার জন্য নিয়াতের প্রয়োজন নেই। কেননা রমযানে রোযা না থাকার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। অবশ্য রোগী ও মুসাফির যাদের জন্য রোযা ফরয নয়, তাদের জন্য নিয়াত করা জরুরী।

ইমাম আবু হানীফার মতে, যে রোযার দিন নির্দিষ্ট, এর নিয়াত সেই দিনের দ্বিপ্রহরের মধ্যে করলেই চলবে। কিন্তু যে রোযার দিন নির্দিষ্ট নয় সে দিনের রোযার নিয়াত ফযর উদয় হওয়ার পূর্বে হওয়া আবশ্যক। এ মূলনীতির দৃষ্টিতে রমযান মাসের রোযার ও নির্দিষ্ট দিনের জন্য মানত করা রোযার নিয়াত সে দিনের দ্বিপ্রহরের মধ্যে করলেই কর্তব্য সম্পাদন হবে। কিন্তু কাফ্ফারা, কাযা ও অনির্দিষ্ট মানতের রোযার নিয়াত রাত্রিকালেই করতে হবে। তাঁর দলীল হল- হযরত ইবনে আব্বাসের বর্ণনা। একজন বেদুঈন নবী করীম (সা)-এর নিকট চাঁদ দেখার সাক্ষ্য দেয়। তা শুনে নবী করীম (সা) ঘোষণা করে দিলেন যে, যে লোক কোন কিছু খেয়েছে, সে যেন দিনের অবশিষ্ট সময়ে কিছুই না খায়। আর যে লোক এখন পর্যন্ত কিছুই পানাহার করেনি, সে যেন রোযা রাখে। 

(আবূ দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, নাসাঈ)

হযরত হাফসা (রা) বর্ণিত উপরিউক্ত হাদীস সম্পর্কে হানাফী ফিকহবিদদের বক্তব্য হল- প্রথমত উক্ত হাদীসটি

রাসূলে করীম (সা)-এর কথা, )مرفوع( না সাহাবীর কথা )موقوف( এ বিষয়েই মতভেদ রয়েছে। উহাকে যদি সহীহ হাদীস মেনে নেয়া যায়, তবুও বলা যায়, তাতে রোযা আদৌ না হওয়ার কথা বলা হয় নি, বরং বলা হয়েছে রোযার সাওয়ার না হওয়ার কথা। অর্থাৎ কোন লোক যদি রমযানের রোযার নিয়াত রাত্রে না করে দিনের দ্বিপ্রহরের মধ্যে করে, তবে সে রোযার মাহাত্ম্য লাভ থেকে বঞ্চিত থাকবে। রোযা তার হয়ে যাবে। তবে এর শুভ প্রতিফল পাবে সে সময় থেকে যখন সে নিয়াত করবে। (আল-কাওবুদ দুররী, তুহফাতুল আহওয়াজী ও আল-লুম'আত)

অন্যান্য ফিকহবিদের মতে হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসটি অনুযায়ী আমল করা যাবে কেবল তখন, যখন দিনের বেলাই রোযা শুরু হওয়ার কথা জানতে পারবে। কেননা তখন তো আর রাত্রিকাল ফিরে পাওয়া যাবে না। ইমাম যাইলায়ী ও হাফেয ইবনে হাজার আসকালানীও এ মত প্রকাশ করেছেন। ইমাম শাওকানী লিখেছেন, হযরত হাফসা (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসটি থেকে রাত্রিকালেই রোযার নিয়াত করা ওয়াজিব প্রমাণিত হয়। হযরত ইবনে উমর ও জাবির ইবনে ইয়াযীদ এ মত গ্রহণ করেছেন। রোযা ফরয কিংবা নফল এ ব্যাপারে তাঁরা কোন পার্থক্য করেননি। আবু তালহা, আবু হানীফা, শাফেয়ী, আহমদ ইবনে হাম্বল বলেছেন:

নফল রোযার নিয়াত রাত্রিকালে করা ওয়াজিব নয়।

হযরত আয়েশা (রা)-এর মত হল- দ্বিপহরের পর নিয়াত করলে রোযা সঠিক হবে।

আরো পড়ুন: হালাল ও হারাম উপার্জন হারাম উপার্জন থেকে দান করা ও অপরের অধিকার হরণ 

রোযার পরকালীন ফল

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলে কারীম (সা) বলেছেন: যে ব্যক্তি রমযান মাসের রোযা রাখবে ঈমান ও চেতনাসহকারে, তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। (বুখারী, মুসলিম, আবূ দাউদ তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমদ)

ব্যাখ্যা

রমযানের রোযা ফরয। এ রোযা যথাযথভাবে রাখার জন্য এ হাদীসে বিশেষ উৎসাহব্যঞ্জক সুসংবাদ দান করা হয়েছে। এ পর্যায়ে দুটি শব্দের উল্লেখ হয়েছে। একটি আর দ্বিতীয়টি এখানে প্রথম শব্দটির অর্থ, নিয়াত এবং দ্বিতীয় শব্দটির অর্থ দৃঢ়সংকল্প। অর্থাৎ রোযা রাখতে হবে ঈমান সহকারে এবং এ বিশ্বাস সহকারে যে, রোযা আল্লাহ তাআলাই ফরয করেছেন এবং মুসলমান হিসেবে এটা আমার উপর অবশ্য পালনীয় কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয়ত এ রোযা রাখতে হবে একান্তভাবে আল্লাহর সন্তোষ বিধানের উদ্দেশ্যে, লোক দেখানোর জন্য নয় এবং তা রাখতে হবে এ আশায় যে, এজন্য আল্লাহ তাআলার নিকট থেকে বিশেষ সাওয়াব ও প্রতিফল পাওয়া যাবে। উপরন্ত এজন্য মনে দুরন্ত ইচ্ছা বাসনা ও একান্তভাবে কাম্য। রোযা রাখার প্রতি একবিন্দু অনীহা ও বিরক্তিভাব থাকতে পারবে না, একে একটা বোঝা মনে করা যাবে না রোযা রাখা যতই কষ্টকর হোক না কেন। বরং রোযার দিন দীর্ঘ হলে ও রোযা থাকতে কষ্ট অনুভূত হলে একে আল্লাহর নিকট থেকে আরো বেশী সওয়াব পাওয়ার কারণ মনে করতে হবে। অতএব এমন মানসিকতা সহকারে রোযা রাখা হলে এর ফলস্বরূপ অতীতের যাবতীয় গুনাহ মাফ হয়ে যাবে।

রোযা না রাখার অনুমতি

কুরআন মাজীদের আয়াত 'যারা রোযা রাখতে সমর্থ নয়, এমন ব্যক্তির জন্য একজন দরিদ্র ব্যক্তির খাবারের বিনিময় মূল্য হিসেবে দেয়া তাদের কর্তব্য' সম্পর্কে হযরত ইবনে আব্বাস বলেছেন। অত্যন্ত বয়ঃবৃদ্ধ ও খুব বেশী বয়সের বৃদ্ধার জন্য রোযা রাখতে সামর্থ্যবান হওয়া সত্ত্বেও এ সুবিধাদান করা হয়েছে যে, তারা দু'জন রোযা ভাঙ্গবে (রোযা রাখবে না)। আর প্রত্যেক দিনের রোযার পরিবর্তে একজন গরীব ব্যক্তিকে খাওয়াবে এবং গর্ভবতী ও যে স্ত্রীলোক শিশুকে দুগ্ধ সেবন করায়-এ দু'জন যদি তাদের সন্তানদের ব্যাপারে আশংকাবোধ করে, তবে তারা রোযা ভাঙ্গবে ও মিসকীনকে খাওয়াবে। (আবু দাউদ)

ব্যাখ্যা

কুরআন মাজীদের এ আয়াতটি সূরা আল-বাকারার ১৮৪ নম্বর আয়াত। এ আয়াতটি সম্পর্কে তাফসীরকার ও হাদীসবিদদের মধ্যে বিশেষ মতভেদের উদ্ভব হয়েছে। উপরিউক্ত হাদীসটিতে হযরত ইবনে আব্বাসের অভিমত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বিবৃত হয়েছে। তাঁর মত হল, এ আয়াতটি শাশ্বত। এর অর্থ ও তাৎপর্য চির কার্যকর। এ আয়াত অনুযায়ী গর্ভবতী বা যে মেয়েলোক নিজের গর্ভজাত সন্তানকে দুগ্ধ সেবন করায় তাদের জন্য রোযা না রাখার অনুমতি রয়েছে। যে বৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও রোযা রাখার সামর্থ্য রাখে, তাকে রোযা রাখতে হবে। সে বিনিময় মূল্য ফিদইয়া দিয়ে রোযা রাখার দায়িত্ব এড়াতে পারবে না। কিন্তু গর্ভবতী ও দুগ্ধপোষ্য শিশুর মা- যে দুগ্ধ সেবন করায়-রোযার মাসে রোযা ভাঙ্গলে প্রত্যেক দিনের পরিবর্তে একজন করে মিসকিনকে খাওয়াতে হবে এবং অসুবিধার সময় অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর রোযা কাযা করতে হবে। তাদের উপর না-রাখা রোযা কাযা করার বাধ্যবাধকতার সঙ্গে সঙ্গে মিসকীন খাওয়ানোর দায়িত্ব এজন্য চাপানো হয়েছে যে, তারা নিজেদের নয়, অন্যের কারণে রোযা ভাঙ্গছে। রোযা রাখলে গর্ভস্থ কিংবা দুগ্ধপোষ্য শিশুর ক্ষতি হবে এ ভয় ও আশংকাই তাদের রোযা ভাঙ্গার মূল কারণ, পক্ষান্তরে থুরথুরে বৃদ্ধকে রোযা ভাঙ্গার অনুমতি দেয়া সত্ত্বেও মিসকীন খাওয়ানোর দায়িত্ব আরোপিত হয়েছে। কেননা সে রোযা ভাঙ্গছে নিজের দৈহিক অক্ষমতার কারণে। ইমাম শাফেয়ী, আহমদ ইবনে হাম্বল ও মুজাহিদ (র) এ মত প্রকাশ করেছেন।

কিন্তু যে থুরথুরে বৃদ্ধ রোযা থাকতে অক্ষম, সে শুধু মিসকীন খাওয়াবে। তাকে রোযা কাযা করতে হবে না। হযরত আনাস (রা) থেকে এ কথাই বর্ণিত হয়েছে। তিনি যখন খুব বেশী বয়োবৃদ্ধ হয়েছিলেন, তখন তিনি নিজেই এটা করেছেন। ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম আওযায়ীর মতে গর্ভবতী ও দুগ্ধপোষ্য শিশুর মা না-রাখা রোযা শুধু কাযা করবে, মিসকীন খাওয়াতে হবে না। এ দুইজনের অবস্থা রোগাক্রান্ত ব্যক্তির মত। হযরত হাসান বসরী, আতা, নাখয়ী ও যুহরী থেকে এটাই বর্ণিত হয়েছে। ইমাম মালিক ইবনে আনাস বলেছেন, গর্ভবতী নারী রোগীর মতই শুধু রোযা করবে, মিসকীনকে খাওয়াবে না। আর শিশুকে দুগ্ধ সেবন করানোর কারণে যে স্ত্রীলোক রোযা ভাঙ্গবে, সে মিসকীনও খাওয়াবে এবং রোযা কাযাও করবে। 

হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে অপর একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে-

থুরথুরে নড়বড়ে বৃদ্ধকে রোযা ভাঙ্গার ও প্রত্যেক দিনের পরিবর্তে একজন মিসকীন খাওয়ানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তাকে না-রাখা রোযা কাযা করতে হবে না। (দারাকুতনী)


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url