পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, জুম্মা, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার সালাত আদায়ের নিয়ম

আজ এই আর্টিকেলটি পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, সালাতের আহকাম আরকান, জুম্মার সালাত, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার সালাত ও সালাতের নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

 


সালাত

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো সালাত বা নামায। সালাতের কতকগুলো নিয়ম আছে। এই নিয়মগুলো পালন করা ফরজ।

সালাতের আহকাম - 

সালাত শুরুর আগে সাতটি ফরজ কাজ করতে হয়। এগুলোকে বলে সালাতের আহকাম। আহকাম ঠিকমতো পালন না করলে সালাত আদায় হয় না।

১। শরীর পাক হওয়া ২। কাপড় পাক হওয়া ৩। সালাতের জায়গা পাক হওয়া ৪। সতর ঢাকা ৫। কিবলামুখী হওয়া ৬। নিয়ত করা ৭। সময়মতো সালাত আদায় করা।

সময়মতো সালাত আদায় করা আল্লাহ তায়ালার আদেশ। সময়মতো আদায় না করলে সালাত আদায় হয় না। মহান আল্লাহ বলেন, " সঠিক সময়ে সালাত আদায় করা মুমিনের জন্য ফরজ।" সালাতের নির্দিষ্ট সময় হলো

ফজর

রাত শেষে পূর্ব আকাশে সাদা আভা দেখা দিলে ফজর শুরু হয়। সূর্য উঠার পূর্ব মুহূর্তে তা শেষ হয়।

যোহর

দুপুরে সূর্য পশ্চিমে নামতে আরম্ভ করলে যোহর শুরু হয়। আর কোনো কাঠির ছায়া সে কাঠির মূলছায়া বাদে তার দ্বিগুণ হলে তা শেষ হয়।

আসর

যোহর শেষ হওয়ার সাথে সাথে আসর শুরু হয়। সূর্য ডোবার পূর্বে তা শেষ হয়।

মাগরিব

সূর্য ডোবার পর মাগরিব শুরু হয়। পশ্চিম আকাশে আলোর লাল আভা মুছে যাওয়ার সাথে সাথে তা শেষ হয়।

এশা

মাগরিব শেষ হওয়ার পর এশা শুরু হয়। ফজরের পূর্ব পর্যন্ত এশার সালাতের সময় থাকে। তবে মধ্য রাতের পূর্বে এশার সালাত পড়া ভালো।

সালাতের আরকান-

সালাতের ভিতরে ছয়টি ফরজ কাজ আছে। এগুলোকে সালাতের আরকান বলে। যথা:

১। তাকবির-ই-তাহরিমা বা আল্লাহু আকবর বলে সালাত শুরু করা।

২। কিয়াম অর্থাৎ দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করা। তবে কোনো কারণে দাঁড়াতে অক্ষম হলে বসে, এমনকি শুয়েও সালাত আদায় করা যায়।

৩। কিরাত অর্থাৎ কুরআন মজিদের কিছু অংশ তিলাওয়াত করা।

৪। রুকু করা।

৫। সিজদাহ্ করা।

৬। শেষ বৈঠকে বসা, সালাম-এর মাধ্যমে সালাত শেষ করা।

এর কোনো একটা বাদ পড়লে সালাত আদায় হয় না। তাই এগুলো আদায়ের ব্যাপারে আমরা খুবই সাবধান থাকব।

আরো পড়ুন: রোযার গুরুত্ব ও তাৎপর্য রোযা রাখার ফলাফল এবং রোযা কাযা করা  না করার অনুমতি

সালাত আদায়ের নিয়ম

সালাত সবচেয়ে বড় ইবাদত। মহানবি (স) যেভাবে সালাত আদায় করতেন আমরাও সেভাবে সালাত আদায় করব। আমরা সালাত আদায়ের জন্য দাঁড়াব। আমাদের মুখ থাকবে পবিত্র কিবলার দিকে। আমরা পাকসাফ হয়ে সারা জাহানের বাদশাহ আল্লাহ তায়ালার দরবারে হাজির হব। সালাতে যা যা পড়বো তার অর্থ জেনে নেব।

সর্বপ্রথম বলব আল্লাহু আকবর- اঅর্থ আল্লাহ সবচেয়ে বড়।

মুখে এ বিরাট অঙ্গীকার করে পৃথিবীর যাবতীয় জিনিস হতে নিজের সম্পর্ক ছিন্ন করব। প্রতীক হিসেবে কান পর্যন্ত দুই হাত তুলব। এরপর সারা জাহানের বাদশাহর সামনে আল্লাহু আকবর বলে হাত বেঁধে দাঁড়াব।

এরপর বিনয় সহকারে সানা পড়ব। সানা হলো- সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়াবিহামদিকা ওয়া তাবারাকাসমুকা ওয়াতায়ালা জাদ্দুকা ওয়া লা ইলাহা গাইরুকা।

এরপর আউযূ বিল্লাহি মিনাশ শায়তনির রাজিম এবং বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম পড়ব। তারপর সূরা ফাতিহা পাঠ করে অন্য কোনো সূরা বা সূরার অংশ পাঠ করব। আল্লাহ আকবর বলে রুকু করব। রুকুতে তিনবার সুবহানা রাব্বিয়াল আযীম পড়ব। সামি আল্লাহ্র লিমান হামিদাহ বলে সোজা হয়ে দাঁড়াব। দাঁড়ানো অবস্থায় রব্বানা লাকাল হামদ বলব। এরপর আল্লাহু আকবর বলে সিজদাহ করব।

এরপর আল্লাহু আকবর বলে সোজা হয়ে দাঁড়াব। সূরা ফাতিহা পাঠ করে অন্য কোনো সূরা পাঠ করব। পরে প্রথম রাকআতের মতো রুকু সিজদাহ করে স্থির হয়ে বসব। তাশাহহুদ, দরুদ ও দোয়া মাসুরা পাঠ করব। এরপর প্রথমে ডান দিকে মুখ ফিরিয়ে আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ, পরে বাম দিকে মুখ ফিরিয়ে বলব আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ। এভাবে দুই রাকআত বিশিষ্ট সালাত আদায় করব।

যদি তিন বা চার রাকআত বিশিষ্ট সালাত হয় তবে আবদুহু ওয়া রাসূলুহু পর্যন্ত পড়ে আর বসব না। আল্লাহ্ আকবর বলে উঠে দাঁড়াব। তারপর আগের মতো তৃতীয় ও চতুর্থ রাকআত পড়ব। তবে ফরজ সালাতের ক্ষেত্রে তৃতীয় ও চতুর্থ রাকআতে শুধুমাত্র সূরা ফাতিহা পাঠ করব।

মহানবি (স) জামাআতের সাথে সালাত আদায় করতেন। আমরাও জামাআতের সাথে সালাত আদায় করব।

জুমুআর সালাত

প্রতিদিন পাঁচবার মসজিদে জামাআত হয়। পাড়ার, মহল্লার লোকজন একসাথে সালাত আদায় করেন। এতে পরস্পর দেখা-সাক্ষাৎ হয়, কুশলাদি জানা যায়। সুখে-দুঃখে একে অন্যের সাহায্য-সহযোগিতার সুযোগ হয়।

প্রতি সপ্তাহে জামে মসজিদে আরও বা আকারে জুমুআর জামাআত হয়। শুক্রবারে জুমুআর সালাতের জন্য অনেক মুসল্লির সমাবেশ ঘটে। আল্লাহপাক বলেন, "জুমুআর দিন আযান হলে সালাতের জন্য দ্রুত যাও। বেচাকেনা কন্ধ রাখ। সালাত শেষে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর রহমত তালাশ কর।"

জুমুআর দিন গোসল করা, ভালো পোশাক পরা, আতরমাখা সুন্নত। এদিন যোহরের সালাতের পরিবর্তে জুমুআর দুই রাকআত সালাত ফরজ।

ফরজ সালাতের আগে চার রাকআত কাবলাল জুমুআ সালাত পড়া সুন্নত। ফরজের পর চার রাকআত বাদাল জুমুআ সালাত পড়াও সুন্নত। এ ছাড়া সময় পেলে নফল সালাত পড়াও উত্তম।

জুমুআর সালাত যোহরের ওয়াক্তেই জামাআতে আদায় করতে হয়। জামাআত ছাড়া জুমুআর ফরজ আদায় হয় না।

জুমুআর জন্য দুটি আযান দেওয়া হয়। প্রথম আযান মিনারায় বা মসজিদের বাইরে দিতে হয়। ইমাম সাহেব খুতবা দিতে মিম্বারে বসলে দ্বিতীয় আযান দিতে হয়। এরপর ইমাম মিম্বারে দাঁড়িয়ে দুটি খুতবা দেন। খুতবা অর্থ বক্তৃতা। খুতবায় ইসলামের বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করা হয়।

খুতবা শোনা ওয়াজিব। এ সময় কথা বলা বা অন্য কিছু করা যায় না। এমনকি সালাত আদায় করাও নিষেধ।

খুতবা শেষে ইমামের সাথে দুই রাকআত ফরজ সালাত আদায় করতে হয়। ফরজের আগে নিয়ত করব, "আমি কিবলামুখি হয়ে আল্লাহর ওয়াস্তে দুই রাকআত জুমুআর ফরজ সালাত এই ইমামের সাথে পড়ার নিয়ত করলাম আল্লাহু আকবর।" তবে নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা বা পড়া আবশ্যক নয়।

জুমুআর সালাত মোট দশ রাকআত। চার রাকআত কাবলাল জুমুআ সুন্নত। দুই রাকআত ফরজ। চার রাকআত বাদাল জুমুআ সুন্নত।

আরো পড়ুন: জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

ঈদের সালাত

ঈদ হলো খুশির দিন। বিশ্বের মুসলিমগণ দুটি ঈদ উৎসব করেন। একটি রোযার শেষে ঈদুলফিতর। আরেকটি হলো কুরবানির ঈদ বা ঈদুলআযহা। ঈদের দিন সারা এলাকার মুসল্লিগণ ঈদগাহে একত্রিত হন। দুই রাকআত ঈদের সালাত আদায় করে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ঈদের সালাত পড়া ওয়াজিব।

ঈদুল ফিতর

পবিত্র রমযান মাসে সিয়াম সাধনার পর শাওয়াল মাসের প্রথম দিন হলো ঈদুলফিতর এর দিন। ঈদ অর্থ আনন্দ। ফিতর অর্থ রোযা ভক্তা করা। দীর্ঘ একমাস রোযা রাখার তাওফিক দানের জন্য মুসলিমগণ এদিন আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এটি নিছক আনন্দ উৎসবের দিন নয়।

এদিন পাড়া-প্রতিবেশী, গরিব-দুঃখীর খোঁজখবর নিতে হয়। বিধবা, ইয়াতীম, সকলের মুখে সাধ্যমতো হাসি ফুটানোর চেষ্টা করতে হয়। ধনীদের উপর এ দিন সাদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। কারণ আনন্দের দিন যাতে কেউ অভুক্ত না থাকে। ঈদের দিনে রোযা রাখা হারাম।

ঈদের দিনের সুন্নত: সকালে গোসল করা, খুশবুমাখা, পরিষ্কার কাপড় পরা, মিষ্টি জাতীয় কিছু খাওয়া, ঈদের সালাত মাঠে আদায় করা।

ইমামের সাথে দুই রাকআত ঈদুলফিতরের সালাত আদায় করা ওয়াজিব। এতে ছয়টি অতিরিক্ত ওয়াজিব তাকবির দিতে হয়।

ঈদের সালাত আদায় করার নিয়ম

প্রথমে কাতার করে ইমামের পিছনে দাঁড়াব। নিয়ত করব। আল্লাহু আকবর বলে কান পর্যন্ত হাত উঠিয়ে তাহরিমা বাঁধব। সানা পাঠ করব। এরপর কান পর্যন্ত হাত উঠিয়ে ইমামের সাথে তিন তাকবির দিব। প্রথম দুইবার হাত না বেঁধে ছেড়ে রাখব। তৃতীয় তাকবির দিয়ে সালাতে হাত বাঁধার মতো দুই হাত বাঁধব। এরপর ইমাম সাহেব অন্যান্য সালাতের মতো সূরা ফাতিহা ও যে কোনো সূরা পাঠ করবেন এবং যথারীতি রুকু সিজদাহ করে প্রথম রাকআত শেষ করবেন। অতঃপর দ্বিতীয় রাকআতে ইমাম সাহেব সূরা ফাতিহাও যে কোনো সূরা পাঠ করবেন। এরপর তিন তাকবির দিবেন। আমরাও তিনবার আল্লাহ্র আকবর বলব। তিনবারই কান পর্যন্ত হাত উঠিয়ে নামিয়ে রাখব, হাত বাঁধব না। পরে চতুর্থবার আল্লাহ্র আকবর বলে রুকু করব।

এরপর অন্যান্য সালাতের মতো সিজদাহ করব, তশাহহ্রদ, দরুদ, দোয়া মাসুরা পাঠ করে ইমামের সাথে সালাম ফিরাব। সালাত শেষে ইমাম সাহেব দুইটি খুতবা দেবেন। খুতবা শোনা ওয়াজিব।

ঈদুলআযহা

দ্বিতীয় ঈদ হলো ঈদুলআযহা বা কুরবানির ঈদ। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। আল্লাহর নির্দেশে এদিন হযরত ইবরাহীম (আ) নিজপুত্র হযরত ইসমাঈল (আ)-কে আল্লাহর নির্দেশে কুরবানি করতে তৈরি হন। তাঁর এ ত্যাগের স্মৃতি স্বরূপ মুসলমানের উপর কুরবানি ওয়াজিব করা হয়েছে।

যিলহজ মাসের দশম তারিখ ঈদুল আযহার দিন। ঈদুলফিতরের মতো এদিনও গোসল করে খুশবু মেখে পরিষ্কার কাপড় পরে ঈদগাহে একই নিয়মে দুই রাকআত ওয়াজিব সালাত আদায় করতে হয়। সালাত শেষে ইমাম দুইটি খুতবা দেবেন। খুতবা শোনা ওয়াজিব। এদিন সালাতের আগে কিছু না খাওয়া ভালো। রাস্তায় জোরে জোরে তাকবির পড়া সুন্নত।

ঈদের তাকবির হলো: আল্লাহ্ আকবর আল্লাহু আকবর, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, ওয়া লিল্লাহিল হামদ।

যিলহজ মাসের নবম তারিখ ফজর থেকে তের তারিখ আসর পর্যন্ত ফরজ সালাত শেষে এই তাকবির পড়া ওয়াজিব। ঈদুলফিতরের দিন এই তাকবির আস্তে আস্তে পড়তে হয়।

সালাত শেষে কুরবানি করতে হয়। কুরবানির গোশত তিন ভাগ করে একভাগ নিজের জন্য রাখব, একভাগ আত্মীয়দের মাঝে বিতরণ করব, আরেক ভাগ গরিবদের মাঝে বণ্টন করব। এভাবে ঈদের খুশিতে সবাই শরিক হতে পারে। এতে সমাজে মধুর সম্পর্ক স্থাপিত হয়।

আমরা ঈদের এ মহান শিক্ষা নিজেদের জীবনে বাস্তবায়িত করব। সবার সঙ্গে মিলেমিশে ঈদের আনন্দ উপভোগ করব। ঈদের এ শিক্ষাকে সমাজে ছড়িয়ে দেব।

আল্লাহ হাফেজ***

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url