আরবের ভৌগোলিক অবস্থান ও গোত্র-উপগোত্র সম্পর্কে বিস্তারিত
সিরাতে নববি তথা নবিজি সা.-এর জীবনচরিত বলতে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ প্রদত্ত ওই রিসালাতকে বোঝায়, যা তিনি নিজের কথাবার্তা, আমল-আখলাক ও সুমার্জিত চলাফেরার মাধ্যমে সমগ্র মানবজাতির সামনে জীবন্ত করে তুলে ধরেছেন এবং যার মাধ্যমে তিনি মানুষকে গুমরাহির গাঢ় অন্ধকার থেকে বের করে তুলে এনেছেন হিদায়াতের আলোকজ্জ্বল রাজপথে। মানুষকে মানুষের দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে দেখিয়েছেন মালিকের বন্দেগির নুরানি পথ। আমূল বদলে দিয়েছেন মূর্খতায় আচ্ছন্ন সমাজ। পাল্টে দিয়েছেন বিপথে বয়ে চলা ইতিহাসের গতিপথ।
নবিজি সা.-এর পবিত্র জীবনধারার পরিপূর্ণ প্রতিচ্ছবি অঙ্কন ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব নয়, যতক্ষণ না রিসালাতের পূর্বাপর অবস্থার তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ করা হবে। সুতরাং মূল আলোচনায় পূর্বে আলোচ্য অধ্যায়ে প্রাক ইসলামিক যুগে আরবে বসবাসরত জাতি- উপজাতিগুলোর অবস্থা ও অবস্থান এবং তাদের উত্থান ও পতনের চিত্রগুলো সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরছি। আরও তুলে ধরছি সে সময়কার নিখুঁত চিত্র, যে সময় নবিজি সা.-কে রিসালাত দান করা হয়েছিল।
আরো পড়ুন: আখলাক বা মানুষের স্বভাব চরিত্র সর্ম্পকে বিস্তারিত
আরবের ভৌগোলিক অবস্থান
আরব শব্দের শাব্দিক অর্থ, বালুকাময় ঊষর-ধূসর মরুপ্রান্তর; তৃণশস্যহীন অঞ্চল। প্রাচীনকাল থেকেই শব্দটি আরব উপদ্বীপ ও সেখানকার বসবাসরত জাতিদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আরবের পশ্চিম দিকে লোহিত সাগর ও সিনাই উপদ্বীপ, পূর্বে আরব উপসাগর ও দক্ষিণ ইরাকের একটি বড় অংশ এবং দক্ষিণে আরব সাগর, যা ভারত মহাসাগরের বিস্তৃত অংশ, উত্তরে সিরিয়া ও উত্তর ইরাকের কিছু অংশ। বর্ণিত সীমানার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা মতভিন্নতা রয়েছে। সমগ্র ভূভাগের আয়তন ১০ লক্ষ হতে ১৩ লক্ষ বর্গ মাইল পর্যন্ত ধরা হয়ে থাকে। আরব উপদ্বীপ ভৌগোলিক ও ভূপ্রাকৃতিক দুই দিক থেকেই অপরিসীম গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে। এই উপদ্বীপের চতুর্দিক মরুভূমি ও দিগন্তজোড়া বালুকাময় প্রান্তর দ্বারা পরিবেষ্টিত। ফলে এই উপদ্বীপ এমন এক সুরক্ষিত কেল্লায় পরিণত হয়েছে, যেকোনো ভিনদেশী শক্তির পক্ষে এর ওপর আক্রমণ করা, অধিকার প্রতিষ্ঠা করা কিংবা প্রভাব বিস্তার করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। আল্লাহ প্রদত্ত এই নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণেই এই উপদ্বীপের অধিবাসীগণ স্মরণাতীত কাল থেকেই সম্পূর্ণ স্বাধীন থেকে স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে চলতে সক্ষম হয়েছে। অথচ এই উপদ্বীপটি ভৌগোলিক দিক থেকে এমন দুই পরাশক্তির প্রতিবেশী-ভূপ্রাকৃতিক এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকলে এই পরাশক্তিদ্বয়ের হস্তক্ষেপ থেকে আরবের মুক্ত থাকা কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। বহির্বিশ্বের দিক থেকে আরব উপদ্বীপের প্রতি খেয়াল করলে সহজেই বোঝা যায়, প্রাচীনকাল থেকেই এই উপদ্বীপটি মহাদেশসমূহের একেবারে মধ্যস্থলে অবস্থিত ও জল ও স্থল দু-পথেই মহাদেশগুলোর সাথে সংযুক্ত। কারণ, এর উত্তর পশ্চিম সীমান্ত হচ্ছে আফ্রিকা মহাদেশের প্রবেশপথ, উত্তর পূর্ব সীমান্ত হচ্ছে ইউরোপ মহাদেশের প্রবেশমুখ এবং পূর্ব সীমান্ত হচ্ছে ইরান ও মধ্য এশিয়া হয়ে চীন, ভারতসহ দূর প্রতীচ্যে আসা-যাওয়ার রাজদুয়ার। এভাবেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও মহাদেশের সঙ্গে সাগর ও মহাসাগরের জলপথ আরব উপদ্বীপের এক চমৎকার যোগসূত্র রচনা করেছে। বিভিন্ন দেশের জাহাজগুলো সরাসরি আরবের বন্দরে গিয়ে নোঙর করে। প্রাকৃতিক এমন ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই আরব উপদ্বীপের উত্তর ও দক্ষিণ সীমান্ত ছিল বিভিন্ন জাতির ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের প্রাণকেন্দ্র।
আরবের গোত্রসমূহ
ইতিহাসবিদগণ আরব সম্প্রদায়গুলোকে জন্মসূত্রের আলোকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন-
১. আরবে বায়িদা: তারা হলেন সে সমস্ত প্রাচীন গোত্র, যাদের ব্যাপারে জানার জন্য নির্ভরযোগ্য তথ্য ও প্রমাণাদির সন্ধান লাভ অসম্ভব হয়ে পড়েছে। যেমন আদ, সামুদ, তাসাম, জাদিস, আমালিকা ইত্যাদি।
২. আরবে আরিবা: যারা ইয়াশজুব ইবনু ইয়ারুব ইবনু কাহতানের বংশোদ্ভূত। তাদেরকে কাহতানি আরব বলা হয়।
৩. আরবে মুসতারিবা: যাঁরা হজরত ইসমাইল সা.-এর বংশধারা থেকে আগত। তাঁদেরকে আদনানি আরব বলা হয়। আরবে আরিবা তথা কাহতানি আরবদের প্রকৃত বসতবাড়ি ছিল ইয়ামান রাজ্য। কাহতানের বংশধারা বহু শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। যার মধ্যে দুটি শাখা পরবর্তীকালে অনেক প্রসিদ্ধি লাভ করে।
১. হিমইয়ার: এর প্রসিদ্ধ শাখাগুলো হচ্ছে-জাইদুল জমহুর, কুজাআ ও সাকাসিক।
২. কাহলান: এর প্রসিদ্ধ শাখাগুলো হলো-হামদান, আনমার, তাই, মাজহিজ, কিন্দাহ, লাগম, জুজাম, আজদ, আউস, খাজরাজ এবং জাফনাহর বংশধরগণ, যারা পরবর্তীতে শামদেশের আশপাশে সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে অধিকাংশ কাহলানি গোত্রগুলো ইয়ামান ছেড়ে আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের এই হিজরতের ঘটনার বৃহৎ অংশটা ঘটে সাইলে আরিমের কিছুটা পূর্বে। যখন রোমীয়রা মিশর ও শামে অনুপ্রবেশ করে ইয়ামানিদের ব্যবসা-বাণিজ্যের জলপথের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে এবং স্থলপথের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধার দুয়ার চিরতরে বন্ধ করে দেয়। ফলে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য একেবারে উজাড় হয়ে যায়। তবে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই, কাহলানিদের এই দেশত্যাগের অন্যতম কারণ ছিল হিমইয়ারিদের সাথে তাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহ। যার প্রমাণ বহন করে কাহলানিদের দেশত্যাগ সত্ত্বেও হিমইয়ারিদের সেখানেই স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়াটা। দেশত্যাগী কাহলানিরা চারটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
আরো পড়ুন: আল-কুরআন আল্লাহর অপ্রতিদ্বন্দ্বী গ্রন্থ সম্পর্কিত আয়াত
১. আজদ: তারা নিজেদের নেতা ইমরান ইবনু আমর মুজাইকিয়ার পরামর্শে দেশত্যাগ করেন। প্রথম দিকে তারা নিজ দেশেরই এক এলাকা হতে আরেক এলাকায় হিজরত করতে থাকেন এবং অবস্থার সঠিক ধারণা পেতে অগ্রভাগে অনুসন্ধানী দল প্রেরণ করতে থাকেন। এরপর তারা উত্তর দিকে গমন করেন এবং বিভিন্ন স্থানে নিজেদের বসতি স্থাপন করেন। তাদের দেশান্তর ও বসতি স্থাপন সংক্রান্ত বিবরণ নিম্নরূপ-
সালাবা ইবনু আমর: তিনি প্রথমে হিজাজ অভিমুখে অগ্রসর হয়ে সালাবিয়া ও জিকার নামক স্থানের মধ্যবর্তী এলাকায় বসতি গড়ে তোলেন। যখন তার সন্তান-সন্ততি প্রাপ্তবয়স্ক হয় এবং তার গোত্র শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তখন তিনি মদিনা অভিমুখে অগ্রসর হয়ে সেখানেই বসবাস করতে শুরু করেন। এই সালাবা ইবনু আমরের বংশধারা থেকেই আউস ও খাজরাজ গোত্রের জন্ম। আউস ও খাজরাজ ছিল হারিসা ইবনু সালাবার দুই পুত্র।
হারিসা ইবনু আমর: তিনি এবং তার সন্তানাদি হিজাজভূমিতে ছড়িয়ে পড়েন। একপর্যায়ে তাঁরা মাররুজ-জাহরান নামক স্থানে এসে বসবাস করতে থাকেন। অতঃপর তাঁরা হারাম শরিফের ওপর প্রবলবেগে আক্রমণ করে সেখান থেকে বনু জুরহুমকে বহিষ্কার করে নিজেরাই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন।
ইমরান ইবনু আমর: তিনি এবং তার সন্তানাদিরা ওমানে এসে বসবাস করতে থাকেন। এ কারণেই তাদেরকে আজদে ওমান বলা হয়।
নাসর ইবনু আজদ: তার অধীন গোত্রগুলো তুহামায় অবস্থান গ্রহণ করে। তাদেরকে আজদে শানুয়াত বলা হয়।
জাফনা ইবনু আমর: তিনি শামে গমন করেন এবং সেখানেই স্থায়ী বসতি গড়ে সপরিবারে বসবাস শুরু করেন। তিনিই হচ্ছেন গাসসানি শাসকদের গর্বিত পূর্বপুরুষ। শামে গমনের পূর্বে হিজাজে গাসসান নামক ঝরনার ধারে তারা কিছুদিন বসবাস করেছিলেন; তাই তাদেরকে গাসসানি বংশ বলা হতো।
২. লাখম ও জুজাম গোত্র: এই লাখমিদের মধ্যে নাসর ইবনু রবিআ নামক এক ব্যক্তি ছিলেন, যিনি হিরার মুনাজিরাহ বংশের শাসকদের মধ্যে অত্যন্ত প্রতাপশালী পূর্বপুরুষ ছিলেন।
৩. বনু তাই: বনু আজদ দেশত্যাগের পর তাঁরা উত্তর দিকে এগিয়ে আজা ও সালামা দুই পাহাড়ের পাদদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। এ কারণেই এই দুটি পাহাড় বনু তাই গোত্রের নামেই পরিচিতি লাভ করে।
৪. কিন্দা গোত্র: তারা প্রথমে বাহরাইনে শিবির স্থাপন করেন। কিন্তু সেখানকার পরিবেশ অনুকূল না হওয়ায় বাধ্য হয়ে হাজরামাউত অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু সেখানেও তেমন সুযোগ-সুবিধা করতে না পেরে পরিশেষে নাজদ অঞ্চলে গিয়ে বসতি স্থাপন করেন। তারা সেখানে একটি সুবিশাল জাঁকজমকপূর্ণ রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন। কিন্তু সেই রাষ্ট্র বেশিদিন স্থায়িত্ব পায়নি। কিছুদিনের মধ্যেই তার অস্তিত্ব চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। হিমইয়ারিদেরও কুজাআ নামে একটি গোত্র রয়েছে, যদিও তাদের হিমইয়ারি হওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। যারা ইয়ামান ছেড়ে ইরাকের সীমান্ত বাদিয়াতুস সামাওয়াতে বসতি স্থাপন করেছিলেন।
আরবে মুসতারিবা: তাদের প্রধান পূর্বপুরুষ ছিলেন হজরত ইবরাহিম আ.। যিনি মূলত ইরাকের 'উর' শহরের বাসিন্দা ছিলেন। এ শহরটি ফোরাত নদীর বেলাভূমিতে কুফার সন্নিকটে অবস্থিত। ফোরাত নদী খননের সময় যে সমস্ত শিলালিপি পুথি-পুস্তক ও দলিলাদি উদ্ধার করা হয়, সেসবের মাধ্যমে এ শহর সম্পর্কে নানা মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি প্রকাশিত হয়েছে। যার মধ্যে হজরত ইবরাহিম আ.-এর উর্ধ্বতন বংশধর, তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে অনেক তথ্য ছিল। হজরত ইবরাহিম আ. এখান থেকে হিজরত করে হাররান শহরে গিয়েছিলেন। তারপর সেখান থেকে ফিলিস্তিনে উপনীত হন এবং ফিলিস্তিনকেই নবুওয়াতি কর্মকাণ্ডের জন্য কেন্দ্র হিসেবে গ্রহণ করেন। এখান থেকেই তিনি দেশের ভেতর-বাইর দ্বীনের প্রচারে সর্বতোভাবে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি একবার মিশরে গমন করেন। তাঁর সঙ্গে তাঁর স্ত্রী সারাহ আ.-ও ছিলেন। মিশরের তৎকালীন রাজা তাঁর মন্ত্রীর মুখে সারাহ আ.-এর অনিন্দ্য রূপগুণের কথা শুনে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে ও অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থের মানসে তাঁর দিকে পা বাড়ায়। এ অবস্থায় তিনি জালিমের প্রতি একরাশ ঘৃণা ও ক্ষোভ নিয়ে আকুলচিত্তে মালিকের দরবারে নিজের মুক্তির প্রার্থনা জানান। আল্লাহ তাআলা তৎক্ষণাৎ তার দুআ কবুল করে নেন। তিনি রাজার হাত-পা অকেজো ও বিকল করে দেন। শেষ পর্যন্ত সে একদম নাজেহাল হয়ে পড়ে। এমন ভয়াবহ পরিণতিতে রাজা হতবাক হয়ে পড়ে। এমন মর্মান্তিক অবস্থার মধ্য দিয়ে বুঝতে সক্ষম হয়, সারাহ কোনো সাধারণ নারী নন, বরং তিনি হচ্ছেন আল্লাহ তাআলার পরম প্রিয়দের শ্রেণিভুক্ত এক মহীয়সী নারী। হজরত সারাহ আ-এর এমন অনন্য ব্যক্তিত্বের উদ্ভাসে তিনি এতটাই মুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে পড়েন, হাজিরাকে সারাহ আ.-এর সেবায় সর্বতোভাবে নিয়োজিত করে দেন। হাজিরার সেবা-যত্ন ও গুণ-গরিমায় মুগ্ধ হয়ে নিজ স্বামী হজরত ইবরাহিম আ-এর জন্য তাঁকে হিবা করে দেন। হজরত ইবরাহিম আ. তাঁদের দুজনকে সঙ্গে নিয়ে নিজ দেশ ফিলিস্তিনে প্রত্যাবর্তন করেন। প্রত্যাবর্তনের পর আল্লাহ তাআলা হাজিরার গর্ভে হজরত ইবরাহিম আ.-কে এক নেককার পুত্রসন্তান দান করেন। তাঁর নাম রাখা হয় ইসমাইল। হাজিরার গর্ভে হজরত ইবরাহিম আ.-এর সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ায় হজরত সারাহ লজ্জিত এবং বিব্রতবোধ করতে থাকেন। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আশায় তিনি হজরত ইবরাহিম আ-কে উপর্যুপরি চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন-যেন তিনি শিশু সন্তানসহ হাজিরাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন। ফলে তিনি তাদেরকে নিয়ে হিজাজভূমিতে আগমন করেন। সেখানে বাইতুল্লাহ শরিফের সন্নিকটে অনাবাদি ও গাছ-পালাহীন উপত্যকায় রেখে ফিরে যান তাঁদেরকে। তৎকালীন সময় সেখানে এ সময়ের বাইতুল্লাহর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। সেখানে ছিল শুধু একটি উঁচু টিলা। যার ডান-বাম দিয়ে প্লাবনের ধারা বয়ে চলত। সে সময় জমজমের পাশে মসজিদে হারামের উপরিভাগে একটি বিশালকায় বৃক্ষ ছিল। তিনি তাঁদেরকে সেই বৃক্ষের নিচে রেখে যান। তখন সেখানে না ছিল কোনো পানির উৎস, আর না ছিল কোনো বসতি। এক পাত্রে কিছু খেজুর ও মশকে কিছুটা পানি রেখে তিনি সুদূর ফিলিস্তিনে ফিরে যান। অল্প কদিনেই খেজুর ও পানি ফুরিয়ে আসে। কঠিন এক সঙ্কটে নিপতিত হন তাঁরা। তবে আল্লাহ তাআলা সেই সঙ্কটকে খুব দীর্ঘ হতে দেননি। অলৌকিক পন্থায় সেই সঙ্কট সমাধানের রাজপথ খুলে দেন। সৃষ্টি করে দেন জমজমের পবিত্র ধারা। যার মাধ্যমে তাঁদের জীবিকা নির্বাহের এক সহজ পথ উন্মুক্ত হয়। এর কিছুদিন পর ইয়ামান থেকে এক গোত্রের কিছু লোক সেখানে আগমন করেন। ইতিহাসে যাদেরকে দ্বিতীয় জুরহুম বলা হয়। তারা হজরত হাজিরা আ-এর অনুমতি সাপেক্ষে সেখানে বসবাস করতে শুরু করেন। বলা হয়ে থাকে, প্রথমে তারা পবিত্র মক্কার আশপাশের পার্বত্য অঞ্চলে বসতি স্থাপন করছিল। সহিহ বুখারিতে এ কথাও সুস্পষ্টভাবে বিবৃত হয়েছে, তারা হজরত ইসমাইল আ.-এর আগমনের পর মক্কায় আগমন করেছিলেন, হজরত ইসমাইল আ তখনও যৌবনে পদার্পণ করেননি। তবে তারা অনেক আগ থেকেই এ পথ ধরে যাতায়াত করতেন।
মরুভূমিতে রেখে আসা স্ত্রী-পুত্রের সাথে সাক্ষাতের জন্য হজরত ইবরাহিম আ. মাঝেমধ্যে পবিত্র মক্কায় আসতেন। তবে তিনি ঠিক কতবার মক্কার পবিত্র ভূমে আগমন করেছেন- তার সঠিক বিবরণ হাদিসে পাওয়া যায় না। ইতিহাসবিদদের অভিমত হচ্ছে, তিনি মোট চার বার মক্কায় আগমন করেছিলেন। যার বিবরণ নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
১. আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, তিনি স্বপ্নযোগে হজরত ইবরাহিম আ.-কে দেখালেন, তিনি আপন পুত্র হজরত ইসমাইল আ.-কে জবাই করছেন। নবিদের স্বপ্ন ওহি হয়ে থাকে। তাই তিনি এ স্বপ্নকে আল্লাহ তাআলার নির্দেশ বিশ্বাস করে তা পালনে পরিপূর্ণ প্রস্তুত হয়ে গেলেন। ইরশাদ হচ্ছে-
সুতরাং তারা যখন উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং পিতা পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিলো। আর আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইবরাহিম, তুমি তোমার স্বপ্ন সত্য করে দেখিয়েছ। নিশ্চয় আমি সৎকর্মশীলদের এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয় এটি একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে মুক্ত করলাম একটি মহান কুরবানির বিনিময়ে। (সুরা সাফফাত, আয়াত ১০৩-১০৭)
'মাজমুআহ বাইবেলের জন্মপর্ব'-এ উল্লেখ আছে, হজরত ইসমাইল আ নিজ ভাই ইসহাক আ থেকে ১৩ বছরের বড় ছিলেন। পবিত্র কুরআনের বর্ণনাভঙ্গি প্রমাণ করে, আলোচ্য ঘটনা হজরত ইসহাকের জন্মের পূর্বেই সংঘটিত হয়েছিল। কারণ, হজরত ইসমাইলের কুরবানির পুরো ঘটনা বলার পর আল্লাহ তাআলা হজরত ইসহাকের জন্মের সুসংবাদ প্রদান করেছেন। এই ঘটনা এ কথাই প্রমাণ করে, ইবরাহিম আ. হজরত ইসমাইল আ-এর যৌবনে পদার্পণ করার পূর্বে একবার হলেও মক্কায় আগমন করেছিলেন। মক্কায় তাঁর অবশিষ্ট তিন বার আগমনের বিবরণ সহিহ বুখারির এক দীর্ঘ বর্ণনায় পাওয়া যায়, যা হজরত ইবনু আব্বাস রাদি থেকে বর্ণিত। যার সংক্ষিপ্তসার নিম্নরূপ-
২. হজরত ইসমাইল আ যখন যৌবনে পদার্পন করেন, তখন জুরহুম গোত্রের লোকজন থেকে আরবিভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন এবং সার্বিকভাবে সকলের সুদৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হন। ফলে তারা নিজেদের এক মেয়েকে তাদের প্রিয়পাত্র হজরত ইসমাইলের সাথে বিবাহ দেন। সময়টা বেশ ভালোই যাচ্ছিল তাঁদের। কিন্তু এমন সময় হজরত হাজিরা আ. তাঁর কলিজার টুকরা ইসলাইলকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে পরম মালিকের সান্নিধ্যে চলে যান।
এদিকে হজরত ইবরাহিমের স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে মরুভূমিতে রেখে আসা স্ত্রী-সন্তানের কথা। তিনি দ্বিতীয়বারের মতো মক্কা অভিমুখে যাত্রা করেন। মক্কায় পৌঁছে সন্তানের সাক্ষাৎ পেলেন না। কারণ, তিনি তখন সেখানে ছিলেন না। সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা হয় পুত্রবধূর সাথে। তিনি তাকে তাদের সাংসারিক অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে নিজেদের পারিবারিক অসচ্ছলতার অভিযোগ করেন তিনি। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে তিনি পুত্রবধূকে জোর তাকিদ দিয়ে বলেন, ইসমাইল ফেরা মাত্রই বলবে, সে যেন তাঁর দরজার চৌকাঠ পরিবর্তন করে নেয়। পিতার নির্দেশের অভিপ্রায় বুঝতে পেরে তিনি স্ত্রীকে তালাক দিয়ে অন্য নারীকে বিয়ে করে নেন। তিনি ছিলেন জুরহুম গোত্রের নেতা মুজাজ ইবনু আমরের কন্যা।
আরো পড়ুন: পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, জুম্মা, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার সালাত আদায়ের নিয়ম
৩. হজরত ইসমাইল আ.-এর দ্বিতীয় বিয়ের পর তিনি আবার পবিত্র মক্কা নগরীতে গমন করেন। ঘটনাক্রমে এবারও তিনি পুত্রের সাক্ষাৎ পেলেন না। পুত্রবধূর কাছে হজরত ইসমাইল ও তাঁদের সাংসারিক অবস্থাদি জিজ্ঞেস করেন। তিনি আল্লাহ তাআলার প্রকৃত বান্দির মতো প্রাণ খুলে মালিকের প্রশংসা করেন। এতে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হন এবং তাঁদের জন্য মনভরে দুআ করেন। আর বলে যান, ইসমাইল যেন নিজের দরজার চৌকাঠ স্থায়ীভাবে রেখে দেয়। এরপর তিনি ফিলিস্তিনে ফিরে যান।
৪. এরপর তিনি আবার পবিত্র মক্কায় গমন করেন, যখন হজরত ইসমাইল আ জমজম কূপের নিকট একটি বৃক্ষের নিচে তির তৈরি করছিলেন। পিতার ওপর চোখ পড়তেই তিনি বাধভাঙা আবেগ ও আনন্দের আতিশয্যে একেবারে লাফ দিয়ে ওঠেন। শিশু সন্তানের মতোই দরদি পিতার মায়াভরা বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পিতাও কলিজার টুকরা সন্তানকে নিজের কলিজার সাথে জড়িয়ে নেন। প্রাণপ্রিয় সন্তানকে দীর্ঘসময় পর্যন্ত বুকে জড়িয়ে রেখে নিজের অন্তরে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা সুদীর্ঘ বিচ্ছেদের অনল নির্বাপিত করেন। এবারের সাক্ষাৎটি ছিল সুদীর্ঘ সময়ের বিচ্ছেদের পর বহুল কাঙ্ক্ষিত। ফলে তা পিতা ও পুত্র উভয়ের জন্যই ছিল সীমাহীন আবেগময় ও মর্মস্পর্শী। যাহোক, এবারের সফরেই তিনি পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে কাবাগৃহ নির্মাণ করেন। নির্মাণকাজ সুসম্পন্ন হওয়ার পর তিনি আল্লাহ তাআলার আদেশে পবিত্র হজ পালনের জন্য বিশ্ব-মুসলিম জাতিকে উদাত্ত আহ্বান জানান।
আল্লাহ তাআলা মুজাজের কন্যার গর্ভে হজরত ইসমাইল আ-কে ১২ জন পুত্রসন্তান দান করেন। যাদের নাম যথাক্রমে-নাবিত বা নাবায়ুত, কাইদার, আদবায়িল, মিবশাম, মিশমা, দুমা, মিশা, হাদাদ, তাইমা, ইয়াতুর, নাফিস ও কাইদুমান। তাঁর ১২জন সন্তান থেকে ১২টি গোত্রের উদ্ভব ঘটে এবং তাঁরা সকলেই মক্কাতেই বসবাস করতে থাকেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের জীবিকানির্বাহের পথ ইয়ামান, মিশর ও সিরিয়া প্রভৃতি দেশের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। সময়ের ব্যবধানে তাঁদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ক্রমান্বয়ে তাঁরা আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন অঞ্চলে, এমনকি আরবের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েন। শুধুমাত্র নাবিত ও কাইদারের বংশধরই কালের আবর্তনে সৃষ্ট গাঢ় তিমির থেকে নিজেদের মুক্ত রেখে সভ্য ও পরিচিত জাতি হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হন। অন্য সবাই পর্দার আড়ালেই অজ্ঞাত, অখ্যাত অবস্থায় থেকে যান। সময়ের পরিক্রমায় উত্তর হিজাজে নাবিতের বংশধররা সাহিত্য ও শিল্প সংস্কৃতিতে ঈর্ষণীয় উৎকর্ষ সাধন করেন। শুধু তাই নয়, বরং তাঁরা এককভাবে একটি শক্তিশালী জাতি হিসেবে নিজেদেরকে গড়ে তোলেন। প্রতিষ্ঠিত করেন এক সুবিশাল সুসংহত সাম্রাজ্য। আশপাশের জনগোষ্ঠীকে নিজেদের অধীন করে নিয়ে তাদের থেকে নিয়মিত করও আদায় করতে থাকেন। তাঁরা বাতরা-কে নিজেদের রাজধানী হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁদের সাথে দ্বন্দ্বে জড়ানোর মতো দুঃসাহস সেখানকার কারও ছিল না। তবে সময়ের ব্যবধানে এ চিত্র একসময় পাল্টে যায়। আবির্ভাব ঘটে রোমানদের। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁরা এতটাই উন্নতি সাধন ও এতবেশি শক্তি সঞ্চয় করেন, তখন নাবিতিদের শক্তি-সামর্থ্য এবং প্রভাব-প্রতাপের কথা রূপকথার মতো গল্প- কাহিনিতে পরিণত হয়। মাওলানা সাইয়িদ সুলাইমান নদবি রহ. স্বীয় গবেষণা, আলোচনা ও গভীর অনুসন্ধানের পর এ কথা প্রমাণ করেছেন, গাসসান বংশধর ও মদিনার আনসার তথা আউস ও খাজরাজ গোত্রের কেউই কাহতানি আরবের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না, বরং সেই অঞ্চলে নাবিত ইবনু ইসমাইল আ.-এর বংশধরদের যাঁরা অবশিষ্ট ছিলেন, কেবল তাঁবাই আরবভূমিতে ছিলেন।
পূণ্যভূমি মক্কাতেই কাইদার ইবনু ইসমাইল আ-এর বংশবৃদ্ধি ঘটে। সময়ের পরিক্রমায় তাঁরা সেখানে উন্নতি ও প্রগতির স্বর্ণশিখরে উপনীত হন। আবার একসময় তাঁরা অজ্ঞাত ও অখ্যাত হয়ে পড়েন। এরপর একসময় সেখানে আদনান ও তাঁর সন্তান মাআদের আবির্ভাব ঘটে। আদনানি আরবদের বংশপরম্পরার সূত্র বিশুদ্ধভাবে তাঁদের থেকেই সংরক্ষিত রয়েছে।
আদনান হচ্ছেন রাসুল সা এর বংশপরম্পরার সূত্রে ২১তম উর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ। কিছু কিছু বর্ণনায় পাওয়া যায়, নবিজি সা. যখন নিজ বংশপরম্পরা বর্ণনা করতেন, তখন আদনান পর্যন্ত গিয়ে হঠাৎ থমকে যেতেন, আর একটুও সামনে এগোতেন না। এরপর বলতেন, বংশ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা ভুল বলেছেন।
কিন্তু আলিমদের মধ্য একদলের মত হলো, আদনান থেকে আরও ওপরে বংশপরম্পরার সূত্র বর্ণনা করা যেতে পারে। তাঁরা এ বর্ণনাটিকে দুর্বল বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁরা আরও বলেন, হজরত ইবরাহিম আ. ও আদনানের মধ্যে ৪০জন পুরুষের ব্যবধান রয়েছে।
মাআদের সন্তান নাজার থেকে কয়েকটি পরিবার অস্তিত্ব লাভ করে। বলা হয়ে থাকে, নাজার ছাড়া মাআদের আর কোনো সন্তান ছিল না। নাজারের চার সন্তান ছিল। তাঁর প্রতিটি সন্তান থেকে একেকটি গোত্রের গোড়াপত্তন ঘটে। তাঁর চার সন্তানের নাম ছিল যথাক্রমে-ইয়াদ, আনমার, রাবিআ ও মুজার। এদের মধ্যে রাবিআ ও মুজার গোত্রের শাখা-প্রশাখা ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করে। সুতরাং রাবিআ থেকে আসাদ ইবনু রাবিআ, আনজাহ, আবদুল কাইস, ওয়াইল গোত্রের অন্তর্ভুক্ত বনু বকর ও বনু তাগলিব ও বনু হানিফার উৎপত্তি হয়।
মুজারের বংশধররা দুটি বড় গোত্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কাইস আইলান ইবনু মুজার ও ইলয়াস ইবনু মুজার। কাইস আইলান থেকে বনু সুলাইম, বনু হাওয়াজিন, বনু গাতফান। বনু গাতফান হতে আবস ও জুবইয়ান, আশজা ও গনি ইবনু আসারের উদ্ভব হয়। ইলয়াস ইবনু মুজার হতে তামিম ইবনু মুররাহ, হুজাইল ইবনু মুদরিকা, বনু আসাদ ইবনু খুজাইমা ও কিনানা ইবনু খুজাইমা গোত্রসমূহের উদ্ভব হয়। অতঃপর কিনানা থেকে কুরাইশ গোত্রের সূত্রপাত ঘটে। এই গোত্রটি ফিহর ইবনু মালিক ইবনু নাজার ইবনু কিনানার সন্তানাদি। অতঃপর কুরাইশ গোত্র বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে প্রসিদ্ধ শাখাগুলোর নাম যথাক্রমে-জুমাহ, সাহম, আদি, মাখজুম, তাইম, জুহরাহ এবং কুসাই ইবনু কিলাবের বংশধর তথা আবদুদ-দার ইবনু কুসাই, আসাদ ইবনু আবদিল উজ্জা ও আবদে মানাফ। এই তিন গোত্রই ছিল কুসাইয়ের সন্তান। এদের মধ্যে আবদে মানাফের ছিল চার পুত্র। এই চার পুত্র হতে সৃষ্টি হয় চারটি গোত্রের। আবদে শামস, নাওফাল, মুত্তালিব এবং হাশিম। এই হাশিম গোত্র থেকেই আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রাণের রাসুল সা-কে পাঠিয়েছেন। নবিজি সা ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা হজরত ইবরাহিমের সন্তানাদি থেকে হজরত ইসমাইল আ.-কে, তাঁর সন্তানাদির মধ্য থেকে কিনানাকে, কিনানার সন্তানাদির মধ্য থেকে কুরাইশকে, কুরাইশ থেকে বনু হাশিমকে এবং বনু হাশিম থেকে আমাকে মনোনীত করেছেন।
হজরত ইবনু আব্বাস রাদি থেকে বর্ণিত, নবিজি সা ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা সমগ্র মাখলুক সৃষ্টি করেছেন আর আমাকে সৃষ্টিকুলের মধ্যে সর্বোত্তম দলে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। অতঃপর তিনি গোত্রসমূহ নির্বাচন করেছেন এবং সেখানেও তিনি আমাকে সর্বোত্তম গোত্রভুক্ত করেছেন। এরপর আমাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সুতরাং আমি ব্যক্তিসত্তায় যেভাবে সর্বোত্তম, তেমনই বংশমর্যাদায়ও সবচাইতে উত্তম।
যখন আদনানের বংশধররা সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পেতে থাকে, তখন তাঁরা জীবিকার প্রয়োজনে আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। যার ধারাবাহিকতায় আবদুল কাইস গোত্র, বকর ইবনু ওয়াইলের কয়েকটি শাখা এবং বনু তামিমের বংশধররা বাহরাইন অভিমুখে যাত্রা করে এবং সেখানে বসতি স্থাপন করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। বনু হানিফা ইবনু সাব ইবনু আলি ইবনু বকর গোত্র ইয়ামামা অভিমুখে যাত্রা করে এবং এর কেন্দ্রস্থল হুজর নামক স্থানে বসতি স্থাপন করে। বকর ইবনু ওয়াইল গোত্রের অবশিষ্ট শাখাসমূহ ইয়ামামা থেকে বাহরাইন, সাইফে কাজামা, সাওয়াদে ইরাক, উবুল্লাহ এবং হিত প্রভৃতি অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। বনু তাগলিব গোত্র ফোরাত উপদ্বীপ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। অবশ্য তাদের কোনো কোনো শাখা বনু বকরের সাথেও বসবাস করতে থাকে। এদিকে বনু তামিম গোত্র বসরার প্রত্যন্ত অঞ্চলকেই বসবাসের জন্য উপযুক্ত মনে করে। বনু সুলাইম গোত্র মদিনার নিকটবর্তী স্থানে বসতি স্থাপন করে। তাদের আবাসস্থল ছিল ওয়াদিউল কুরা হতে শুরু করে খাইবার ও মদিনার পূর্বদিক দিয়ে অগ্রসর হয়ে হাররায়ে বনু সুলাইমের সঙ্গে মিলিত দুই পাহাড় পর্যন্ত সুবিস্তৃত। বনু সাকিফ তায়িফে বসতি স্থাপন করে। বনু হাওয়াজিন মক্কার পূর্বদিকে আওতাস প্রান্তরের আশপাশে বসতি গড়ে। তাঁদের বাসস্থান ছিল মক্কা-বসরার রাজপথের দুই পাশে। বনু আসাদ তাদের বসতি স্থাপন করে তাইমার পূর্বে ও কুফার পশ্চিমে। তাদের ও তাইমার মধ্যে বনু তাই গোত্রের একটি পরিবার বসবাস করত। তাদের বোহতার বলা হতো। বনু আসাদের বাসস্থান ও কুফার মধ্যকার দূরত্ব ছিল পাঁচ দিনের পথ। বনু জুবইয়ান তাইমার কাছে হাওরানের আশপাশে বসবাস করত। বনু কিনানার লোকজন থেকে যায় তিহামায়। কুরাইশরা বসতি গড়ে পবিত্র মক্কা ও তার আশপাশের অঞ্চলে। এসব লোকজন ছিল বিচ্ছিন্ন ধ্যান-ধারণার অধিকারী। তাঁরা কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলার ধার ধারত না। এভাবেই তাদের বেপরোয়া জীবনযাপন অতিবাহিত হচ্ছিল। একসময় কুসাই ইবনু কিলাব নামক এক ব্যক্তি তাঁদের নেতৃত্বভার নিজ কাঁধে তুলে নেন এবং তাদেরকে ঢেলে সাজান। বলিষ্ঠ নেতৃত্বদানের মাধ্যমে তাদেরকে প্রচলিত অর্থে মর্যাদা ও সম্মানের সুআসনে আসীন করেন। করেন বিজয়ী।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url