কিয়ামত ও কিয়ামতের নিদর্শনাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত
আজ এই আর্টিকেলটিতে কিয়ামতের পরিচয় কিয়ামতের ছোট নিদর্শনের বিবরণ কিয়ামের বড় নিদর্শনাবলি বিশ্লেষণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন। যত
কিয়ামতের পরিচয়
কিয়ামত হল আখিরাতের একটি পর্যায়ের নাম। কিয়ামত অর্থ-উঠা, দন্ডায়মান হওয়া এবং পুনরুত্থান। ইসলামের পরিভাষায় যে দিন মহান আল্লাহর নির্দেশে ইসরাফীল (আ)-এর ফুৎকারে মহাবিশ্ব ও মহাবিশ্বের অধিবাসী এবং সকল বস্তু নিশ্চিহ্ন ও ধ্বংস হয়ে যাবে, বাকি থাকবে একমাত্র আল্লাহর অস্তিত্ব। অতঃপর সকল মানুষ ও জিন জাতি আল্লাহর নির্দেশে বিচার-ফয়সালার জন্য দণ্ডায়মান হবে বিশালকার ময়দানে, সে মহাপ্রলয়ের দিনকে বলা হয় 'কিয়ামত।'
যে দিন মহান আল্লাহর নির্দেশে ইসরাফীল (আ)- এর ফুৎকারে মহাবিশ্ব ও মহাবিশ্বের অধিবাসী এবং সকল বস্তু নিশ্চিহ্ন ও বংস হয়ে যাবে, বাকি থাকবে একমাত্র আল্লাহর অস্তিত্ব, অতঃপর সকল মানুষ ও জিন জাতি আল্লাহর নির্দেশে বিচার- ফয়সালার জন্য দণ্ডায়মান সে মহাপ্রলয়ের দিনকে বলা হয় 'কিয়ামত।
কিয়ামতের আলামতসমূহ প্রকাশ হওয়ার পর হযরত ইসরাফীল (আ) আল্লাহর নির্দেশে শিঙ্গায় ফুঁক দেবেন ১০ মুহররম শুক্রবার। এর শব্দ এত বিকট ও প্রচণ্ড হবে যে, তার তীব্রতায় কান, হৃদপিন্ড, কলিজাসহ মানব শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো ফেটে যাবে, মানুষ বেহুশ হয়ে পড়বে। আকশ ফেটে খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যাবে। পাহাড়-পর্বত ধুনিত তুলার ন্যায় উৎক্ষিপ্ত হতে থাকবে। নক্ষত্ররাজি বিলুপ্ত হবে। চন্দ্র সূর্য জ্যোতিহীন হয়ে একত্রিত হবে। মহান আল্লাহ তা'আলা বলেন-
"অতঃপর যখন শিঙ্গায় ফুঁৎকার দেওয়া হবে একটি মাত্র ফুৎকার, পর্বতমালা সমেত পৃথিবী উৎক্ষিপ্ত হবে এবং মাত্র এক ধাক্কায় এরা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাবে। সেদিন সংঘটিত হবে মহাপ্রলয়। আকাশ বিদীর্ণ হয়ে যাবে আর সেদিন তা বিশ্লিষ্ট হয়ে যাবে।" (সূরা আল-হাক্কাহ: ১৩-১৬)
আরো পড়ুন: মানব জীবন সমস্যার সমাধানে আল-কুরআনের ভূমিকা
অন্যত্র আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
"তারা জিজ্ঞাসা করে, কবে কিয়ামত দিবস? বল, যেদিন চক্ষু স্থির হয়ে যাবে, চন্দ্র জ্যোতিহীন হয়ে পড়বে এবং সূর্য ও চন্দ্র একত্রিত করা হবে।" (সূরা আল-কিয়ামা: ৬-৯)
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন-
"যখন আকাশ বিদীর্ণ হবে ও তার প্রতিপালকের নির্দেশ পালন করবে এবং এটাই তার করণীয়। এবং পৃথিবীকে যখন সম্প্রসারিত করা হবে ও পৃথিবী তার ভেতরে যা আছে তা নিক্ষেপ করবে এবং শূনাগর্ভহবে এবং তার প্রতিপালকের নির্দেশ পালন করবে এটাই তার করণীয়; তখন তোমরা পুনরুত্থিত হবেই।" (সূরা ইনশিকাক: ১-৫)
সূরা আল-কারিয়ায় আল্লাহ বলেন-
করাঘাতকারী (মহাপ্রলয়)। করাঘাতকারী বা (মহাপ্রলয় কী)? করাঘাতকারী বা মহাপ্রলয় সম্পর্কে আপনি জানেন কি? যেদিন মানুষ হবে বিক্ষিপ্ত পতংগের মত। আর পর্বতমালা হবে ধূনিত রঙ্গিন পশমের মত।" (সূরা আল-কারিয়া: ১-৫)
কিয়ামত দিবসে ইসরাফীলের শিঙ্গার ফুৎকার এত প্রচণ্ড ও প্রবল হবে যে, তার প্রচণ্ডতায় গর্ভবতী স্ত্রীলোকের গর্ভপাত হয়ে যাবে। আর দুগ্ধদাতা মাতা তার শিশু পুত্রকে দুগ্ধদানের কথা ভুলে যাবে।
আল্লাহ আরও বলেন
"হে মানব জাতি। তোমরা তোমাদের প্রতিপালকে ভয় কর। নিশ্চয় কিয়ামতের প্রকম্পন এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। যেদিন তোমরা তা প্রত্যক্ষ করবে, সেদিন দুগ্ধদাতা মা বিস্মৃত হবে তার দুগ্ধপোষ্য শিশু থেকে এবং প্রত্যেক গর্ভবতী তার গর্ভপাত করে দিবে এবং মানুষদেরকে নেশাগ্রস্ত মাতালের ন্যায় দেখাবে। যদিও তারা নেশাগ্রস্ত নয়। বস্তুত আল্লাহর শাস্তি অত্যন্ত ভয়াবহ।" (সূরা আল-হাজ্জ: ১-২)
কিয়ামত দিবসের ভয়াবহ পূর্ণাঙ্গরূপ তুলে ধরে সূরা 'যিলযালে; বলা হয়েছে-
"যখন পৃথিবী তার কম্পনে প্রকম্পিত হবে, তখন সে তার বোঝা বের করে দিবে এবং মানুষ বলবে এর কি হল? সেদিন মানুষ বিভিন্ন দলে প্রকাশ পাবে। যাতে তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম দেখানো যায়। অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে।” (সূরা যিলযাল: ১-৮)
আল্লাহ বলেন-
"ভূ-পৃষ্ঠে যা কিছু আছে সবই নশ্বর, অবিনশ্বর কেবল তোমার প্রতিপালকের সত্তা, যিনি মহিমান্বিত ও মহানুভব।" (সূরা আর-রাহমান: ২৬-২৭)
অতঃপর ইসরাফীল (আ) আল্লাহর নির্দেশে দ্বিতীয়বার শিংগায় ফুঁৎকার দেবেন এবং তাতে সমস্ত মানুষ কবর হতে পঙ্গপালের ন্যায় হাশরের মাঠের দিকে উঠে আসবে। তারা বিচার- ফয়সালার জন্য আল্লাহর সামনে একত্রিত হবে। সে দিবস হবে পৃথবীর সমানুপাতে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান।
আল্লাহ বলেন,
"ফেরেশতা এবং রূহ আল্লাহর প্রতি ঊর্ধ্বগামী হবে এমন একদিনে, যা পার্থিব পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান।" (সূরা আল-মাআরিজ: ৪)
এ দিবসটি লোকদের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ। বিশেষ করে পাপী এবং অপরাধীদের জন্য, যাদের আমলনামা তাদের বাম হাতে দেওয়া হবে। সূর্য সেদিন মাথার একমুষ্ঠি হাত উপরে থাকবে, যার দোর্দণ্ড প্রতাপ ও খরতাপে ঘামের সমুদ্র বয়ে যাবে। পাপীদের সারা শরীর পুড়ে তামার মত হয়ে যাবে।
পক্ষান্তরে যারা সৎ, পুণ্যবান ও মুত্তাকী লোক তারা আল্লাহর আরশের ছায়াতলে আশ্রয় পাবেন এবং কিয়ামত দিবসের কোন ভয়াবহতাই তাদের স্পর্শ করতে পারবে না। আল্লাহ বলেন-
"মহাভীতি তাদের বিস্বাদক্লিষ্ট করবে না।" (সূরা আল-আম্বিয়া: ১০৩)
হাদীসে এসেছে, "হাশরের ময়দানে ঐ উত্তপ্ত সূর্যের প্রখরতা ও কষ্ট হতে সাত বাক্তি আল্লাহর আরশের ছায়াতলে আশ্রয় পাবেন।" তারা হলেন-
১ ন্যায়পরায়ণ রাজা-বাদশাহ।
২. যে যুবক আল্লাহর ইবাদাতে মাশগুল ছিল:
৩. যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে পরস্পরকে ভালোবেসেছে।
৪. যে যুবক সুন্দরী লাবণ্যময়ী রমণীর মনের কুপ্রবৃত্তি নিবারণের আহবানে সাড়া দেয়া থেকে বিরত থেকেছে:
৫ যে ব্যক্তি আত্মম্ভরিতার ভয়ে নির্জনে আল্লাহর ইবাদাতে মাশগুল থেকে চোখের পানি ফেলেছে, ৬. যে ব্যক্তি অতি গোপনে দান-সাদকা করেছে এবং
৭. যার হৃদয় সর্বদাই মসজিদের প্রতি আকৃষ্ট ছিল।
আল্লাহ তা'আলা সেদিন মানুষকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন এবং যাতে তারা মিথ্যা উচ্চারণ করতে না পারে এ জন্য তাদের জবান বন্ধ করে দেবেন। ফলে তাদের শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তাদের আমল নামার বিবরণ দিবে। এ মর্মে আল্লাহ বলেন-
"আমি আজ তাদের মুখ মোহর করে দেব, তাদের হাত কথা বলবে আমার সাথে এবং তাদের পা সাক্ষ্য দেবে তাদের কৃতকর্মের।" (সূরা ইয়াসিন: ৬৪)
সেদিন আল্লাহর তা'আলা তুলাদণ্ড দ্বারা কৃতকর্ম ওজন করবেন। যার পুণ্যের ভাগ বেশি হবে তিনি হবেন জান্নাতী। আর যার পাপের ভাগ বেশি হবে, সে হবে জাহান্নামী।
এই মর্মে আল্লাহ বলেন-
"তখন যার পাল্লা ভারী হবে, সে তো লাভ করবে সন্তোষজনক জীবন। কিন্তু যার পাল্লা হালকা হবে, তার স্থান হবে হাবিয়া।" (সূরা আল-কারিয়া: ৬-৯)
আরো পড়ুন: চরিত্র গঠনে আল-কুরআনের শিক্ষার বিবরণ সর্ম্পর্কে বিস্তারিত
কিয়ামতের নিদর্শন
কিয়ামত অবশ্যই সংঘটিত হবে। এ ব্যাপারে কোন দ্বিধা-সংশয় নেই। তবে কিয়ামত সংঘটনের সময়কাল একমাত্র আল্লাহরই জানা। আল্লাহর বলেন-
"তারা তোমাকে প্রশ্ন করে কিয়ামত কখন অনুষ্ঠিত হবে। বল, এ বিষয়ের জ্ঞান তো শুধু আল্লাহরই আছে।" (সূরা আল-আরাফ: ১৮৭)
আবশ্য আল-কুরআন ও আল-হাদীসে কিয়ামত সংঘটন পূর্বেকার কতকগুলো আলামত বা নিদর্শন প্রকাশ পাওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। এগুলোকে শরীআতের পরিভাষা اشراط الساعة বা কিয়ামতের আলামত বলে। এ আলামতগুলো দু'ভাগে বিভক্ত। যথা-
১. প্রথমত: ছোট নির্দশনসমূহ
২. দ্বিতীয়ত: বড় নিদর্শনসমূহ
নিম্নে এ দুই প্রকার আলামতের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হল:
১. কিয়ামতের ছোট নিদর্শনসমূহ
কিয়ামত সংঘটিত হরার পূর্বাভাস হিসেবে যে সব বড় বড় নিদর্শনাবলি প্রকাশিত হবে সেগুলোর পূর্বে প্রকাশিত নিদর্শনাবলিকে আলামতে সুগরা বা ছোট আলামত বলে। এগুলো নিম্নরূপ।
১ ধীরে ধীর দ্বীনি ইলম (জ্ঞান) লোপ পাবে।
২. অজ্ঞতা ব্যাপক আকার ধারণ করবে।
৩. যেনা ও ব্যভিচারের সয়লাবে সমাজ হেয়ে যাবে।
৪. মদ্যপান ও নেশা গ্রহণ স্বাভাকি হয়ে আসবে
৫. আনুপাতিক হারে পুরুষের সংখ্যা কমে যাবে।
৬. মেয়েদের সংখ্যা বেড়ে যাবে, ফলে একজন সক্ষম-সবল পুরুষের দায়িত্বে পঞ্চাশজন মহিলা হবে যাদের দেখা শুনা সে করবে। হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসে উপরোক্ত ছয়টি আলামতের ধারাবাহিক বর্ণনা বিবৃত হয়েছে।
৭. দেশের শাসনকর্তা জাতীয় সম্পদের অপব্যবহার ও অপচয় করবে।
৮ আমানতকে গণীমত মনে করে খিয়ানত করবে।
৯. যাকাত প্রদান করাকে দণ্ড স্বরূপ মনে করবে।
১০. জনগণ দীনকে পালন করার উদ্দেশ্যে শিক্ষার্জন করবে না।
১১. পুরুষ লোকেরা স্ত্রী লোকের একান্ত অনুগত ও বাধ্যগত হবে।
১২. সন্তানরা পিতা-মাতার অবাধ্য হয়ে তাদেরকে পর মনে করবে।
১৩. লোকেরা বন্ধু-বান্ধবদের আপন মনে করবে এবং
১৪. পিতা-মাতাসহ আত্মীয়-স্বজনকে দূরে সরিয়ে দিবে।
১৫ মসজিদের মধ্যে উচ্চবাক্য ও অশ্লীল কথা বলবে।
১৬. অনুপযুক্ত ও অযোগ্য ব্যক্তি দেশ ও সম্প্রদায়ের শাসনকর্তা নিযুক্ত হবে।
১৭. লোকেরা অত্যাচারের ভয়ে অত্যাচারী ও শোষক ব্যক্তিকে সম্মান করবে।
১৮. অসৎ, লোভী ও নিকৃষ্ট লোকেরা সমাজ ও জাতির নেতা নিযুক্ত হবে।
১৯. সমাজে নাচ-গান ও নর্তকী-গায়িকার প্রসার ঘটবে। ২০. সমাজে ঢাক-ঢোল, তবলা ও সারিঙ্গিসহ গানবাজনার সামগ্রী ব্যাপক আকার ধারণ করবে।
২১. এ উম্মাতের পরবর্তীরা পূর্ববর্তীদের দোষারোপ ও অভিশম্পাৎ করবে। (তিরমিযি শরীফে বর্ণিত হযরত আবু হুরাইরা (রা) এর হাদীসে উক্ত আলামতগুলোর ধারবাহিক বিবরণ মিলে)।
২২. সম্পদ বেড়ে যাবে, সারা পৃথিবী চষেও যাকাত গ্রহণের মত ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না। হযরত আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে "কিয়ামত ততক্ষণ পর্যন্ত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না সম্পদ বেড়ে গিয়ে তার সয়লাব হবে, এমনকি ব্যক্তি তার সম্পদের যাকাত গ্রহণের মত কাউকে খুঁজে পাবে না।" (সহীহ মুসলিম)
২৩. সময় সংক্ষিপ্ত হয়ে আসবে। অর্থাৎ ঘণ্টা মিনিটের সমান, মাস দিনের সমান এবং বছর মাসের সমান মনে হবে।
২৪. বায়তুল মোকাদ্দাসের দ্বার চিরতরে উন্মুক্ত হবে।
২৫ ৩০ ব্যক্তি মিথ্যা নবুওয়াত দাবি করবে।
২৬. কখনো অনাবৃষ্টি, কখনো অতিবৃষ্টি এবং দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে।
২৭. দুনিয়াতে অন্যায়-অবিচার বেড়ে যাবে।
২৮. ধনীগণ গরীব শ্রেণীকে ঘৃণার চোখে দেখবে।
২৯. বাতিল মতবাদ, বিদআত ও মানব রচিত মতবাদ ব্যাপক আকার লাভ করবে।
৩০. অমুসলমানগণ মুসলমানদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করবে।
৩১. সততা বোকামী বলে গণ্যহবে।
৩২. আদব-কায়দা-শিষ্টাচার হ্রাস পাবে।
৩৩. মিথ্যা ও অন্যায় আইন কানুন জারি হবে।
৩৪. মানুষের মন থেকে খোদাভীতি উঠে যাবে।
৩৫ মিথ্যাবাদী প্রতারকরা বুদ্ধিমান ও বুদ্ধিজীবী বলে গণ্য হবে।
৩৬. মানুষের আয়ু কমে আসবে।
৩৭. লোকেরা কুরআন শরীফের সম্মান কম্ করবে।
৩৮ মানুষ আল্লাহর ইবাদাত কম করবে এবং আমোদ-প্রমোদ, গান-বাজনা ও বাজে কাজে লিপ্ত হয়ে পড়বে।
৪০. মানুষের লজ্জা ও মায়া-মমতা হ্রাস পারে।
৩৯. প্রত্যেক জিনিসের স্বাদ, ঘ্রাণ ও বরকত কমতে থাকবে।
৪১ মানুষ দুনিয়ার পরিবেশে আকৃষ্ট হবে।
৪২. নতুন নতুন রোগ ব্যাধির প্রাদুর্ভাব ঘটবে। ৪৩. লোকেরা দাসী বাঁদীদের সাথে ব্যভিচার করবে।
৪৪ দুশ্চরিত্র লোকদের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাবে, পক্ষান্তরে সম্মানী ও চরিত্রবান লোকেরা তাদের হাতে লাঞ্ছিত হবে।
৪৫. মানুষ প্রকাশ্যে নেশাপানে মত্ত হবে এবং এতে সে লজ্জাবোধ করবে না।
৪৬. বড় ব্যক্তিদের মধ্যে অশ্লীলতা বৃদ্ধি পাবে।
৪৭. ছোটদের সম্মান ও প্রতিপত্তি বাড়বে।
আরো পড়ুন: আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও ক্ষমতা সম্পর্কিত বিস্তারিত বর্ণনা
কিয়ামতের বড় নিদর্শনাবলি
কিয়ামতের ছোট ছোট আলামতগুলো সংঘটিত হবার পর কতকগুলো বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ এবং ভয়ংকর আলামত কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে প্রকাশ পাবে, সেগুলোকে পরিভাষায় আলামতে কুবরা বা বস্তু বড় নিদর্শনাবলি বলা হয়। হাদীসে এ আলামতগুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে মহানবী (স) বলেন- "যখন কিয়ামতের ছোট ছোট আলামতগুলো প্রকাশ পাবে, তখন তোমরা আরো কতকগুলো বড় বড় আলামতের জন্য অপেক্ষা করবে।
" ইমাম মুসলিম এ মর্মে হুযাইফা ইবনে উসাইদ আল-গিফারী থেকে হাদীস বর্ণনা করেন, যাতে ধারাবাহিকভাবে নিম্নের আলামতের বর্ণনা এসেছে-
কিয়ামতের ছোট ছোট আলামতগুলো সংঘটিত হবার পর কতকগুলো বড় কড় গুরুত্বপূর্ণ এবং ভয়ংকর আলামত কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে প্রকাশ পাবে, সেগুলোকে পরিভাষায় আলামতে কুবরা বা বড় বড় নিদর্শনাবলি বলা হয়।
১. আকাশে ধোঁয়া
হযরত ঈসা (আ)-এর ইন্তিকালের পর ক্রমান্বয়ে পৃথিবীর সর্বত্র মানুষ আল্লাহকে তুলে নানারূপ পাপ কাজ করতে থাকবে। এ সময় আকাশে এক প্রকার ধোঁয়া দেখা দেবে এবং তা পৃথিবীতে আসলে তার প্রভাবে পৃথিবীর মুসলমানদের সর্দির ভাব হবে এবং কাফিররা বেহুঁশ হয়ে যাবে। চল্লিশ দিন পর এ ধোঁয়া পরিষ্কার হয়ে যাবে।
২. দাজ্জালের আবির্ভাব
দাজ্জাল শব্দটি جلত শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ ভেজাল, প্রবঞ্চনা, মুনাফেকী ও মিথ্যা ভাষণ। দাজ্জাল অর্থ ধোঁকাবাজ ও মিথ্যাবাদী। এ অর্থে দাজ্জাল অনেক হবে। যার মধ্যে এ বিশেষত্ব থাকবে সেই দাজ্জাল হবে। সে হবে কানা, ইয়াহুদী বংশোদ্ভূত। তার উপাধি মসীহ। হাবশীদের চুলের মত তার কেশ কোঁকড়ানো হবে। তার মস্তকের মাঝামাঝি লেখা থাকবে কাফির।
তার বৈশিষ্ট্য থেকে জানা যায়, সে প্রকৃতি বিজ্ঞানে অত্যন্ত দক্ষ হবে। লোকদের অদ্ভুত কাণ্ড কারখানা ঘটিয়ে দেখাবে। সে হবে স্বীয় যুগের 'সামেরী' এবং লোকদের উপর জাদুকরী প্রভাব বিস্তার করা তার জন্য খুবই সহজ হবে। তার আয়ত্ত্বে এমন কিছু উপায়-উপকরণ থাকবে, যা অপর কারো কাছে থাকবে না। এভাবে সে লোকদের নিজের দলে ভিড়াবে। সে নিজেকে আল্লাহ বলে দাবি করবে। অবশেষে পুনরায় আবির্ভূত হযরত ঈসা মসীহর (আ) হাতে সে নিহত হবে।
৩. দাব্বাতুল আরদের আবির্ভাব
পশ্চিম আকাশ থেকে সূর্যোদয় হবার পর দ্বিতীয় দিনে বিরাট ভূমিকম্পে মক্কা শরীফের 'সাফা' পাহাড় ফেটে যাবে এবং তার মধ্য থেকে এক অদ্ভুত প্রাণি বের হয়ে আসবে, যা আল্লাহর কুদরতে লোকদের সাথে কথা বলবে। মহান আল্লাহ বলেন,
"আর যখন তাদের ওপর আমার শান্তি পূর্ণ হওয়ার সময় এসে পৌঁছাবে, তখন আমি তাদের জন্য জমি থেকে একটি প্রাণী বের করবো, তা তাদের সাথে কথা বলবে এ জন্য যে, মানুষ আমার নিদর্শনে অবিশ্বাসী।" (সূরা আন-নামল: ৮২)
হাদীসে এসেছে, আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেন, "নবী (স) বলেছেন, সেই সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ, হিংস্র জানোয়ার মানুষের সাথে কথা না বলা পর্যন্ত কিয়ামত হবে না।" (তিরমিযী)
৪. পশ্চিমাকাশে সূর্যোদয়
পশ্চিম আকাশে সূর্যোদয় ঘটবে সৌর ব্যবস্থাপনায়-এ পরিবর্তন ভয়ংকর দুর্যোগেরই ঘণ্টা ধ্বনি। সূক্ষ্ম এবং সুদৃঢ় ব্যবস্থাপনার অধীনে গ্রহ-নক্ষত্ররাজি সুশৃঙ্খলভাবে মহাবিশ্বে সাঁতার কাটছে। তা এখন আল্লাহর হুকুমে এলোমেলো হতে যাচ্ছে। এরপর গ্রহ-নক্ষত্র কক্ষচ্যুত হতে থাকবে। পাহাড় নিজ স্থান থেকে সরে যেতে থাকবে এবং বন-জঙ্গলের পশু-পাখি এক জায়গায় সমবেত হতে থাকবে।
৫. ঈসা (আ)-এর অবতরণ
হযরত ঈসা (আ) পুনর্বার পৃথিবীতে আগমন করবেন। এ বিশেষত্ব কেবল তাঁকেই দান করা হয়েছে, অন্য কোন নবীকে নয়। তাঁকে আল্লাহর আসনে বসান হয়েছে এবং তাঁর নামে অত্যন্ত শক্তিশালী কয়েকটি রাষ্ট্র রয়েছে-এ বাতিল ধারণাকে প্রতিহত করার জন্য তিনি নিজেই পুনর্বার আগমন করবেন। খ্রিস্টানদের এসব কল্পকাহিনীর মূলোৎপাটন তিনি নিজেই করবেন।
সহীহ হাদীসের বর্ণনা মোতাবেক তিনি পৃথিবীতে আগমন করে প্রথমে দাজ্জালকে হত্যা করবেন, অতঃপর কাফিরদের থেকে জিযিয়া গ্রহণ করবেন, তাদেরকে ঈমান আনয়নে বাধ্য করবেন, চার্চগুলো ভেঙ্গে দেবেন, কুকুর ও শুকর হত্যা করবেন। তিনি বিবাহ করবেন এবং তার সন্তান-সন্ততিও হবে। তিনি চল্লিশ বছর যাবত ইসলামী আইনের আলোকে শাসনকার্য ও রাজ্য পরিচালনা করবেন। ইন্তিকালের পর তাকে মহানবী (স)-এর পাশেই দাফন করা হবে।
৬. ইয়াজুজ-মাজুজের আবির্ভাব
ইয়াফিস ইবনে নূহ (আ)-এর বংশোদ্ভূত একটি জাতির নাম ইয়াজুজ ও মাজুজ। দুটি পাহাড়ের মধ্যেও তাদের অবস্থান। তাদের বের হওয়ার রাস্তাটি বাদশাহ জুলকারনাইন পাকাপোক্তভাবে বন্ধ করে গেছেন। শেষ যামানায় যখন দেয়াল ভেঙ্গে যাবে, তখন এ সর্বনাশা জাতি পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়বে। কেউ তাদের মোকাবিলা করতে পারবে না। অবশেষে আসমানী গজবে এরা মারা যাবে। লোকেরা সাত বছর পর্যন্ত তাদের তীর-ধনুক ইন্ধনরূপে ব্যবহার করবে।
৭.৮.৯. পূর্ব-পশ্চিম ও আরব উপদ্বীপে বিরাট ভূমিকম্প
কিয়ামতের বড় আলামতের আর একটি হল-এ সময় প্রাচ্যে, পাশ্চাত্যে এবং আরব উপদ্বীপে তিন তিনটি বিরাট ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হবে।
১০. ইমাম মাহদীর আবির্ভাব
কিয়ামতের বড় আলামতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হল ইমাম আল-মাহদী (আ)-এর আগমন। মাহদী শব্দের অর্থ হিদায়াত প্রাপ্ত। প্রতিশ্রুত মাহদী হলেন একজন ব্যক্তি, যিনি হযরত ঈসা (আ)-এর আগমনের পূর্বে এবং দাজ্জালের আবির্ভাবের প্রাক্কালে আবির্ভূত হবেন। তিনি মহানবী (স)-এর বংশধর। তার নাম, পিতা-মাতার নাম মহানবীর (স) সাথে মিলে যাবে।
১১. ইয়েমেন থেকে অগ্নি নির্গমন
"কিয়ামতের সর্বশেষ আলামত হল ইয়েমেন থেকে একটি অগ্নিশিখা প্রকাশ পাবে, যা পৃথিবীর সব অঞ্চলের লোকদেরকে হাশরের ময়দানের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে।" (মিশকাত)
১২. বায়ু, অগ্নি ও হাবশীর উৎপাত
দাব্বাতুল আরদ প্রকাশ পাবার পরই সিরিয়ার দিক থেকে এক প্রকার ঠান্ডা বায়ু প্রবাহিত হবে, যাতে পৃথিবীরে সমুদয় ঈমানদার ও সৎলোক মৃত্যুপ্রাপ্ত হবে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য অসৎ লোকেরা বাকী থাকবে। অতঃপর আবিসিনিয়ায় কাফিরদের রাজত্ব ও আধিপত্য হবে। তারা কাবা ধ্বংস করবে। এর অভ্যন্তরের ধনভাণ্ডার উন্মোচন করবে। অত্যাচার, অরাজকতা চরমে পৌঁছবে। লোকেরা পশুর মত ব্যভিচারে লিপ্ত হবে। কাগজ হতে কুরআন উঠে যাবে। পৃথিবীতে একজন ঈমানদারও বাকী থাকবে না। জোর-যুলুমের দেশ উজাড় হবে, দুর্ভিক্ষ, মহামারী দেখা দেবে।
১৩. শিঙ্গায় ফুৎকার,
উপরিউক্ত আলামতসমূহ প্রকাশ পাবার পর হযরত ইসরাফীল (আ) আল্লাহর নির্দেশে শিঙ্গায় ফুঁক দেবেন এবং এর আওয়াজের প্রচণ্ডতায় সকল প্রাণীজগত বেহুঁশ হয়ে পড়বে। আর সকল সৃষ্টি চূর্ণ- বিচূর্ণ হয়ে যাবে। মহান আল্লাহ ব্যতীত আর কারো অস্তিত্ব থাকবে না। মহান আল্লাহ বলেন-
"আর যখন শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে, ফলে যাদের আল্লাহ ইচ্ছা করেন তারা ব্যতীত আকাশ মণ্ডলী ও পৃথিবীর সকলে মূর্ছিত হয়ে পড়বে।" (সূরা আয-যুমার: ৬৮)
সারসংক্ষেপ
কিয়ামত হচ্ছে মহাপ্রলয়ের দিবস। মহান আল্লাহর নির্দেশে ইসরাফীল (আ)-এর ফুঁকারে মহাবিশ্ব এবং মহাবিশ্বের অধিবাসীরা নিশ্চিহ্ন ও ধ্বংস হয়ে যাবে। সকল মানুষ ও জিন জাতি আল্লাহর আদেশে বিচার-ফয়সালার জন্য দণ্ডায়মান হবে হাশরের ময়দানে, সে মহাপ্রলয়ের দিনকে বলা হয়। কিয়ামত।
কিয়ামতের দিন-ক্ষণ আল্লাহ ছাড়া আর কেউ বলতে পারেন না। রাসূলুল্লাহ (স) কিয়ামতের কিছু নিদর্শনের কথা বলেছেন। সে সব নিদর্শন দেখা গেলে বোঝা যাবে যে, কিয়ামতের সময় ঘনিয়ে এসেছে। ঐ নিদর্শন আবার দু'রকম। কিছু কিছু নিদর্শন ছোট আর কিছু রয়েছে বড়। রাসূল (স) কিয়ামতের নিদর্শন বিষয়ে যা কিছু বলেছেন তা সবই সত্য।
আল্লাহ হাফেজ**
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url