ইমাম আবু হানীফা (র)-এর জীবনী

ইমাম আবু হানীফা (র)-এর জন্ম ও বংশ পরিচয় ইমাম আবু হানীফা (র)-এর শিক্ষা জীবন ইমাম আবু হানীফা (র)-এর কতিপয় বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে লিখতে পারবেন।ইমাম আবু হানীফা (র) সম্পর্কে কতিপয় আলিমের অভিমত সত্য ও ন্যায়ের পথে ইমাম আবু হানীফা (র)-এর ধৈর্য ও মৃত্যু সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।

জন্ম ও বংশ পরিচয়

ইমাম আবু হানীফা (র) ৮০ হিঃ সালে কুফা নগরীতে খলিফা আব্দুল মালিকের শাসনামলে জন্মগ্রহণ করেন। অবশ্য কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায় তিনি ৬১ হিঃ সালে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু এটা সঠিক নয়। তাঁর প্রকৃত নাম নুমান। পিতার নাম ছাবিত। তিনি পারস্যের সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কথিত আছে ছাবিত, শৈশবকালে আলীর (রা) সান্নিধ্যে গমন করেন। অতঃপর আলী (রা) তাঁকে ও তাঁর বংশধরদের জন্য দোয়া করেন। আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি আরব বংশোদ্ভূত। কিন্তু মূলত: তিনি ছিলেন ফার্সী বংশোদ্ভূত।

তাঁর উপনাম হল আবু হানীফা। এ উপনামে তাঁর খ্যাতি লাভের কারণ হল, তিনি লেখার সময় সর্বদা একটি দোয়াত ব্যবহার করতেন। তৎকালে ইরাকী ভাষায় দোয়াতকে হানীফা বলা হতো। তাই তাঁর উপনাম হয় আবু হানীফা। আবার কেউ কেউ বলেন, তাঁর একটি মেয়ে ছিল যার নাম ছিল হানীফা। কিন্তু একথা সত্য নয়। কারণ তাঁর একটি মাত্র সন্তান হাম্মাদ ছাড়া আর কোন ছেলে মেয়ে ছিল না। আবার কেউ কেউ বলেন, তাঁকে আবু হানীফা উপনাম করণের কারণ হচ্ছে, তিনি সত্য ধর্মের প্রতি অত্যধিক নিবেদিত ছিলেন। হানীফা মানে ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট ও নিবেদিত।

শিক্ষা জীবন

ইমাম আবু হানীফা (র) কুফায় জন্মগ্রহণ করেন এবং কুফায় লালিত পালিত হন। আবু হানীফার শৈশবকালে তাঁকে বিদ্যাশিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট করার কেউ ছিল না। তাই তিনি প্রথমে ব্যবসায় লিপ্ত হন। কিন্তু ইমাম শাবী তাঁর মধ্যে প্রখর মেধা শক্তি দেখে তাঁকে শিক্ষার প্রতি উৎসাহিতো করেন। তখন থেকে তিনি বিদ্যা শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। প্রথমতো তিনি কালাম শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। অল্প দিনের মধ্যেই তিনি কালাম শাস্ত্রবিদ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। অতঃপর তিনি বসরায় গমন করেন এবং তথায় কালাম শাস্ত্রবিদদের সাথে বিভিন্ন প্রকার যুক্তি তর্কে লিপ্ত হন। তৎকালে কালাম শাস্ত্রকে অধিক মূল্য দেয়া হতো এবং তাকে উসুলুদ্দীনের অন্তর্ভুক্ত মনে করা হতো।

কিন্তু পরবর্তীতে তাঁর মনে এ অনুভূতি জাগে যে, সাহাবী ও তাবিঈগণের কেউ কালাম শাস্ত্র নিয়ে মাথা যামাননি, যদিও কালামশাস্ত্রে তাঁদের অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। বরং তাঁদেরকে এ কাজ থেকে বারণ করা হয়েছে। আর তাঁরা ইলমে শরীআহ, ফিকহ ও মানুষকে শিক্ষাদান নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। তখন তিনি কালামশাস্ত্র ত্যাগ করেন এবং শরীআতী ইলম ও ফিকহ ইত্যাদির জ্ঞান আহরণে মনোনিবেশ করেন।

তিনি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ শায়খ হাম্মাদের শিক্ষা মজলিসের এককোণে বসতেন। হাম্মাদ ছাত্রদেরকে যা পড়াতেন তিনি তা সবই মুখস্থ করে ফেলতেন। আর হাম্মাদের ছাত্রদের ভুল সংশোধন করে দিতেন। তাঁরপর শায়খ হাম্মাদ তাঁকে মজলিসের মধ্যবর্তী স্থানে এবং তাঁর সম্মুখে বসতে দন। এভাবে সুদীর্ঘ ১০ বছর তিনি শায়খ হাম্মাদের নিকটতম ছাত্র হিসেবে কাটান। অতঃপর শায়খ হাম্মাদ শুধু ছাত্রদের দিয়ে শিক্ষা মজলিস গড়ার ইচ্ছা পোষণ করলেন। ঠিক এ সময় তাঁর উস্তাদ হাম্মাদের দূরবর্তী কোন আত্মীয়ের মৃত্যু ঘটলে তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত মাল আনার জন্য তিনি তথায় গমন করেন। ভ্রমণের প্রাক্কালে তিনি আবু হানীফাকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে যান। দু'মাস যাবৎ তিনি শায়খ হাম্মাদের মজলিসে দারস দিতে থাকেন। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তাঁর নিকট ৬০টি মাসআলার ফাতওয়া চাওয়া হয়। সেগুলো সম্পর্কে তিনি ইতঃপূর্বে শায়খ হাম্মাদের মুখে কিছু শুনেননি। তিনি এ গুলোর ফাতওয়া প্রদান করেন। শায়খ হাম্মাদের প্রত্যাবর্তনের পর ঐ মাসআলাগুলো তাঁর সম্মুখে পেশ করা হলে তিনি ঐ ফাতওয়াগুলোর ৪০টি আবু হানীফার স্বপক্ষে রায় দেন এবং বাকী ২০টির সাথে তাঁর মতোবিরোধ হয়। তখন আবু হানীফা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন যে, শায়খ হাম্মাদের মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তাঁর ছাত্র হিসেবেই থাকবেন।

খতীব বাগদাদী বর্ণনা করেন, ইমাম আবু হানীফা (র) ইলম চর্চায় মনোনিবেশ করার পূর্বে বিভিন্ন ইলম -এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে চিন্তা করলেন। তিনি দেখলেন, কালাম শাস্ত্র চর্চার পরিণাম শুভ নয়। কারণ মানুষ এটাকে খারাপ চোখে দেখে।

সাহিত্যে ও কবিতা চর্চা ও এর শিক্ষা দানও ততটা ফলদায়ক নয়। কারণ এতে সত্য-মিথ্যা জড়িয়ে যায়। হাদীস চর্চা ও এর শিক্ষাদানে অধিক সময়ের প্রয়োজন, যাতে মানুষের জীবন বিলিন হতে পারে। আবার এতে তাঁকে কম স্মৃতিশক্তি ইত্যাদির কারণে কেউ মিথ্যা অপবাদ দিতে পারে, যাতে কিয়ামতো পর্যন্ত তার আদালত বা বিশ্বস্ততা বিপন্নও হতে পারে।

সর্বশেষ তিনি ইলমে ফিকহ সম্পর্কে চিন্তা গবেষণা শুরু করলেন। তিনি বলেন, আমি যতই বেশি করে ফিকহ চর্চা করতে শুরু করলাম, ততই মধুর মনে হল। আর দেখলাম, ফিকহ ছাড়া ইহকাল ও পরকালের মঙ্গল সাধন সম্ভব নয়। সুতরাং আমি ফিকহ শাস্ত্রে মনোনিবেশ করলাম। অতঃপর তিনি ফিকহ শাস্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়েন। অল্পদিনের মধ্যে ফকীহ হিসেবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। তিনি মাসআলা গবেষণার ব্যাপারে কিয়াস ও ইজতিহাদ অধিকহারে প্রয়োগ করতেন। অবশ্য তা সর্বত্রে নয়। বরং যে সর্ব ব্যাপারে তিনি কুরআন-সুন্নাহ হতে দলীল পেতেন না, তাতেই শুধু কিয়াস ও ইজতিহাদ করতেন।

তিনি অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। রাজা-প্রজা সকলেই তাঁকে সম্মানের চোখে দেখতেন। একদা তিনি খলীফা মনসুরের নিকট প্রবেশ করলেন। তখন তাঁর নিকট ঈসা ইবনে মূসা উপস্থিত ছিলেন। ঈসা বললেন, আবু হানীফা বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ আলিম বা জ্ঞানী। অতঃপর মনসুর বললেন, হে আবু হানীফা, আপনি কোন উত্তাদের কাছে বিদ্যা শিক্ষা করেছেন? তদুত্তরে তিনি বললেন, ওমরের (রা) শিস্যদের থেকে ওমরের ইলম শিখেছি এবং আলীর (রা) শিষ্যদের থেকে আলীর (রা) ইলম শিক্ষা করেছি। তখন খলীফা বললেন, এ জন্যই আপনার ইলমের ভিত্তি এতেঠ শক্ত হয়েছে।

ইমাম আবু হানীফা (র) তাঁর উস্তাদ শায়খ হাম্মাদের ইন্তিকালের পর (১০৯হি:) তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি শুধু ফিকহ শাস্ত্রেই পণ্ডিত ছিলেন না বরং তিনি তাফসীর, হাদীস, ইলমুল কালাম, হিকমতো, সাহিত্যো ও অন্যান্য বিষয়েও মহাপণ্ডিত ছিলেন।

ইমাম আবু ইউসুফ (র) বলেন, আমি হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম আবু হানীফার চেয়ে অধিকতর পণ্ডিত কাউকে দেখিনি। সুফিয়ান ইবনে উয়াইনাহ বলেন, কুফায় আবু হানীফাই ছিলেন সর্বপ্রথম ব্যক্তি যিনি আমাকে হাদীস শিক্ষার মজলিসে বসান।

ইমাম আবু হানীফা (র) ৮০ হিঃ সালে কুফা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম নুমান। পিতার নাম ছাবিত। তাঁর উপনাম হল আবু হানীফা। প্রথমত তিনি কালাম শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। তিনি কালাম শান্ত অধ্যয়ন করেন এবং কালামশাস্ত্রবিদদের সাথে বিভিন্ন যুক্তি তর্কে লিপ্ত হন। পরবর্তীতে তিনি কালামশাস্ত্র ত্যাগ করেন এবং শরীআতী ইলম ও ফিকহ্ন ইত্যাদির জ্ঞান আহরণে মনোনিবেশ করেন।

শিক্ষকমণ্ডলী

ইমাম আবু হানীফা (র) শুধু ফিকহ পান্তেই পণ্ডিত ছিলেন না, বরং তিনি তাফসীর, হাদীস, ইলমুল কালাম, হিকমত, সাহিত্য ও অন্যান্য বিষয়েও মহাপণ্ডিত ছিলেন।

এ সম্পর্কে ইবনু হাজার আল-হায়ছামী আল-মাক্কী বলেন, ইমাম আবু হানীফার অসংখ্য শিক্ষক রয়েছেন। ইমাম আবু হাফস আল-কবীর বলেন, ইমাম আবু হানীফার চার হাজার শিক্ষক রয়েছেন। আবার কেউ বলেন, শুধু তাবিঈদের মধ্যে তাঁর চার হাজার শিক্ষক রয়েছেন, এর পরের স্তর তথা তাবি তাবিঈন এর তো কথাই নেই। তৎকালে কুফা নগরী স্বাধীন মতামত প্রকাশের প্রাণকেন্দ্র ছিল। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ ছিলেন কুফা নগরিতে শরীআতের স্বাধীন মতামত প্রকাশের প্রবক্তা। স্বাধীন মতামত প্রকাশের মূল নায়ক। স্বাধীন মতামত প্রকাশের ব্যাপারে উমরের (রা) বহু অনুসারী সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁরা ফিকহ শাস্ত্রের জন্য গৌরব স্বরূপ। শেষ পর্যন্ত আহলুর রায় বা স্বাধীন মতামত পোষণকারীদের নেতৃত্ব ইমাম আবু হানীফার কাছে গিয়ে পৌঁছে।

ইমাম আবু হানীফার শিক্ষকমণ্ডলীর মধ্যে রয়েছেন, হাম্মাদ, আতা, ইকরামা, নাফে, ইমাম জাফর সাদিক ও যায়িদ ইবনে আলী প্রমুখ। অবশ্য এদের ছাড়াও তাঁর আরো বহু উস্তাদ ছিলেন। 

আরো পড়ুন: মানব মর্যাদা সম্পর্কিত আয়াত  সম্পর্কে বিস্তারিত 

ছাত্রবৃন্দ

শায়খ হাম্মাদের মৃত্যুর পর ইমাম আবু হানীফা তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি তাঁর শায়খ এর স্থানে কুফার মসজিদে বসে মানুষকে ইলম শিক্ষা দিতেন এবং ফাতওয়া প্রদান করতেন। তাঁর নিকট বহু ছাত্রের সমাগম হতে থাকে। এদের অন্যতম ছিলেন, ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মদ, যুফার ও হাসান ইবনে যিয়াদ প্রমুখ। এরাই পরবর্তীতে ইমাম আবু হানীফার (র) মাযহাবকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। এদের মধ্যে ইমাম আবু ইউসুফের দ্বারা হানাফী মাযহাবের অধিক প্রচার ও প্রসার ঘটে।

ইমাম আবু হানিফার ছাত্রদের অন্যতম ছিলেন- ইমাম আবু ইউসুফ ইমাম মুহাম্মদ, যুফার ও হাসান ইবনে যিয়াদ প্রমুখ।

শিক্ষকতা ও ফাতওয়াদান

ইমাম আবু হানীফার উস্তাদ শায়খ হাম্মাদের ইন্তিকালের পর কুফাবাসী প্রথমে তাঁর পুত্রকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেল তিনি তাঁর পিতার মতো পণ্ডিত ব্যক্তি নন। তিনি কালামশাস্ত্র ও আরবী ব্যাকরণ ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন না। তখন কুফাবাসী পুনরায় ইমাম আবু হানীফাকে তাদের উস্তাদ হিসেবে বেছে নেন। তিনি ইলমে দীনের সকল ক্ষেত্রেই গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। তার নিকট শিক্ষার্থীরা ভীড় জমাতে থাকে। তিনি অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে তাদের শিক্ষা দিতে থাকেন। আর তাঁদের বিভিন্ন মাসআলার ফাতওয়া দিতে থাকেন। অতঃপর তার অধীনে দলে দলে ছাত্র শিক্ষা লাভ করতে থাকে এবং পরবর্তীতে তারা ইলমে দীনের ইমাম হিসেবে পরিগণিত হতে থাকেন। এদের মধ্যে প্রসিদ্ধ হলেন ইমাম আবু ইউসুফ, মুহাম্মদ, মুফার প্রমুখ। এমনিভাবে ইমাম আবু হানীফার সুখ্যাতি বাড়তে থাকে এবং মসজিদে তার শিক্ষা মজলিসই সর্ববৃহৎ মজলিস হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। অতঃপর সকল লোকের দৃষ্টি তাঁর দিকেই আকৃষ্ট হয়। আমীর- উমারা ও খলীফাগণ তাঁকে সম্মান প্রদর্শন করতে থাকেন। তিনি এমন কঠিন সমস্যার সমাধান দিতেন এবং ফাতওয়া প্রদান করতেন যা অন্যান্যদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এতেঠদসত্ত্বেও তাঁর বহু প্রতিপক্ষ ও বিরুদ্ধবাদী দাঁড়িয়ে যায়। এটা আল্লাহর সৃষ্টির চিরাচরিত নিয়ম যা মানুষের মধ্যে চলতেই থাকবে। তাঁর অনুসৃত নীতি ও ফাতওয়ার সমষ্টিই হল হানাফী মাযহাব। এ মাযহাবই সর্বশ্রেষ্ঠ মাযহাব। মুসলিম বিশ্বে এ মাযহাবের অনুসারী সংখ্যা সর্বাধিক।

ইমাম আবু হানীফা (র)-এর কতিপয় অনন্য বৈশিষ্ট্য

১. ইমাম আবু হানীফা (র) সাহাবীকে দেখেছেন। রাসূল (স) বলেন, ঐ ব্যক্তি সৌভাগ্যবান, যে আমাকে দেখেছে অথবা আমাকে যে দেখেছে তাঁকে দেখেছে। অত্র হাদীসে সাহাবী ও তাবিঈ যুগের মর্যাদার কথা বলা হয়েছে। ইমাম আবু হানীফা (র) একজন তাবিঈ ছিলেন।

২. তিনি মহানবীর (স) ঘোষিত শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করেন। যে শতাব্দীর মর্যাদা সম্পর্কে রাসূলের )স) হাদীস রয়েছে ير القرون قرنیত্তম শতাব্দী হল আমার শতাব্দী'। 

 ৩. তিনি তাঁর যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ আলিম ছিলেন। একদা তিনি খলীফা মানসুরের নিকট গমন করেন। তখন তাঁর নিকট ঈসা ইবনে মূসা উপস্থিত ছিলেন। তিনি খলীফাকে লক্ষ্য করে বলেন, হে আমিরুল মুমিনীন। বর্তমান বিশ্বে আবু হানীফাই সর্বাপেক্ষা বড় আলিম। খলীফা তাঁকে প্রশ্ন করলেন, আপনি কাদের নিকট থেকে ইলম হাসিল করেছেন? তদুত্তরে তিনি বলেন, উমরের (রা) ছাত্রদের থেকে উমরের ইলম, আলীর ছাত্রদের থেকে আলীর ইলম এবং ইবনে মাসউদ (রা)-এর ছাত্রদের থেকে ইবনে মাসউদের ইলম। তখন খলীফা বললেন, আপনি এ জন্যই এত পাণ্ডিত্যের অধিকারী হয়েছেন।

৪. তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি ইলমে ফিকহকে পুস্তক আকারে সংকলন করেন যাতে তিনি ফিকহকে অধ্যায় ও পরিচ্ছেদ আকারে বিন্যাস করেন, যা আজ পর্যন্ত অবিকলই রয়ে গেছে। পরবর্তীতে ইমাম মালিক তাঁর প্রণীত 'আল-মুয়াত্তা' এন্থে তাঁর পদ্ধতি অনুসরণ করেন। ইমাম আবু হানীফা (র)-এর পূর্বে মানুষ ইলম সংরক্ষণ করতে গিয়ে শুধু হিফয বা স্মৃতি শক্তির উপরই নির্ভর করতেন।

৫ তিনি তাবিঈদের যুগেই ইজতিহাদ ও ফাতওয়াদান শুরু করেন, যা চার মাযহাবের কোন ইমামের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

৬. তিনি আল্লাহর রাস্তায় তাঁর নিজস্ব আয়লব্ধ অর্থ থেকে প্রচুর পরিমাণ দান-খয়রাত করতেন।

৭. তিনি রাজা বাদশাহদের উপহার বা উপঢৌকন গ্রহণ করতেন না।

৮ তিনি বন্দিশালায় নিপীড়িত অবস্থায় ইন্তিকাল করেন।

আরো পড়ুন: সূরা আল-নূরের আলোকে ব্যভিচারের পরিণাম ও দন্ডবিধি

ইমাম আবু হানীফার প্রশংসায় আলিম সমাজ

একদা ইমাম মালিককে প্রশ্ন করা হল, আপনি কি আবু হানীফাকে দেখেছেন? তদুত্তরে ইমাম মালিক বললেন, হ্যাঁ আমি আবু হানীফা নামে এক ব্যক্তিকে দেখেছি, তিনি যদি এই স্তম্ভটিকে স্বর্ণ নির্মিত বলে দাবি করেন, তবে তিনি এটাকে দলীলের সাহায্যে স্বর্ণানির্মিত স্তম্ভ হিসেবেই প্রমাণ করতে পারবেন।

ইমাম শাফিঈ (র) বলেন, ফিকহ শাস্ত্রে সকল মানুষ ইমাম আবু হানীফার পরিবারভুক্ত। আমি আবু হানীফার চেয়ে কাউকে অধিক বড় ফকীহ হিসেবে জানি না।

ইবনুল মুবারক বলেন, ইমাম আবু হানীফা (র) সর্বাপেক্ষা বড় ফকীহ ছিলেন। আমি তাঁর চেয়ে বড় ফকীহ দেখিনি। তিনি আরো বলেন, ইমাম আবু হানীফা হলেন, ইলমের মগজ। তিনি ছাড়া অনুসরণ যোগ্য আর কেউ নেই।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) বলেন, ইমাম আবু হানীফা (র) ছিলেন অত্যন্ত মুত্তাকী। আর তিনি ইহকালের উপর পরকালকে এতেঠই প্রাধান্য দিতেন যা অন্যের পক্ষে সম্ভব নয়। মনসুর তাকে কাযীর পদ গ্রহণের জন্য কোড়া মারতেন। এতেঠদসত্ত্বেও তিনি ঐ পদ গ্রহণ করেননি। আল্লাহ তাঁর উপর রহমতো বর্ষণ করুন।

মাক্কী ইবনে ইবরাহীম বলেন, ইমাম আবু হানীফা (র) তাঁর সময়কালে সর্বাপেক্ষা বড় আলিম ছিলেন। 

ঈসা ইবনে ইউনুস বলেন, তোমরা এমন লোককে বিশ্বাস করো না যে ইমাম আবু হানীফার (র) বিরূপ সমালোচনা করে।

খারিজা বলেন, চার বাক্তি পবিত্র কাবা ঘরের মধ্যে কুরআন খতম করেন, তাঁদের মধ্যে একজন হলেন ইমাম আবু হানীফা (র)।

তাকওয়া

ইমাম আবু হানীফা (র) তাকওয়া ও খোদাভীতিতে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁর যুগে তিনি সর্বাপেক্ষা মুত্তাকী ছিলেন। ইবনুল মুবারক বলেন, একদা আমি কুফায় প্রবেশ করে জিজ্ঞেস করলাম, এদেশে সর্বাপেক্ষা খোদাভীরু ব্যক্তি কে? তখন কুফার অধিবাসীগণ বললেন, ইমাম আবু হানীফা (র)।

মাক্কী ইবনে ইবরাহীম বললেন, ইমাম আবু হানীফা (র) অত্যন্ত মুত্তাকী ছিলেন। হারাম কাজ কর্ম থেকে সর্বদা বিরত থাকতেন। এমনকি হারামে পতিত হওয়ার ভয়ে বহু হালাল বস্তুও ত্যাগ করতেন। এমন কোন ফকীহ দেখিনি, যিনি আবু হানীফার মতো তাঁর আত্মা ও ইলমকে বাঁচারার চেষ্টায় ব্রতী ছিলেন। তাঁর সর্বপ্রকার কাজ ও সংগ্রাম কবরের জন্যই ছিল। অর্থাৎ পরকালের জন্যই তিনি সকল কাজ করতেন।

ইমাম আবু হানীফা (র) অত্যন্ত মুত্তাকী ছিলেন। হারাম কাজ কর্ম থেকে সর্বদা বিরত থাকতেন। এমনকি হারামে পতিত হওয়ার ভয়ে বহু হালাল বস্তুও ত্যাগ করতেন।

ইয়াযীদ ইবনে হারুন (র) বলেন, আমি এক হাজার শায়খ থেকে লেখাপড়া শিখেছি, কিন্তু ইমাম আবু হানীফার মতো মুত্তাকী কাউকে দেখিনি।

হাসান ইবনে সালিহ (র) বলেন, আল্লাহর শপথ ইমাম আবু হানীফা (র) কখনো কোন রাজা- বাদশার উপঢৌকন গ্রহণ করতেন না। তিনি একদা তাঁর ব্যবসায়ের অংশীদারকে কাপড়ের গাঁট বিক্রি করতে পাঠালেন এবং বলে দিলেন, তার মধ্যে একখানা কাপড় ত্রুটিযুক্ত। কিন্তু তাঁর সহকর্মী কাপড় বিক্রয়ের সময় ত্রুটিযুক্ত কাপড়টির কথা বলতে ভুলে গেলেন। বহু খোঁজ করেও ক্রেতাকে পাওয়া গেল না। তখন তিনি ঐ সমুদয় বিক্রয় লব্ধ কাপড়ের অর্থ আল্লাহর রাস্তায় দান করে দেন। ঐ অর্থের পরিমাণ ছিল ত্রিশ হাজার দিরহাম। অতঃপর তিনি তাঁর অংশীদার থেকে পৃথক হয়ে যান।

আরো পড়ুন: ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ: সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও এর দন্ডবিধি

ইমাম মালিক (র) বলেন, ইমাম আবু হানীফা (র) যদি কোন শুম্ভকে স্বর্ণ নির্মিত বলে দাবি করেন, তবে তিনি এটাকে দলীলের সাহায্যে স্বর্ণানির্মিত স্তম্ভ হিসেবেই প্রমাণ করতে পারবেন।

সত্য ও ন্যায়ের পথে তাঁর ধৈর্য ও ইনতিকাল 

ইমাম আবু হানীফা (স) সত্য ও ন্যায়ের প্রচারে অত্যন্ত নির্ভীক ছিলেন। এ জন্য তাঁকে বহু বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে।

ইরাকে মারোয়ানের গভর্নর ইয়াযীদ ইবনে হুরায়রা ইবনে ওমর ইমাম আবু হানীফাকে কুফার কার্যী (বিচারক) নিয়োগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। কিন্তু ইমাম আবু হানীফা (র) এতে অস্বীকৃতি জানান। তখন ইয়াযীদ তাঁকে রোজ দশটি করে মোট একশত দশটি কোড়া লাগাবার নির্দেশ দেয়। কিন্তু তাতেও ইমাম আবু হানীফা (র) তাঁর অসম্মতির উপর অটল থাকেন।

খলীফা মানসুর তাঁকে কুফা হতে বাগদাদে ডেকে পাঠালেন এবং তাঁকে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিতে চাইলেন; কিন্তু তিনি এতে অসম্মতি জানান। মানসুর শপথ করলেন, ইমাম সাহেবকে অবশ্যই প্রধান বিচারক পদে নিয়োগ করবেন। অপরপক্ষে ইমাম সাহেবও শপথ করলেন, তিনি কখনো এ পদ গ্রহণ করবেন না। তখন খলীফার দেহরক্ষী তাঁকে বললেন, খলীফা শপথ করে বলছেন: আপনাকেই বিচারপতি নিয়োগ করবেন। তদুত্তরে ইমাম সাহেব বললেন, শপথের কাফফারা দেওয়া আমার চেয়ে খলিফার জন্য সহজ হবে। তখন খলিফা তাঁকে বন্দী করার নির্দেশ দিলেন। অতঃপর মানসুর তাঁকে ডাকলেন এবং বললেন, আপনি প্রধান বিচারকের পদ গ্রহণ করুন। ইমাম সাহেব বললেন, আমি এর উপযুক্ত নই। খলীফা বললেন, আপনি মিথ্যা বলেছন। কেননা আপনিই এ পদের উপযুক্ত। তখন ইমাম সাহেব বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন। আপনার কথায়ই আপনি পরাজিত হয়েছেন। কারণ আমি যদি মিথ্যাবাদী হই তাহলে কিভাবে আপনি একজন মিথ্যাবাদীকে মুসলিম বিশ্বের প্রধান বিচারক নিয়োগ করবেন? অতঃপর খলীফা তাঁকে কারাগারে নেয়ার নির্দেশ দিলেন এবং তাঁকে প্রত্যহ দশটি কোড়া লাগাতে বললেন। খলীফার নির্দেশে তাকে রোজ দশটি কোড়া লাগানো হতো। কিন্তু তিনি তাঁর অসম্মতি জ্ঞাপনে অবিচল রইলেন। একদা তাঁকে এমন কঠিনভাবে মারা হলো যে, তাঁর সর্বশরীর রক্তে রঞ্জিত হল। তবুও তিনি তাঁর কথায় অটল রইলেন। এভাবে তাঁকে দশদিন কোড়া লাগানো হল। এমনকি কারাগারে তাঁকে পানাহারে কষ্ট দেওয়া হল। দশদিন কোড়া লাগানোর পর তিনি আল্লাহর দরবারে মিনতি স্বরে কাঁদলেন এবং দোয়া করলেন। এর পাঁচদিন পর তিনি ইন্তিকাল করেন। বর্ণিত আছে, কারাগারে তার হাতে একটি পেয়ালা দেয়া হয়, যাতে বিষ ছিল। কিন্তু তিনি তা হাতে নিয়ে বললেন, আমি অবশ্যই জানি, এ পেয়ালার মধ্যে কী আছে। তবে আমি আমার হতো্যার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারি না। এ কথা বলে বিষের পেয়ালা ছুঁড়ে ফেললেন। তারপর তাঁর মুখে জোর পূর্বক বিষ ঢেলে দেয়া হয়। ফলে তিনি ইন্তিকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। বর্ণিত আছে, খলিফা মানসুরের উপস্থিতিতে তাঁর মুখে বিষ দেয়া হয়। তিনি (ইমাম আবু হানীফা (র)) যখন মৃত্যু নিশ্চিত মনে করেন তখন সিজদায় চলে যান। আর সিজদাতেই তিনি মৃত্যু মুখে পতিত হন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। তিনি ১৫০ হি: সালে ইন্তিকাল করেন।

তাঁর ইন্তিকালের পর বাগদাদের কাযী হাসান ইবনে আম্মারা তাঁকে গোসল করান। গোসল শেষে তিনি বললেন, হে ইমাম আবু হানীফা। আপনার উপর আল্লাহর রহমতো বর্ষিত হোক। আপনি আমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় ফকীহ, আবিদ ও মুত্তাকী ছিলেন। আর আপনার মধ্যে সচ্চরিত্রের সকল প্রকার গুণের সমাবেশ ছিল।

আল্লাহ হাফেজ #**


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url