ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র) ও তাঁর মাযহাব

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র)-এর পরিচয়  ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র)-এর শিক্ষাজীবন ইসলামের প্রচার ও প্রসারে তাঁর অবদান ইমাম আহমাদের কারাজীবন ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র)-এর চরিত্রের দৃঢ়তা হাম্বলী মাযহাবের মূলনীতি হাম্বলী মাযহাবের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তারিত আজ এই আর্টিকেলটিতে জানতে পারবেন।

 


ভূমিকা

জীবনের চেয়ে মরণকে বেশি স্বাগত জানায় কে? মৃত্যুর মুখোমুখী দাঁড়িয়ে কে সত্য উচ্চারণ করতে পারে? কে সাহস করে বলতে পারে, মরণের সিদ্ধান্ত জমিনে নয় আসমানেই হয়ে থাকে? জেলখানার অমানবিক অত্যাচার সহ্য করেও কে হকের উপর টিকে থাকতে পারে? পারে শুধু সে ব্যক্তি যার সর্বস্ব আল্লাহ তা'লার জন্য নিবেদিত। এ জাতীয় ব্যক্তিদের প্রথম সারিতে রয়েছেন ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র)। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমরণ সংগ্রামী, সত্য সুন্দর দীন ইসলামের অতন্দ্রপ্রহরী, সত্যের পক্ষে একজন সাহসী সৈনিক, অকথ্য শারীরিক নির্যাতন আর ক্ষুধা-তৃষ্ণায় যখন তিনি খুঁকে ধুঁকে নিশ্চিত মৃত্যুর পথে যাত্রা করেছেন, তখনও তিনি এক মুহূর্তের জন্যও বাতিলের সাথে আপোস করেননি। তিনি ছিলেন এক আপোসহীন মহান সংগ্রামী ইমাম।

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র) সত্যের পক্ষে একজন সাহসী সৈনিক ছিলেন। অকথ্য শারীরিক নির্যাতন আর ক্ষুধা- তৃষ্ণায় যখন তিনি ধুকে বুকে নিশ্চিত মৃত্যুর পথে যাত্রা করেছেন, তখনও তিনি এক মুহূর্তের জন্যও ব্যতিলের সাথে আপোন করেননি। তিনি ছিলেন এক আপোসহীন মহান সংগ্রামী ইমাম।

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র)-এর পরিচয়

নাম: আহমাদ, উপনাম-আবু আবদুল্লাহ, পদবী আল-হুযায়লী, আল-শায়বানী, আল-বাগদাদী, পিতার নাম: মুহাম্মদ, দাদার নাম। হেলাল। তিনি হলেন আবু আবদুল্লাহ আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হেলাল আল-হুযায়লী, আল-শায়বানী, আল-বাগদাদী। তবে তিনি ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বর নামে সমধিক পরিচিত।

আল্লাহ তা'আলার প্রিয় বন্ধু ইবরাহীম (আ) পর্যন্ত গিয়ে তাঁর বংশ পরম্পরা পৌছেছে। ইমাম আহমাদ (র) আল্লাহর বিধানের ক্ষেত্রে অতি কঠোর ছিলেন। ছিলেন অত্যন্ত সাহসী ও নির্ভীক। দুনিয়ার তথাকথিত কোন রাজা-বাদশাহকে তিনি পছন্দ করতেন না।

আরো পড়ুন: চরিত্র গঠনে আল-কুরআনের শিক্ষার বিবরণ সর্ম্পর্কে বিস্তারিত

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র)-এর জন্ম ও বাল্যকাল

১৬৪ হিজরী সনের রবিউল আউয়াল মাস। এ মাসে তিনি বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের মাত্র তিন বছর পর তার পিতা ইন্তিকাল করেন। তিনি মায়ের স্নেহ-আদরে বড় হতে থাকেন। ছোট বেলা থেকেই তিনি প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন। যে কোন বিষয় অতি সহজে মুখস্থ করে ফেলতেন।

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র)-এর শিক্ষাজীবন

ইমাম শাফিঈ (র) বাগদাদে আগমন করেছিলেন। ইমাম আহমাদ এ সুযোগকে কাজে লাগিয়েছিলেন। তিনি ইমাম শাফিঈর নিকট যথেষ্ট লেখাপড়া করেন। ইমাম আহমাদের জ্ঞানের গভীরতা দেখে তিনি অবাক হয়ে যান। ফিকহ এর চেয়ে হাদীসের প্রতি ইমাম আহমাদ বেশি গুরুত্ব দিতেন। তিনি অসংখ্য হাদীস মুখস্থ করেছিলেন। তিনি সেই সময়ের মুহাদ্দিসগণের ইমাম ছিলেন।

হাদীসের ক্ষেত্রে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় এবং বিখ্যাত শিক্ষক ছিলেন হুশাইম ইবনে বশীর ইবনে আবি খাযেম।

ফিকহ এর চেয়ে হাদীসের প্রতি ইমাম আহমাদ বেশি গুরুত্ব দিতেন। তিনি অসংখ্য হাদীস মুখস্থ করেছিলেন। তিনি তাঁর সময়ের মুহাদ্দিসগণের ইমাম ছিলেন।

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র)-এর কর্মজীবন

তিনি ফিকহ এবং হাদীসের বিশিষ্ট ইমাম ছিলেন। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অধিকারী ছিলেন। পাঁচবার তিনি পবিত্র হজব্রত পালন করেন। এ সফরের তিনবারই ছিল পদব্রজে। এ সময় তিনি অসংখ্য মানুষকে শিক্ষাদান করেন। নিজেও বড় বড় আলিমগণ থেকে শিক্ষালাভ করেন। ইব্রাহীম হারবী তাঁর সম্পর্কে বলেন, "আল্লাহ তা'আলা ইমাম আহমাদের মধ্যে অগ্রজ অনুজ সকল আলিমের জ্ঞান একত্র করেছেন।"

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র) ফিকহ এবং হাদীসের বিশিষ্ট ইমাম ছিলেন। ইমাম শাফিঈ (র) তাঁর সম্পর্কে বলেন, "আমি যখন বাগদাদ ত্যাগ করি তখন আহমাদার) বাগদাদের শ্রেষ্ঠ ফকীহ এবং শ্রেষ্ঠ আল্লাহভীরু ছিলেন।

আরো পড়ুন: আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও ক্ষমতা সম্পর্কিত বিস্তারিত বর্ণনা 

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র)-এর জীবনযাপন

ইমাম আহমাদ অত্যন্ত সাধারণ জীবন যাপন করতেন। রুটি এবং ছাতু ব্যতীত অন্যকিছু আহার করতেন না। রাজা-বাদশাহের উপহার তিনি গ্রহণ করতেন না। তাঁকে বহু অর্থ সম্পদ দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। রাজা-বাদশাহদের সাথে যারা সম্পর্ক রাখতো তারাও কোন বস্তু দিলে ইমাম আহমাদ (র) তা গ্রহণ করতেন না।

খলীফা মামুন একবার সিদ্ধান্ত নিলেন যে, হাদীস বিশারদদের মধ্যে তিনি বেশকিছু স্বর্ণমুদ্রা বিতরণ করবেন। সকল আলিমই এ স্বর্ণমুদ্রা গ্রহণ করেছিলেন, শুধু ইমাম আহমাদ তা গ্রহণ করেননি। এভাবে অতিকষ্টের মধ্যে তিনি জীবন নির্বাহ করতেন। তিনি দুনিয়াদারদের সাথে কখনো আপোস করেননি। তাঁর জীবন যাপনের মান দেখে অনেকেই অবাক হতেন।

কারাগারে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র)

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র) কঠিন বিপদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। খলিফা মামুন, মুতাসিম এবং মুতাওয়াক্কিলের যুগে তিনি চরম নির্যাতনের শিকার হন। এ সময়ে মুতাযিলা সম্প্রদায় খলীফাদের ছত্রছায়ায় ছিলো। তারা মনে করতো যে, পবিত্র কুরআন হলো 'মাখলুক' বা সৃষ্ট। ইমাম আহমাদ (র)- এর উপর বিভিন্ন চাপ প্রয়োগ করা হয় কুরআনকে 'সৃষ্ট' হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য। তাঁর উপর অত্যাচার করা হয়, কিন্তু তিনি জীবন দিতে প্রস্তুত, তবুও একথা স্বীকার করতে রাজি নন। কেননা জীবন বাজি রাখা যায় কিন্তু আল্লাহর কুরআনকে অসম্মান করা যায় না। খলীফা মুতাসিমের যুগে দীর্ঘ ৩০ মাস তাঁকে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়।

কারাগারে নির্মমভাবে তাঁর উপর বেত্রাঘাত করা হয়। আঘাতের যন্ত্রণায় তিনি বেহুঁশ হয়ে যান। সমস্ত শরীর রক্তাক্ত হয়ে যায়। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও তিনি কুরআনকে 'সৃষ্ট' বলে স্বীকার করেননি। এতেঠ অত্যাচার ভোগ করেও ইমাম আহমাদ ব্যতিলের সাথে আপোস করেননি। সাহসী সৈনিকের মতো সকল বিপদ মোকাবলা করে গেছেন। অবশেষে খলীফা মুতাসিমের মৃত্যুর পর খলীফা মুতাওয়াকিল তাঁকে কারাগার থেকে মুক্ত করেন।

এটাই হলো মূলত দীনের সংগ্রাম, সত্যের জন্য লড়াই। তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আল্লাহর কুরআনের মর্যাদা রক্ষা করেছেন। ইমাম আহমাদ (র) সেদিন আপোস করলে দীন ইসলামের অস্তিত্ব টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়তো।

খলিফা মামুন, মুতাসিম এবং মুতাওয়াক্কিলের যুগে কুরআনকে সৃষ্ট হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য কারাগারে নির্মমভাবে তাঁকে বেত্রাঘাত করা হয়। আঘাতের যন্ত্রণায় তিনি বেহুঁশ হয়ে যান। সমস্ত শরীর রক্তাক্ত হয়ে যায়। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও তিনি কুরআনকে সৃষ্ট' বলে স্বীকার করেননি।

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র)-এর ইন্তিকাল

২৪১ হিজরী সনের ১২ রবিউল আউয়াল শুক্রবার। এদিন সকাল বেলা বাগদাদে শোকের কালোছায়া নেমে আসে। আর এর একমাত্র কারণ ছিলো ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রা)-এর ইন্তিকাল।

তাঁর ইন্তিকালের খবর জানার পর অসংখ্য মানুষ ইমামের বাড়ীতে ভিড় করতে থাকে। যখন তাঁর কফিন কবরস্থানের দিকে নেয়া হচ্ছিল তখন লাখ লাখ নারী-পুরুষ পিছনে পিছনে চলছিলো।

ইমাম বায়হাকী বলেন, "ইমাম আহমাদের জানাযায় তের লক্ষাধিক মানুষ হাজির হয়েছিলো। জাহেলী থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত অন্য কোন মানুষের জানাযায় এতো মানুষ হাজির হয়নি।"

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র)-এর মাযহাব

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র) হাদীসের পরিত ছিলেন। তাই তাঁর মাযহাবে বিশুদ্ধ হাদীসের যথেষ্ট প্রাধান্য দেখা যায়। হাম্বলী মাযহাবের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি রয়েছে। সেগুলোর বর্ণনা নিম্নরূপ-

হাম্বলী মাযহাবের মূলনীতিসমূহ

ইমাম আহমাদ (র) ইমাম শাফিঈর নিকট জ্ঞানার্জন করেছেন। তাই তাঁর মাযহাবের মূলনীতিসমূহ শাফিঈ মাযহাবের কাছাকাছি। হাম্বলী মাযহাবের মূলনীতিগুলো হলো।

১. আল-কুরআন 

২. আস-সুন্নাহ বা হাদীস 

৩. সাহাবাদের কথা 

৪. আল-ইজমা বা ঐকমত্যে 

৫ আল-কিয়াস 

৬. আল-ইসতিসহাব বা প্রতিটি বিষয়ের মূল অবস্থ 

৭. আল-মাসালিহ আল-মুরাসলা বা ব্যাপক কল্যাণমূলক চিন্তা 

৮ অকল্যাণের পথ রুদ্ধ করণ

আরো পড়ুন: যুলম-নির্যাতন রোধ সংক্রান্ত হাদিস সম্পর্কে বিস্তারিত

হাম্বলী মাযহাবের প্রক্রিয়া

অন্যান্য ইমামদের মতো ইমাম আহমাদ ফিকহ শাস্ত্রের কোন কিতাব রচনা করেননি। বরং তাঁর কথা, কাজ এবং বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর থেকে মাযহাবকে গ্রহণ করা হয়েছে।

ইমাম আহমাদ (র) হাদীস শাস্ত্রের এক বিশাল কিতাব সংকলন করেছেন, যার নাম হলো আলমুসনাদ )المسند( এ কিতাবের মধ্যে চল্লিশ হাজারেরও বেশি হাদীস রয়েছে। তাই তিনি তাঁর মাযহাব রচনার হাদীসের উপর বেশি নির্ভর করেছেন।

হাম্বলী মাযহাবের সম্প্রসারণ

আরব বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় হাম্বলী মাযহাব ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে। এ ক্ষেত্রে ইমাম আহমাদের ছাত্রগণ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এসব ছাত্রের অন্যতম হলেন-

১. ইমাম আহমাদের বড় ছেলে সালেহ ইবনে আহমাদ ইবনে হাম্বল। (মৃত্যু ২৬৬ হিজরী)

২. ইমাম আহমাদের অন্য এক ছেলে যার নাম আবদুল্লাহ ইবনে আহমাদ ইবনে হাম্বল। (মৃত্যু ২৯০হিজরী)

৩. আবু বকর আহমদ ইবনে মুহাম্মদ, যিনি 'আসরাম' নামে পরিচিত। (মৃত্যু ২৭৩ হিজরী)

৪ আবদুল মালিক ইবনে আব্দুল হামিদ। (মৃত্যু ২৬৬ হিজরী)

৫ আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনুল হাজ্জাজ। (মৃত্যু ২৬৬ হিজরী)

৬. হারব ইবনে ঈসমাইল আল-হানসালী। (মৃত্যু ২৬৬ হিজরী) 

৭. ইব্রাহিম ইবনে ইসহাক আল-হারবী। (মৃত্যু ২৬৬ হিজরী)

তাঁদের পর যে বিখ্যাত আলিম আগমন করেন তিনি হলেন-আবু বকর আল-খাল্লাল। যিনি সমস্ত হাম্বলী ফিকহকে একত্র করেছেন। তাই তাঁকে 'হাম্বলী ফিকহের জমাকারী' বলা হয়।

হাম্বলী মাযহাবের বৈশিষ্ট্যসমূহ

হাম্বলী মাযহাবের কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সেগুলো হলো-

১. ইমাম আহমাদ কুরআনের সরাসরি ও স্পষ্ট অর্থকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।

২ বিশুদ্ধ হাদীসের উপর তিনি অধিক নির্ভরশীল।

৩. 'মুরসাল হাদীস' এবং "হাসান হাদীস' দ্বারা তিনি দলীল গ্রহণ করেছেন।

৪. দুর্বল  হাদীসকে তিনি কিয়াস এর উপর প্রাধান্য দিয়েছেন।

৫. তিনি মাও  হাদীসকে মারফু  হাদীসের মতো দলীল হিসেবে মনে করেন।

৬. মদীনাবাসীদের কার্যাবলিকে তিনি দলীল হিসেবে মনে করতেন না।

৭. তবে তিনি 'মুনকার' হাদীস দ্বারা দলীল গ্রহণ করেননি।

৮. হাম্বলী মাযহাবে যুক্তি তর্কের স্থান খুবই কম।

আল্লাহ হাফেজ**



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url