বাংলাদেশের অধীনতা থেকে স্বাধীনতা

বাংলাদেশের অধীনতা থেকে স্বাধীনতা

কত সুন্দর আমাদের দেশ। কত সুন্দর আমাদের চারপাশের মানুষ আমাদের কেউ কি না খেয়ে থাকে? এখানে কথা বলতে কি কেউ বাধা দেয়? এই গানগুলো গাইতে পারবে না, এমন কথা বলে কি কেউ? আচ্ছা এই যে আমরা কাগজে লিখি, সেই কাগজটা কি বিদেশ থেকে আনতে হয়? সরকারি অফিস-আদালতগুলো কি বিদেশিরা চালায়?


এই প্রশ্নগুলোর জবাব নিশ্চয়ই প্রায় সবারই জানা। আমাদের দেশের মানুষ খাবারের অভাবে মারা যায় না, আমাদের কথা বলতে বাধা নেই, গান গাইতে নিষেধ করে না কেউ, আমাদের লেখার কাগজ আমরাই তৈরি করি, সরকারি অফিস আদালতে শতভাগ লোক আমাদের দেশের। আমাদের সেনাবাহিনীতেও সবাই আমাদেরই ভাই-বোন কিংবা আত্মীয়-স্বজন, সবাই বাংলাদেশের।

আরো পড়ুন:

বিষয়গুলো এই মুহূর্তে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে না হতে পারে। কিন্তু আমরা যখন পরাধীন ছিলাম, প্রতি বছর আমাদের দেশে অনেক অনেক মানুষ না খেতে পেরে রোগে ভুগে মারা গেছে। কারণটা কী?

পাকিস্তানিরা বাংলাদেশে কৃষি উন্নয়নে মোটেও নজর দিত না। ওরা নিজের দেশে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করত। আমাদের দেশের কৃষকরা ফসল ফলাতে পারত না- ভালো বীজ পেত না বলে, সার-কীটনাশক-ওষুধ পেত না বলে। আর কৃষি গবেষণা হতো না বলে। জনসংখ্যার তুলনায় বেশি জমি থাকার পরও উপোস কাটাতে হতো বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে। জমিতে ফসল না হলে খাবার পাবে কোথা থেকে? সরকারও খাবারের ব্যবস্থা করত না। কিন্তু আজকের অবস্থাটা কী?


বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন বলা হয় ১৮ কোটি। এই বিশাল সংখ্যার মানুষ কেউ না খেয়ে থাকে না। অনাহারে অসুখ হয় না কারো। কৃষক জমিতে ভালো ফসল পেয়ে হাসতে পারে। কারণটা কী? কারণ হচ্ছে এখন তারা ভালো বীজ পায়, সেচ সুবিধা পায়, সার পায়। এবং কৃষিতে গবেষণা হয়। নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন হয়। যে কারণে ফসলের উৎপাদন হয় অন্তত ১০ গুণ। আর তাই পাকিস্তান আমলের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ থেকে ১৮ কোটি হওয়ার পরও খাবারের অভাব হয় না।


এবার আসি কথা বলার স্বাধীনতার প্রসঙ্গে। পাকিস্তান আমলে, আমার খাবার নেই, খাবার দাও এমন কথাও বলা যেত না। যদি মানুষ বলত খাবার দাও, অমনি তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হতো। যদি বলত আমাদের দেশ আমরা চালাব- সঙ্গে সঙ্গে গুলি চালানো হতো। এই গুলি-নির্যাতনের মুখেও যদি মানুষ নিজেদের পছন্দের মানুষকে শাসন ক্ষমতায় বসানোর সুযোগ পেত, সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানিরা সেই সুযোগ কেড়ে নিত। জারি করত সামরিক শাসন। সামরিক শাসন মানে সরকারের যত অন্যায়-অপরাধ-নির্যাতন-জুলুমই থাকুক না কেন, মুখ বুজে সইতে হবে।

আরো পড়ুন:

বড় কথাটাই বলা হয়নি। এই যে কথা বলতে দিত না, তাই বলি। আমরা ছিলাম পাকিস্তানের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যার এলাকাধীন। আমাদের বাংলা ভাষা ছিল পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ মানুষের ভাষা। পাকিস্তানিরা করল কী, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে - চাপিয়ে দিল। অথচ এই উর্দুভাষা পাকিস্তানের ৩ শতাংশ মানুষ ব্যবহার করত। আমাদের দেশের সবারই ভাষা বাংলা। অথচ - বলা হলো, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। সরকারি  অফিস-আদালতে উর্দুভাষা ব্যবহার হবে। কেমন অত্যাচার! আমি মা-কে মা ডাকি, বাবাকে বাবা বলতে পারব না? তার প্রতিবাদে বাঙালি মাঠে নামল। একুশে ফেব্রুয়ারির কথা তো আমরা সবাই জানি। সেই যে সালাম, রফিক, জাব্বার জীবন দিল। পৃথিবীতে খুব কম জাতি আছে, যারা নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকার লাভের জন্য জীবন দিয়েছে। আমরা সেই বীরের জাতি। আমরা প্রাণ দিতেও দ্বিধা করিনি। এখানেই শেষ নয়, পাকিস্তানিরা বাঙালি ও বাংলা ভাষাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করল। - বলল, বাংলা হচ্ছে অমুসলমানের ভাষা। তোমরা বাংলায় কথা বলো ঠিক আছে, তবে বাংলা লিখতে হবে আরবি অক্ষরে। আচ্ছা, এটাও কী হয়! আমাদের নিজের অক্ষর আছে, ভাষা = আছে, আমরা ধার করে আনব কেন? বাঙালি জাতি সেটাও হতে দেয়নি। এখন কী পরিবর্তন এসেছে আমাদের? গত ৫০ বছর ধরে আমাদের দেশ শাসন করছে আমাদের মানুষ। আমরাই আমাদের সরকার গঠন করি। সরকারও হয় আমাদের। আমাদের মানুষ সরকারের ভুলত্রুটির সমালোচনা করতে পারে। তাদের * দাবি-দাওয়া জানাতে পারে। অফিস-আদালত, ঘরে-বাইরে সবখানে আমরা বাংলা ভাষা ব্যবহার করি। মনের কষ্ট, আনন্দ প্রকাশ করি নিজের ভাষায়।


আর কথা বলার স্বাধীনতার কথা যদি বলি, নিশ্চয়ই আমাদের পত্র-পত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশনের কথা বলতে হবে। আমরা এখন অকপটে সব বলতে পারি। আমাদের সংবাদ মাধ্যমগুলো অবাধে সংবাদ প্রচার করতে পারে। রাজনীতিবিদগণ মাঠেঘাটে সবখানে তাদের নিজেদের কথা, দাবি-দাওয়া প্রকাশ করতে পারে। যা পাকিস্তান আমলে ভাবাও যেত না।


আচ্ছা গান গাইতে বারণ- এমন কথা কি এখন কেউ ভাবতে পারে? কিন্তু পাকিস্তান আমলে আমাদের এমন বাঁধাও এসেছে। আমাদের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান গাওয়া যাবে না, পাকিস্তান আমলে এমন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। আমি বাংলায় কথা বলি, রবীন্দ্রনাথ আমার বাংলার কবি, অথচ তাঁর গান গাওয়া যাবে না, এমনটাও হয়েছিল এই দেশে। আর সেই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল পাকিস্তান সরকার।


ওই যে শুরুতে বলছিলাম কাগজের কথা, এখনকি আমাদের কাগজ বিদেশ ঘুরে আমাদেরই হাতে আসে। বিষয়টা খুলে বলি- পাকিস্তানের সব কাগজই আমরা উৎপাদন করতাম। অর্থাৎ বাংলাদেশে উৎপাদিত কাগজ দিয়ে পুরো পাকিস্তান চলত। এই কাগজ কিন্তু চন্দ্রঘোনা কিংবা খুলনা থেকে সরাসরি আমরা বাজারে নিতে পারতাম না। এই কাগজ নিয়ন্ত্রণ হতো পাকিস্তানের করাচি হতে। ২৫ তা কাগজ আমরা কিনতাম ১২ আনায়, অথচ ওরা সেই কাগজ পেত ১০ আনায়। এখনকার সঙ্গে যদি তুলনা করি, তাহলে কী বলব? আমরা কাগজ উৎপাদন করি, আমরা বাজারে বিক্রি করি, আমরাই ব্যবহার করি। আমাদের মাঝখানে আর কোনো দেশ নেই, যে আমাদের শিল্পকারখানা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।


আসলে কাগজের কথা বলা হলো একটা উদাহরণ দেওয়ার জন্য। আরেকটা উদাহরণ দেই। এক সময় পৃথিবীর সেরা পাট উৎপাদনকারী দেশ ছিলাম আমরা। পাকিস্তানি ব্যবসায়ীরা করল কী, সেই পাট ওদের দেশে নিয়ে যেতে শুরু করল। ওদের দেশে পাটকল স্থাপন করল। আর আমাদের এখান থেকে পাট নিয়ে তাদের কারখানাগুলো চালাতে শুরু করল। তাতে কী হলো, আমাদের শ্রমিকদের কাজের সুবিধা হারাতে হলো। শুধু কি তাই? কিছু পাঠকল এই দেশেও হলো। আর সেই পাটকলগুলোর মালিকও হলো ওদের দেশের মানুষ। আমাদের সুযোগ দেওয়া হলো না। আর ব্যবসা করে যে টাকা মুনাফা পেত, তার পুরোটাই তারা নিয়ে যেত তাদের দেশে। সামান্য কিছু মানুষ শ্রমিক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেলেও তাদের মজুরি দেওয়া হতো অতি সামান্য। অবস্থাটা কী ছিল? আমাদের দেশের কৃষক পাট ফলাত আর ফল ভোগ করত ওরা।


আর ওই যে অফিস-আদালতে চাকরি সুবিধার কথা বলছিলাম। আমাদের দেশের অফিস-আদালত, অথচ আমাদের লোকজনকে চাকরি করতে দেওয়া হতো না। একটা উদাহরণ দেই। সরকারি কর্মকর্তাদের সবচেয়ে বড় পদ হচ্ছে সচিব। সেই সচিব ছিল


সবাই পাকিস্তানি। বাঙালিকে সচিব হতে দেওয়া হতো না। - তাদের চাকরিই দেওয়া হতো খুবই কম। আর যারা চাকরি পেত, তাদেরও পদোন্নতি দেওয়া হতো না। পিওন থেকে শুরু করে - সচিব পর্যন্ত প্রায় সবাই ছিল পাকিস্তানি। সেনাবাহিনীর কথা বলি- আমরা ছিলাম পাকিস্তানের অর্ধেক জনসংখ্যা। অথচ পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ১০০ জনের মধ্যে মাত্র ১০ জন ছিল বাঙালি। কলকারখানাগুলোতেও একই অবস্থা।


আর আজকে? অফিস-আদালত-সেনাবাহিনী সবখানে শুধুই বাঙালি। পাকিস্তানিরা নেই, নেই অন্য দেশেরও কোনো মানুষ। ওই সময় বড় বড় অফিস-আদালত সবই ছিল পাকিস্তানে। এখন সবই আমাদের দেশে। একটা উদাহরণ দেই, আমাদের দেশ নদীমাতৃক। আমাদের ছেলেরা নদীতে-বিলেঝিলে সাঁতার কেটে বড় হয়। বলতে গেলে আমাদের গভীর সম্পর্ক নদী-সাগর-বিলের সঙ্গে। অথচ নৌবাহিনীর সদর দফত নৌপরিবহনের সদর দফতরও ছিল পাকিস্তানে।

আরো পড়ুন:

আর এখন? সব সব অফিস-আদালত আমাদের দেশে সমুদ্রবন্দর, নদী, বন্দর সবই আমাদের এখান পরিচালনা হয়। যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এমন প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা এগিয়ে আছি। সেটা হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা পাওয় কারণে। আমাদের মানুষেরা পরিশ্রম করে তাদের ভাগ্য পরিব করেছে। আমরা এখন পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে সব দিক দিয়েই এগিয়ে গেছি। যে পাকিস্তান আমাদের সবকিছু কেড়ে নিয়েছিল, আমাদের দেশকে তাদের কলোনি বানিয়েছিল, সেই পাকিস্তান এখন আফসোস করে বলে- হায় খোদা, তুমি আমাদের বাংলাদেশ বানিয়ে দাও। ওরা হা করে তাকিয়ে আছে, আর বাংলাদেশ তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে।


এতক্ষণ তো বাংলাদেশের অতীত আর বর্তমানের কথা বললাম, পরিবর্তনের কথা বললাম, বাঙালির ভাগ্য উন্নয়নের কথা বললাম। এই পরিবর্তন অর্থাৎ স্বাধীনতা আর স্বাধীনতার সুফল কি এমনি-এমনিই হয়ে গিয়েছে? সবাই বলবে- অবশ্যই সেটা আমাদের অর্জন করতে হয়েছে। তাই তো সত্য। তাহলে অর্জনটা হলো কী করে?


সবাই জানি বাঙালি সংগ্রাম করে, লড়াই করে স্বাধীনতা পেয়েছে। তার জন্য জীবন দিতে হয়েছে। পাকিস্তানিদের বাংলা থেকে তাড়াতে হয়েছে। তার জন্য গোটা বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। তার মধ্যমণি ছিল কে? কার নেতৃত্বে মানুষ এত বড় ত্যাগ স্বীকার করল? এটাও আমাদের জানা- একজন মহান ব্যক্তি আমরা পেয়েছিলাম হাজার বছরের মধ্যে। যিনি নির্দেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাখ লাখ মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে। জীবন দিতেও দ্বিধা করেনি। সেই মহামানব হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। আমাদের জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধু।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url