যুলম-নির্যাতন রোধ সংক্রান্ত হাদিস সম্পর্কে বিস্তারিত

 

 অত্যাচারী ও অত্যাচারিতকে কিভাবে সাহায্য করা যায় তার বিধান অন্যায়ভাবে কারো সম্পদ আত্মসাৎ করার পরিণতি যুলম-নির্যাতনকারী এবং সম্পর্ক ছিন্নকারীর পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।


ভূমিকা 

মুসলমানগণ পরস্পর ভাই ভাই। তারা পরস্পরে মিলেমিশে বসবাস করবে। এক মুসলমান তার অপর মুসলমান ভাইয়ের উপর অত্যাচার করতে পারে না। অথবা তাকে শত্রুর নিকটও সোপর্দ করতে পারে না। এটা মুসলমানের আদর্শ নয়। সর্বদা মুসলমান ভাইয়ের সাহায্যে এগিয়ে আসা কর্তব্য। তাহলেই আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যাবে। অতএব, আল্লাহ আমাদের এ হাদীসের শিক্ষা গ্রহণ করে তা জীবনে অনুশীলনের তাওফীক দান করুন।

 হযরত জাবির (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: তুমি তোমার ভাইকে অত্যাচারী ও অত্যাচারিত উভয় অবস্থায় সাহায্য কর। যদি সে অত্যাচারী হয়, তবে তাকে অত্যাচার করা থেকে বিরত রাখ এবং যদি সে অত্যাচারিত হয়, তবে তাকে সাহায্য কর। (আদ-দারিমী)

ব্যাখ্যা

সুনান আদদারিমীতে সংকলিত এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা) যালিমকে যুলম থেকে বিরত রেখে এবং মজলুমকে যালিমের অত্যাচার থেকে রক্ষা করে সাহায্য করতে বলেছেন। 

এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নির্দেশ হচ্ছে- কোন লোক অত্যাচার করলে তাকে যথা শক্তি প্রয়োগে প্রতিরোধ কর, তাকে যুলম ও অত্যাচার করতে দিওনা। মযলুম বা অত্যাচারিত ও উৎপীড়িত ব্যক্তিকে অত্যাচারীর কবল থেকে রক্ষা কর। আসলে যুলম একটি অন্যায় ও জঘন্য অপরাধ যা ইসলামী জীবন দর্শনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সুতরাং কোন ব্যক্তি যদি কারো প্রতি কোনরূপ যুলম ও অত্যাচার করে তবে আমাদের উচিত অত্যাচারীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাধা দেয়া। অত্যাচারিত ব্যক্তিকে প্রয়োজনমত যথাসাধ্য সাহায্য করা।

এজন্যই হাদীসে বলা হয়েছে- অত্যাচারী ব্যক্তি যদি আপন ভাইও হয়, তবু তাকে বাধা দিতে হবে। অত্যাচার করা থেকে যে কোন উপায়েই হোক না কেন, তাকে বিরত রাখতে হবে। তাকে প্রতিরোধ করতে হবে। কেননা যে অন্যায় করে এবং যে অন্যায় সহে উভয়ই সমঅপরাধী। যেমন কবির ভাষায়-

অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে

তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে।

কেননা যুলম ও অত্যাচার চলতে থাকলে সে সমাজে বাস করা জাহান্নামে বাস করার মতই অসহনীয় হয়। আর এটা সমাজ সভ্যতা বিকাশের পরিপন্থীও বটে। সুতরাং সমাজ থেকে এরূপ জঘন্য ও গর্হিত কাজ যা মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) মোটেই পছন্দ করেন না চিরতরে দূর করে দিতে হবে। প্রয়োজনে কঠোর থেকে কঠোরতম পন্থা অবলম্বন করে যুলম মুক্ত সমাজ গঠন করতে হবে। অতএব আলোচ্য হাদীসের মাধ্যমে আমরা

কারও প্রতি যুলম করা থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে অঙ্গীকার করি।

অত্যাচারী বা যালিমকে অত্যাচার করতে দেয়া যাবে না। সম্ভব হলে শক্তি প্রয়োগ করে জুলম-নির্যাতন বন্ধ করার প্রত্যয় গ্রহণ করি।

অত্যাচারীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা মুসলমানদের নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে আমরা প্রতিটি মানুষকে একাজে উদ্বুদ্ধ করি।

 অত্যাচারীকে যুলম থেকে বাধা দিয়ে সৎপথে নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজনীয় চেষ্টা করতে সমাজের সকলে এগিয়ে আসি।

মজলুম বা অত্যাচারিতের পক্ষাবলম্বন করে প্রত্যেকে ঈমানী দায়িত্ব পালন করি। 

 মজলুম মানবতার অধিকার আদায়ে সোচ্চার হওয়া ও তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসা ইসলামী আদর্শের অংশ হিসেবে দায়িত্ব পালন করি।

অন্যায়ভাবে ও জুলুম করে কারো জমি দখল করার শাস্তি

হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে এক বিঘত পরিমাণ জমি দখল করবে তার গলায় সাত তবক জমি ঝুলিয়ে দেয়া হবে। (বুখারী ও মুসলিম)

ব্যাখ্যা

মুসলমান একজন অন্যজনকে সম্মান করবে। কোন প্রকার বিরোধীতা করা বা শত্রুতা পোষণ করা বা ষড়যন্ত্র করা এবং অন্যায়ভাবে পর সম্পদ গ্রাস করা থেকে বিরত থাকবে। আলোচ্য হাদীসে মহানবী (সা) অন্যায়ভাবে কারো ভূমি তথা সম্পদ আত্মসাৎ করার পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন- যে ব্যক্তি এভাবে এক বিঘত পরিমাণ জমি অন্যায়ভাবে দখল করে অথবা সীমানা অন্যের জমির ভিতর ঢুকিয়ে দেয় অথবা আইল কেটে নিজের জমির ভিতর নিয়ে নেয় অথবা জোরপূর্বক দখল করে নেয় অথবা কোন প্রাকৃতিক কারণে আইল ভেঙ্গে নিজের জমির সাথে মিশে যায় এতে সে ব্যক্তি নিজ খুশীতে তা নিয়ে নেয় এবং মালিককে তা ফেরত দেওয়ার ইচ্ছা করে না। নিশ্চয়ই কিয়ামত দিবসে এ ধরনের অন্যায়, যুলম ও অবৈধ দখলের জন্য তাকে অভিযুক্ত করা হবে এবং তাকে সে জমি বহন করতে দেয়া হবে। সাত তবক জমি বা সম পরিমাণ জমির গভীরতা ও ভার তার গলার উপর ঝুলিয়ে দেয়া হবে। আর তাকে বলা হবে যে, এ শান্তি তোমার গাদ্দারীর জন্য। অন্যায়ভাবে অপরের জমি আত্মসাৎ করার পরিণতি আজ গলায় ধারণ কর যাতে লোকেরা তা দেখতে পায়। অন্যায়ভাবে কারো সম্পদ ভোগ করার পরিণতি আজ ভোগ কর, অন্যের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন না করে যুলম করার পরিণাম ভোগ কর। অবৈধ পন্থায় কারো জমি কর্তন করার পরিণতির শাস্তি আজ ভোগ কর। এখানে উল্লেখ্য যে, কারো জমি থেকে নিজ প্রয়োজনে মাটি কেটে আনার অধিকারও ইসলাম অন্যকে দেয়নি। মাটি কেটে আনতে হলে অবশ্যই জমির মালিকের অনুমতি লাগবে। অতএব, মুসলিম সম্প্রদায় হিসেবে আমাদের কর্তব্য হল- অন্যায় ও যুলমের মাধ্যমে আমরা অন্যের জমি কর্তন করব না। যাতে করে হাদীসে বর্ণিত শাস্তি আমাদের গ্রাস না করতে পারে এবং কিয়ামত দিবসে সাত তবক জমি কাঁধে বহন করে আমাদেরকে মানুষের সামনে দিয়ে চলতে না হয়। যদি কেউ কারো সম্পদ আত্মসাৎ ও অবৈধভাবে দখল করে অথবা কারো জমি কর্তন করে নেয় তাহলে মুসলিম ভাইদের উচিত তারা যেন তাকে মালিকের কাছে তা ফেরত দেয়ার জন্য উপদেশ ও পরমর্শ প্রদান করে। যাতে করে মুসলিম সমাজে যুলম, নির্যাতন বন্ধ থাকে এবং ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট না হয়। সমাজের প্রতিটি মানুষ পরস্পর ভাই ভাই হিসেবে নিরাপদে বসবাস করতে পারে। আল্লাহ তাআলা হাদীসে কুদসীতে বলেছেন-

হে বান্দাগণ। আমি নিজের উপর যুলম করাকে নিষিদ্ধ ও হারাম করেছি এবং তোমাদের পরস্পরের মধ্যেও বুলমকে হারাম করে দিয়েছি। সুতরাং তোমরা পরস্পরে যুলম করবে না। 

আলোচ্য হাদীস থেকে একথাই প্রতীয়মান হয় যে,

এক মুসলমান উপর অপর মুসলমানের প্রতি যুলুম করা হারাম। যদি কোন ব্যক্তি অন্যায় করে এক বিঘত পরিমাণ জমি দখল করে নেয় তাহলে কিয়ামতের দিন সাত তবক জমি বা তার সমপরিমাণ ভার উক্ত ব্যক্তির গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে। সমাজের মানুষ যদি একে অন্যের উপর যুগ্ম করা থেকে বিরত থাকে তাহলে সমাজের প্রতিটি মানুষের মধ্যে ভালবাসা ও ঐক্য বিরাজ করবে।

যুলুম ও নির্যাতন এবং সম্পর্ক ছিন্নকারীর পরিণতি

হযরত আবু বাকরা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: যুলম ও নির্যাতনকারী এবং রক্ত সম্পর্ক ছিন্নকারী ব্যক্তি থেকে অধিক গুণাহকারী আর কেউ হবে না, যাদেরকে আল্লাহ দুনিয়া এবং আখিয়াতে শান্তি দান করবেন। (আবু দাউদ)

ব্যাখ্যা

প্রত্যেক পাপই নিকৃষ্ট এবং ঘৃণিত, কেননা তা মানুষের জন্য দুনিয়া এবং আখিরাতে শান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শাস্তির দিক থেকে সবচেয়ে কঠিন পাপ যা দুনিয়াতে দ্রুত নিপতিত হবে এবং পরকালেও ভয়ানক শাস্তি দেয়া হবে তা হচ্ছে মানুষের উপর যুলম নির্যাতন এবং রক্ত সম্পর্ক ছিন্ন করা। সত্যের সাধক মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) এ সংবাদ প্রদান করেছেন। নিশ্চয় যারা মানুষের উপর নির্যাতন ও যুগ্ম করবে এবং যারা মা-বাবাকে কষ্ট দেবে এবং রক্ত সম্পর্ক ছিন্ন করবে আর তাদের সাথে কোনরূপ সুন্দর আচরণ করবে না, মা-বাবার প্রতি ইহসান করার জন্য আল্লাহর নির্দেশ ভুলে যাবে দুনিয়াতে অতি সত্তর আল্লাহর শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করবে এবং আখিরাতেও তারা আল্লাহর নির্ধারিত শাস্তি ভোগ করবে। সুতরাং মুসলিম ভাইদের উচিত তারা যেন মাতা-পিতার সাথে সুন্দর আচরণ করে এবং তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখে, তারা কখনও সমাজে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টির পায়তারা না করে তাহলে তারা এ কঠিন শাস্তি থেকে রক্ষা পাবে। তাদের জন্য পরিবারে এবং সমাজে উচ্চ স্থান নির্ধারিত হবে। এ সকল লোকই আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের কামনা করতে পারে যারা মাতা-পিতার প্রতি সদাচারণে গুরুত্বারোপ করে, রক্তের সম্পর্ক স্থায়ী রাখে এবং ঔদ্ধতা প্রকাশ ও যুলম থেকে বিরত থাকে। আমাদের দুনিয়াতে শান্তি এবং পরকালে মুক্তির জন্য যুলম নির্যাতন, রক্ত সম্পর্ক ছিন্ন করা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকতে হবে। তাহলে কাংখিত ফল লাভ সম্ভব হবে।


যুলম সম্পর্কিত অপর একটি হাদীস এখানে উল্লেখ করা হল-

হযরত ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) ঘোষণা করেছেন, এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। সে তাকে অত্যাচারও করবে না এবং তাকে শত্রুর নিকট সমর্পণও করবে না। আর যে ব্যক্তি তার কোন মুসলমান ভাইয়ের প্রয়োজনে এগিয়ে আসে, আল্লাহ তার প্রয়োজনে এগিয়ে আসেন। (বুখারী ও মুসলিম)

ব্যাখ্যা ও শিক্ষা

বুখারী শরীফের এ হাদীসে মহানবী (সা) মুসলমানগণের পরস্পরের সম্পর্ক এবং তাদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। 

রাসূলুল্লাহ (সা) মুসলিম উম্মাহকে লক্ষ করে ঘোষণ করেছেন যে- মুসলমানগণ পরস্পর ভাই ভাই। মুসলমান ভাইয়ের কর্তব্য হল আরেক ভাইকে সকল বিপদাপদে সাহায্য-সহযোগিতা ও সহানুভূতি প্রদর্শন করা। শত্রুর আক্রমণ ও আঘাত থেকে সর্বদা রক্ষা করা।

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ এ মর্মে ঘোষণা করেন:

 মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমাদের ভাইদের মধ্যে শান্তি স্থাপন কর। (সূরা আল-হুজুরাত)

কোন মুসলমান অপর মুসলমানকে কোনরূপ অত্যাচার করতে পারবে না। যত বড় মারাত্মক অপরাধই করুক না কেন। তাকে কোন অবস্থাতেই দুশমনের হাতে ছেড়ে দেয়া যাবে না।

 আপন ভাইয়ের বিপদের সময়ে ভাই যেমন সাহায্য করতে এগিয়ে এসে, তেমনি এক মুসলমান ভাইও অপর মুসলমান ভাইয়ের বিপদে-মুছিবতে সম্ভাব্য সকল উপায়ে তার সাহায্যে এগিয়ে আস্য ঈমানী কর্তব্য। এ মর্মে রাসূল (সা) বলেন- আল্লাহ তাআলা ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁর বান্দার সাহায্য করতে থাকেন, যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার কোন মুসলমান ভাইয়ের সাহায্যে লিপ্ত থাকে। (মুসলিম) 

কাজেই আল্লাহ তাআলার সাহায্য পেতে হলে অপর মুসলমান ভাইয়ের সাহায্য করা কর্তব্য। এক মুসলমানের বিপদে অপর মুসলমান ভাইয়ের এগিয়ে না আসার কারণেই আজ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলমানগণ অত্যাচারিত, নিপীড়িত ও নির্যাতিত হচ্ছে। বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত হচ্ছে। স্বাধীনতা হারিয়ে পরাধীনতার লাঞ্ছিত জীবন অতিবাহিত করছে। যদি আল্লাহ ও রাসূলের (সা) নির্দেশ অনুযায়ী মুসলমানগণ নিজেদের ভোগ-বিলাস ও সংকীর্ণ স্বার্থ-চিন্তা পরিহার করে মুসলমান ভাইয়ের সাহায্যের জন্য জিহাদের ময়দানে অবতীর্ণ থেকো, তবে কোন জাতির পক্ষেই মুসলমানদের উপর অত্যাচার করা সম্ভব হত না। আর এ কারণেই আজ মুসলমানগণ আল্লাহর সাহায্য থেকে বঞ্চিত।

আল্লাহ হাফেজ***


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url