হাদীস সংরক্ষণ ও সংকলনের প্রয়োজনীয়তা হাদিস সংকলনের পদ্ধতি ও বিভিন্ন যুগের ধারণা

 হাদীস সংরক্ষণ ও সংকলনের প্রয়োজনীয়তা হাদীস সংকলনের পদ্ধতি বর্ননা হাদীস সংকলনের প্রথম যুগ সম্পর্কে ধারণাহাদীস সংকলনের বিভিন্ন যুগের বর্ণনা সম্পর্কে বিবরণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।


ভূমিকা 

হাদীস শাস্ত্র বা হাদীস সাহিত্য ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক মহৎ ভান্ডার। ইসলামী জীবন ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা ও অবকাঠামো এ হাদীস শাস্ত্রের ওপরই নির্ভরশীল। মানবতার মুক্তির দিশারী বিশ্বনেতা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জীবনাদর্শই হাদীস। হাদীস ইসলামী জীবন বিধানের দ্বিতীয় উৎস। কুরআনের পরেই এর স্থান। তবে কুরআন যেভাবে নাযিলের সময় নিয়মতান্ত্রিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়, হাদীস ঠিক তেমনিভাবে রাসূলের আমলে নিয়মিতভাবে লিপিবদ্ধ না হলেও উম্মতের নিয়মিত আমল, রাসূলের লিখিত ফরমান এবং সাহাবীদের স্মৃতিভান্ডার থেকে পরবর্তী সময়ে তা নিয়মিতভাবে এবং অতীব সতর্কতার সাথে সংরক্ষণ করা হয়।

তবে রাসূলের যুগে এমনকি খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগেও তা গ্রন্থাকরে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী পর্যায়ে হিজরী প্রথম শতকের শেষ দিকে সরকারী দিক-নির্দেশনায় এবং হাদীসবেত্তাদের সাধনায় ব্যাপকভাবে হাদীস সংগ্রহ ও সংকলন, গ্রন্থাবন্ধকরণ, শ্রেণীকরণ, যাচাই-বাছাই করণের কাজ সম্পাতি হয়। যার ইতিবৃত্ত সংক্ষিপ্তভাবে এখানে তুলে ধরা হল।

আরো পড়ুন: গিবত কি বিভিন্ন ধরনের গিবত ও গিবতের ক্ষতি সম্পর্কে বিস্তারিত

হাদীস সংরক্ষণ ও সংকলনের প্রয়োজনীয়তা

ইসলামী জীবন দর্শনে হাদীসের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অপরিসীম। এজন্য ইসলামের প্রাথমিক যুগ সংরক্ষণ ও সংগ্রহের ধারা চালু হয়। হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের কয়েকটি উদ্দেশ্য নিম্নরূপ-

হিদায়াতের উৎস

হাদীস জ্ঞান-বিজ্ঞান ও হিদায়াতের উৎস। মুসলিমগণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস ও হিদায়াতের অমর বাণী হিসেবে হাদীস সংগ্রহ ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করেন।

মহানবী (স)-এর ইনতিকাল

মহানবী (স)-এর জীবদ্দশায় তাঁর সমগ্র হাদীস পুস্তকাকারে সংকলিত হয়নি এবং এর প্রয়োজনও ছিল না। কেননা তখন উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে সরাসরি তিনিই সমাধান দিতেন। কিন্তু তাঁর ইনতিকালের পর নব উদ্ভূত পরিস্থিতি সমাধানের জন্য হাদীস সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

ইসলামের প্রসারতা লাভ

ঐতিহাসিক বাস্তবতার নিরিখে প্রতীয়মান হয় যে, মহানবী (স)-এর ইনতিকালের পর ইসলাম হয়ে উঠে দিগন্তবিস্তারকারী। মরু আরবের চৌহদ্দি পেরিয়ে তিনি তাঁর সাম্য ও শান্তি জ্যোতির বিচ্ছুরণ ঘটান দেশ হতে দেশান্তরে, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে। দেশে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী শাসন। আর এ ব্যাপক বিস্তৃতিই ইসলামী সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে সৃষ্টি করে ব্যক্তিগত, বৈষয়িক ও শাসনতান্ত্রিক জটিলতা। উদ্ভূত এ অবস্থার নিরসন কল্পে বিশুদ্ধ হাদীস সংগ্রহ ও সংকলন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠে।

জ্ঞান লাভ

মহানবীর (স) পর ইসলামের সম্প্রসারণের সাথে সাথে তাঁর সাহাবীগণ বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন ও বসতি স্থাপন করেন। ফলে এক এলাকায় বসাবাসরত রাবীর স্মৃতিতে রক্ষিত হাদীস সম্পর্কে অন্য এলাকার রাবীর অবহিত হওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। কাজেই সকল হাদীস সম্পর্কে সমগ্র বিশ্বের সব জায়গায় লোকদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান লাভের জন্য হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

শাসনতান্ত্রিক প্রয়োজন

ইসলামী হুকুমত সম্প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে রাজনৈতিক, শাসনতান্ত্রিক ও বিচার সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য কুরআনের পরই হাদীসের নির্দেশাবলীর প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হয়।

কুরআনের ব্যাখ্যায় মতপার্থক্য

মহানবী (স)-এর অবর্তমানে কুরআনের কোন কোন আয়াতের ব্যাখ্যায় সমস্যা দেখা দেয়। তা ছাড়া সাহাবীদের শাহাদতবরণ ও ইনতিকালে হাদীস অবলুপ্তির আশঙ্কা দেখা দেয়। সুতরাং হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে দেখা দেয়।

ভন্ড দলের আবির্ভাব

ইসলামের মধ্যযুগ তথা খিলাফতে রাশেদার শেষের দিকে বিশেষ কিছু স্বার্থান্বেষী ও ভ্রান্ত ধর্মীয় ফেরকার আবির্ভাব ঘটে। এদের মধ্যে খারেজী, রাফেজী, জাবরিয়া, কাদারিয়া ও মুতাযিলা সম্প্রদায় খুবই সক্রিয় ছিল। এসব ফেরকার লোকেরা হাদীসের ভুল ব্যাখ্যা বা নিজেদের স্বার্থে হাদীস রচনা করতো। এদের থেকে হিফাজতের জন্য হাদীস সংকলন করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে দেখা দেয়।

জাল হাদীস প্রতিরোধ

রাজনৈতিক ও দলীয় প্রয়োজনে ষড়যন্ত্রমূলক কিছু জাল হাদীস রচনা করে কেউ কেউ ফায়দা হাসিলের চেষ্টা চালাত। এদের থেকে সহীহ হাদীসকে সংরক্ষণ করার প্রয়োজনে এবং জাল হাদীস প্রতিরোধের জন্য হাদীস সংরক্ষণ করা জরুরী পয়ে পড়ে।

স্মরণ শক্তি হ্রাস

বয়োবৃদ্ধে এবং দুনিয়াবী ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় হাদীসবিদ সাহাবী ও তাবিঈগণের স্মরণ শক্তি ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। বস্তুত এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং তাঁরা সঠিক ও শুদ্ধ হাদীস সংরক্ষণের জন্য হাদীসকে লিখে রাখার প্রতি যতন্ত্রবান হন।

অনাগত উম্মাহর কাছে পৌঁছানো

বিদায় হাচ্ছে মহানবী (স) বলেছিলেন, "একটি বাক্য হলেও তোমরা তা পৌছে দাও। তোমরা উপস্থিত যারা তারা অনুপস্থিতদের কাছে আমার বাণী পৌছে দিও।" এসব হাদীসের প্রেক্ষাপটে হাদীসবেত্তাগণ হাদীস সংকলন করে অনাগত মানুষের কাছে পৌছে দেয়ার ব্যবস্থা করেন।

উপর্যুক্ত পরিস্থিতি বিবেচনায় খ্যাতনামা রাবী ও মুহাদ্দিসগণ হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনে অবিশ্রান্ত সাধনা ও প্রয়াস চালান এবং চিরদিনের জন্য হাদীস সংকলন ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

আরো পড়ুন: পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের গুরুত্ব সালাত আদায় না করার পরিণতি ও ফরজ হওয়ার ইতিহাস 

হাদীস সংরক্ষণের পদ্ধতি

মুসলিম উম্মাহ হাদীস সংরক্ষণের জন্য প্রধানত চারটি পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন-

  •  হাদীস মুখস্থকরণ,
  •  হাদীসের লিখন,
  •  হাদীসের আমল ও জীবনে বাস্তবায়ন।
  •  হাদীসের শিক্ষাদান,

মহানবী (স) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে হাদীস সংকলিত না হওয়ার কারণ

ইসলামী জীবন বিধানের যাবতীয় সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানকল্পে পবিত্র কুরআনে হাকীমের পরবর্তী স্থান আল-হাদীসের যা মহানবী (স) এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে সংকলের প্রয়োজন পড়েনি। পরবর্তী সময়ে নির্ভুল তত্ত্ব ও তথ্যের মাধ্যমে হাদীস সংরক্ষিত হয়। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) ও সাহাবায়ে কেরামের সময় হাদীস শাস্ত্র সংকলিত না হবার যেসব যৌক্তিক কারণ রয়েছে তা হল-

মহানবী (স)-এর নিষেধাজ্ঞা

মহানবী (স) নিজেই ঘোষণা করেছিলেন।

"তোমরা আমার থেকে কিছু লিখে রেখো না, আর যদি কেউ কুরআন ব্যতীত অন্য কিছু লিখে রেখে থাক, তাহলে তার উচিত তা মুছে ফেলা।"

সাহাবীগণের প্রখর স্মৃতিশক্তি

সাহাবীগণের স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর। তাঁরা শ্রবণ করেই তা অনেক দিন যাবত সরাসরি মুখস্থ রাখতে পারতেন। তাই হাদীস সংকলন প্রয়োজন পড়েনি।

কুরআন ও হাদীস একত্রিত হবার আশংকা

মহানবী (সা)-এর উপর কুরআন মাজীদ নাযিল হতো। আর পবিত্র কুরআন তখন লিপিবদ্ধ করা হচ্ছিল। তাই হাদীস লিখে রাখলে কুরআনের সাথে মিলে যেতে পারে এ ভয়ে হাদীস গ্রন্থাকারে সংরক্ষণ করা তখন নিষেধ ছিল।

উপকরণের অপ্রতুলতা

মহানবীর (স) আমলে লেখার প্রায়োজনীয় উপকরণ ছিল খুবই কম। এছাড়াও লেখার পদ্ধতি ছিল অনুন্নত। পাথরে খোদাই করে লিখন পদ্ধতি কিংবা হাড়-বাকল পাতায় লিখার চেয়ে তাদের কাছে মুখস্থকরণ পদ্ধতি সহজ হওয়ায় সাহাবাগণ হাদীস সংরক্ষণ করার পরিবর্তে মুখস্থ করে রাখতেন।

লেখকের সংখ্যায়তা

লেখার উপকরণের অপ্রতুলতার মতই তখনকার সময়ে লেখকেরও অভাব ছিল। তাই যেসব লেখক ছিলেন তাঁরা কুরআন লিখনের কাজে ব্যস্ত থাকায় হাদীস সংকলন করেননি।

বাতিল সম্প্রদায়ের অধিকার

সাহাবায়ে কিরামের যামানার শেষের দিকে খারেজী, রাফেজী মু'তাযিলা ও বিদ'আতী প্রভৃতি মতবাদের উদ্ভব হলে তারা অনেকেই মহানবীর (স) হাদীসে পরিবর্তন এনে হাদীস বর্ণনা শুরু করেন। এহেন যুগসন্ধিক্ষণে হাদীসের সত্যাসতা নির্বাচন একান্ত জরুরী হয়ে পড়ে। এ সময়ও বেশ কিছু সাহাবী জীবিত ছিলেন। তাঁদের থেকেই সঠিক হাদীস সংরক্ষণ কর্ম শুরু হয়।

সর্বপ্রথম হাদীসশাস্ত্র সংরক্ষণ ও গ্রন্থায়নের মহৎ কাজে কে এগিয়ে এসেছেন তা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রা) ও হযরত রাফে ইবনে খাদীজ (রা) প্রথম হাদীস সংরক্ষণ করার ব্যাপারে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা সহকারে কাজ শুরু করেন। এ সময় অনেক সাহাবীই হাদীস সংরক্ষণে আপন শক্তি বায় করেন। এভাবে হিজরী প্রথম শতকের শেষের দিকে হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয (র) তাঁর খিলাফতকালে মদীনার কাযী ইবনে হাজমকে হাদীস সংরক্ষণ ও গ্রন্থায়নের নির্দেশ প্রদান করেন।

এ সময় থেকে প্রধানত হাদীস লিখন শুরু হয়। এদিক থেকে হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয ছিলেন প্রথম হাদীসের সংগ্রাহক আর ইবনে শিহাব যুহরী ছিলেন হাদীস সংরক্ষণের প্রথম রূপকার।

হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয়ের ইন্তেকালের পর হাদীস সংরক্ষণের কাজ আরো বেগবান হয়। গ্রন্থবদ্ধ হয় মহানবীর হাদীসের অমর বাণী, যা আমাদের জীবন বিধানকে ইসলামী মূল্যবোধের স্বর্গীয় ছাঁচে গড়ে তুলতে অতুলনীয় মাধ্যম।

আরো পড়ুন: পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ অঙ্গ, কীভাবে পবিত্রতা অর্জন করবেন সেই সম্পর্কে ব্যাখ্যাসহ বিস্তারিত 

হাদীস সংরক্ষণ ও সংকলনের ক্রমবিকাশের ইতিবৃত্ত

প্রথম যুগ : রাসুলুল্লাহ (স)-এর নবুওয়াত প্রাপ্তি থেকে হিজরী প্রথম শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত (মোট ১১২ বছর)।

মহানবী (স) -এর জীবদ্দশায় 

মহানবী (স) তাঁর মন্ত্রী জীবনে কুরআনের সাথে হাদীসের সংমিশ্রণের আশংকায় সাময়িকভাবে হাদীস লিখে রাখতে নিষেধ করেছিলেন। এ কারণে তাঁর সময়ে কুরআন যেভাবে লিখিত হত হাদীস সেভাবে লেখা হতো না। তবে মাদানী জীবনে এসে তিনি তাঁর নিষেধাজ্ঞা শিখিল করেন। এ সময় অনেক বড় বড় সাহাবী, বিশেষত যাঁরা উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন তাঁরা হাদীস লিখে রাখতেন। তাঁর সময়ের কয়েকটি হাদীস গ্রন্থ হচ্ছে-

(ক) আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা)-এর সাহীফাহ্ সাদিকাহ। এটা ছিল সহস্র হাদীসের এক অনবদ্য সংকলন।

(খ) আবু শাহ ইয়ামানীকে রাসূল (স)-এর আদেশে হাদীস লিখে দেওয়া হয়।

(গ) হযরত আলী (রা)-এর নিকট হাদীসের সংকলন ছিল। এর মধ্যে ছিল যাকাত, দন্ডবিধি, হারামে মদীনা এবং বিভিন্ন ফরমান, বিভিন্ন রাজা বাদশাহের কাছে প্রেরিত চিঠিপত্র ও দাওয়াতনামা।

এছাড়া এ সময়ে হাদীস শাস্ত্রের চর্চা হতো নিলিখিত পদ্ধতিতে-

(ক) স্মৃতিভান্ডারে সংরক্ষণ তথা কন্ঠস্থ করে একে অপরের কাছে পৌঁছান।

(খ) হাদীসের শিক্ষাদান ও পঠন-পাঠন।

(গ) দৈনন্দিন জীবনে হাদীসের আমল ও বাস্তবায়ন।

(ঘ) বিভিন্ন বিষয় সম্বলিত হাদীসের ব্যক্তিগত সংকলন।

এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলের (স) যুগেই হাদীস সংরক্ষণ ও গ্রন্থায়নের ক্রমবিকাশের ধারা শুরু হয়।

খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে

রাসূলুল্লাহ (স)-এর অবর্তানে খোলাফায়ে রাশেদীন মুসলিম জাহানের নেতৃত্ব দেন। তাঁদের আমলে পবিত্র কুরআন গ্রন্থাবন্ধকরণের কাজ সম্পন্ন হয়। এ সময়ে হাদীস সংরক্ষণ ও সম্পাদনার কাজ রাষ্ট্রীয়ভাবে না হলেও সাহাবায়ে কিরাম স্ব স্ব উদ্যোগে হাদীস শাস্ত্রের ব্যাপক চর্চা, শিক্ষাদান, বাস্তবসম্মত পঠন-পাঠনের মাধ্যমে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে তা বাস্তবায়নের ধারায় হাদীস শাস্ত্রের ব্যাপক উন্নতি ও উৎসর্ক সাধিত হয়।

(ক) প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর (রা) পাঁচশত হাদীসের এক সংকলন করেন। কিন্তু তিনি তা কুরআনের সমতুল্যতা কিংবা ভুল-ভ্রান্তির আশংকায় বিনষ্ট করে ফেলেন।

(খ) দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর (রা) নিজে বহু হাদীস সংগ্রহ ও সংকলন করে বিভিন্ন রাজ্যে প্রেরণ করেন। তা ছাড়া হাদীস ব্যাপক বিকাশের লক্ষে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন কেন্দ্রে ও বিভিন্ন দেশে সাহাবীদের প্রেরণ করেন।

(গ) তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান (রা) ছিলেন খুবই সতর্ক ব্যক্তি। তিনি নিজে কিছু হাদীস বর্ণনা করেছেন। তবে তিনি পবিত্র কুরআনের বিশুদ্ধ গ্রন্থায়ন কর্ম নিয়ে বেশি ব্যস্ত ছিলেন। তা ছাড়া হাদীসে যদি কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে যায় সে আশংকায় বেশি হাদীস বর্ণনা করতেন না বা লিখে রাখতেন না। তবে তাঁর সময়ে অন্যান্য হাদীস বিশারদ সাহাবীগণ হাদীস চর্চায় ব্যাপকভাবে ব্যাপৃত ছিলেন।

(ঘ) চতুর্থ খলীফা হযরত আলী (রা) স্বয়ং রাসূলের কাছ থেকে হাদীস লিখে রাখতেন। তাঁর হাদীস সংকলনের নাম ছিল 'সহীফা'। এতে বিভিন্ন আহকাম ও রাষ্ট্রীয় ফরমান সন্নিবেশিত ছিল।

সাহাবায়ে কিরামের যুগে হাদীস চর্চার বিকাশ

খোলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবায়ে কিরামের যুগে হাদীস শাস্ত্র নিয়মিতভাবে গ্রন্থাবদ্ধ করার কাজ শুরু না হলেও আসলে যেসব সাহাবায়ে কিরামের কাছে হাদীস লিখিত আকারে ছিল না, তাঁরা এবং বয়োজ্যেষ্ঠ তাবিঈগণ তাঁদের জানা হাদীসগুলো লিখে ফেলেন এবং সেগুলোর পঠন-পাঠনের সিলসিলা চলতে থাকে। এ সময় হাদীস চর্চা চলছিল এভাবে-

(ক) ব্যাপক মুখস্থকরণ

(খ) হাদীসের ব্যাপক পঠন-পাঠন ও শিক্ষাদান

(গ) হাদীসের উপর বাস্তব আমল এবং

(ঘ) ব্যক্তিগত উদ্যোগে ব্যাপকভাবে হাদীস লিপিবদ্ধকরণ

দ্বিতীয় যুগ: হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দী। হাদীস সংরক্ষণ ও সংকলন

এ যুগ তাবিঈ ও তাবে তাবিঈনের যুগ। দ্বিতীয় হিজরী শতকের শুরু থেকে হাদীস সংকলনের প্রচেষ্টা একটা নতুন মোড় নেয়। তাবিঈগণের একটা বিরাট দল হাদীস শাস্ত্রের সংকলনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁরা সাহাবী ও বয়োজ্যেষ্ঠ তাবিঈগণের লিখিত হাদীসসমূহকে একত্র করতে থাকেন ব্যাপকভাবে। হাদীস সংকলনের এ ধারা চলে প্রায় হিজরী দ্বিতীয় শতকের শেষ পর্যন্ত। এ সময়ে হাদীসের ব্যাপক চর্চার ধারাটি ক্রমোন্নতির পথে অমসর হতে থাকে।

রাষ্ট্রীয় নির্দেশনায় হাদীস শাস্ত্রের ক্রমবিকাশ

উমাইয়া খলীফা খোলাফায়ে রাশেদার পঞ্চম খলীফা নামে খ্যাত হযরত উমার ইবনে আবদুল আযীয (র) হাদীস শাস্ত্র গ্রন্থায়নের লক্ষে সরকারী ফরমান জারি করেন। এ রাষ্ট্রীয় নির্দেশের ফলে হাদীস শাস্ত্রের সংগ্রহ ও গ্রন্থায়নের প্রবাহ তরঙ্গায়িত হয়ে উঠেছিল। তারপর তা কয়েক শতাব্দীকাল অব্যাহত থাকে। ফলে হাদীস শাস্ত্রের বিভিন্ন গ্রন্থ রাজধানী দামেশকে পৌঁছতে থাকে। খলীফা সে-গুলোকে কপি করে সমগ্র ইসলামী বিশ্বে ছড়িয়ে দেন।

এ যুগে হাদীস শাস্ত্রের প্রায় অর্ধশত গ্রন্থ সংকলন করা হয়। এর মধ্যে প্রসিদ্ধ হাদীসের সংকলন হচ্ছে

  •  মুআত্তা ইমাম মালিক
  •  জামে সুফিয়ান আস সাওরী
  •  জামে ইবনে মুবারক
  •  জামে ইমাম আওজায়ী
  •  জামে ইবনে জুরাইয
  • কাযী আবু ইউসুফের কিতাবুল খারাজ
  •  ইমাম মুহাম্মদের কিতাবুল আসার
  • ইমাম শাফিয়ীর কিডাবুল উম্ম ও মুসনাদ
  • ইমাম আবু হানীফার মুসনাদ
  • আবদুর রাজ্জাকের জামে
  • লাইস-এর মুসান্নাফ
  • ইমাম আহমদের মুসনাদ।

তৃতীয় যুগ: হিজরী তৃতীয় শতাব্দী: ক্রমবিকাশের স্বর্ণ যুগ

এটা হচ্ছে হাদীস সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও সংকলনের চরম উন্নতি ও পরিপূর্ণতার যুগ। এ যুগে এমন সকল হাফিযেষ হাদীসের জন্ম হয়, যাঁদের সমতুল্য দুনিয়া খুব কমই দেখেছে। এ যুগে হাদীস শাস্ত্র একটি পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞানের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এর এক একটি শাখা এবং বিভাগ সম্পূর্ণ ও স্বতন্ত্রভাবে গঠিত হয়।

এ শতাব্দীর মুহাদ্দিস ও হাদীস বর্ণনাকারীগণ হাদীসের অনুসন্ধানে জলে-স্থলে পরিভ্রমণ করেন। মুসলিম জাহানের প্রতিটি কেন্দ্রে এবং প্রতিটি অঞ্চলে হাদীসের খোঁজে হন্যে হয়ে বেড়িয়েছেন। এক একটি শহর, এক একটি গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত পৌছে বিক্ষিপ্ত সকল হাদীসকে একত্র করেন। এ যুগেই সিহাহ সিত্তাহ'র বিশ্ববিখ্যাত ছয়খানা হাদীস শাস্ত্রের মহাগ্রন্থ সংকলিত হয়।

এ যুগের হাদীস শাস্ত্রের আরও বিশেষ কাজগুলো হচ্ছে যাচাই-বাছাই করণ

হাত। পূর্বে হাদীসবিদগণ হাদীস যাচাই বাছাই না করে সহীহ ও দুর্বল সব হাদীসই প্রকাশ করেছিলেন। এ যুগে হাদীসমূহকে যাচাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ছাটাই বাছাই এবং সত্য-মিথ্যা নির্ধারণ করে তার আলোকে সমস্ত হানীস শাস্ত্রকে পৃথক করা হয়। এ কাজে আগ্রণী ভূমিকা পালন করেন বিশ্বনন্দিত হাদীস বিজ্ঞানী ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম আন-নিশাপুরী। এছাড়া শত শত হাদীসবিজ্ঞানীও তাঁদের সমগ্র জীবন এ কাজে ব্যয় করেন।

বিভিন্ন বিজ্ঞানের উদ্ভাবন

সহীহ হাদীস বাছাই ও হাদীস যথাযথভাবে সংরক্ষণের জন্য এ যুগে হাদীস বিজ্ঞানীগণ হাদীস শাস্ত্র সংক্রান্ত একশটিরও বেশি ইলম বা বিজ্ঞানের উদ্ভাবন করেন। যেমন ইলমে আরাহ্ ও তাদীল, ইলমে আসমাউর রিজাল এবং তানকীদ ফীল হাদীস ইত্যাদি।

বিষয়ভিত্তিক হাদীসের সজ্জায়ন

এ যুগে মুহাদ্দিসগণ ফিকহ শাস্ত্রের অধ্যায় অনুযায়ী হাদীস শাস্ত্রকে সংশ্লিষ্ট অধ্যায় ও পরিচ্ছেদে একত্রিত করেন।

জামে (বিশ্বকোষ) পদ্ধতি সংকলন

এ যুগেই হাদীস সাহিত্যকে জামে পদ্ধতিতে অর্থাৎ সিয়ার, আদাব তাফসীর, ফিতান, আকাইদ, আহকাম, আশরাজ, মানাকির সম্পর্কিত হাদীসমূহকে পৃথক পৃথক অধ্যায় ও পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত করা হয়

সহীহ ও সুনান পদ্ধতিতে সংকলন

এ যুগেই অত্যন্ত সতর্কতা ও কঠোর মানদন্ডে নিরূপন করে অগণিত হাদীস ভান্ডার থেকে সহীহ ও সুনান পদ্ধতিতে হাদীসের সংকলন করা হয়। সুনান ও সিহাহ সিত্তার হালীস গ্রন্থসমূহ যথা, সহীহ বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ ও আবু দাউদ শরীফ।

চতুর্থ যুগ: হিজরী চতুর্থ শতাব্দী ও তার পরবর্তী যুগ

এ অধ্যায়টি ছিল হাদীস শাস্ত্রের অলংকরণ, সংক্ষেপণ ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের যুগ। অবশ্য তৃতীয় শতাব্দীতেই হাদীস শাস্ত্রের পরিপূর্ণ রূপরেখা পূর্ণ পরিণতি লাভ করে। কাজেই চতুর্থ শতাব্দীতে সেই কাজের জের চলতে থাকে। হাদীস শাস্ত্রের কিছু স্বতন্ত্র গ্রন্থও এ শতকে প্রণীত ও সম্পাদিত হয়।

এভাবেই হাদীস সাহিত্যের অফুরন্ত বিশাল ভান্ডার জ্ঞান বিজ্ঞানের বিপুলায়তন সম্পদ রাশি সংকলিত ও সম্পাদিত হয়ে চিরদিনের জন্য সুরক্ষিত অবস্থায় আছে। পরবর্তী যুগসমূহে বিশেষত আজ পর্যন্ত এবং অনাগত যুগ পর্যন্ত (সেই বিপুলায়তন হাদীসের ভান্ডার থেকেই বিশ্ব মানবতা তাদের জীবন পথের দিশা গ্রহণ করে থাকবে।

সারকথা

নবুয়াতের প্রথম দিকে একমাত্র কুরআনুল কারীম ব্যতীত অন্য কিছু লিখে রাখার অনুমতি ছিলনা। শেষের দিকে অনুমতি দেওয়া হলে কাগজে কলমে কিছু কিছু লিপিবদ্ধ হলেও প্রচলিত নিয়মে পুরোপুরি হাদীস সংকলিত ও সংরক্ষিত হয়নি। এর পেছনে কয়েকটি কারণ নিম্নরূপ।

১। কুরআন লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষণ ব্যস্ততা।

২। কুরআন ও হাদীসের মাঝে সংমিশ্রণের ভয়।

৩। প্রাথমিক পর্যায়ে হাদীস লিখনে মহানবীর (স) নিষেধাজ্ঞা।৩

৪। তদানীন্তন আরবগণের স্মরণশক্তির প্রখরতা ও তীক্ষ্মতা।

৫। যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থাকায় সময়ের স্বল্পতা।

তবে হাদীস সংরক্ষণে অবশ্যই রাসূলুল্লাহ (স) প্রিয় সাহাবীগণকে উৎসাহিত করেন এবং তাঁরাও আল্লাহ প্রদত্ত স্মরণশক্তির উপর নির্ভর করে মুখস্থ করতেন। অবশ্য পরবর্তী সময় অনুমতি থাকায় কোন কোন সাহাবী বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কিছু হানীস লিপিবদ্ধ করেন। তবে সাহাবীগণের পারস্পরিক আলোচনা পর্যালোচনা ও অনুশীলনের কারণে হাদীস অলিখিতভাবেই পুরোপুরি সংরক্ষিত হয়।

তাই এ কথা প্রমাণিত যে, মহানবীর (স) যুগেই বিক্ষিপ্ত আকারে লিপিবদ্ধ থাকার পাশাপাশি অনুশীলনের মাধ্যমে হাদীস পুরোপুরি সংরক্ষিত ছিল।

মহানবী (স)-এর ওফাত পরবর্তী সময় হাদীসের বিশুদ্ধতা সংরক্ষণ ও বর্ণনার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনে দুর্বলতা ও শৈথিল্য দেখা দেয়। এছাড়াও কতিপয় কারণে বিশুদ্ধ হাদীস সংকলনের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হয়।

১. দীনের তাবলীগ ও প্রচারের উদ্দেশ্যে সাহাবীগণের বিভিন্ন দেশে যাতায়াত।

২. সাহাবীগণের ইন্তিকাল ও শাতাদাতবরণ।

৩. বর্ণনাকারীগণের স্মৃতি শক্তির প্রখরতা হ্রাস।

৪. মুসলমানগণের অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে বাক্তি ও দলীয় স্বার্থে হাদীসের ব্যবহার।

৫. বিভিন্ন ফিরকা ও মতবাদের স্বপক্ষে হাদীসের বাবহার ও জাল (মাওযু) করণ।

উল্লিখিত কারণে হাদীস বিশারদগণ বিশুদ্ধ হাদীস সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। সর্বপ্রথম যিনি এ কৃতিত্বের অধিকারী হন তিনি হলেন হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয (র) (মৃ. ১০১)।

তিনি রাষ্ট্রীয় ফরমান জারি করে বলেন-

"রাসূলে কারীম (স)-এর হাদীসের প্রতি অনতিবিলম্বে দৃষ্টি দাও এবং তা লিখে রাখো।"

তিনি হাদীস সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য মদীনার শাসনকর্তা ও বিচারপতি আবু বকর ইবনে হাযম (মৃ. ১১৭/১২ হিঃ) এবং ইবনে শিহাব আয-যুহরীকে (মৃ. ১২৪হি) বিশেষভাবে অনুরোধ করেন।

হাদীস সংরক্ষণ ও গ্রন্থায়নের এই মহতি উদ্যোগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেণ ইবনে শিহাব আয-যুহরী। আর এভাবেই হাদীস সংরক্ষণের এক নব অধ্যায় সূচিত হয়।

আল্লাহ হাফেজ***


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url