শিরক কী শিরকের প্রকারভেদ শিরকের কারণ ব্যাখ্যা সম্পর্কে বিস্তারিত

আজ আর্টিকেলটিতে শিরক কী শিরকের প্রকারভেদ বর্ণনা শিরকের কারণ ব্যাখ্যা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।


শিরক-এর পরিচয়

শিরক অর্থ শরীক করা বা অংশীদার স্থাপন করা। একাধিক বিশ্ব নিয়ন্তা, একাধিক বিশ্বস্রষ্টা ও একাধিক মাবুদ বা ইলাহে বিশ্বাস করার নাম শিরক। এই বিশ্বের একচ্ছত্র অধিপতি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক বা অংশীদার সাব্যস্ত করা বা কাউকে তাঁর সমকক্ষ মনে করা বা কাউকে সমগুণ সম্পন্ন মনে করাই শিরক। শিরক তাওহীদের বিপরীত। আল্লাহ তা'আলার পাশাপাশি কোন সৃষ্ট বস্তুকে আল্লাহর সমতুল্য, সমগুণ সম্পন্ন ও সমশক্তি সম্পন্ন ধারণা বা বিশ্বাস করা আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শামিল। আবার যে সকল ইবাদাত আল্লাহ তা'আলার জন্যে নির্দিষ্ট সেগুলোর সাথে অন্য কাউকে উপস্থিত করা এবং তাঁর নিকট সাহায্য চাওয়াও শিরক। যদি কেউ আল্লাহকে বাদ দিয়ে কোন মৃত বুজুর্গ ব্যক্তি, পীর- আউলিয়ার নিকট কোন কিছু প্রার্থনা করে তবে তা শিরকে পরিণত হবে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করা এবং তাদের নিকট থেকে কোন কিছু পাওয়ার আশা করা শিরক। বিপদ-আপদে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নিকট থেকে উন্নতি কামনা করা-এ সবই শিরক।

আরো পড়ুন :  তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ববাদ ও তাওহীদের পরিচয় 

শিরকের প্রকারভেদ

শিরক দু'ভাগে বিভক্ত

১. শিরকে আকবার বা বড় শিরক।

২. শিরকে আসগার (শিরকে খাফী) বা ছোট শিরক।

শিরকে আকবার বা বড় শিরক

শিরকে আকবার হচ্ছে আল্লাহ তা'আলার সাথে কাউকে অংশীদার বানানো। আল্লাহকে ডাকার মতো অন্য কাউকে ডাকা, আল্লাহকে ভয় করার মতো অন্য কাউকে ভয় করা, আল্লাহর কাছে যা চাওয়া হয় তা অন্য কারো নিকট চাওয়া। আল্লাহ তা'আলাকে ভালোবাসার ন্যায় অন্যকে অনুরূপ বা ততোধিক ভালোবাসা। আল্লাহর সাথে যাকে অংশীদার করা হয় যে, কোন ধরনের ইবাদাত তার জন্য নির্দিষ্ট করা। এ ধরনের শিরকে লিপ্ত ব্যক্তির মধ্যে বিন্দুমাত্র ঈমান অবশিষ্ট থাকে না। এ ধরনের মুশরিকদের জন্য আল্লাহ তা'আলা জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। জাহান্নামই হচ্ছে তাদের শেষ ঠিকানা।

আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশ্যে নিবেদিত ইবাদাতকে ইবাদাত, উসীলা অথবা অন্য যে কোন নামে আখ্যায়িত করার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কারণ এ সবই হচ্ছে শিরকে আকবার বা বড় শিরক। এ ধরনের শিরকের বিচার্য বিষয় হচ্ছে, বস্তুত হাকিকাত বা প্রকৃত পরিচয়। শব্দ ও বাক্য এক্ষেত্রে বিচার্য বিষয় নয়।

শিরক কুফরীর মতোই ঘৃণ্য পাপ। আল্লাহ তা'আলা শিরককে অমার্জনীয় অপরাধ বলে আল-কুরআনে উল্লেখ করেছেন। তৎকালীন পৌত্তলিকদের সম্বন্ধে কুফর ও শিরক এ উভয় শব্দের ব্যবহার আল কুরআনে পাওয়া যায়। লাত, মানাত, ওজ্জা, গুবল ইত্যাদি অলীক কল্পিত দেবতা হিসেবে স্বীকার করা ও তাদের মূর্তি বানিয়ে তার পুজা করা শিরকে আকবার।

ইয়াহুদীদের বাছুর পুজা এবং যিন্দিক ও পারসিকদের অগ্নিপূজাও শিরক। খ্রিস্টানদের মধ্যে যারা ট্রিনিটি বা ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী তারাও মুশরিক। তাদের কেউ ঈসা (আ)-কে আল্লাহর পুত্র এবং God the Father, God the son and God the holy Soul-এ তিন সত্তার স্বীকৃতি দেয়। তারাও শিরকে লিপ্ত।

কারো কারো বিশ্বাস যে, ভালো-মন্দ এ দুই বিপরীত গুণ একই সময়ে একই সত্তায় বিদ্যামান থাকতে পারে না। তাই তারা দুটি পৃথক সত্তার কল্পনা করে। একজন মঙ্গলের সত্তা এবং অপরজন মন্দের সত্তা। এভাবে দুই বিপারীত গুণ বিশিষ্ট দুই শক্তির উপাসনা করা শিরকে আকবার।

আবার এ বিশ্বের সৃষ্টি থেকে লয় পর্যন্ত পরিচালনার যাবতীয় কাজ একজনের পক্ষে সম্ভব নয় বলে কোন কোন সম্প্রদায় মনে করে। তাদের বিশ্বাস এ বিশ্বের একজন স্রষ্টা, একজন পালনকর্তা এবং একজন সংহারকর্তা আছেন। আর এ তিন সত্তা হচ্ছে, ব্রহ্ম, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। তারা এদের কল্পিত মূর্তি তৈরি করে পূজা করে। এ সবই শিরকে আকবার বা বড় ও প্রকাশ্য শিরক।

আরো পড়ুন : ফেরেশতার পরিচয় ও তাঁদের দায়িত্ব

শিরকে আকবার বা প্রকাশ্য শিরক করার পরিণতি

শিরকে আকবার বা প্রকাশ্য শিরক করার পরিণতি সম্পর্কে কুরআনের দলীল প্রমাণ আল্লাহ তা'আলা বলেন-

"নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শিরক করা ক্ষমা করবেন না। এতদ্ব্যতীত অন্যান্য গুনাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমাকরে দেবেন।" (সূরা আন-নিসা: ৪৮)

"সেই ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক বিভ্রান্ত কে, যে আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুকে ডাকে যা কিয়ামত দিবস পর্যন্তও তাকে সাড়া দেবে না? এবং এগুলো তাদের প্রার্থনা সম্বন্ধেও অবহিত নয়।" (সূরা আল- আহকাফ: ৫)

 "তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করবে এবং তাঁর সাথে অন্য কিছুকে শরীক করো না।" (সূরা আন-নিসা: ৩৬) 

 "আল্লাহ যে সব শস্য ও গবাদিপশু সৃষ্টি করেছেন, সেগুলো থেকে তারা এক অংশ আল্লাহর জন্য নির্ধারণ করে এবং ধারণা অনুযায়ী বলে, এটা আল্লাহর জন্য এবং এটা আমাদের দেবতাদের জন্য। যে অংশ তাদের দেবতাদের তা তো আল্লাহর দিকে পৌঁছে না এবং যা আল্লাহর অংশ তা তাদের দেবতাদের কাছে পৌঁছে যায়। তারা যা বিচার করে তা নিকৃষ্ট।" (সূরা আল-আনআম: ১৩৬)

"আল্লাহ ছাড়া অপর কাউকে ডেকো না, যা তোমার কোন উপকার করতে পারবে না এবং ক্ষতিও করতে পারবে না। যদি তুমি এমন করো তা হলে নিশ্চয় তুমি জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।" (সূরা ইউনুছ: ১০৬)

হাদীস দ্বারা দলীল প্রমাণ

১. হযরত ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা) ইরশাদ করেছেন।

 "যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।" (বুখারী)

২. হযরত জাবির (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূল (স) ইরশাদ করেছেন। "যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করে মৃত্যুবরণ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি তাঁর সাথে কাউকে শরীক করে মৃত্যুবরণ করবে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।" (মুসলিম)।

 শিরকে আসগার (শিরকে খাফী) বা ছোট শিরক

যে সব কথা ও কাজের মাধ্যমে মানুষ শিরকের দিকে ধাবিত হয়, সে সব কথা ও কাজই শিরকে আসগার বা ছোট শিরক। যেমন: মাখলুকের (সৃষ্ট কিছুর) কোন বিষয়ের ব্যাপারে এমনভাবে সীমালংঘন করা, যা ইবাদাতের পর্যায়ে পৌছে না। ইবাদাতের পর্যায়ে পৌঁছলে তা শিরকে আকবারে পরিণত হবে। যেমন-

লোক দেখানো কাজ যা মানুষের জন্য করা হয়। ইবাদাতে আল্লাহ তা'আলার প্রতি একাগ্রতা প্রদর্শন না. করা। মানুষকে দেখানোর জন্য কোন ইবাদাত করা শিরকে আসগার। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন সত্তার নামে কসম খাওয়া অথবা একথা বলা যে, 'আল্লাহর ইচ্ছায় এবং আপনার ইচ্ছায়' অথবা 'আল্লাহ এবং আপনি আমার জন্য যথেষ্ট, আপনার কারণে একাজ সাধিত হয়েছে ইত্যাদি শিরকে আসগার।

কখনো এ জাতীয় শিরক অবস্থাভেদে বক্তার উক্তির পরিপ্রেক্ষিতে এবং বক্তার উদ্দেশ্যের কারণে শিরকে আকবারে পরিণত হয়।

রিয়া বা লোক দেখানো কাজ শিরকে খাফী বা শিরকে আসগার তথা ছোট শিরকের অন্তর্গত। রিয়া শব্দের অর্থ হল, লোক দেখানো ইবাদাত যা দ্বারা মানুষ তার নিজের কর্ম প্রদর্শন করে। আর এ ধরনের আমল আল্লাহর উদ্দেশ্যে করা হয় না। দুনিয়ার স্বার্থে লোক দেখানোই এ ধরনের ইবাদতের মূল উদ্দেশ্য। যেমন নামাযে মুনাফিকদের অবস্থা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা'আলা বলেন, "তারা নামাযে দাঁড়ালে খুবই অলসতা সহকারে দাঁড়ায় লোক দেখানোর জন্য এবং তারা আল্লাহকে খুব কমই স্মরণ করে।" (সূরা আন-নিসা: ১৪২)

এ ধরনের খাটি ও প্রকৃত রিয়া কোন মুমিন ব্যক্তির রোযায় সংঘটিত হয় না। কিন্তু এ জাতীয় রিয়া বা লোক দেখানোর কাজ সংঘটিত হয় যাকাত, নামায ও হজ্ব আদায়কালে এবং এ আমলগুলো ব্যতীত অন্যান্য প্রকাশ্য আমলের ক্ষেত্রেও রিয়া সংঘটিত হয়। এ সকল ক্ষেত্রে একামতা খুবই দুর্লভ। তাই তারা এ আমলের কোন পুরস্কার আল্লাহর নিকট থেকে লাভ করবে না বরং তারা শান্তির যোগ্য বলে বিবেচিত হবে।

শিরকে আসগার-এর দলীল-প্রমাণ

হযরত রাসূল (সা) বলেন, "আমি তোমাদের জন্য যে জিনিসটি সব চেয়ে বেশি ভয় করি তা হচ্ছে শিরকে আসগার অর্থাৎ ছোট শিরক। তাঁকে ছোট শিরক সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি উত্তরে বললেন: ছোট শিরক হচ্ছে রিয়া তথা লোক দেখানো কাজ।"

এধরনের শিরক মানুষের মধ্যে অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়ে যায়, যা বাহ্যিক দৃষ্টিতে শিরক মনে না হলেও প্রকৃত পক্ষে তা শিরকের অন্তর্গত। শিরকে আসগারের উদাহরণে বলা হয় যে, অন্ধকার রাত্রতে কালো মসৃণ পাথরের মধ্য দিয়ে যখন একটি ক্ষুদ্র কালো পিপীলিকা চলতে থাকে তা যেমন টের পাওয়া যায় না, শিরকে আসগার সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারেও তেমনি টের পাওয়া যায় না।

নামায আদায় করা, সিয়াম পালন করা এবং দান-খয়রাত করা ইসলামের বিধান। এটি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য করতে হয়। যখন নামায পড়া ও সিয়াম পালন করা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে হয় এবং দান-খয়রাত করা লোক দেখানোর জন্য হয়, তখন এধরনের ইবাদাতের কোন গুরুত্ব থাকে না। আর আল্লাহ তা'আলাও এ ধরনের আমলের মুখাপেক্ষী নন। বান্দার এ কাজ তখন শিরকে পরিণত হয়।

হাদীস শরীফে আছে, হযরত রাসূল (সা) বলেন, "যে ব্যক্তি লোক দেখানোর জন্য নামায আদায় করলো, সে শিরক করলো। যে ব্যক্তি লোক দেখানোর জন্য সিয়াম সাধনা করলো সে শিরক করলো এবং যে ব্যক্তি লোক দেখানোর জন্য দান করলো সে শিরক করলো।" (মুসনাদ আহমদ)

শিরক গুরুতর অপরাধ। তাওবা বা আন্তরিক ক্ষমা প্রার্থনা ছাড়া এ পাপ মাফ হয় না। মুশরিকদের দোয়া কবুল হয় না। শিরক জঘন্য অপরাধ। সুতরাং সকল প্রকার শিরক থেকে মুক্ত থাকা প্রত্যেক মুমিন-মুসলমানের জন্য অপরিহার্য।

আরো পড়ুন :  কিয়ামত ও কিয়ামতের নিদর্শনাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত

শিরকের কারণ

সর্বপ্রথম শিরক আরম্ভ হয় হযরত নূহ (আ)-এর উম্মতের মাঝে। তাদের কতিপয় সৎলোকের মৃত্যুর পর তাদের প্রতি অতি ভক্তির কারণে তাদের কবরে সিজদা আরম্ভ করে দেয়। আর এভাবে শিরকের বিস্তার ঘটে এবং যুগে যুগে এ শিরক ব্যাপকতা লাভ করতে থাকে। বর্তমানে পীর-পুরোহিতদের দরবারে মানত করা, তাদের মাজারে সিজদা করা সহ বিভিন্ন প্রকার শিরক কর্ম হযরত নূহ (আ)-এর উম্মতের শিরকের ধারাবাহিকতা মাত্র। এছাড়া মানুষ শয়তানের ধোঁকায় পড়ে যুগে যুগে বিভ্রান্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। তাওহীদের মূল শিক্ষা থেকে দূরে সরে পড়ছে। মানুষ আল্লাহর শিক্ষাকে ভুলে গিয়ে আপাত মধুর প্রলোভনে অসংখ্য সৃষ্ট বস্তুর পূজা আরম্ভ করছে। আল্লাহর ইবাদাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নানা রকম কল্পিত দেবদেবীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করছে। তাদেরকে রুবুবিয়্যাতের ক্ষেত্রে এবং উলুহিয়্যাতের ক্ষেত্রে আল্লাহর সমতুল্য হিসেবে বিশ্বাস করা হচ্ছে। আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে তারা নিজেদের আত্মমর্যাদাবোধ ভূলুষ্ঠিত করছে। আল্লাহকে বাদ দিয়ে তারা কখনো আগুনের পূজা করছে, কখনো চন্দ্র-সূর্যকে সৃষ্টিকর্তার মর্যাদায় বসাচ্ছে এবং সেগুলোর কাছে মাথা নত করছে। কখনো বা তারা শক্তিশালী কোন মানুষের পূজা করছে, এমন কি তারা বড় বড় জীব-জন্তু, বড় বড় বৃক্ষ-লতা, নদী-পাহাড় ইত্যাদির পূজা করছে। আবার কোন কোন সম্প্রদায়ের লোকেরা কল্পিত ধনের দেবতা, যশের দেবতা, বিদ্যার দেবতা ইত্যাদির মূর্তি বানিয়ে পূজা করেছে এবং বর্তমানেও করছে।

আবার কখনো আত্মগরিমায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেকে সরাসরি প্রভু ও উপাস্য বলে ঘোষণা দিয়েছে। এ বিভ্রান্তিতে মানব সমাজে সৃষ্টি হয়েছে যন্য-কলহ, ফিতনা-ফ্যাসাদ। আল্লাহর বিধান ও জীবনব্যবস্থাকে ছেড়ে দিয়ে কোন ব্যক্তি রচিত বিধানের আনুগত্য করার ফলেও অগণিত লোক শিরকে লিপ্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। আর এভাবেই যুগে যুগে বিভ্রান্ত, বিপথগামী ও আত্মবিস্মৃত মানুষ এভাবে একত্ববাদের আকীদা থেকে বিচ্যুত হয়ে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে এবং বর্তমানেও করছে। একত্ববাদ তথা তাওহীদের পরিবর্তে বহুত্ববাদ, অংশীদারবাদ প্রভৃতিতে বিশ্বাসী হয়েছে। ফল স্বরূপ তারা ন্যায়-অন্যায় এবং হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে এবং ফেলছে।

মানবজাতিকে এহেন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে কল্যাণের পথে পরিচালনার জন্য মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর আবির্ভাব হয়েছিল। তাঁর আনীত বিধানই মানবজাতির পার্থিব সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ আসমানী বিধান। আর এ বিধানের নাম হচ্ছে মহাগ্রন্থ আল কুরআন। আল-কুরআনের নির্দেশ মুতাবিক তিনি বাস্তব জীবন গঠন করে মানবসমাজের ইতিহাসে এক নযীরবিহীন আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন। তিনি প্রচার করেছেন: আল্লাহর একত্ববাদ ভিত্তিক জীবন বিধান অনুযায়ী মানব জীবন পরিচালিত হলেই বলবৎ না থাকায় আল্লাহকে বিশ্বাস করা সত্ত্বেও প্রকৃত পক্ষে তা পালন করা হচ্ছে না। আজ রুবুবিয়াতের তাওহদিকে মূলত অস্বীকার করা হচ্ছে। রব হিসেবে মেনে নেওয়া হচ্ছে আল্লাহ ব্যতীত আরো অনেক শক্তিকে। শব্দগত আকীদা হিসেবে যদিও আল্লাহকে রিযিকদাতা, জীবনদাতা, মৃত্যুদাতা, সৃষ্টিকর্তা, বিশ্ব ব্যবস্থাপক এবং রব বলে স্বীকার করা হয়, কিন্তু এ শ্রেণীর লোকেরাই আল্লাহকে বাদ দিয়ে মৃত বুজুর্গ ব্যক্তিদের কাছে প্রার্থনা করে।

বিশ্বের স্রষ্টা পালনকর্তা, সংহারকর্তা এবং শেষ বিচারে দিনের পুরস্কার ও শাস্তি দেয়ার মালিক এক আল্লাহ। তাঁর কোন অংশীদার থাকলে বা সমতুল্য থাকলে বিশ্বের চিরন্তন নিয়ম শৃংখলায় ব্যাঘাত ঘটত। এক রাজ্যে একাধিক অধিকারী প্রতিদ্বন্দ্বী থাকলে সে রাজ্যে শান্তি শৃংখলা ব্যহত হতে বাধ্য।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বলা হয়েছে।

"যদি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে আল্লাহ ব্যতীত বহু ইলাহ থাকত, তবে উভয়ে ধংস হয়ে যেতো। অতএব তারা যা বলে, তা থেকে আরশের অধিপতি আল্লাহ পবিত্র, মহান।" ( সূরা আল আম্বিয়া: ২২ )

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা'আলা আরো ঘোষণা করেন:

"তাঁর সাথে অপর কোন ইলাহ নেই; যদি থাকত তবে প্রত্যেক ইলাহ নিজ নিজ সৃষ্টি নিয়ে পৃথক হয়ে যেত এবং একে অপরের উপর প্রাধান্য বিস্তার করতো। তারা যা বলে, আল্লাহ তা থেকে কত পবিত্র।" (সূরা আল-মুমিনুন: ৯১)

আল্লাহর একত্ববাদ বা তাওহীদ প্রতিষ্ঠা কল্পে কুরআনে আল্লাহ তা'আলা আরো ঘোষণা করেন-

"বল, আমি তো তোমাদের মতো একজন মানুষই, আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের ইলাহই একমাত্র ইলাহ। অতএব, যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাৎ কামনা করে সে যেন সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তাঁর পালনকর্তার সাথে কাউকে শরীক না করে।" (সূরা আল কাহফ: ১১০)

এরূপ বণ্ড আয়াতে আল্লাহ তা'আলা তাঁর একত্ববাদ সম্পর্কীয় বাণী উচ্চারণ করেছেন এবং বিশ্ব প্রকৃতির সৃষ্টি ও তা যথানিয়মে পরিচালিত হওয়ার কলাকৌশলের দিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আসমান ও জমিনের সৃষ্টি, চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্রসমূহের সৃষ্টি, এদের উদয় ও অন্ত, রাত দিনের পর্যায়ক্রম, আবহাওয়ার পরিবর্তন, উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের বৈচিত্র্য, আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির ভাষা বর্ণ ও আকৃতির পার্থক্য এতসব বৈচিত্র্যের মধ্যে ও বিশ্ব চরাচর একটি অমোঘ নিয়মের আওতায় নিয়ন্ত্রিত। যে মহাশক্তি এ অমোঘ বিধানের নিয়ামক তিনি এক, অদ্বিতীয়, শরীকহীন ও অতুলনীয় সত্তা। এ হচ্ছে তাওহীদের মূলকথা আর এর বিপরীত হচ্ছে শিরক।

আল্লাহ হাফেজ**


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url