কুফর কি কুফরের প্রকারভেদ কী কী কাজে কুফর হয় তা নির্ণয় ও কুফরের পরিণতি

আজ এই আর্টিকেলটিতে কুফর-এর পরিচয় কুফরের প্রকারভেদ কী কী কাজে কুফর হয় তা নির্ণয় কুফরের পরিণতি সম্পর্কে  বিস্তারিত বিবরণ দিতে পারবেন।


কুফর-এর পরিচয়

কুফর ঈমানের বিপরীত। কুফর হচ্ছে এক ধরনের মূর্খতা, শুধু মূর্খতাই নয় বরং সর্বাপেক্ষা বড় মুর্খতা। মানুষ আল্লাহকে না চিনে অজ্ঞ থাকলে তার চেয়ে বড় মূর্খতা আর কি হতে পারে? কুফর সবচেয়ে বড় যুলুম, আল্লাহর সাথে বিদ্রোহ, অকৃতজ্ঞতা ও নিমকহারামী এবং মারাত্মক পাপ। কুফরের অনিষ্ট পৃথিবীকে বিষায়িত ও দুর্বিষহ করে তোলে। সকল অনাচারের মূল উৎস হচ্ছে এ কুফর। সুতরাং কুফর হতে বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহ যুগে যুগে নবী-রাসূলগণকে পাঠিয়েছেন।

আরো পড়ুন: কিয়ামত ও কিয়ামতের নিদর্শনাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত

'কৃষ্ণর' শব্দের আভিধানিক অর্থ

কোন কিছু ঢেকে রাখা, গোপন করা, অবিশ্বাস করা, অস্বীকার করা ও অকৃতজ্ঞ হওয়া। ইসলামি পরিভাষায় সর্বশক্তিমান আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার ও অবিশ্বাস করাকে কুফর বলে। অনুরূপভাবে ইসলামি জীবনব্যবস্থার মৌল বিঘ্নয়াবলীকে অবিশ্বাস করাও কুফর। কাজেরই যে ব্যক্তি কুফরী কাজে লিপ্ত তাকে কাফির' বলা হয়। কুফর ঈমান ও ইসলামের আকীদা পরিপন্থী কাজ।

ব্যাপক সংজ্ঞা

 "নবী করীম (স) কর্তৃক আনীত বিষয়াদি যা অকাট্যভাবে দীনের অঙ্গ বলে প্রমাণিত তার সবকিছু বা কোন একটি অস্বীকার করাকে কুফর বলা হয়।"

কাজেই আল্লাহ, নবী-রাসূল, ফেরেশতা, আসমানী কিতাব, তাকদীর, কিয়ামত, আখিরাত, হাশর, বিচার, জান্নাত-জাহান্নাম এবং ইসলামের অন্যান্য শুকুম-আহকাম যা কুরআন ও হাদীস দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত এসব অস্বীকার করা যেমন কুফরী অনুরূপভাবে কোন একটি অস্বীকার করাও কুফরী।

আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (র) বলেন, কুফর চার প্রকার।

১. কুফরে ইনকারী অর্থাৎ মুখে ও অন্তরে শরীআতকে অস্বীকার করা এবং সত্যকে বিশ্বাস না করা। 

২. কুফরে জুহদ অর্থাৎ হক বা সত্যকে অন্তর দিয়ে সত্য জানা কিন্তু মুখে স্বীকার না করা।

৩. কুফরে ইনাদ অর্থাৎ সত্যকে সত্য জানা এবং মুখে তা স্বীকারও করা, তবে তা গ্রহণ না করা।

৪. কুফরে নিফাক অর্থাৎ মুখে সত্যকে স্বীকার করা কিন্তু অন্তরে তা অস্বীকার করা।

কুফর-এর পরিণতি

কুফর জঘন্য অপরাধ। তাই এর শাস্তিও কঠোর। কুরআন মজীদে এর ভয়াবহ শাস্তির কথা উল্লেখ রয়েছে। ঘোষিত হয়েছে।

"যারা কুফরী করে তাদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে আগুনের পোশাক, তাদের মাথার উপর ঢেলে দেওয়া হবে ফুটন্ত পানি, বা নিয়ে তাসের উদরে যা আছে তা এবং তাদের চামড়া বিগলিত করা হয়ে এবং ড্যাদির জন্য থাকবে লোহার মন্ডর। যখনই আত্মা যন্ত্রণা কাতর হয়ে জাহান্নামে থেকে বের হতে চাইবে তখনই তাদেরকে আবার সেখানে ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং তানেরকে বলা হবে, সহন ধন্ত্রণা আস্বাদ গ্রহণ কর। (সূরা আল-হজ্জ: ১৯-২২)

অন্য আয়াতে খোদিত হয়েছে-

"যারা কুফরী করেছে তাদের জন্য রয়েছে দূর্ভোগ এবং তিনি তাদের কর্ম ব্যর্থ করে দিবেন। তা এ জন্য যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তারা তা অপছন্দ করে। কাজেই আল্লাহ তাসের কর্ম নিষ্ফল করে দিবেন।" (সূরা মুহাম্মদ : ৮-৯)

যারা কুফরী করে, শয়তান তাদের অভিভাবক এবং তারা হল জাহান্নামী। কুরআন মজীদে বর্ণিত হয়েছে।

"আর যারা কুফরী করে ভাওর তাদের অভিভাবক, তারা তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারে নিয়ে যায়। তারাই জাহান্নামী, সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে। ( সূরা আল-বাকারা: ২৫৭ )

আরো পড়ুন: সূরা আল-নূরের আলোকে ব্যভিচারের পরিণাম ও দন্ডবিধি

কুফরী কাজ ও কথা

অল্লাহ, রাসূল, কুরআন ও আখিরাতের উপর ঈমান রাখা সত্ত্বেও এমন কিছু বিশ্বাস, কথাবার্তা এবং কাজকর্ম রয়েছে যা কুফরীরই অন্তর্ভুক্ত। যেমন আল্লাহ বা নবী-রাসূলকে গালি দেওয়া তাঁদের প্রতি কটুক্তি করা অথবা তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা ইত্যাদি। নবী-রাসূলকে গালি দেওয়ার শাস্তি হল মৃত্যুদণ্ড। কিয়ামতের দিন রাসূলুল্লাহ (স) উম্মাতের জন্য সুপারিশ করবেন, এটিকে অস্বীকার করাও। কুফরী। ঈমান ও কুফরকে এক মনে করাও কুফরি। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কোন গুরুমকে (বিধান) খারাপ ও ত্রুটিপূর্ণ মনে করা এ ত্রুটি-বিচ্যুতি তালাশ করা অলবা ফেরেশতাদের সম্পর্কে কটূক্তি করা এবং তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করাও কুফরী।

হযরত মুহাম্মদ (স)-কে সর্বশেষ নবী হিসাবে বিশ্বাস না করা। অনুরূপ তাঁর পরে কোন নবী আসতে পারে বলে বিশ্বাস রাখাও কুফরী। নিজের ঈমান সম্পর্কে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে থাকা বা সন্দেহ পোষণ করাও কুফরী।

কারো মৃত্যুতে আল্লাহর উপর অভিযোগ আনা বা আল্লাহ সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করা, পবিত্র কুরআনের কোন আয়াতকে অস্বীকার করা বা এর কোন নির্দেশ সম্পর্কে ঠাট্টা বিদ্রূপ করা কুফরী।

কাউকে গুনাহের কাজ করতে দেখে কেউ যদি বলে, তুমি কি মুসলমান না? উত্তরে সে যদি বলে, আমি মুসলমান নই, তবে সে কাফির বলে গণ্য হবে।

কেউ যদি বলে, 'আল্লাহ তা'আলা বললেও আমি এ কাজ করব না' অথবা এরূপ বলে, 'জিব্রাঈল নেমে এসে বললেও আমি তার কথা মানব না' তবে সে কাফির হয়ে যাবে।

কাফিরের কোন কাজ পছন্দ হওয়ার পর কেউ যদি আগ্রহ বাক্ত করে বলে, যদি কাফির হতাম তবে ভাল হতো, তাহলে সে কাফির বলে গণ্য হবে। নামায সম্পর্কে অবজ্ঞা প্রকাশ করা, যেমন এ কথা বলা, আমার উপর নামায় ফরম নয় জ্ঞানীদের জন্য নামায পড়া ঠিক নয়, মাল আদায় করে লাক জীৎ আমার অমুক আত্মীয় মরে গিয়েছে বা আমার নী সম্পদ ধংস হয়ে নিয়েছে আমার নামায পড়ে কি হবে ইত্যাদি বলা কুফরী। ইচ্ছাকৃতভাবে কেবলা ব্যতীত অন্যদিকে ফিরে নামায আদায় করা অগবা ইচ্ছাকৃতভাবে বিন্য উদ্বৃতে নামাম পড়া কুফরী। আযানের ধ্বানি সম্পর্কে কটূক্তিকরা কুফরী। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা) এর প্রতি ব্যভিচারের অপবাদ দেওয়া, হযরত আবু বকর সিদ্দিকী (রা) ও হযরত উমর ফারুক (রা) এর খিলাফত অবৈধ মনে করা অথবা এরূপ আকীদা পোষণ করা যে হযরত জিব্রাঈল (আ) ভুলক্রমে রাসূলুল্লাহ (স) এর নিকট ওন্থী নিয়ে এসেছিলেন, আসলে তাঁর ওহী নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল হযরত আলী (রা) -এর নিকট এসব আকীদা পোষণ কুফরী।

হালালকে হারাম জানা বা হারামকে হালাল জানা এবং তা প্রচার করাও কুফরী। হারাম বস্তু ভক্ষণ করার সময় বিসমিল্লাহ বলাও কুফরী। অনুরূপভাবে তোন হারাম কর্মের পূর্বে বিসমিল্লাহ প্যাড় আরম্ভ করার একই বিধান।

আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভাল-মন্দের মালিক মনে করা জোতিষী বা ননকের ভবিষ্যদ্বাণী ও গায়েবী খবরে বিশ্বাস করা কারো সম্পর্কে এমন বিশ্বাস রাখা যে, তিনি গায়েবের খবর জানেন বা কোন কিছুই তার অজ্ঞাত নয় অথবা সে সকল বস্তু আল্লাহ ছাড়া কারো দেওয়ার ক্ষমতা নেই এমন বস্তু কেউ দিতে পারে বলে আকীদা পোষণ করা বা কারো কাছে তা চাওয়া কিংবা আল্লাহ ছাড়া কারো নামে পশু যবেহ করা কুফরী।

ইচ্ছাকৃতভাবে কুফরী কথা উচ্চারণ করলে ঈমান চলে যায়। পূর্বে নামায রোযা, হজ্জ, ইবাদাত- বান্দাগী যত কিছু করা হয়েছে সব বাতিল হয়ে যাবে। বিবাহ নষ্ট হয়ে যাবে। কাজেই তাওবা করে পুনরায় ঈমান গ্রহণ করতে হবে। এরপর বিবাহ নবায়ন করে নিতে হবে। আল্লাহ না করুন কোন মুসলমান যদি ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে নাস্তিক-মুরতাদ হয়ে যায় তবে তাকে তিন দিনের সময় দিতে হবে। তার অন্তরে ইসলামের ব্যাপারে কোন সান্দহ সৃষ্টি হলে এর সমাধান দিতে হবে এতে যদি ভার বুঝ আসে এবং সে তাওবা করে মুসলামন হয়ে যায় তবে ভাল, নতুবা তিন দিন পরে তাকে হত্যা করা হবে।

কুফরের প্রকৃতি

কুফরের প্রকৃতি জঘন্য খারাপ। কেননা কাফির ব্যক্তি নিজে তার আপন স্বভাব-প্রকৃতির উপর অজ্ঞতার পর্দা ফেলেছে। সে সৃষ্টি হয়েছে ইসলামি স্বভাব নিয়ে। তার গোটা দেহ, দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাজ করে যাচ্ছে ইসলামি স্বভাবের উপর। আর সে তার বুদ্ধি-বিবেকের উপর পর্দা ফেলে স্বভাব। প্রকৃতির বিপরীত চলতে চায়। সুতরাং কাফির ব্যক্তি গভীর বিভ্রান্তিতে ডুবে আছে।

কুফর হচ্ছে-সর্বাপেক্ষা বড় মূর্খতা। এজন্য কাফির ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্তির পড়ে নিমজ্জিত। কৃফর হচ্ছে, তার জীবন ও স্রষ্টার প্রতি সবচেয়ে বড় যুলুম। কেননা প্রকৃতির সকল কিছুই আল্লাহর বিধান মেনে নিচ্ছে, কিন্তু কাফির ব্যক্তি তা না মেনে নিজের জীবনের উপর যুলুম করছে।

কুফর হচ্ছে, মহান আল্লাহর সাথে চরম বিদ্রোহ অকৃতজ্ঞতা ও নিমকহারামী। কেননা আল্লাহর দেওয়া সবকিছু ভোগ ব্যবহার করে তাঁরই বিধান অমানা ও অস্বীকার করা জঘন্য অপরাধ, নিকৃষ্টতম কাজ। কুফর একটি মারাত্মক, ধংসাত্মক ও গুরুতর অপরাধ এবং মহাপাপ। কাফির ব্যক্তি আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে এবং গোপন করে বলে সে রাজদ্রোহীর শামিল। সে আল্লাহর চরম অকৃতজ্ঞ ও নিকৃষ্টতম বিদ্রোহী। সকল অনাচার, বিশৃঙ্খলা ও অন্যায়ের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে এ কুফর। সুতরাং কুফর একটি ধংসাত্মক জঘন্যতম মহাপাপ।

কুফর যে মহাপাপ এটা দিবালোকের অভই ভাস্বর। আমাদেরকে কুফরী কাজ হতে সতর্ক থাকতে হবে। আর পৃথিবী হতে যাবতীয় কুফরী ও খোদাদ্রোহিতা নির্মূল করতে হবে। নির্ভেজাল তাওহীদ তথা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব-প্রতিষ্ঠা করে পৃথিবীকে স্বর্গরাজ্যে পরিণত করার আপ্রাণ প্রয়াস চালাতে হবে। তা হলেই মানব জন্ম সার্থক ও সুন্দর হবে ইহ ও পরকালে।

আল্লাহ হাফেজ**

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url