সংবিধান ও সরকার সংবিধানের সংজ্ঞা ও শ্রেণীবিভাগ

আজ এই আর্টিকেলটিতে সংবিধানের সংজ্ঞা ও শ্রেণীবিভাগ লিখিত ও অলিখিত সংবিধান কি তা বলতে পারবেন। সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান সম্পর্কে আলোচনা করতে পারবেন; এককেন্দ্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান কি তা ব্যাখ্যা করতে পারবেন।

ভূমিকা

সংবিধান হচ্ছে কোন রাষ্ট্র বা সরকারের প্রধান চালিকাশক্তি। সংবিধান ব্যতীত কোন রাষ্ট্রই সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালিত হতে পারে না। সংবিধানের মূল্য উদ্দেশ্য হচ্ছে রাষ্ট্রের ক্ষমতা কোথায় তা নির্ধারণ করা এবং সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে বিরাজমান ক্ষমতা ও জনগণের সঙ্গে সম্পর্কের মৌলিক কাঠামোর বিবরণ দেয়া। সহজ কথায় বলা যায় যে একটি দেশের সংবিধানে ক্ষমতা সম্পর্কে বিবরণ থাকে। সমাজ ব্যবস্থায় এ সম্পর্কে পরিবর্তন ঘটলে সংবিধানেরও পরিবর্তনের দাবী লক্ষ্য করা যায়।

সরকার রাষ্ট্রের একটি মৌলিক উপাদান। রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বপালনকারী আইনি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকার সার্বক্ষণিক ভাবে ক্রিয়াশীল। সরকার বলতে কোন একক প্রতিষ্ঠানকে বোঝায় না। বরং সংবিধানের অধীনে ও সমর্থনে আইনানুযায়ী প্রতিষ্ঠিত সকল প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও এজেন্সীকে সরকারের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়। সংবিধানে বর্ণিত আদেশাবলীকে বাস্তবায়িত করার দায়িত্বসম্পন্ন সকল প্রতিষ্ঠানের সমষ্টিবাচক অভিব্যক্তিই হল সরকার। বিভিন্ন রাষ্ট্রের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভিন্নতার কারণে সরকারের ভিন্ন ভিন্ন রূপ আমরা দেখতে পাই। বিশ্বের প্রতিটি দেশে সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ইচ্ছা প্রকাশিত ও কার্যকরী হয়। সরকারের ক্ষমতা ও কার্যাবলীকে মূলত তিনটি শাখায় ভাগ করা হয়। যথা: আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। সাধারণত আইন বিভাগ আইন প্রণয়ন করে। শাসন বিভাগ প্রণীত আইন কার্যকর করে। বিচার বিভাগ আইনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং আইন অমান্যকারীকে শাস্তি প্রদান করে। এভাবে তিনটি বিভাগের মাধ্যমে সরকার তার ভূমিকা পালন করে।

ক্ষমতার বিভাজন, পারস্পরিক সম্পর্ক, ভারসাম্য, জনগণের সাথে এর পরস্পর ক্রিয়া, অধিকার, কর্তব্য ইত্যাদি নিয়েই সংবিধান প্রতিষ্ঠিত হয়।


এই অধ্যায়ের পাঠগুলোতে যে সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে তা নিম্নরূপ:

গ্রীক দার্শনিক এরিষ্টটল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বহু চিন্তাবিদ এবং রাষ্ট্রবিদগণ বিভিন্নভাবে সংবিধানের সংজ্ঞা দিয়েছেন। এরিষ্টটলের মতে, "সংবিধান এমন একটি জীবন পদ্ধতি যা রাষ্ট্র নিজের জন্যে বেছে নিয়েছে।" (Constitution is the way of life the state has chosen for itself) অধ্যাপক ফাইনারের মতে (The Fundamental Political institutions is the constitution.) অর্থাৎ "মৌলিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গুলোই হচ্ছে সংবিধান"। সি. এফ স্ট্রং এর মতে, "সংবিধান হচ্ছে সেই সকল নিয়ম কানুনের সমষ্টি যা দ্বারা সরকারের ক্ষমতা, শাসিতের অধিকার এবং এ দু'য়ের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ধারিত হয়ে থাকে।" লর্ড ব্রাইস সংবিধানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, "সংবিধান হলো এমন কতগুলো আইন ও প্রথার সমষ্টি যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালিত হয়।" অধ্যাপক কে. সি. হুইয়ারের ভাষায়, "সংবিধান হচ্ছে সে সকল নিয়মের সমষ্টি যা কি উদ্দেশ্যে এবং কোন বিভাগের মাধ্যমে সরকারের ক্ষমতা পরিচালিত হবে তা নিয়ন্ত্রণ করে।

সংবিধান সম্পর্কে উপরোক্ত সংজ্ঞাসমূহ থেকে বলা যায়, সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্রের সেইসব মৌলিক রীতিনীতি যা দ্বারা সরকারের গঠন কাঠামো, সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও ক্ষমতা এবং জনগণের উপর সরকারের ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব এবং জনগণের অধিকার ইত্যাদি নির্ধারিত হয়ে থাকে।

অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন যে সংবিধানকে ব্যাপক এবং সংকীর্ণ অর্থে ব্যাখ্যা করা না হলে কোন সংবিধানের স্বরূপ যথাযথভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। সংকীর্ণ অর্থে সংবিধান হল সেই সব পূর্ণাঙ্গভাবে লিখিত নিয়মকানুনের সমষ্টি যাদের দ্বারা সরকারের গঠন, প্রকৃতি, সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সংগঠন, কার্যাবলী এবং তাদের পারষ্পরিক সম্পর্ক, রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকদের সম্পর্ক প্রভৃতি নিয়ন্ত্রিত হয়। অধ্যাপক গার্ণার সংকীর্ণ অর্থ ভিত্তিক সংবিধানকে 'আনুষ্ঠানিক সংবিধান' নামে অভিহিত করেছেন। ব্যাপক অর্থে সংবিধান বলতে কোন দেশের শাসনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণকারী লিখিত এবং অলিখিত সকল প্রকার নিয়মকানুন এবং আধুনিক অর্থে সংবিধান বলতে সাংবিধানিক ও সাধারণ আইন এবং অলিখিত নিয়মকানুন বলতে প্রথা, দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত রীতি ও আচার আচরণকে বোঝায়। গার্ণার ব্যাপক অর্থে সংবিধানকে 'প্রকৃত' সংবিধান নামে উল্লেখ করে বলেন যে, "প্রকৃত সংবিধান হল প্রথা এবং তা অলিখিত আইনের দ্ধারা সংশোধিত, পরিবর্তিত এবং নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আনুষ্ঠানিক সংবিধান।

সংবিধানের শ্রেণীবিভাগ

সংবিধানের একাধিক শ্রেণীবিভাগ রয়েছে, যেমন:

১ লিখিত এবং অলিখিত।

২. সুপরিবর্তনীয় এবং দুষ্পরিবর্তনীয়।

৩. এককেন্দ্রীক এবং যুক্তরাষ্ট্রীয়।

লিখিত ও অলিখিত সংবিধান

সংবিধানকে লিখিত এবং অলিখিত এ দু'ভাগে ভাগ করা যায়। লিখিত সংবিধান হচ্ছে সেই সংবিধান যেখানে সংবিধানের মৌলিক নীতিগুলো এক বা একাধিক দলিলে লিখিত অবস্থায় বিদ্যামান থাকে। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও বাংলাদেশের সংবিধান লিখিত সংবিধান। অপরদিকে অলিখিত সংবিধান হলো সেই সংবিধান যেখানে সংবিধানের মৌলিক নীতিগুলো বিভিন্ন আচার, প্রথা, রীতিনীতি এবং বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তের মধ্যে বিরাজমান থাকে। ব্রিটিশ সংবিধান এর একটি উত্তম উদাহরণ।

প্রকৃতপক্ষে কোন সংবিধানই সম্পূর্ণরূপে লিখিত কিংবা সম্পূর্ণরূপে অলিখিত নয়। অলিখিত সংবিধানেও কিছু কিছু লিখিত অংশ থাকে। আবার লিখিত সংবিধানেও কিছু কিছু অলিখিত অংশ থাকে। যেমন- ব্রিটেনের সংবিধান মূলত অলিখিত কিন্তু এর কিছু অংশ যেমন, ম্যাগনাকার্টা, অধিকার বিল, অধিকারের আবেদন প্রভৃতি লিখিত অংশ। অপরদিকে আমেরিকার সংবিধান লিখিত হলেও প্রেসিডেন্টের নির্বাচন পদ্ধতি, রাজনৈতিক দলের সংগঠন, কংগ্রেসের কর্মপদ্ধতি প্রভৃতি প্রথা ও প্রচলিত রীতিনীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।

সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান

সংবিধানকে আবার সুপরিবর্তনীয় এবং দুষ্পরিবর্তনীয় এ দু'ভাগে ভাগ করা যায়। লর্ড ব্রাইস এ শ্রেণী বিভাগের উদ্দ্যোক্তা। মূলত সংশোধন পদ্ধতির-উপর ভিত্তি করে সংবিধানের এ শ্রেণী বিভাগ করা হয়। সুপরিবর্তনীয় সংবিধান হলো যা সহজে সংশোধন, পরিবর্তন বা রদবদল করা যায়। এ প্রকারের সংবিধানকে পরিবর্তন করতে হলে কোন বিশেষ নিয়মের প্রয়োজন হয় না। যেমন ব্রিটেনের সংবিধান সুপরিবর্তনীয়। সেখানে কোন সাংবিধানিক আইনকে পরিবর্তন বা সংশোধন করতে হলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে কোন পৃথক বা জঠিল পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয় না। যে কোন সাধারণ আইনের মত সংশোধন করা যায়।

অপরদিকে দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান বলতে বোঝায় যে সংবিধান পরিবর্তন করতে হলে কোন একটি বিশেষ ধরনের জটিল বা পৃথক পদ্ধতি অবলম্বনের প্রয়োজন হয়। আইনসভা ইচ্ছে করলেই কোন আইনকে সংশোধন করতে পারে না। সাধারণত মোট সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনসহ অন্যান্য কিছু জটিল শর্ত পূরণ করতে হয়।

এককেন্দ্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান

সংবিধানকে এককেন্দ্রীক এবং যুক্তরাষ্ট্রীয়-দুশ্রেণীতে ভাগ করা যায়। এককেন্দ্রীক সংবিধান হচ্ছে যেখানে সরকারের সকল ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে নিয়োজিত থাকে। এ ধরনের সংবিধানে কেন্দ্র এবং প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করা হয় না। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানে সরকারের সকল ক্ষমতা কেন্দ্রে না থেকে কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে বিভক্ত থাকে। এককেন্দ্রিক সংবিধানের উদাহরণ হলো বৃটিশ সংবিধান এবং যুক্তরাষ্ট্রেীয় সংবিধানের উদাহরণ হলো আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান। সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান দুষ্পরিবর্তণীয় এবং এককেন্দ্রীক সংবিধান সুপরিবর্তণীয় হয়ে থাকে।

সারকথা

সংবিধান হচ্ছে- কতগুলো আইন ও নিয়ম-কানুনের সমষ্টি যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালিত হয়। সংবিধান ছাড়া কোন রাষ্ট্র বা সরকার সুন্দরভাবে পরিচালিত হতে পারে না। রাষ্ট্র ও সমাজভেদে সংবিধান বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পরিবর্তন ও প্রয়োজনের তাগিদে সংবিধানেরও পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধিত হয়ে থাকে। সংবিধান রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক আইন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url