উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্য এবং সংবিধান প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন পদ্ধতি

সংবিধান প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি কি তা বলতে পারবেন; সংবিধান প্রতিষ্ঠার চারটি পদ্ধতি আলোচনা করতে পারবেন। উত্তম সংবিধান এবং  উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে পারবেন।


ভূমিকা

একটি দেশের সংবিধানের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে রাষ্ট্রের মূল ক্ষমতা কোথায় তা নির্ধারণ করা এবং সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে বিরাজমান ক্ষমতা সম্পর্কের সঠিক বিবরণ দেয়া। সংবিধান রাষ্ট্রের মৌলিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন, আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ, রাজনৈতিক দল ও নির্বাচকমণ্ডলী প্রভৃতির মধ্যকার ক্ষমতা সম্পর্ক কেমন হবে ইত্যাদির নির্দেশ দান করে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলো একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সুতরাং সংবিধান হচ্ছে একটি দর্পনস্বরূপ। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতি সাধনের জন্য রাষ্ট্রে একটি উত্তম সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কি কি বৈশিষ্ট্য বা গুনাবলী থাকলে একটি সংবিধান উত্তম বলে বিবেচিত হবে এ বিষয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞগণ নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। যথাঃ

আরো পড়ুন: হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নবুওয়াতের প্রমাণ

উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্য

১. সুস্পষ্টতা: উত্তম সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সুস্পষ্টতা। সংবিধান সুষ্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট হওয়া দরকার, যেন সংবিধানটি বুঝতে কারও অসুবিধা না হয়। সুতরাং উত্তম সংবিধান অর্থপূর্ণ, প্রাঞ্জল ও সহজ ভাষায় রচিত হতে হবে।

২. মৌলিক অধিকার: সংবিধানে মৌলিক অধিকারের উল্লেখ থাকলে সরকার কখনও স্বেচ্ছাচারী হতে পারে না। শাসন বিভাগ জনগণের অধিকার ক্ষুন্ন করতে চাইলে জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে সংবিধান লংঘনের অভিযোগ আনতে পারে। ফলে সরকারের স্বৈরাচারী প্রবণতা বন্ধ হয় এবং জনগণের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন থাকে। সুতরাং মৌলিক অধিকার অর্ন্তভুক্তকরণ উত্তম সংবিধানের একটি বিশেষ দিক।

৩. লিখিত সংবিধান: উত্তম সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো লিখিত সংবিধান। লিখিত সংবিধান না থাকলে অনেক জটিলতা দেখা দিতে পারে। লিখিত সংবিধানে জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত থাকার সম্ভাবনা বেশী।

৪. সার্বভৌম ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা: উত্তম সংবিধানের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সার্বভৌম ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা। সার্বভৌমত্ব বন্টনের ক্ষেত্রে উত্তম সংবিধান বিশেষ ভূমিকা পালন করে। কারণ সরকার এবং জনগণের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যাবশক অন্যথায় গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লবের ভয় থাকে।

৫ সময়োপযোগিতা: উত্তম সংবিধানের অপর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, উত্তম সংবিধানকে অবশ্যই

সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। সমাজ গতিশীল, সমাজে নিয়ম ও মূল্যবোধের পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। জনগণের চাহিদা এবং আশা-আকাঙ্খারও পরিবর্তন ঘটছে। সংবিধানকে অবশ্যই জনগণের এ পরিবর্তিত চাহিদা ও অধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলতে হবে। অন্যথায় সাংবিধানিক বিধি বিধান উদ্দেশ্যের সঙ্গে জনগণের ইচ্ছার দ্বন্দ্ব ও সংঘাত দেখা দিবে। ফলে বিপ্লবের সূচনা হতে পারে। সমাজ ও রাষ্ট্র অস্থির হয়ে উঠতে পারে।

৬. সংক্ষিপ্ততা: উত্তম সংবিধানের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর সংক্ষিপ্ততা। বিভিন্ন ধারা, উপধারার সংক্ষিপ্ত হওয়া বাঞ্ছনীয় যেন সংবিধানের মধ্যে অযথা অপ্রয়োজনীয় প্রসঙ্গের অনুপ্রবেশ না ঘটে। অবশ্য সংবিধান শুধু সংক্ষিপ্ত হলেই চলবে না বরং সামগ্রিক ভাবে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশের গঠন এবং কিভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিচালিত হবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যবস্থার উল্লেখ থাকতে হবে। তবে অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের উল্লেখ করে সংবিধানকে বড় করে তোলার প্রয়োজন নেই। কে.সি. হুইয়ার বলেন, একটি সর্বোত্তম আদর্শ সংবিধানের আবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ততা। উল্লেখ্য যে, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে মাত্র ৪ হাজার শব্দ সন্নিবেশিত হয়েছে। এদিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান একটি উত্তম সংবিধান।

৭. জনগণের অগ্রাধিকার: উত্তম সংবিধানে জনমতের প্রতিফলন ঘটে। উত্তম সংবিধান হবে জনমতের ধারক ও বাহক। জনমতের প্রতি লক্ষ্য রেখে সময়ে সময়ে সংবিধান পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হতে হবে।

৮. স্থায়ীত্ব: উত্তম সংবিধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর স্থায়ীত্ব। সংবিধান স্থায়ী হলে তা প্রকারান্তরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সহায়ক হয়ে। এর ফলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সুনিশ্চিত হয়ে থাকে।

৯. জাতীয় আশা আকাঙ্খার প্রতিচ্ছবি: একটি উত্তম সংবিধান জনমতের প্রতিফলন ঘটে। যার ফলে এর মাধ্যমে সমগ্র জাতির আশা আকাঙ্খার পূর্ণতা প্রকাশ পায়। দীর্ঘদিন ধরে একটি জাতি যে স্বকীয়তা ও মৌলিকত্ব লালন করে থাকে তাই সংবিধানে ফুটে উঠে।

১০. সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি: উত্তম সংবিধানকে অবশ্যই একটি সহজ সংশোধন পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। সংবিধান যদি সুপরিবর্তনীয় না হয় তা হলে তাকে প্রয়োজনবোধে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। অবশ্য সংশোধন পদ্ধতি খুব সহজসাধ্য হওয়া উচিত নয়। কারণ এর ফলে ভাবাবেগ, উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে আইনসভা অপ্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন করতে প্রয়াসী হয়। আবার সংশোধন পদ্ধতি অত্যাধিক জটিল হওয়াও বাঞ্ছনীয় বা কাম্য নয়। কারণ এর ফলে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে অহেতুক বিলম্ব ঘটে। ডব্লিউ এফ উইলোবি বলেন- "Rigidity and flexibility are the two opposing tendencies of a good constitution."

১১. বিচার বিভাগের প্রাধান্য: উত্তম সংবিধানের প্রাধান্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিচার বিভাগের প্রাধান্য নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য বিচার বিভাগের হাতে সংবিধানকে ব্যাখ্যা করবার ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। কারণ বিচার বিভাগই সংবিধানের রক্ষক ও অভিভাবক।

সারকথা

উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, একটি সংবিধানকে উত্তম হতে হলে একে অনেকগুলো বৈশিষ্টা ও গুণের অধিকারী হতে হবে। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতি সাধনের জন্য রাষ্ট্রে একটি উত্তম সংবিধানের প্রয়োজন রয়েছে। জনগণের মৌলিক অধিকার সন্নিবেশিত করা উত্তম বা আদর্শ সংবিধানের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক।

আরো পড়ুন: প্রথম মানব ও নবী হযরত আদম (আ)

সংবিধান প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন পদ্ধতি 

অধ্যাপক গেটেলের মতে চারটি ভিন্ন ও পৃথক পদ্ধতির মাধ্যমে আধুনিক রাষ্ট্রে সংবিধান প্রতিষ্ঠিত হয়। এ পদ্ধতিগুলো হচ্ছে:

১ অনুমোদন সূত্রে;

২. ইচ্ছাকৃত রচনার মাধ্যমে;

৩. ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে;

৪. বিপ্লবের মধ্যমে।

 অনুমোদন সূত্র

রাষ্ট্র উৎপত্তির বিকাশ ধারার প্রথমাবস্থায় অধিকাংশ রাষ্ট্রেই স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু ছিল। শাসক ছিলেন সেচ্ছাচারী এবং সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তখনও বিকশিত হয় নি। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ শুরু হলে জনগণের মধ্যে মৌলিক অধিকার সম্পর্কে ধারণা জন্ম লাভ করে। এমতাবস্থায় বিপ্লবের ভয়ে রাজা বা শাসক একটি বিধিবদ্ধ দলিলের মাধ্যমে জনগণের নিকট শাসন ক্ষমতা প্রয়োগ করার অঙ্গীকার করেন। রাজা প্রদত্ত চুক্তির এসব শর্তাবলীকে সংবিধান বলে মনে করা হয়। রাজা চুক্তির বিধি বিধানগুলো নিজে ইচ্ছাকৃতভাবে পরিবর্তন করতেন না। এ ধরনের চুক্তিই রাজার ক্ষমতার পরিধি অনেকাংশে সীমিত করে। এভাবে ১৮১৪ সালে ফরাসী রাজা অষ্টাদশ লুই, ১৯০৫ সালে রাশিয়ার দ্বিতীয় জার নিকোলাস, ১৮৪৯ সালে অস্ট্রিয়ায় রাজা ফ্রান্সিস জোসেফ এবং জাপানের সম্রাট নিজ নিজ দেশের সংবিধান ঘোষণা করেন। আর এটিই হল অনুমোদনের মাধ্যমে সংবিধান প্রতিষ্ঠার প্রকৃত পদ্ধতি। অতএব আমরা বলতে পারি সংবিধান প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পদ্ধতি হচ্ছে অনুমোদন পদ্ধতি।

ইচ্ছাকৃত রচনা

সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে বিশ্বের কোন কোন দেশে বিশেষ সম্মেলনের ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে গণপরিষদ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করে। আইন পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য ছাড়া এই খসড়া সংবিধান গৃহীত হলে তা সংবিধান হিসাবে পরিগণিত হয়। এ ধরনের সংবিধান প্রণয়নের বাস্তব ধারণা রূপলাভ করে ফরাসী বিপ্লব ও ১৭৭৬ সালে ফিলাডেলফিয়া সম্মেলনে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়নের পর থেকে। তা'ছাড়া বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও কমনওয়েলথভুক্ত নতুন রাষ্ট্রগুলোতে এ পদ্ধতিতে সংবিধান রচিত হয়েছে।

ক্রমবিবর্তন

ঐতিহাসিক বিবর্তনের মাধ্যমেও সংবিধান প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক ধ্যান ধারণা বিকাশের সাথে সাথে স্বেচ্ছাচারী শাসকদের ক্ষমতা জনপ্রতিনিধিদের হাতে চলে আসে। দীর্ঘদিন ধরে সমাজে প্রচলিত বিধি বিধান ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সরকার কর্তৃক বৈধতা লাভ করে। এসব প্রথা, প্রচলিত নিয়ম ও রীতিনীতিগুলো শেষ পর্যন্ত সাংবিধানিক মর্যদা লাভ করে। এ ধরনের সংবিধান ক্রমবিবর্তনের ফল। এই পদ্ধতিতে প্রণীত সংবিধান তৈরী করা হয় না বরং তা বিকশিত হয়। ব্রিটেনের সংবিধান এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। ইতিহাসের ধারায় ১৬৮৮ সালের গৌরবময় বিপ্লব, ১৬৮৯ সালের বিল অব রাইটস্, ১৭০১ সালের এ্যাক্ট অব সেটেলমেন্ট ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ব্রিটেনের সংবিধান বিকাশ লাভ করেছে।

 বিপ্লব

বিপ্লবের মাধ্যমেও সংবিধান প্রতিষ্ঠিত হয়। জনগণ যখন প্রচলিত সরকার এবং শাসন ব্যবস্থায় উক্ত সরকার ও শাসন ব্যবস্থাকে উৎখাত করার পথ না পায় তখনই তারা বিপ্লবের মাধ্যমে তা সাধন করতে অগ্রসর হয়। যখন জনগণ অত্যাচারিত, অপমানিত এবং লাঞ্চিত হতে থাকে তখন তারা বিপ্লবকেই একমাত্র পরিত্রাণের উপায় বলে মনে করে। কখন ও দেখা যায় যে, বিপ্লবের ফলে ক্ষমতায় আসা, সামরিক কর্তৃপক্ষ নতুন সংবিধানের খসড়া তৈরী করে জনগণের নিকট সরাসরি অনুমোদন চেয়ে বসে। আবার অনেক সময় সামরিক কর্তৃপক্ষ সংবিধান কমিশন গঠনের মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়ন করতে অনুমোদন কামনা করে। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের কোন কোন অঙ্গরাজ্যে, ফরাসী বিপ্লবের পর ফ্রান্সে, ১৯১৭ সালে বিপ্লবের পর রাশিয়ায় এবং সাম্প্রতিককালে স্পেনে উপরোক্ত পদ্ধতির মাধ্যমে সংবিধান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

সারকথা

সংবিধান প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন প্রক্রিয়া রয়েছে। অনুমোদন, ইচ্ছাকৃত রচনা, ক্রমবির্তন ও বিপ্লব প্রভৃতি পদ্ধতির যে কোন একটি অবলম্বনে করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংবিধান প্রণয়ন করেছে। তবে একথা সত্য যে, উপরোক্ত পদ্ধতিগুলোর মধ্যে গণপরিষদ কর্তৃক প্রণীত সংবিধানই শ্রেষ্ঠ সংবিধান বলে স্বীকার করা হয়।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url