গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ গণতন্ত্র

আজ এই আর্টিকেলটিতে গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র গণতন্ত্র শব্দটির অর্থ ও উৎপত্তি সম্পর্কে বলতে পারবেন;গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিতে পারবেন; প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ গণতন্ত্র কি তা ব্যাখ্যা করতে পারবেন।

ভূমিকা

আধুনিককালে গণতন্ত্র বিশ্ববাসীর নিকট উৎকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা হিসাবে সমাদৃত। অনেক পরিবর্তন ও বিবর্তনের মধ্যদিয়ে বর্তমানে গণতন্ত্র একটি জনপ্রিয় শাসন ব্যবস্থায় রূপ লাভ করেছে। গণতন্ত্র একটি নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি। এতে সরকারের পরিবর্তন শাসনতন্ত্র অনুযায়ী নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় হয়ে থাকে। গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র পরস্পর বিপরীতধর্মী আদর্শ। একনায়কতান্ত্রিক সরকারের ভিত্তি হচ্ছে ইচছামাফিক প্রয়োগযোগ্য ক্ষমতা, আইন নয়। একনায়কতন্ত্র সাংবিধানিক রীতিনীতির তোয়াক্কা করে না। অনেক সময় একনায়কতান্ত্রিক সরকারে লোক দেখানো জননির্বাচিত আইন পরিষদ থাকলেও তা কার্যতঃ ক্ষমতাহীন। এটি গুরুত্বপূর্ণ কোন ভূমিকা পালন করতে পারে না।

গণতন্ত্র সরকার পরিচালনায় ও নীতিনির্ধারণে জনগণের অংশগ্রহণ, মানুষের স্বাধীনতা ও অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়, রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি করে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে এবং সরকারকে দায়িত্বশীল করে। জনসাধারণের সার্বিক বিকাশ ও কল্যাণ গণতন্ত্রের মাধ্যমে সম্ভব। একনায়কতন্ত্রে এগুলো স্বীকৃত। একনায়কতন্ত্রে স্বাধীনতা ও অধিকার বিনষ্ট করা হয়। একনায়কতন্ত্র একটি স্বেচ্ছাচারী শাসনব্যবস্থা।

আরো পড়ুন: সংবিধান ও সরকার সংবিধানের সংজ্ঞা ও শ্রেণীবিভাগ

গণতন্ত্রের সংজ্ঞা: প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ গণতন্ত্র

গণতন্ত্রের অর্থ হল জনগণের শাসন। গ্রীক Demos ও Kratia শব্দদ্বয় হতে Democracy শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে। Demos শব্দের অর্থ জনসাধারণ এবং Kratia শব্দের অর্থ শাসন বা ক্ষমতা। সুতরাং শব্দগত বা উৎপত্তিগত অর্থে গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণ পরিচালিত শাসনব্যবস্থা। গণতন্ত্র হচ্ছে এমন এক ধরনের সরকার ব্যবস্থা যেখানে ক্ষমতা জনগণের হাতে ন্যস্ত থাকে। চিন্তাবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে গণতন্ত্র শুধুমাত্র সরকার ব্যবস্থাই নয় বরং এক ধরনের জীবন দর্শন বা জীবনপদ্ধতি।

বিভিন্ন লেখক ও চিন্তাবিদ গণতন্ত্র শব্দটিকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। প্রাচীন গ্রীকরা গণতন্ত্র শব্দটিকে বহুজনের শাসন বলে উল্লেখ করেছেন। আড়াই হাজার বছর পূর্বে গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস গণতন্ত্রের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে বলেন, "গণতন্ত্র হচ্ছে এমন এক ধরনের শাসন ব্যবস্থা যেখানে শাসন ক্ষমতা কোন শ্রেণীর উপর ন্যস্ত না থেকে বরং সমাজের সকল সদস্যের হাতে ন্যস্ত থাকে।" প্রফেসর সিলী বলেন, "এটি এমন এক ধরনের সরকার ব্যবস্থা যেখানে প্রত্যেকের অংশ আছে।" (A government in which everyone has a share.)। লর্ড ব্রাইস, 'Modern Democracy' নামক গ্রন্থে বলেন, "Democracy is that form of government in which the ruling of a state is legally vested not in any particular class or classes but in the members of the community as a whole." অর্থাৎ গণতন্ত্র হচ্ছে সেই ধরনের শাসন ব্যবস্থা যাতে রাষ্ট্রশাসন আইনত কোন বিশেষ শ্রেণী বা শ্রেণীগুলোর হাতে না থেকে সমাজের নাগরিকদের হাতে থাকে।

সি. এফ স্ট্রং সুন্দরভাবে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়েছেন। তিনি বলেন, "শাসিতগণের সক্রিয় সম্মতির উপর যে সরকার প্রতিষ্ঠিত তাকে গণতন্ত্র বলে।" (Democracy implies that government which shall rest on active consent of the governed.) অধ্যাপক লিন্ডসে উল্লেখ করেন যে, গণতন্ত্র সরকারের ন্যায় সমাজেরও একটি তত্ত্ব বটে (Democracy is a theory of society as well as a theory of government)। কার্ল জি ফ্রেডরিখ বলেন, "গণতন্ত্র হচ্ছে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন সংঘটনের জন্য স্বীকৃত একটি প্রধান উপায়।"

১৮৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন গণতান্ত্রিক সরকারের স্বরূপ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, "গণতন্ত্র হল জনগণের, জনগণের জন্য এবং জনগণের দ্বারা সরকার।" (Democracy is a government of the people, for the people and by the people) জনগণের সরকার বলতে জনগণের প্রতি অনুগত সরকারকে বুঝায়। জনগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের কল্যাণে প্রতিনিধির মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালনা করে থাকতে পারে। স্যার ক্রিপসের মতে, "গণতন্ত্র হচ্ছে সেই শাসনব্যবস্থা যেখানে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি সকল বিষয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের ইচ্ছাকে প্রভাবিত করতে পারে।" ম্যাকাইভারের মতে, "গণতান্ত্রিক শাসনে সরকার জনগণের এজেন্ট মাত্র এবং তারা সরকারকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য করে।"

আরো পড়ুন: রিসালাত নবুওয়াত রিসালাত ও নবুওয়াত-এর পরিচয়

প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ গণতন্ত্র

গণতন্ত্র দু'রকমের হতে পারে। যথা:

১. প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র ও

২ প্রতিনিধিত্বমূলক বা পরোক্ষ গণতন্ত্র।

১. নাগরিকগণ যখন সরাসরিভাবে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করে রাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রয়োগ করে, নীতি নির্ধারণ করে এবং আইন প্রণয়ন করে তখন তাকে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বলে। এই শাসন ব্যবস্থায় নাগরিকগণ একটি সভায় সম্মিলিত হয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করে থাকে। প্রাচীন গ্রীসের নগররাষ্ট্রগুলোতে এই ধরনের প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।

আধুনিককালে সুইজারল্যান্ডের চারটি ক্যান্টন প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের ভিত্তিতে শাসিত হয়। বর্তমান যুগে প্রত্যেক গণতন্ত্র কার্যকর করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কেবলমাত্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোতে কার্যকর করা যেতে পারে। আধুনিক রাষ্ট্র বহু জনসংখ্যা অধ্যুষিত জাতি-রাষ্ট্র। এসব রাষ্ট্রে জনসংখ্যা খুব বেশী এবং বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। সেহেতু প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের পরিবর্তে পরোক্ষ গণতন্ত্র চালু করা হয়েছে।

২. এখন আমরা পরোক্ষ গণতন্ত্র সম্পর্কে আলোচনা করব। পরোক্ষ গণতন্ত্র হল জনগণের প্রতিনিধির শাসন। জন স্টুয়ার্ট মিল বলেন যে, পরোক্ষ গণতন্ত্র হল সেই শাসন ব্যবস্থা যেখানে জনগণ পর্যায়ক্রমিক নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে জনসাধারণ সরাসরি শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করতে পারে না। যেমন কোন অঞ্চলের ৮০/৯০ হাজার ভোটার ভোট দিয়ে একজন জনপ্রতিনিধিকে ৩/৪ বছরের জন্য নির্বাচিত করে এবং ঐ অঞ্চলের মানুষ তাঁর মাধ্যমে শাসন ক্ষমতার অংশীদার হয়। নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ জনগণের কল্যাণে জনগণের শাসন কার্য পরিচালনা করেন। আধুনিক যুগ মূলত পরোক্ষ গণতন্ত্রের যুগ।

সারকথা

উপরোক্ত আলোচনার আলোকে আমরা বলতে পারি যে, গণতন্ত্র হচ্ছে মূলতঃ সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থে গঠিত ও পরিচালিত সরকার। জনমত হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রাণ। সুতরাং যে শাসন ব্যবস্থা জনমতের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে তাকে গণতন্ত্র বলে। সাধারণভাবে গণতন্ত্রকে দু'ভাগে ভাগ করা যায়-প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র ও পরোক্ষ গণতন্ত্র।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url