সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি ও তার কার্যকারিতার

আজ এই আটিকেলটিতে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি ও তার কার্যকারিতার ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির সংজ্ঞা সম্বন্ধে বর্ণনা করতে পারবেন। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ প্রকৃতপক্ষে বাস্তবসম্মত ও সম্ভব কিনা তা ব্যাখ্যা করতে পারবেন।


ভূমিকা

রাষ্ট্র একটি বিমূর্ত ধারণা। রাষ্ট্র সরকারের মাধ্যমে তার ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে থাকে বিভিন্ন প্রকার কার্যাবলী সম্পাদনের মাধ্যমে। গতানুগতিকভাবে এ সব কাজ সম্পাদনে আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ দায়িত্ব পালন করে থাকে। কর্ম সম্পাদনে এক বিভাগ অন্য বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করলে ব্যক্তি স্বাধীনতার পথে প্রতিবন্ধকতা বা হুমকি সৃষ্টি হবার আশঙ্কা দেখা দেয়। কিন্তু যেহেতু সরকার একটি জৈব সত্ত্বার মত সেহেতু তিনটি বিভাগের কাজের মধ্যে সুস্পষ্ট বিভাজন করাও সম্ভব নয়, সর্বদা কাম্যও নয়। কারণ, সরকারের কাজ রাষ্ট্রের নাগরিক মানুষকে নিয়ে। মানবজীবনের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে একে ভাবতে হয় বলে বিশেষ এক বিভাগ সর্বদা স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে কাজ করতে পারে না। তাকে প্রয়োজনে অন্য বিভাগের সাথে পারস্পরিক ক্রিয়া বা সহযোগিতা করে চলতে হয়। এসব কারণে, দেখা যায় যে, কর্ম সম্পাদনের ক্ষেত্রে সরকারী বিভাগগুলো সাধারণক্ষেত্রে একে অপরের থেকে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র হলেও বিশেষ ক্ষেত্রে নির্ভরশীলতার সম্পর্কও তাদের মধ্যে রয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে এই ইউনিটটি রচিত।

আরো পড়ুন: সংবিধান ও সরকার সংবিধানের সংজ্ঞা ও শ্রেণীবিভাগ

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি: সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা

আধুনিক কালে পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্রই জাতীয় রাষ্ট্র। এদের আয়তন বিশাল, জনসংখ্যা বিপুল। তাছাড়া রাষ্ট্রের কাজও আগের তুলনায় বহুগুণ বেড়ে গেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি, মানুষের জীবন-যাপন পদ্ধতিতে জটিলতা বৃদ্ধি এবং কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণা রাষ্ট্রের কাজ বেড়ে যাবার প্রধান কারণ। রাষ্ট্রের সব কাজই সাধারণত আইন মাফিক পরিচালিত হয়। শাসন বিভাগের ছত্রচ্ছায়ায় প্রশাসনিক সংস্থাগুলো আইন প্রয়োগ করে। আইনসভা প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করে। আইন প্রয়োগের ফলে নাগরিক জীবনে কোন সমস্যা দেখা দিলে বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচার বিভাগ তার সমাধান করে। সহজ কথায় বলতে গেলে, আইন বিভাগ আইন তৈরি করবে, তা প্রয়োগ করবে শাসন বিভাগ এবং আইনের ব্যাখ্যা দান করবে বিচার বিভাগ। রাষ্ট্রের এ তিন ধরনের কাজে সরকারের তিনটি বিভাগ পৃথক ভাবে নিয়োজিত থাকবে এটাই ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের মূলকথা।

সংজ্ঞা: যে নীতি অনুযায়ী সরকারের তিনটি বিভাগ সংবিধান কর্তৃক তাদের জন্য নির্ধারিত ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করে, এক বিভাগ অন্য বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করে না, সে নীতিকেই ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি (Theory of separation of power) বলে। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের ধারণা নতুন কিছু নয়। গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটলের The Politics গ্রন্থের চতুর্থ পর্বের চতুর্দশ অধ্যায়ে এর সন্ধান পাওয়া যায়। তিনি সরকারের অঙ্গ বা বিভাগসমূহকে গণপরিষদ শাসকবর্গ এবং বিচার বিভাগ নামে আখ্যায়িত করেন। ফরাসী দার্শনিক মন্টেস্কু ১৭৪৮ সালে প্রকাশিত তার লিখিত The Spirit of Laws গ্রন্থে এ সম্বন্ধে সবচেয়ে পান্ডিত্যপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, "প্রত্যেক সরকারের তিন প্রকার ক্ষমতা রয়েছে। প্রথমটি; আইন প্রণয়ন কিংবা প্রণীত আইন বাতিল করা; দ্বিতীয়টি, শান্তিকালীন বা যুদ্ধকালীন অবস্থা বজায় রাখা, কূটনৈতিক মিশন প্রেরণ বা গ্রহণ করে গণনিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা ও অনধিকার প্রবেশ বন্ধ করা। তৃতীয়টি দ্বারা অপরাধীর শাস্তি বিধান বা ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে দ্বন্দ্ব মীমাংসা করা হয়।"

মন্টেস্কুর মতে, আইন প্রণয়ন ও শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা একই ব্যক্তি বা সংস্থার হাতে কেন্দ্রীভূত হলে কোন স্বাধীনতা থাকতে পারে না। কারণ, এতে একই শাসক বা সিনেট কর্তৃক স্বৈরাচারী আইন প্রণীত হবার এবং তা প্রয়োগের আশংকা থাকবে। আবার যদি আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের হাতে বিচার বিভাগীয় ক্ষমতার সমাবেশ ঘটে তাহলেও ব্যক্তি স্বাধীনতা হবে হুমকির সম্মুখীন। যদি তা আইন বিভাগের হাতে দেয়া হয়, তাহলে প্রজা সাধারণের জীবন শ্বৈর নিয়ন্ত্রণের কবলে পড়িত হবে। এ সব ক্ষমতা শাসন বিভাগের সাথে সংযুক্ত হলে বিচারকের আচরণ হবে হিংসা ও নির্যাতনমূলক।

ব্রিটিশ আইনবিদ ব্লাকস্টোন (Blackstone) এ প্রসঙ্গে বলেন, "আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের অধিকার একই ব্যক্তি বা একই ব্যক্তি-সংস্থার হাতে অর্পিত হলে জনগণের কোন স্বাধীনতা থাকবে না। শাসক স্বৈরাচারী আইন প্রণয়ন করে স্বেচ্ছাচারীর মত প্রয়োগ করবে। বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা আইন প্রণেতার হাতে দিলে জনগণের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তি স্বেচ্ছাচার বিচারকের কবলে পতিত হবে। তাঁরা নিজেদের মতামত দ্বারা নিজেদেরই সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করবে। সেখানে আইনের কোন কার্যকারিতা থাকবে না। বিচার ক্ষমতা শাসন ক্ষমতার সাথে যুক্ত হলে তা হবে আইন বিভাগের সাথে অসম।"

উপরের সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যার মূলকথা হল, সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা ভাগ করে দিতে হবে এবং প্রত্যেক বিভাগের ক্ষমতার সীমানা হতে হবে সুচিহ্নিত, যাতে এক বিভাগ অন্য বিভাগের সীমানায় প্রবেশ করতে না পারে। এটিই হচ্ছে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ। রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য মানবকল্যাণ। এ কল্যাণ সাধনে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। এ তত্ত্বে মনে করা হয় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের মাধ্যমেই তা সম্ভব।

আরো পড়ুন:  উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্য এবং সংবিধান প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন পদ্ধতি

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ কি সম্ভব?

এক কথায় বলতে গেলে সরকারের ক্ষমতার পূর্ণ পৃথকীকরণ বা স্বতন্ত্রীকরণ সম্ভব নয়। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এ বক্তব্য বিচার করা যায়। প্রথমত, মন্টেছু ও ব্লাকস্টোন- এর কথায় যা প্রকাশ পেয়েছে তা সর্বজনীন হতে পারে। এ নীতির আংশিক বাস্তবায়ন সম্ভব। কারণ, তাঁদের বক্তব্যে এক ব্যক্তি বা ব্যক্তি সংস্থার হাতে সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হলে সাধারণভাবে কি ঘটতে পারে তাই বুঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতার সীমানা নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায় না। কারণ, রাষ্ট্রদেহ হচ্ছে মানবদেহের মতই জৈবসত্তা। এর এক অংশ অন্য অংশের সাথে যুক্ত থেকে এবং একটি অপরটির সহায়তা করেই গোটা সত্তার অস্তিত্ত্ব বজায় রাখতে পারে। মানবদেহের মত সরকারের কোন অংশ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। Federalist নামক গ্রন্থে ম্যাডিসন বলেছেন, "প্রকৃতপক্ষে মন্টেস্থ যা বুঝাতে চেয়েছেন তা হল এক বিভাগের সম্পূর্ণ ক্ষমতা অন্য বিভাগের একই ব্যক্তি বা ব্যক্তিসংস্থার দ্বারা ব্যবহৃত হলে সরকার ব্যবস্থার মৌলিক নীতি লংঘিত হবে।"

কোন কোন লেখক সরকারের কাজ তিন বিভাগে বিভক্ত করার নীতিই মানতে রাজী নন। তাদের কেউ কেউ ক্ষমতাকে দু'শ্রেণীতে এবং কেউবা পাঁচ শ্রেণীতে বিভক্ত করার পক্ষপাতি। কিছু লেখক বিভাগগুলো পৃথক করে সরকারী কাজের মধ্যে নিবিড় ভারসাম্য স্থাপনের বিপক্ষে। তাঁদের মতে, সরকারী কাজ সমন্বয়ের মাধ্যমে এক সাথে, এক তালে, একীভূত পদ্ধতিতে হওয়া ভাল। এদের সকলের মত হল, সরকারের কাজকে পৃথকভাবে চিহ্নিত হতে হবে, কাজের বিশেষীকরণ করতে হবে এবং তার মধ্য দিয়ে অর্জিত হবে দক্ষতা।

প্রায় সব সরকারেই বিভাগগুলো পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত। এক বিভাগ অন্য বিভাগের ওপর নির্ভরশীল। এক বিভাগকে এমন কিছু কাজ করতে হয় যা সত্যিই অন্য বিভাগের কাজ। এর মধ্যে বিচার বিভাগের অবস্থান সাধারণভাবে সুস্পষ্ট। বিচারকের চাকরির মেয়াদ আগে থাকতে নির্ধারিত থাকায় তাঁরা রাজনৈতিক পক্ষপাত বা বাহ্যিক প্রভাব হতে মুক্ত থাকেন। সাধারণত তাঁদের নিয়োগ করেন শাসন বিভাগের কর্তৃপক্ষ। তার পরও বিচার বিভাগীয় কিছু কাজ আইনসভা ও শাসন বিভাগকে করতেই হয়। আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিচার বিভাগ নিছক একটি অংশীদার। তাছাড়া প্রশাসনিক কর্তব্যের ধারাবাহিকতায় শাসন বিভাগকে ক্ষমতা প্রদর্শন ও দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য যে কাজ করতে হয় তাতে বিচার বিভাগীয় কর্তৃত্ত্বই প্রকাশ পায়।

আইন ও শাসন বিভাগের পূর্ণ পৃথকীকরণ সম্ভব নয়। শাসন বিভাগ যে আইন বাস্তবায়িত করে তার বিরাট অংশ আইনসভা কর্তৃক প্রণীত। সংসদীয় সরকারে মন্ত্রিপরিষদ এমন সব আইন প্রণয়নে পার্লামেন্টকে নির্দেশ প্রদান করে যা শাসন বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ হিসাবে এর সদস্যগণকে প্রয়োগ করতে হবে। এখানে একই ধরনের ব্যক্তিমন্ডলী দু'টি বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করেন। অন্যদিকে আইন বিভাগ এর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বলে শাসন বিভাগের কর আরোপ ও সংগ্রহ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। আইন বিভাগের অনুমোদন ছাড়া কোন দেশেই শাসন বিভাগ চুক্তি সম্পাদন করতে পারে না। শাসন বিভাগ তার ভেটো ক্ষমতা, অধ্যাদেশ জারির ক্ষমতা এবং সম্পূরক আইন প্রণয়ন ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে আইন বিভাগীয় কর্তৃত্বে অংশগ্রহণ করে থাকে। সামরিক বাহিনীর উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকায় শাসন বিভাগ যুদ্ধের সময় সমগ্র সরকারের উপর ব্যাপক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে।

ব্রিটেনের উদাহরণ

গণতন্ত্রের সূতিকাগার ও চর্চাকেন্দ্র ব্রিটেনে সংসদীয় ব্যবস্থা বিদ্যমান। এখানে মন্ত্রিসভা আইন পরিষদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মন্ত্রীসভার সদস্যগণ মূলত আইনসভার সদস্য এবং আইনসভার নিকট প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। তাছাড়া আইন প্রণয়নে শাসক দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবর্গ হিসাবে মন্ত্রীগণ আইনসভার কমিটির মত। ওয়াল্টার বেজহট (Walter Bazehot) তাই বলেন, "The British Cabinet is not merely a fusion but almost a complete union of both the legislative and the executive functions of the government" অর্থাৎ ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা শুধু একটি মিশ্রণ মাত্র নয় বরং সরকারের আইন ও শাসন সম্বন্ধীয় কার্যাদির পূর্ণ সমাহার। ব্রিটেনে কেবিনেটের পরামর্শে রাণী বা রাজা বিচারকগণকে নিযুক্ত করেন। তাঁরা তাঁদের কাজের জন্য দায়ী থাকেন কেবিনেটের নিকট এবং সদাচরণ সাপেক্ষে স্বীয় পদে বহাল থাকেন। পার্লামেন্টের দু'কক্ষের সুপারিশক্রমে তাঁদেরকে অপসারণ করা, যায়। বিচারক প্রদত্ত রায়কে আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ ঘোষণা করার অধিকার পার্লামেন্টের রয়েছে। তাছাড়া লর্ড সভার সভাপতি লর্ড চ্যান্সেলর মন্ত্রিপরিষদের সদস্য এবং প্রধান বিচারালয়ের একজন বিচারক। উপরের আলোচনা থেকে বলা যায় যে, ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থায় একই ব্যক্তি সরকারের বিভিন্ন বিভাগে দায়িত্ব পালন করায় ক্ষমতার ব্যক্তিগত স্বতন্ত্রীকরণ ঘটে নি। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে বিভাগ তিনটির মধ্যে যে স্বতন্ত্রীকরণ ঘটেছে তাকে বিভাগীয় স্বতন্ত্রীকরণ Organic separation বলে। এ থেকে বলা যায় যে, ব্রিটেনে সরকারী ক্ষমতার বিভাগীয় স্বতন্ত্রীকরণ ঘটেছে।

আরো পড়ুন: গণতন্ত্রের গুণাবলী গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ, সাফল্যের শর্তাবলী ও সীমাবদ্ধতা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ

গণতন্ত্রের আরেক আদর্শ ক্ষেত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সে দেশের সংবিধান প্রণেতাগণ সংবিধান রচনার সময় মন্টেজুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত হন। সেজন্য ঐ সংবিধানে এ তত্ত্বকে রূপায়িত করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এ প্রসঙ্গে "Theory and Practice of Modern Government" গ্রন্থে হারমেন ফাইনার (Finer) বলেন "The American constitution was consciously and elaborately made an essay on the separation of powers" অর্থাৎ মার্কিন সংবিধানে সচেতন ও বিশদভাবে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির উপর একটি প্রবন্ধ লিখিত হয়েছে।

মার্কিন শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি এবং কংগ্রেস পরস্পরের নিয়ন্ত্রণমুক্ত। রাষ্ট্রপতি তাঁর চার বছরের মেয়াদে একজন অত্যন্ত ক্ষমতাবান শাসকের মতই শাসন করে থাকেন। একমাত্র দীর্ঘস্থায়ী ও জটিল অভিশংসন পদ্ধতিতে সংবিধান লংঘনের সুষ্পষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত না হলে কংগ্রেস তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে না। মার্কিন কেবিনেট তাঁর কাজের জন্য শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতির নিকট দায়ী। অন্যদিকে সুপ্রীম কোর্ট কংগ্রেস ও রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রণমুক্ত। রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের দ্বিতীয় কক্ষ সিনেটের অনুমোদনক্রমে বিচারকগণকে নিয়োগ করেন বটে, কিন্তু বিচারকার্যে তিনি কোনরূপ হস্তক্ষেপ করেন না। উপরের এ বর্ণনায় যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত বলে মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। রাষ্ট্র যে মানবদেহের মতই একটি জৈব সত্তা তা এ শাসন ব্যবস্থায় বিশেষভাবে পরিস্ফুট।

মার্কিন রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসে বাণী প্রেরণ করেন। তিনি প্রয়োজনে নির্বাহী আদেশ জারি করে রাষ্ট্রের দায়িত্ব সম্পাদন করেন, ভেটো প্রদান করেন কংগ্রেস প্রণীত বিলে। এসব কাজের দ্বারা তিনি আইন প্রণয়নকে প্রভাবিত করেন। মার্কিন রাষ্ট্রপতি সে দেশের জনমতের কেন্দ্রবিন্দু এবং প্রধানতম প্রতিনিধি। তাঁর বক্তৃতা বিবৃতি ও সিদ্ধান্ত জনমতকে চালিত ও প্রভাবিত করে। ফলে কংগ্রেস আইন প্রণয়ন কালে জনমতের আবেগ ও অনুভূতি উপেক্ষা করতে পারে না।

সিনেটীয় সৌজন্য (Senatorial courtesy) মার্কিন শাসন ব্যবস্থায় এক উল্লেখযোগ্য দিক। রাষ্ট্রপতি তাঁর পদে নির্বাচিত হবার পর সরকারের কেবিনেটসহ বিভিন্ন উচ্চপদে নিয়োগের জন্য যে সব ব্যক্তিকে মনোনীত করেন কংগ্রেসের দ্বিতীয় কক্ষ সিনেট (Senate)- এর অনুমোদন ছাড়া তাঁদের নিয়োগ করতে পারেন না। সাধারণত সিনেট তাঁর মনোনয়নকে সৌজন্যের খাতিরে অনুমোদন করে। তবে প্রয়োজনে আপত্তি উত্থাপনেরও বহু নজীর বিদ্যমান। তাছাড়া কংগ্রেস অর্থসংক্রান্ত বিল পাস ও বাজেট অনুমোদন না করলে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কোন অর্থ ব্যয় করতে পারেন না।

আইন প্রণয়নে কংগ্রেস শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত একটি সার্বভৌম সংস্থা। কিন্তু সুপ্রীমকোর্ট কংগ্রেস প্রণীত আইনকে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা দ্বারা সংবিধান পরিপন্থি ঘোষণা করলে সে আইন আর কার্যকর থাকে না। বাস্তবে সংবিধানের ব্যাখ্যায় সুপ্রিম কোর্টই সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ। বিচারপতি হিউজেস (Hughes) বলেন, "We are under a constitution, but the constitution is, what the judges say it is." অর্থাৎ আমরা একটি সংবিধানের অধীনে, কিন্তু সংবিধান তাই যা বিচারপতিরা বলেন।

উপরের আলোচনায় দেখা যায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি ভাবগত ভাবে বিরাজমান। বাস্তবে সেখানে এক বিভাগকে অন্য বিভাগের প্রতি নির্ভরশীল রেখে ক্ষমতার ভারসাম্যপূর্ণ বণ্টন করা হয়েছে যা নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি (Theory of checks and balances) এর বহিঃপ্রকাশ। বিশ্বের প্রায় সকল সরকারেরই ক্ষমতা মোটামুটি এভাবেই বিন্যস্ত করা হয়েছে। এটিই বাস্তব ও প্রয়োজনীয়। তাই বলা যেতে পারে যে, ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ সম্ভব নয়, কাম্যও নয় (Theory of separation of power is neither possible, nor desirable)

সারকথা

আধুনিক সব রাষ্ট্রই বিশাল আয়তন ও বিপুল লোকসংখ্যা অধ্যুষিত। সরকারের কাজও তাই অনেক বেশি। এ সব কাজকে বিভক্ত করে আইন, শাসন ও বিচার বিভাগের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়েছে। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুযায়ী আইনসভা আইন প্রণয়ন করবে, শাসন বিভাগ সে আইন দিয়ে দেশ পরিচালনা করবে এবং বিচার বিভাগ বিভিন্ন দ্বন্দ্ব ও সমস্যার সমাধানে সে আইন দিয়ে বিচার করবে। সরকারের এ তিন ধরনের কাজ করতে গিয়ে তিন বিভাগের কোনটিই অন্যের এখতিয়ারে হস্তক্ষেপ করবে না। এটাই ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের মূলকথা। এর ব্যতিক্রম ঘটলে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও অধিকার ক্ষুন্ন হবে। তবে রাষ্ট্র জীবদেহের মত। এর বিভাগ তিনটিকেও তাই বিচ্ছিন্ন রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু সরকারের কাজকে তিন বিভাগের মধ্যে কঠিনভাবে সীমিত করলে সরকারই অচল হয়ে পড়বে। এজন্য এক বিভাগ অন্য বিভাগের উপর সব সময় হস্তক্ষেপ না করে কিংবা সর্বদাই দূরে দূরে না থেকে প্রয়োজনমত পরস্পরের ব্যাপারে সমন্বয় সাধন করে ভারসাম্য স্থাপন করবে। এ নীতিকেই বলা হয় ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি। পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট গণতন্ত্র ব্রিটেন বিভাগকেন্দ্রিক স্বতন্ত্রীকরণ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বতন্ত্রীকরণ নীতিরই প্রতিফলন ঘটেছে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url