নির্বাচকমন্ডলী ও রাজনৈতিক দল নির্বাচকমন্ডলীর গুরুত্ব ও কার্যাবলী

নির্বাচকমন্ডলী ও রাজনৈতিক দল নির্বাচকমন্ডলী সম্বন্ধে আলোচনা করতে পারবেন; রাষ্ট্রপরিচালনায় নির্বাচকমন্ডলীর গুরুত্ব অনুধাবন করবেন এবং নির্বাচকমন্ডলীর কার্যাবলী ব্যাখ্যা করতে পারবেন।

ভূমিকা

আধুনিককালে সরকার মূলত দলীয় সরকার। এসব সরকার নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনগণের এক বিরাট অংশ দ্বারা সমর্থিত। রাজনৈতিক অধিকার তথা ভোটাদানের অধিকার প্রাপ্ত জনগোষ্ঠীই নির্বাচকমন্ডলী নামে পরিচিতি। নির্বাকমন্ডলী সরকার গঠন ও সরকারী কর্ম পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। রাষ্ট্রপরিচালক নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্বাচকমন্ডলী জনমতের প্রতিফলন ঘটিয়ে থাকে। কিন্তু জনমত আপনাআপনিই সংগঠিত হয় না। এর জন্য প্রয়োজন হয় রাজনৈতিক দল এবং এর তৎপরতার। মূলত রাজনৈতিক দলই জনমতকে নিজেদের পথে আনার জন্য প্রচারণা চালায় এবং এর ভিত্তিতে নির্বাচকমন্ডলীকে তাদের দলীয় কর্মসূচি সমর্থন করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে থাকে। নির্বাচনে এরই প্রভাব পড়ে। নির্বাচকমন্ডলী কখনও পরোক্ষভাবে, কখনও প্রত্যক্ষভাবে এ সমর্থন ব্যক্ত করে থাকে। এ ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা পালন করে রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রশাসনে সরকারের তিনটি বিভাগের পাশাপাশি একটি স্বতন্ত্র বিভাগের বৈশিষ্ট্য নিয়ে গড়ে উঠেছে। সরকার গঠন ও পরিচালনায় রাজনৈতিক দলের ভূমিকা অপরিহার্য। তবে দলব্যবস্থা হবে কেমন তা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের প্রকৃতি ও জনগণের মানসিকতার উপর। এসব বিষয়কে সামনে রেখেই গড়ে উঠেছে এ ইউনিটটি। এতে পাঁচটি পাঠ অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।

আরো পড়ুন: সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি ও তার কার্যকারিতার

নির্বাচক কাকে বলে?

আইন অনুযায়ী যে ব্যক্তি আইনসভার সদস্য নির্বাচনে কিংবা দেশের প্রেসিডেন্ট পদে বা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচনে ভোট দান করে তাকেই নির্বাচক বলে। এককথায় নির্বাচক অর্থ হচ্ছে ভোটার। অর্থাৎ যে ভোট দেয় বা ভোট দেবার অধিকার রাখে। অতএব ভোটার বা নির্বাচক হচ্ছে এক ব্যক্তি। এ ব্যক্তির অধিকার থাকে তাঁর পছন্দের প্রতিনিধি বেছে নেবার। এ অধিকার বলে কোন ব্যক্তি আইনসভায় সদস্য পদে বা শাসন বিভাগের সর্বোচ্চ পদে যখন কাউকে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে বেছে নেয় তখন সে হল ভোটার। যেমন বাংলাদেশে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচনে দেশের ১৮ বছর বয়স্ক সব নারী-পুরুষ তাঁদের ইচ্ছেমত প্রার্থীর পথে ভোট দেয়। ভোটদানকারী এ সব লোকের প্রত্যেকে একেকজন ভোটার।

নির্বাচকমন্ডলীর সংজ্ঞা

এককথায় নির্বাচকমন্ডলী হচ্ছে সকল ভোটার বা নির্বাচকদের সমষ্টি। প্রত্যেক আধুনিক রাষ্ট্রে এ ধরনের ব্যক্তি রয়েছে যাঁরা তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে। এসব ব্যক্তি আইন অনুযায়ী প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার লাভ করে। এ সকল ব্যক্তির সমাহারকে নির্বাচকমন্ডলী (Electorate) বলে।

নির্বাচকমন্ডলী সংক্রান্ত ধারণা আরো পরিস্কার করতে হলে একটু পিছনে ফিরে তাকাতে হয়। গণতন্ত্র দু'প্রকার। এক প্রত্যক্ষ ও দুই পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে নাগরিকগণ একত্রে আইন প্রণয়ন করতে এবং শাসন পরিচালনা করতে পারে। যেমন: প্রাচীন গ্রীসের নগররাষ্ট্রগুলো করা হত। বর্তমানে সুইজারল্যান্ডে এমনটি আছে। এটা খুব কম সংখ্যক নাগরিকের দেশে সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সব দেশই লোকসংখ্যায় পরিপূর্ণ। তাছাড়া সবাই একত্রে আইন প্রণয়ন ও শাসন পরিচালনার কাজ এ যুগে সম্ভব নয়। সে জন্য নাগরিকগণ তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে এসব কাজ সম্পন্ন করতে চান। ফলে প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের যারা যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিচালিত হয় তাকে পরোক্ষ গণতন্ত্র বলে। পরোক্ষ গণতন্ত্রে সরকার গঠন ও আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী যেসব নাগরিক তাঁদের পছন্দমত প্রতিনিধি নির্বাচিত করার অধিকার পায় তারাই সমষ্টিগতভাবে নির্বাচকমন্ডলী নামে পরিচিত।

আরো পড়ুন:  উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্য এবং সংবিধান প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন পদ্ধতি 

নির্বাচকমন্ডলীর গুরুত্ব

আধুনিক যুগে পৃথিবীর প্রায় সবখানেই গণতন্ত্রের জোয়ার বইছে। সর্বত্র গণতন্ত্র পুরাপুরি ও পূর্ণমাত্রায় প্রতিষ্ঠিত না হলেও জনগণের সম্মতি নিয়ে শাসনক্ষমতা লাভের প্রক্রিয়া সর্বত্রই চালু আছে। তাই সম্মতির দৃষ্টিকোণ হতে নির্বাচকমন্ডলীর গুরুত্ব ক্রমশই বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল।

গণসার্বভৌমত্বের প্রকাশ ঘটে: গণতন্ত্রে জনগণকে সার্বভৌম মনে করা হয়। শাসন ক্ষমতার উৎস যে জনগণ-এটি গণতন্ত্রের মৌলিক বিশ্বাস। তাই শাসন ক্ষমতা লাভের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নেতাকে জনগণের দ্বারে যেতে হয়। জনগণ তাদের মধ্যে কার প্রতি আস্থাশীল তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে নির্বাচনের মাধ্যমে। আর এ নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নির্বাচকমন্ডলী জনগণের সার্বভৌমত্বের মহিমা প্রতিষ্ঠিত করে।

সরকারকে প্রভাবিতকরণ: নির্বাচকমন্ডলীর দায়িত্ব ভোটাধিকার প্রয়োগের মধ্য দিয়েই শেষ হয় না। বরং নির্বাচনের আগে ও পরে নির্বাচকমন্ডলীর শিক্ষিত ও অগ্রসর অংশ সরকারী কার্যকলাপের পক্ষে ও বিপক্ষে প্রচার চালিয়ে জনমতের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে।

সরকারী কর্মসূচিতে প্রভাব সৃষ্টি:: নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন হয়ে সরকার যেসব নীতিনির্ধারণ করে ও কর্মসূচি প্রণয়ন করে সে বিষয়ে নির্বাচকমন্ডলীকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়। এ পর্যায়ে সরকারকে নির্বাচকমন্ডলীর আস্থার কথা বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হয়। সরকার এমন কর্মসূচি গ্রহণ থেকে বিরত থাকে যা নির্বাচকমন্ডলীর নিকট বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।

সরকারের চতুর্থ বিভাগ: সাংবিধানিক আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে নির্বাচক মন্ডলীর গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষত নির্বাচকমন্ডলী গণভোট, গণউদ্যোগ ও পদচ্যুতি নামক তিনটি প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করে সংবিধান সংশোধন, আইন প্রণয়ন ও প্রতিনিধি অপসারণে জড়িত হতে পারে। সুইজারল্যান্ডে এ পদ্ধতি বিদ্যমান।

আরো পড়ুন: এককেন্দ্রিক সরকার এককেন্দ্রিক সরকারের বৈশিষ্ট্য এককেন্দ্রিক সরকারের  দোষ ও  গুণ

নির্বাচকমন্ডলীর কার্যাবলী

নির্বাচনে অংশগ্রহণ: গণতন্ত্রে দেশের আইন অনুসারে নির্দিষ্ট বয়সের নরনারী ভোটদানের অধিকারী। এ অধিকার প্রয়োগের জন্য তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। তারা আইনসভার নির্বাচনে নিজেদের পছন্দ ও বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে সৎ ও যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন করে। রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকারে সরাসরি কিংবা নির্বাচনী সংস্থার সদস্য নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচকমন্ডলী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে থাকে।

সরকারী কার্যাবলী তদারকি: নির্বাচকমন্ডলী শুধু প্রতিনিধি নির্বাচিত করেই ক্ষান্ত থাকে না। নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ দেশ ও জনগণের জন্য উপযোগী আইনপ্রণয়ন কিংবা সরকারী নেতৃবৃন্দ ক্ষমতার অপব্যবহার করছে কিনা তার উপর সজাগ দৃষ্টি রাখে। তারা এসব বিষয়ে ব্যাপক জনমত গঠন করতে পারে এবং প্রয়োজনে পরবর্তী নির্বাচনে নতুন কোন দল ও ব্যক্তিবর্গকে নির্বাচিত করে প্রতিনিধি পরিবর্তন করতে পারে।

আইন প্রণয়ন: প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে গণভোট ও গণউদ্যোগের মাধ্যমে নির্বাচকমন্ডলী সরাসরি আইন প্রণয়নে অংশগ্রহণ করে। পরোক্ষ গণতন্ত্রে বিভিন্ন যোগাযোগ ও গণমাধ্যমে মতামত প্রদান করে আইন প্রণেতাদেরকে উপযোগী আইন প্রণয়নে প্রভাবিত করতে পারে।

সংবিধান সংশোধন: আইন বিভাগ সংবিধানের কোন মৌলিক সংশোধন করলে তা নির্বাচকমন্ডলীর সম্মতি ছাড়া কার্যকর হয় না। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ যদি সংবিধানে কোন মৌলিক সংশোধন করে তবে রাষ্ট্রপতি তাতে সম্মতি দেবার পূর্বে গণভোটের মাধ্যমে নির্বাচকমন্ডলীর মতামত গ্রহণ করতে পারেন।

দলকে প্রভাবিত করা: দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলই নির্বাচকমন্ডলীর দ্বারা প্রভাবিত অর্থাৎ প্রতিটি দলকেই নির্বাচকমন্ডলীর মেজাজ, মর্জি, চাহিদা, মনোভাব প্রভৃতির প্রতি খেয়াল রেখে দলীয় সমর্থন বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হয়। এভাবে নির্বাচকমন্ডলী দলগুলোকে প্রভাবিত করে। কারণ, চূড়ান্ত পর্যায়ে সরকারী ক্ষমতা লাভের জন্য নির্বাচকমন্ডলীর আস্থা ও সমর্থন লাভ অপরিহার্য।

সারকথা

নির্বাচকমন্ডলীই একটি রাষ্ট্রের ক্ষমতার নির্ধারক। কোন দল ক্ষমতায় যাবে, রাষ্ট্র পরিচালনা করবে, আইন প্রণয়ন করবে তা নির্ধারণে নির্বাচকমন্ডলীর রায়ই চূড়ান্ত। তাই দেখা যাচ্ছে যে, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব যেমন নির্বাচকমন্ডলীর রায়ের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়, তেমনি সরকার গঠন হতে শুরু করে সরকারী কার্যক্রম পরিচালনার তদারকি, আইন প্রণয়ন, সংবিধান সংশোধন এবং রাজনৈতিক দলের সমস্ত কার্যক্রম প্রভাবিতকরণে নির্বাচকমন্ডলী সক্রিয় ও ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তাই বলা যায় যে, প্রতিনিধিত্বশীল ও প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচকমন্ডলী সরকারের চতুর্থ অঙ্গ স্বরূপ।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url