সর্বজনীন ভোটাধিকার: প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্বাচন

সর্বজনীন ভোটাধিকার: প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্বাচন সর্বজনীন ভোটাধিকার সম্বন্ধে আলোচনা করতে পারবেন; সর্বজনীন ভোটাধিকারের সুবিধা ও অসুবিধা ব্যাখ্যা করতে পারবেন; প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্বাচন কি তা বলতে পারবেন; প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্বাচনের ত্রুটি ও গুণাবলী বিশ্লেষণ করতে পারবেন।

সর্বজনীন ভোটাধিকারের অর্থ

গণতন্ত্রের মূল নিহিত রয়েছে সর্বজনীন ভোটাধিকারের মধ্যে। গণতন্ত্রের মূল্যবোধই দাবী করে যে, রাষ্ট্র পরিচালনায় সকল নাগরিকেরই অংশগ্রহণের অধিকার রয়েছে। সামাজিকভাবে সকল নাগরিকই সমান এবং রাজনৈতিকভাবে এই সমানাধিকার প্রয়োগের অধিকার তাদের রয়েছে। এ সূত্র অনুযায়ী যখন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষে ও পেশা নির্বিশেষে সকলেই রাষ্ট্র পরিচালনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার লাভ করে তখন তাকে সর্বজনীন ভোটাধিকার বলে। উন্মাদ, দেউলিয়া, রাজদ্রোহী ও অপ্রাপ্তবয়স্ক ছাড়া দেশের সকলেই এ অধিকার ভোগ করতে পারে। ফরাসী দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাক রুশোর বিখ্যাত তত্ত্ব সাধারণ ইচ্ছা (General Will) হতেই সর্বজনীন ভোটাধিকার তত্ত্বের উদ্ভব। কিন্তু জন স্টুয়ার্ট মিল, লেকী, স্যার হেনরী মেইন, সিজউইক, বহুন্টসলী প্রমুখ এ তত্ত্বের প্রধান বিরোধী।

আরো পড়ুন: সরকার কি সরকারের গতানুগতিক শ্রেণীবিভাগ

সর্বজনীন ভোটাধিকারের সুবিধা

• রাজনৈতিক সমানাধিকারের প্রতীক সর্বজনীন ভোটাধিকারই একমাত্র গণতান্ত্রিক পদ্ধতি যার মাধ্যমে জনসাধারণের রাজনৈতিক সাম্যের অধিকার নিশ্চিত হয়। প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক এ অধিকারের সাহায্যে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ করে।

আইনসভার প্রতিনিধিত্ব সর্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে এ সত্যই প্রতিষ্ঠিত হয় যে, দেশের আইনসভা মূলত: জনগণেরই প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত। আইনসভায় যারা নির্বাচিত হন তারা জনগণের মুখপাত্র হিসেবে তাদের সুখদুঃখের সাথে জড়িত সকল প্রশ্নের মীমাংসা করেন।

সুষম প্রতিনিধিত্ব এ পদ্ধতির ফলে রাজনৈতিক সাম্য ভোগের ক্ষেত্রে মোট জনসংখ্যার কোন অংশই বাদ পড়ে না। সম্প্রদায় ও বংশ, ধনী ও দরিদ্র, শহর ও গ্রাম, নারী ও পুরুষ, দলিত ও শ্রমিক শ্রেণীর সকলেই এ অধিকার ভোগের সমান সুযোগ পায়।

বিশেষ ভোটাধিকার বাতিল করে সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে বিশেষ শ্রেণী বা সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ ভোটাধিকার পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রয়োজন হয় না। এতে সকল ব্যক্তির মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। বঞ্চিত শ্রেণীর হীনমন্যতা দূর হয়।

• ব্যক্তির বিকাশে সহায়ক: এ পদ্ধতি ব্যক্তির মধ্যে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করে। রাষ্ট্র পরিচালনায় তার মতামতের মূল্য স্বীকৃতি পাওয়ায় তাঁর মধ্যে মর্যাদাবোধ দৃষ্টি হয়। ভোটাধিকার প্রাপ্ত হলে ব্যক্তির মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। তারা নিজেদের গুরুত্ব ও মর্যাদা উপলদ্ধি করতে পারে। লর্ড ব্রাইস বলেন, 'রাজনৈতিক ভোটাধিকার মানুষকে ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদাসম্পন্ন করে।'

আনুগত্য প্রসারিত করে ভোটাধিকার প্রাপ্ত ব্যক্তির সংখ্যা যত কম হবে রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত ব্যক্তির সংখ্যাও তত কম হবে। কারণ, ভোটাধিকার হতে বঞ্চিত ব্যক্তি রাষ্ট্রের প্রতি বৈরী হতে পারে। সে জন্য আনুগত্যের পরিসীমা ব্যপ্তির লক্ষ্যে সর্বজনীন ভোটাধিকার পদ্ধতিই উত্তম।

সার্বজনীন ভোটাধিকারের অসুবিধাসমূহ

• জন্ম গত অধিকার নয়: অধিকার অর্জনের বিষয়, কেউই জন্মগতভাবে তা দাবি করতে পারে না। এ প্রসঙ্গে মিল বলেন, আমি এটাকে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য মনে করি। কারণ ন্যূনতম লিখতে, পড়তে ও সাধারণ হিসাবের কাজ করতে না পারলে কোন ব্যক্তিরই ভোটাধিকার পাওয়া উচিত হবে না। এ তিনটি শর্তকে বাদ দিয়ে, ভোটাধিকার প্রদান ন্যায় হতে পারে না।" হেনরী মেইন ও লেকী বলেন, "ভোটাধিকার রাষ্ট্রের দেয়া অধিকার। তাই এ অধিকার সকলে পেতে পারে না। পাওয়া উচিতও নয়।"

ভোটাধিকার দায়িত্বও বটে। এ অধিকার প্রাপ্ত ব্যক্তি 'শুধুমাত্র ভোটদান করলেই হয় না। বরং ভোটদানের পূর্বে বিচার বিবেচনারও দাবী রাখে। এটা এক প্রকার দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনের সময় বৃহত্তর কল্যণের চিন্তা থাকা উচিত। কিন্তু সর্বজনীন ভোটাধিকার এ দায়িত্ব বোধ নিশ্চিত করতে পারে না। গার্ণার বলেন, "ভোটধিকার জনকল্যাণের স্বার্থে দায়িত্ব পালনে সমর্থ নাগরিকদের উপর অর্পিত একটি দায়িত্ব।"

জনতাতন্ত্রের প্রবর্তক: সর্বজনীন ভোটাধিকারে শিক্ষিত ও মূর্খদেরকে একই পাল্লায় ওজন করা হয়। অর্থাৎ শিক্ষিত ব্যক্তির ভোটের যে ওজন, একজন মূর্খ লোকের ভোটেরও সেই ওজন। সমাজে যেহেতু শিক্ষিত, সচেতন ও প্রা েলোকের সংখ্যা কম এবং মুর্খদের সংখ্যা বেশি তাই বেশি লোকদের ভোটে জনতাতন্ত্রের (Mobocracy) প্রবর্তন ঘটে। সেজন্যই মিল বলেন, সর্বজনীন ভোটাধিকারের পূর্বে সর্বজনীন শিক্ষার প্রয়োজন।

• অযোগ্য সরকার প্রতিষ্ঠা করে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সর্বজনীন ভোটধিকার প্রকৃত কল্যাণের পরিপন্থি। কারণ, এসব দেশে শিক্ষিতের হার কম হওয়ায় বাকসর্বস্ব নেতারা ছলচাতুরী ও মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাধারণ ভোটারদের মন জয় করে নির্বাচনে জয়ী হতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্যতা তাদের মধ্যে না থাকায় জনগণ এক অযোগ্য সরকার দ্বারা আনাড়িভাবে পরিচালিত হয়। অধ্যাপক লেকী তাই বলেন, "সর্বজনীন ভোটধিকার প্রদানের অর্থ হচ্ছে অশিক্ষিত জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত করা।"

প্রত্যক্ষ নির্বাচন: ভোটারগণ যখন সরাসরি নিজেরাই তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ পায় তখন তাঁকে প্রত্যক্ষ নির্বাচন বলা হয়। এটিকে প্রাথমিক নির্বাচন পদ্ধতিও বলা যায়। এতে ভোটদাতা ও ভোট প্রার্থীর মাঝখানে কোন ব্যক্তি অবস্থান করে না। যেমন বাংলাদেশ, ভারত, গ্রেট ব্রিটেন প্রভৃতি দেশের আইনসভার সদস্যগণ সাধারণ ভোটারদের দ্বারা নির্বাচিত হন।

আরো পড়ুন: সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি ও তার কার্যকারিতার 

প্রত্যক্ষ নির্বাচনের সুবিধা

এ ব্যবস্থায় ভোটার জনসাধারণ দেখেশুনে সরাসরি প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে। ফলে ভোটদাতা ও প্রার্থীর মধ্যে একট বোঝাপড়ার সুযোগ থাকে। তাছাড়া বিজয়ী হলে সে প্রতিনিধি ভোটারদের নিকট নিজের প্রত্যক্ষ দায়িত্বের কথা উপলব্ধি করে।

প্রত্যক্ষ পদ্ধতিতে নির্বাচনের সুযোগ থাকায় ভোটারগণ বিভিন্ন দল ও প্রার্থীর তৎপরতা দেখেশুনে, বিচার বিশ্লেষণ করে ভোট দিতে পারে। ফলে তাদের রাজনীতি সম্বন্ধে শিক্ষা ও সচেতনতার প্রসার ঘটে।

এ পদ্ধতিতে প্রার্থীর পক্ষে প্রলোভন দেখিয়ে সকল ভোটারকে প্রভাবিত করা কঠিন। ফলে নির্বাচনী দুর্নীতি কম হয়।

ভোটারগণ এ পদ্ধতিতে তাদের অভাব অভিযোগের কথা নিজেরাই নির্বাচিত প্রতিনিধিকে জানাতে ও পূরণে চাপ প্রয়োগ করতে পারবে। এতে এসবের দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব হয়।

প্রত্যক্ষ নির্বাচনের অসুবিধা

এ পদ্ধতিতে প্রার্থীদের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের সুযোগ থাকায় অনেক প্রার্থীর মধ্য থেকে যোগ্যতম ব্যক্তিকে বাছাই করতে ভোটারদের বেগ পেতে হয়। অনেক সময় চতুর বা ধূর্ত প্রার্থীর কথার যাদুতে ভুলে প্রকৃত যোগ্যতা বিচার না করেই ভোটাররা প্রতিনিধি নির্বাচিত করে।

ভোটারদের প্রভাবিত করার প্রতিযোগিতা থাকায় এ পদ্ধতি সমস্ত এলাকায় নির্বাচনী উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়। এতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। অনেক সময় হৈ চৈ, দ্বন্দ্ব, কোন্দল ও সংঘর্ষ হতে দেখা যায়।

সাধারণ ভোটরগণ যখন পরোক্ষভাবে আইনসভা বা প্রেসিডেন্ট পদে কোন প্রার্থীকে নির্বাচিত করে তখন তাকে পরোক্ষ নির্বাচন বলে। বাংলাদেশের সাধারণ ভোটাররা ভোট দিয়ে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত করে। এই সদস্যগণের ভোটে নির্বাচিত হন দেশের প্রেসিডেন্ট। ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে এরূপ পরোক্ষ পদ্ধতি প্রচলিত আছে। চূড়ান্ত পর্যায়ে যাঁরা নির্বাচকের দায়িত্ব পালন করেন তাঁদের নিয়েই গঠিত হয় নির্বাচনী সংস্থা (Electoral College)।

আরো পড়ুন: গণতন্ত্রের গুণাবলী গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ, সাফল্যের শর্তাবলী ও সীমাবদ্ধতা

পরোক্ষ নির্বাচনের সুবিধা

• সাধারণ ভোটারদের দ্বারা নির্বাচিত নির্বাচনী সংস্থা চূড়ান্ত প্রতিনিধি নির্বাচনে অধিকতর যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারেন। কারণ, তারা অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত, সচেতন ও রাজনীতি সচেতন হন। এতে দু'বার করে নির্বাচন হওয়ায় বিবেচনার বাড়তি সুযোগ পাওয়া যায়।

উত্তেজনা ও আবেগ প্রশমিত করে। দ্বন্দ্ব ও সংঘাত এড়ানো সম্ভব হয়। প্রার্থী বাছাইয়ে যুক্তির প্রাধান্য বিস্তৃত হয়।

এ ব্যবস্থায় কোন রাজনৈতিক দলই কথার তুবড়িতে চূড়ান্ত ভোটারদের প্রভাবিত করতে পারে না। নির্বাচকগণ ধীরে সুস্থে প্রার্থীদের যোগ্যতার তুলনামূলক হিসাবনিকাশ করার সুযোগ পান।

পরোক্ষ নির্বাচনের অসুবিধা

• চূড়ান্ত প্রতিনিধি ও প্রাথমিক ভোটারদের মধ্যে যথেষ্ট ব্যবধান থাকায় জনসাধারণের নিকট প্রার্থীদের দায়বোধ কম থাকে। এতে গণতন্ত্রের আবেদন কমে যায়।

জনগণ তাদের বিচার বিবেচনা মধ্যবর্তী ভোটার পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখে। এতে রাজনীতির প্রতি তাদের উৎসাহ কমে যায়।

রাজনৈতিক শিক্ষা ও সচেতনতার বিস্তার যথেষ্ট মাত্রায় হয় না।

গণতন্ত্রে দলীয় ব্যবস্থার একাধিপত্য থাকায় পরোক্ষ নির্বাচনকে অহেতুক মনে হয়। কারণ মধ্যবর্তী ভোটার ও চূড়ান্ত প্রার্থীদের সবাই কোন না কোন রাজনৈতিক দলের অনুসারী। তাই মধ্যবর্তী নির্বাচন কতকটা অহেতুক মনে হয়।

• দু'বার করে নির্বাচনের আয়োজন ব্যয় বৃদ্ধি করে।

সারকথা

সর্বজনীন ভোটাধিকার পৃথিবীর প্রায় সব গণতান্ত্রিক দেশেই প্রচলিত। এ নীতি এক ব্যক্তি, এক ভোট পদ্ধতিতে আস্থাশীল। এ পদ্ধতির পথে সবচেয়ে জোরাল এ যুক্তিই প্রদান করা যায় যে, সর্বজনীন ভোটাধিকার নাগরিক সাধারণের মধ্যে প্রতিনিধি নির্বাচনে সাম্য ও স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। কিন্তু এর বিরাট ত্রুটি হচ্ছে যে, এ পদ্ধতি শিক্ষিত- অশিক্ষিত নির্বিশেষে সবাইকে প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকারের ক্ষেত্রে শুধু বয়সের যোগ্যতা দিয়ে বিচার করে। এ ব্যবস্থা অশিক্ষিতদের অধিকার প্রদান করলেও শিক্ষিত ও জ্ঞানীদের মর্যাদা করা হয়। নির্বাচনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভোটদান পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। দুই পদ্ধতিরই গুণ ও দোষ রয়েছে। তবে অধিকাংশ দেশেই প্রত্যক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি অনুসৃত হয়। আবার কোন কোন দেশে অনুসৃত হয় পরোক্ষ পদ্ধতি। বাংলাদেশ সংসদ নির্বাচনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরোক্ষ পদ্ধতি অনুসরণ করে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url