জাতিসংঘ ও জাতিসংঘ গঠনের পটভূমি

জাতিসংঘের জন্মের ইতিহাস বর্ণনা করতে পারবেন। জাতিসংঘ সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারবেন; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের রাজনীতি ও বৃহৎ শক্তিগুলোর ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করতে পারবেন।

ভূমিকা

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এবং বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের ভূমিকা আজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বে উত্তেজনা হ্রাস, জাতিগত দ্বন্দ্বের অবসান, যুদ্ধ বন্ধ, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টিতে জাতিসংঘের ভূমিকা বারেবারে আলোচিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘের এ সনাতন ভূমিকার পাশাপাশি যোগ হয়েছে পরিবেশগত সমস্যা কিংবা নারী উন্নয়ন সম্পর্কিত সমস্যাবলী, যে সব ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকা আজ ব্যাপকভাবে আলোচিত। জাতিসংঘ শীর্ষক আলোচনায় মোট ৫টি পাঠ রয়েছে। প্রথম পাঠে জাতিসংঘ গঠনের পটভূমি বর্ণনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় পাঠে রয়েছে জাতিসংঘের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও নীতিমালা। তৃতীয় পাঠে রয়েছে জাতিসংঘের গঠনপদ্ধতি ও জাতিসংঘের যে ৬টি শাখা নিয়ে গঠিত তার বিবরণ। চতুর্থ পাঠে জাতিসংঘের মহাসচিবের ভূমিকা ও কর্মকান্ড নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আর ৫ম পাঠে জাতিসংঘের সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

আরো পড়ুন: নির্বাচকমন্ডলী ও রাজনৈতিক দল নির্বাচকমন্ডলীর গুরুত্ব ও কার্যাবলী

জাতিসংঘ গঠনের পটভূমি

জাতিসংঘ বা (United Nations) হচ্ছে একটি আর্ন্তজাতিক সংস্থা। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়ক শহরে এ সংস্থার সদর দফতর অবস্থিত। শাখা অফিস রয়েছে জেনেভা, ভিয়েনা ও নাইজেরিয়াতে। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি স্বাধীন দেশ এ সংস্থার সদস্য। জাতিসংঘ নামটির ধারণা দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট। এ সংস্থাটির বয়স ইতোমধ্যে ষাট বছর অতিক্রম করেছে। আর্ন্তজাতিক উত্তেজনা হ্রাস ও বিভিন্ন রাষ্ট্রের মাঝে বিরোধ মিমাংসায় জাতিসংঘ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের জন্ম হলেও মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর গঠিত সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ বা League of Nations এর ব্যর্থতাকে কেন্দ্র করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এ ধরনের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধের ব্যাপক ধ্বংসলীলা ও ভয়াবহতার কারণে যুদ্ধের প্রতি মানুষের ঘৃণা ও বিতৃষ্ণার জন্ম হয়। সেই সাথে ব্যাপকভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও বিভিন্ন দেশের মধ্যে সহযোগিতা ও মৈত্রী বৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এই প্রয়োজনীয়তাকে সামনে রেখেই তৎকালীন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ একটি আর্ন্তজাতিক সংস্থা গঠন করার উদ্যোগ নেন। ১৯৪১ সালের পর থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বিশ্বে উত্তেজনা কমাতে যেসব শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন, যেখানে এ ধরনের একটি আর্ন্তজাতিক সংস্থা গঠনের কথা বলা হয়েছিল।

১৯৪১ সালের আগষ্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল আটলান্টিক চার্টার সনদ (Atlantic Charter) এ স্বাক্ষর করেন। এ সনদে বিশ্বের সকল জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার, বাক স্বাধীনতা, স্থায়ী শাস্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে আক্রমণকারীদের নিরস্ত্রীকরণের কথা বলা হয়েছিল। এসব আদর্শের উপর ভিত্তি করেই পরে জাতিসংঘ সনদ রচিত হয়। তবে জাতিসংঘ নামটি এসেছে ১৯৪২ সালের ১ জানুয়ারী ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যে ঘোষণাপত্র স্বাক্ষর করেছিল, সেই ঘোষণাপত্রের মধ্যে দিয়ে। এ চারটি দেশ এক ঘোষণাপত্রে আটলান্টিক চার্টারে বর্ণিত নীতি ও আদর্শের প্রতি তাদের সমর্থনের কথা ব্যক্ত করেছিলেন যা "United Nations Declaration" বা জাতিসংঘ ঘোষণা নামে পরিচিত। পরে ২ জানুয়ারী আরও ২২টি রাষ্ট্র এ ঘোষণার প্রতি সমর্থন জানায়। জাতিসংঘ গঠনের প্রেক্ষাপট হিসেবে মস্কো ঘোষণা, তেহরান সম্মেলন, ডুম্বারটন ওকস সম্মেলন ও ইয়াল্টা সম্মেলনের কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। ১৯৪৩ সালের অক্টোবর মাসে যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন ও চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রীরা মস্কোতে এক বৈঠকে মিলিত হয়ে একটি ইশতেহার প্রকাশ করেন, যা মস্কো ঘোষণা বা "Moscow Declaration" নামে পরিচিত। মস্কো ঘোষণায় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠন করার কথা বলা হয়েছিল। উক্ত ঘোষণায় বলা হয়েছিল যে, এ সংস্থা সকল শান্তিপ্রিয় দেশের সার্বভৌম ও সমতার নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হবে। বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য ছোট বড় শান্তি প্রিয় সকল দেশের কাছেই এ সংগঠনের সদস্যপদ উন্মুক্ত থাকবে।

১৯৪৩ সালের নভেম্বর মাসে তেহরানে বিশ্ব রাজনীতির তিন শীর্ষ নেতা, রুজভেল্ট (যুক্তরাষ্ট্র), ষ্ট্যালিন (সোভিয়েট ইউনিয়ন) ও চার্চিল (ব্রিটেন) অপর এক শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হন। এক যৌথ বিবৃতিতে তাঁরা জানান যে, একটি আর্ন্তজাতিক সংস্থায় যোগদানের জন্য বিশ্বের সকল ছোট ও বড় দেশকে আমন্ত্রণ জানান হবে। তাঁরা আরো জানিয়েছিলেন যে, বিশ্ব শান্তি রক্ষায় তাঁদের উদ্যোগ সফল হবে। এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে বিশ্বের সকল জাতি যুদ্ধের ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠতে পারবে।

একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তার রূপরেখা প্রণীত ও গৃহীত হয় ১৯৪৪ সালের আগষ্ট মাসে ওয়াশিংটনের ডুম্বারটন ওকস (Dumbarton Oaks) সম্মেলনে। প্রথম পর্যায়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রেট ব্রিটেনের মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৪ সালের ২১ আগষ্ট থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ আলোচনা চলে। দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শুরু হয় ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে এবং তা চলে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত। সম্মেলনে একটি বিশ্বসংস্থা গঠন ও এর কাঠামো সম্পর্কে প্রস্তাব গৃহীত হয়। সম্মেলনে বিশ্বসংস্থার নামকরণ করা হয় সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ বা জাতিসংঘ। সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় যে বিশ্বসংস্থার চারটি শাখা থাকবে। সকল সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে সাধারণ সভা, ১১ সদস্য বিশিষ্ট নিরাপত্তা পরিষদ, আন্তর্জাতিক বিচারালয় ও একটি সচিবালয় থাকবে। নিরাপত্তা পরিষদ গঠনে স্থায়ী ও অস্থায়ী সদস্যের প্রস্তাব করা হয়। বলা হয় পাঁচটি দেশ স্থায়ী সদস্য ও ছ'টি দেশ অস্থায়ী সদস্য পদ পাবে। স্থায়ী সদস্যদের ভেটোর অধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। তবে ভেটো দানের পদ্ধতি সম্পর্কে কোন ঐক্যমত হয় নি। অস্থায়ী সদস্যপদ সম্পর্কে বলা হয়েছিল দু'বছর পর পর সাধারণ সভা কর্তৃক এরা নির্বাচিত হবে।

আরো পড়ুন: সরকার কি সরকারের গতানুগতিক শ্রেণীবিভাগ

ডুম্বারটন ওকস পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ক্রিইয়ান্টায় একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে যোগ দেন রুজভেল্ট, ষ্ট্যালিন ও চার্চিল। ওই সম্মেলনে বৃহৎ পাঁচটি শক্তি যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, চীন ও ফ্রান্সকে ভেটো ক্ষমতা দেওয়া হয়। এবং তাঁরা এমন সিদ্ধান্ত দেন যে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে দ্রুত প্রস্তাবিত আন্তর্জাতিক সংস্থাটি গঠন করা হবে। ইয়াল্টা শীর্ষ বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি সনদ রচনা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকো শহরে ১৯৪৫ সালের ২৫ এপ্রিল থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত ৫০টি দেশের প্রতিনিধিরা মিলিত হন। ২৬ জুন ১১১ টি ধারা সম্বলিত সনদটি অনুমোদিত হয়। এবং তাতে বৃহৎ পঞ্চ শক্তির ভেটো ক্ষমতা স্বীকার করে নেয়া হয়। তবে সর্বসম্মতভাবে সনদটি স্বাক্ষরিত হয় ২৪ অক্টোবর। মোট ৫১টি দেশ মূল সনদে স্বাক্ষর করেছিল। এ কারণে, প্রতি বছর ২৪ অক্টোবরকে জাতিসংঘ দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়ে থাকে। এভাবেই দীর্ঘ চার বছরের পরিকল্পনা ও বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বাড়ানোর প্রয়োজনে জাতিসংঘ আত্মপ্রকাশ করেছিল। জাতিসংঘ সনদ গৃহীত হবার পর ১৯৪৬ সালের ১০ জানুয়ারী লন্ডনের ওয়েষ্ট মিনিষ্টারের সেন্ট্রাল হলে প্রথম বারের মত সাধারণ পরিষদের অধিবেশন বসে। উল্লেখ্য, জাতিসংঘ সনদ গৃহীত হবার পর এ পর্যন্ত সনদের চারটি ধারা সংশোধন করা হয়েছে। ১৯৬৫ সালে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ ১১ থেকে বাড়িয়ে ১৫ করা হয়েছে। এবং বিভিন্ন পদ্ধতিগত ও অন্যান্য সকল বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদের হ্যাঁ সূচক ভোটের সংখ্যা ৭ থেকে বাড়িয়ে ৯ করা হয়েছে। এর মধ্যে স্থায়ী পাঁচ সদস্যের ভোট অবশ্যই থাকতে হবে। ১৯৬৫ সালে অর্থনেতিক ও সামাজিক পরিষদের সদস্যপদ ১৮ থেকে বাড়িয়ে ২৭ করা হয়েছে, এবং ১৯৭৩ সালে তা আরো বাড়িয়ে ৫৪ করা হয়েছে। ১৯৬৮ সালে সনদ পর্যালোচনার জন্য নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক সাধারণ সম্মেলন ডাকতে প্রয়োজনীয় ভোটের সংখ্যা ৭ থেকে বাড়িয়ে ৯ করা হয়েছে।

সারকথা

১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ আত্মপ্রকাশ করলেও, দীর্ঘ চার বছর লেগেছে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন শীর্ষ বৈঠকে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠনের প্রশ্নে মত বিনিময় করেন ও সংগঠনটির চূড়ান্ত রূপরেখা প্রণয়ন করেন। জাতিসংঘের মূল সনদে ৫১টি দেশ স্বাক্ষর করলেও, বর্তমানে জাতিসংঘের সদস্য সংখ্যা তিনগুণের উপরে বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠা, অর্থাৎ বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা হ্রাস ও বিরোধ মিমাংসায় জাতিসংঘ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url