ফেরেশতার পরিচয় ও তাঁদের দায়িত্ব
আজ এই আর্টিকেলটিতে ফেরেশতার পরিচয় ফেরেশতা সম্পর্কে ভ্রান্ত বিশ্বাসের বর্ণনা ফেরেশতার সংখ্যা সম্বন্ধে ধারণা ফেরেশতার গুণাবলী ও চরিত্র ফেরেশতার দায়িত্ব-কর্তব্য বিশ্লেষণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।
ফেরেশতার পরিচয়
ফেরেশতা মহান আল্লাহ তা'আলার অন্যতম এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। তারা মহান আল্লাহর মহাসাম্রাজ্যের অতীন্দ্রিয় কর্মী বাহিনী। মানব চক্ষুর অন্তরালে থেকে মহান আল্লাহর আনুগত্যে নিয়োজিত থাকেন এবং অর্পিত কর্তব্যসমূহ প্রতিপালনে সদা নিমগ্ন থাকেন। আভিধানিক অর্থে আল্-মালাইকাহ )ملئكة( বহুবচন, একবচন মালাকুন এ। অর্থাৎ ফেরেশতা। পারিভাষিক অর্থে Aile বা ফেরেশতার পরিচয় দেওয়া হয় এ ভাষায়-
"ফেরেশতা জ্যোর্তিময় বা নূরানী দেহবিশিষ্ট। বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করতে পারে। আহারও করে না, পানও করে না। পুরুষও নয়, নারীও নয়
মূলত ফেরেশতা আল্লাহর এক অত্যাশ্চর্য সৃষ্টি, অশরীরী ও অতীন্দ্রিয় জীব। তাঁরা নূর বা আলোর তৈরি, তাদের মধ্যে স্ত্রী-পুরুষভেদ নেই। তাদের গানাহার ও নিদ্রা-বিশ্রামের প্রয়োজন হয় না। তাদের সংখ্যা অগণিত, অসংখ্য, যা কেবল আল্লাহই জানেন। তারা আল্লাহর বান্দা। তাঁরা সর্বদা আল্লাহর আদেশ পালনে নিয়োজিত আছেন। তাঁদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-"তাঁরা আল্লাহর কথার বিরুদ্ধাচরণ করে না এবং তাঁরা আল্লাহর আদেশ পালনে নিযুক্ত আছেন। আল-কুরআনের আরেক স্থানে আছে, তাঁরা আল্লাহর ইবাদত করতে অস্বীকার করে না এবং পরিশ্রান্তও হয় না।"
ফেরেশতা আল্লাহর এক অত্যাশ্চর্য সৃষ্টি, অশরীরী ও অতীন্দ্রিয় জীব। তাঁরা দূর বা আলোর তৈরি, তাদের মধ্যে স্ত্রী-পুরুষভেদ নেই। জাদের পানাহার ও নিদ্রা- বিশ্রামের প্রয়োজন হয় না। কাদের সংখ্যা অগণিত, অসংখ্য, যা কেবল আল্লাহই জানেন।
ফেরেশতাদের স্বরূপ
ক. ফেরেশতাগণকে পুরুষ বা স্ত্রী জাতি রূপে চিহ্নিত করা যায় না। কারণ তারা পুরুষ না নারী এ বিষয়ে কোন যুক্তি বা প্রমাণ নেই।
খ. কতক ফেরেশতা অন্যান্য ফেরেশতা হতে মর্যাদাবান ও সম্মানিত এবং আল্লাহর সন্নিকটবর্তী।
গ. ফেরেশতাদের সংখ্যা অগণিত, অসংখ্য। তাঁদের সংখ্যা নিরূপণ করা যায় না। তাঁদের সংখ্যা এত বেশি যে, নতুন সৃষ্টির প্রয়োজন হবে না।
ঘ. ফেরেশতাদের চরিত্র পূত-পবিত্র এবং সর্বপ্রকার ক্লেদ-কালিমা হতে মুক্ত। কেননা তাঁরা নূরের তৈরি এবং মানব চরিত্রের ষড়রিপুর আওতামুক্ত।
আরো পড়ুন: ইমাম আবু হানীফা (র)-এর মাযহাব
ফেরেশতাদের সম্পর্কে ভ্রান্ত বিশ্বাস
পৌত্তলিকদের বিশ্বাস: ফেরেশতাগণকে বেশি সম্মান দেখাতে গিয়ে পৌত্তলিকরা ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর কন্যা বলে থাকে। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ধারণা।
আরববাসী পৌত্তলিকরা কন্যাকে অসম্মানজনক বলে মনে করতো। সুতরাং আল্লাহর সাথে ফেরেশতাগণকে কন্যা সম্পর্ক যুক্ত করাটা আল্লাহর ওপর অসম্মানজনক উক্তি।
ইয়াহুদিদের বিশ্বাস: ইয়াহুদিগণ ফেরেশতাগণের সম্মানকে লাঘব করার জন্য বলে যে, ফেরেশতারা আল্লাহর বিরুদ্ধাচারণ করে। তাদের মতে, ফেরেশতাগণ কুফরী করতে পারে, গুনাহ করতে পারে ও খারাপ কাজ করতে পারে। ফলে আল্লাহ তাদের অপরাধের জন্য শান্তি দিয়ে থাকেন এবং চেহারা পরিবর্তন করে দেন। কিন্তু ইয়াহুদিদের এ ধারণা ফেশেতাগণের সম্মানের পরিপন্থী, মানহানিকর এবং অবাস্তব।
কারও কারও ধারণা : ইবলীসও ফেরেশতা ছিল। সে আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করেছে। যেমন- কুরআনে বলা হয়েছে, "ইবলীস ব্যতীত সব ফেরেশতাই সিজদা করল।" কাজেই দেখা যায় যে, ইবলীসও ফেরেশতাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল কিন্তু এ বিশ্বাস ঠিক নয়। কেননা ইবলীস ছিল জিন, ফেরেশতা ছিল না এবং সে তার প্রভুর বিরুদ্ধাচরণ করেছে।
হারূত-মারূত ফেরেশতাদ্বয় সম্পর্কে বিশ্বাস: হারূত-মারূত ফেরেশতাদ্বয় কুফরী বা কবীরা গুনাহ করেছে বলে ধারণা করা হয়। আসলে এ দু'জন ফেরেশতা কুফরী বা কবীরা গুনাহ করেননি। তবে তাদেরকে যে শাস্তি দেয়া হয়েছিল, তা শুধু তাঁদেরকে শিক্ষাদানের জন্য। যেমন- কোন কোন নবীর সামান্য পদস্খলন ও ভুল সংশোধনের জন্য ও শাস্তি দেয়া হতো। যেমন- নবী যাকারিয়া (আ)-কে করাতে চিরে, ইউনুস (আ)-কে মাছের উদরে পুরে সাবধান করা হয়েছে। তাই হারূত-মারূত সম্পর্কিত ঘটনাবলী ইয়াহুদিদের বানোয়াট রটনা মাত্র।
ফেরেশতাদের সংখ্যা
ফেরেশতাদের সংখ্যা নির্ধারণ তো অসম্ভব বটেই বরং সংখ্যা কল্পনা করাও অসম্ভব। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন-
"তোমার প্রতিপালকের সৈন্য সংখ্যা একমাত্র তিনিই জানেন।" (সূরা আল-মুদাচ্ছির: ৩১)
বস্তুত আল্লাহর সৃষ্টির প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতি পর্যায়ে প্রতিটি স্থানে আল্লাহ ফেরেশতাদের মোতায়েন রেখেছেন। সৃষ্টি জগতের দৃশ্যমান, অদৃশ্যমান সকল কার্য সম্পাদনের পেছনে অদৃশ্য কর্তা ও সম্পাদনকারী হল মহান আল্লাহর সৈনিক, তাঁর আদেশ প্রাপ্ত এসব ফেরেশতা। এছাড়াও রয়েছে আরও অসংখ্য ফেরেশতা, যারা আল্লাহর গুণগান ও তাসবীহ পাঠে রত ও নিমগ্ন রয়েছেন সর্বদা, সার্বক্ষণিকভাবে।
আল্লাহর সৃষ্টির প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতি পর্যায়ে প্রতিটি স্থানে আল্লাহ ফেরেশতাদের মোতায়েন রেখেছেন।
ইমাম রাযী ফেরেশতাদের সংখ্যা বর্ণনা করতে দিতে গিয়ে তার তাফসীরে উল্লেখ করেন-
বনী আদম বা মানবের সংখ্যা হল জিনদের সংখ্যার এক দশমাংশ। জিন ও মানব জাতি মিলে স্থলজ প্রাণীর এক দশমাংশ। এরা সবাই মিলে পাখিদের সংখ্যার এক দশমাংশ। এসব মিলে সামুদ্রিক প্রাণির এক দশমাংশ। এরা সবাই মিলে পৃথিবীতে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত ফেরেশতাদের এক দশমাংশ। এরা সবাই মিলে প্রথম আকাশে নিয়োজিত ফেরেশতাদের এক দশমাংশ। এরা সবাই মিলে তৃতীয় আকাশে নিয়োজিত ফেরেশতাদের এক দমশাংশ। এভাবে সপ্তম আকাশ পর্যন্ত। অতঃপর এ সব সংখ্যা কুরসী -এর ফেরেশতাদের তুলনায় যৎসামান্য। এসব সংখ্যা মিলে আরশ বা সিংহাসনের ৭ লাখ খুঁটির মধ্যে একটি খুঁটিতে নিয়োজিত ফেরেশতাদের এক দশমাংশ। এ প্রত্যেকটি খুঁটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ এবং ছাদের সাথে সকল আকাশ জমিনের বিশালত্ব তুলনামূলকভাবে অতি ক্ষুদ্র এবং অতি স্বল্প। আর এর মধ্যে প্রতিটি পদক্ষেপে রয়েছে অন্তত একজন করে ফেরেশতা, যে সিজদাহ বা রুকু অবস্থায় আছে। অতঃপর পূর্বোক্ত সকল সংখ্যার সমষ্টি আরশের চারদিকে প্রদক্ষিণকারী ফেরেশতাদের তুলনায় সাগরের মধ্যে এক বিন্দু পানির তুলনার মত।
আরো পড়ুন: ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র) ও তাঁর মাযহাব
ফেরেশতাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য
ফেরেশতাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে কয়েক শ্রেণীতে ভাগ করা হয়-
১. আল্লাহর আনুগত্য: ফেরেশতাদের সর্বপ্রথম কর্তব্য হচ্ছে, সর্বক্ষেত্রে মহান আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশ করা। যে কোন অবস্থায় আল্লাহর নির্দেশ পালনে সদা প্রস্তুত থাকা এবং তা বাস্তবায়নকরা। কুরআনে এসেছে-"ফেরেশতাগণ আল্লাহর একান্ত অনুগত ও ফরমাবরদার। তাঁর কোন হুকুমকেই তারা অমানা করে না।" (সূরা আত-তাহরীম: ৬)
২. আল্লাহর গুণ-কীর্তন করা: পবিত্র কুরআন ও হাদীসে উল্লেখ আছে, ফেরেশতারা সর্বক্ষণ আল্লাহ গুণগান ও প্রশংসাসহ পবিত্রতা ঘোষণায় নিয়োজিত রয়েছেন। যেমন, কুরআনে এসেছে-
"আমরাই তো তোমার প্রশংসাসহ তাসবীহ পাঠ করছি এবং তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি।" (সূরা আল-বাকারা: ৩০)
৩. আল্লাহর বাণী বহন: পবিত্র কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত আছে যে, হযরত জিবরাইল (আ) নবী- রাসূলদের নিকট আল্লাহর বাণী বহন করে নিয়ে আসতেন।
৪. জীবের জীবিকার ব্যবস্থা ও বণ্টন: হযরত মীকাঈল (আ) আল্লাহর হুকুমে সমস্ত জীব জন্তুর জীবিকার ব্যবস্থা করেন এবং মেঘ-বৃষ্টি ও বাতাস পরিচালনা করেন।
৫. শিঙ্গায় ফুক দেয়া: হযরত ইস্রাফিল (আ) শিঙ্গা নিয়ে আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন। আদেশ পেলেই তিনি শিঙ্গায় ফুক দেবেন। আর তখনই কিয়ামত আরম্ভ হবে।
৬. জীবের জান কবজ করা: হযরত আজরাঈল (আ) আল্লাহর আদেশে সমস্ত জীবের জান-কবজ করে থাকেন। অর্থাৎ জীবদের জীবন সংহারের দায়িত্ব পালন করেন।
৭. মানুষের কর্মের রেকর্ড করা: 'কিরামুন-কাতিবুন' নামে সম্মানিত ফেরেশতারা মানুষের জীবনের সমস্ত কর্মতৎপরতার রেকর্ড সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করেন।
৮. দরূদ প্রেরণ: ফেরেশতারা নবী করীম (স)-এর ওপর দরূদ ও সালাম পেশ করেন।
৯. ফেরেশতারা আল্লাহর রাজ্যের কর্মীবাহিনী: পবিত্র কুরআনে ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর সৈনিক বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা সাধারণত কোন কাজ সরাসরি নিজে করেন না। ফেরেশতাদের মাধ্যমেই সাধারণত তিনি কার্য সম্পদান করে থাকেন। তাই ফেরেশতারা আল্লাহর সাম্রাজ্যের কর্মীবাহিনী। বিভিন্ন বিভাগে অসংখ্য ফেরেশতা নিয়োজিত রয়েছেন, যারা পরম নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেন।
১০. সব রকম কাজ আঞ্জাম দেয়া: এছাড়াও পবিত্র কুরআনে ফেরেশতাদের বিভিন্ন কাজের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যেমন- ফেরেশতারা অতিথির ছদ্মবেশে এসে হযরত ইবরাহীম (আ)-কে বৃদ্ধ বয়সে তাঁর পুত্র হওয়ার এবং হযরত মারইয়াম (আ)-কে তাঁর গর্ভে ঈসা (আ) এর জন্মের ভবিষ্যদ্বাণী শুনিয়েছেন। আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতারা বিভিন্ন বিদ্রোহী জাতিকে ধ্বংস করেছিলেন। যেমন-হযরত লুত (আ)-এর কাওম, হযরত হুদ (আ)-এর কাওম। কাফিরদের বিরুদ্ধে মহানবী (আ)-কে সাহায্য করার জন্য আল্লাহ বদর, উহুদ ইত্যাদি যুদ্ধে ফেরেশতা বাহিনী প্রেরণ করেছেন। ফেরেশতারা মুমিনদের বন্ধু, মুমিনদের জন্য তারা মাগফিরাতও প্রার্থনা করেন।
১১. আরশ বহনকারী ফেরেশতা: এদের কাজ হল আরশ বহন করা। আল-কুরআনের বাণী-
"সেদিন আটজন ফেরেশতা তোমার প্রতিপালকের আরশ ধারণ করবে তাদের উর্ধ্বে।” (সূরা আল-হাক্কাহ: ১৭)
১২. আরশের চারিদিকে বেষ্টনকারী ফেরেশতা: আল-কুরআনের বাণী-
"তুমি ফেরেশতাদের দেখতে পাবে যে, তারা আরশের চারপাশে ঘিরে তাদের প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছে।" (সূরা আয-যুমার: ৭৫)
১৩. শ্রেষ্ঠ ফেরেশতাবৃন্দ: তারা হলেন-জিব্রাঈল, আজরাঈল ও মিকাঈল (আ)। হাদীসে এসেছে-
আজরাঈল (আ) মৃত্যুর দায়িত্বে নিয়োজিত।
অপরজন হলেন-ইসরাফীল (আ)-যাঁর দায়িত্ব হল শিংগায় ফুক দেয়া। আল্লাহ বলেন, "অতপয় শিংগায় ফুক দেওয়া হবে, ফলে আকাশ ও জমিনবাসীরা বেঁহুশ হয়ে পড়বে।"
১৪. জান্নাতের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতা: কুরআনে এসেছে, "ফেরেশতারা তাদের নিকট সফল দরজা দিয়ে ঢুকবে-তোমাদের ধৈর্য ধারণের জন্য তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। 'অবশ্যই পরকালীন পরিণাম কতইনা উত্তম।
১৫. জাহান্নামের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতা: আল্লাহ বলেন- "তার উপর রয়েছে উনিশজন ফেরেশতা"। (৭৪:৩০) অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে- আমরা জাহান্নামের দায়িত্বশীল হিসেবে ফেরেশতাদের নিয়োজিত রেখেছি।'(৭৪:৩০)
১৬. আদম সন্তানের বিষয়ে দায়িত্বশীল: আল-কুরআনে এসেছে "ফেরেশতাগণ ব্যক্তির ডানে-বামে বসা অবস্থায় আছে। ব্যক্তি যাই উচ্চারণ করুক না কেন, তার জন্যই রয়েছে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষক দ্রষ্টা।"
১৭. কর্ম লিখক ফেরেশতা: এরা হলেন মানুষের আমল সংরক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতা। আল-কুরআনে এসেছে-
"নিশ্চয় তোমাদের উপর রয়েছে তত্ত্বাবধায়কগণ। সাম্মানিত লিপিকরবৃন্দ, তারা জানে তোমরা যা করো।" (সূরা আল-ইনফিতার: ১০-১২)
১৮. পৃথিবীর বিভিন্ন বিষয়ের দায়িত্বশীল: এরা পৃথিবীর সব কার্যাবলি সম্পন্ন করে থাকেন, আল- কুরআনে সূরা সাফফাতে এদের বিশ্লেষণ এভাবে দেওয়া হয়েছে। "শপথ তাদের, যারা সারিবদ্ধ দাঁড়ানো, অতপর ভীতি প্রদর্শনকারীদের।"
সূরা জারিয়ায় এসেছে "শপথ ঝঞ্ঝাবায়ুর, অতপর বোঝা বহনকারী মেঘের, অতপর মৃদু চলমান জলযানের, অতপর কর্মবন্টনকারী ফেরেশতাগণের।"
১৯. কবরে সাওয়ালকারী ফেরেশতা: আরেকদল ফেরেশতা হলেন তাঁরা, যাঁরা মানুষের মৃত্যুর পর তাদের পার্থিব কর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। তাদের বলা হয় মুনকার- নাকীর।
আরো পড়ুন: ইমাম শাফিঈ (র) ও তাঁর মাযহাব
ফেরেশতাদের গুণাবলী
ফেরেশতাগণ আল্লাহর এক অনন্য সৃষ্টি। তাঁরা সর্বদা গর্হিত, অশ্লীল ও অশালীন কার্যাবলি থেকে বিরত থাকেন। তাঁরা পূত-পবিত্র, নিষ্কলুষ, আল্লাহর তাসবীহ পাঠরত। তাঁরা আদেশ পালনে নিয়োজিত। যাদের পাপের ধারণা এবং ধ্বংসশীল মানবীয় গুণাবলি স্পর্শও করতে পারে না। তাফসীরে আল- কবীরে ফেরেশেতাদের গুণাবলীর পর্যায়ে যে সকল ধারণা দেয়া হয়েছে তা নিম্নে তুলে ধরা হল।
১. রিসালাতের ধারক-বাহক: ফেরেশতাগণ আল্লাহর রিসালাতের ধারক ও বাহক এক অতীন্দ্রিয় জীব। রিসালাতের দায়িত্ব পালনে তাঁরা সুনিপূণ ও আন্তরিক। আল্লাহ বলেন-
"আল্লাহ ফেরেশতাদের মধ্য হতে মনোনীত করেন বাণীবাহক এবং মানুষদের মধ্য হতেও।" (সূরা আল-হাজ্ব : ৭৫)
২. আল্লাহর সান্নিধ্যে: ফেরেশতাগণ সবাই আল্লাহর সান্নিধ্যপ্রাপ্ত। এ সান্নিধ্য হল মর্যদাগত, স্থানগত নয়, তাঁরা সর্বদাই তাঁর নিকেটে থেকে তাঁর ইবাদত করে থাকেন। আল্লাহ বলেন-
"তাঁর সান্নিধ্যে যারা আছে তারা অহংকারবশে তাঁর ইবাদাত করা হতে বিমুখ হয় না এবং ক্লান্তিও বোধ করে না।" (সূরা আল-আম্বিয়াহ: ১৯)
৩. আনুগত্য: ফেরেশতাদের কাজই হচ্ছে সর্বদা আল্লাহর ইবাদাত ও আনুগত্য করা। তাঁরা এক মুহূর্তের জন্যও ক্ষমা প্রার্থনা-অযিফা থেতে বিরত হন না। বরং প্রতিটি মুহূর্ত তাঁরা প্রতিপালকের তাসবীহ পাঠে অতিবাহিত করেন। আল্লাহ বলেন-
"তাঁরা দিন-রাত তাঁরই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে, তারা শৈথিল্য প্রদর্শন করে না।" (সূরা আল-আম্বিয়া: ২০)
দ্বিতীয়ত: তাঁরা আল্লাহর সামনে দ্রুততার সাথে তাঁর আদেশ পালন করেন। কোন রূপ দ্বিধা- সংকোচ করেন না।
তৃতীয়ত: তাঁরা সকল কাজ তাঁর আদেশে ও নির্দেশে করে থাকেন। নিজেদের ধারণা ও খেয়াল- খুশিমত কোন কাজ করেন না। আল্লাহ বলেন-
"তারা তাঁর আগে সম্মুখে কখনও কথা বলে না এবং তারা তাঁর নির্দেশ অনুযায়ীই কাজ করে থাকে।" (সূরা আল-আম্বিয়া: ২৭)
৪. প্রচণ্ড শক্তি: ফেরেশতাগণ প্রচণ্ড শক্তিধর। তাঁরা আল্লাহর ইচ্ছায় যে কোন কাজই সম্পাদন করতে পারেন। আরশের মত এত বিশাল জিনিসকে মাত্র ৮জন ফেরেশতা ধারণ করে আছেন। এ ছাড়া হযরত ইসরাফীল (আ) শিংগায় ফুঁক দিলে তার আওয়াজের প্রচণ্ড শব্দে ভেঙ্গে চুরে ফেটে ধংস হয়ে যাবে এ মহাবিশ্বের সমস্ত ব্যবস্থাপনা। দোযখের মত বিশাল ব্যবস্থা ১৯ জন ফেরেশতা সংরক্ষণ করছেন।
হযরত জিব্রাঈল (আ) পর্বতকে বাণী ইসরাঈলের মাথার উপর তুলে ধরেন। এ সবই তাঁদের শক্তির প্রচণ্ডতা বুঝায়। আল্লাহ বলেন-
"কঠোর স্বভাবের ফেরেশতাগণ, যারা অমান্য করেনা তা, যা আল্লাহ তাদের আদেশ করেন।" (সূরা আত-তাহরিম: ৬)
৫. ভয়-ভীতি: ফেরেশতাগণ আল্লাহ তা'আলাকে যেমন ভালবাসেন, তেমনি প্রচণ্ড ভয়ও করেন। মহান প্রতিপালক আল্লাহর ভয়ে তাঁরা সর্বদাই কম্পমান থাকেন। তাঁরা এত ইবাদত, তাসবীহ ও তাহমীদ সত্ত্বেও সর্বদা এ ভয়ে থাকেন যে, তাঁদের সব ইবাদত আবার অপরাধে রূপান্তরিত হয়ে যায় কিনা। আল্লাহ বলেন-
"নিশ্চয় যারা তাদের প্রতিপালকের ভয়ে সন্ত্রস্ত।" (সূরা আল-মমিনুন: ৫৭)
আল্লাহ বলেন, "যখন তাদের অন্তঃকরণ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে, তখন তাঁরা বলবে, তোমাদের প্রতিপালক কী বলেছেন? তারা বলবে, 'সত্য'। তিনি তো মহীয়ান, গণীয়ান।'
সারসংক্ষেপ
ফেরেশতা আল্লাহ তা'আলার অন্যতম এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। তাঁরা মহান আল্লাহর মহাসাম্রাজ্যের অতীন্দ্রীয় কর্মীবাহিনী।
তাঁরা নূর বা আলোর তৈরি, তাঁদের মধ্যে স্ত্রী-পুরুষ ভেদ নেই। তাঁদের পানাহার, নিদ্রা ও বিশ্রামের প্রয়োজন হয় না। তাঁদের সংখ্যা অগণিত, অজস্র, অসংখ্য যা কেবল আল্লাহই জানেন। তাঁরা আল্লাহর বান্দা। তাঁরা সর্বদা আল্লাহর আদেশ পালনে নিয়োজিত আছেন। এদের কোন নিজস্ব মত ও কর্মসূচী নেই। মানব চোখের অন্তরালে তাঁরা অবস্থান করে মহান আল্লাহর আনুগত্যে নিয়োজিত থেকে তাঁর অর্পিত কর্তব্যসমূহ প্রতিপালনে সদা নিমগ্ন থাকেন।
বস্তুত ফেরেশতাদের জীবন ও কর্ম সবই মহান প্রতিপালক আল্লাহর ইবাদাতে নিবেদিত। তাঁরা দুনিয়ার সকল প্রকার কামনা-বাসনা ও লালসা মুক্ত থাকায় সর্বদাই মহাপ্রভুর তাসবীহ পাঠরত থাকেন। তাঁর আদেশ-নিষেধ পুরোপুরিভাবে মেনে চলেন। আল্লাহর প্রতি ভালবাসা ও ভয়ে তাদের জীবন ও কর্ম সমৃদ্ধ। তাঁদের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা প্রতিটি বিশ্বাসী মানুষের জন্য অপরিহার্য।
আল্লাহ হাফেজ**
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url