বিবাহ পাত্র-পাত্রী নির্বাচন একে অপরকে দেখার নিয়ম

বিবাহে পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের গুরুত্ব বলতে পারবেন। পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের মূলভিত্তি আলোচনা করতে পারবেন। পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে একে অপরকে দেখে নেয়ার গুরুত্ব বর্ণনা করতে পারবেন। বিবাহে কনের মতামত প্রদান সম্পর্কে ইসলামের বিধান উল্লেখ করতে পারবেন।

বিবাহ পাত্র-পাত্রী নির্বাচন

মানব জীবনে বিবাহ এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য বিষয়। বিয়ে ছাড়া-নারী পুরুষের যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা ইসলাম সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করেছে। বিয়ে সমাজ পরিসরে আল্লাহ প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী একজন নারী ও একজন পুরুষের মধ্যে এমন এক বন্ধন ও সম্পর্ক স্থাপন করে যার কারণে তাদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক সম্পূর্ণ হালাল হয়ে যায় এবং একজনের জন্য অপরজনের উপর সুনিদ্দিষ্ট অধিকার ও দায়িত্ব বর্তায়।

ইসলাম এই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে কিছু সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেসব সীমারেখার ভিতর থেকে পাত্র-পাত্রী নির্বাচন করতে হয়। পাত্র-পাত্রী নির্বাচন বা বাছাই এর ব্যাপারে ইসলাম সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব প্রদান করেছে চরিত্র, নৈতিকতা ও দীনদারীর উপর।

পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের গুরুত্ব: পাত্র-পাত্রী নির্বাচন বিবাহ-শাদীর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দাম্পত্য জীবনের পরিধি যেমন খুবই ব্যাপক, এর সমস্যাও অতি বিস্তৃত। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি স্পষ্ট বাহ্যিক ও সামাজিক দৃষ্টিতে প্রকট কোন ব্যবধান ও অসামঞ্জস্য থাকে তবে অনেক ক্ষেত্রেই তা আর কাটিয়ে ওঠা সম্ভবপর হয় না। যে কারণে, বিয়ের পূর্বেই পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের সময় এ সব বিষয় বিবেচনা করা উচিত। হাদীস শরীফে আছে- 

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ (স.)-এর কাছে এসে বলল, 'আমি একজন আনসারী মেয়েকে বিয়ে করতে চাচ্ছি। রাসূলুল্লাহ (স.) বললেন, মেয়েটিকে দেখে নাও। আনসারীদের চোখে সমস্যা থাকে।

আরো পড়ুন: পরিবার কি পরিবারের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের মানদন্ড

আলোচ্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ (স.) পাত্রী নির্বাচনের পূর্বে তাকে দেখে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন, যেন পরবর্তীতে সমস্যা না হয়। অধিকন্তু পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে কি কি বিষয়ে লক্ষ্য করা বাঞ্চনীয় সে কথাও অন্য হাদীসে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় উদ্ধৃত হয়েছে। মহানবী (স.) বলেন-

আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন: 'চারটি বৈশিষ্ট্যের কারণে কোন মেয়েকে বিয়ে করা হয়। তার সম্পদ, তার সৌন্দর্য, তার বংশমর্যাদা ও তার দীনদারী। তবে তোমরা ধর্মপরায়ণতাকেই অগ্রাধিকার দেবে।'

এই হাদীসে নারীর সম্পদ, বংশ গৌরব, রূপ সৌন্দর্য ও ধর্মানুরাগকে এমন বৈশিষ্ট্য বলে বিবেচনা করা হয়েছে যার আলোকে তাকে নির্বাচন করা হয়ে থাকে। তবে ধর্মানুরাগই সর্বাধিক বিবেচ্য বিষয়। আর এ বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে। ধর্মানুরাগকে বাদ দিয়ে অন্য সকল গুণাগুণ বিচার করলেও একটি মাত্র গুণের অভাবে বৈবাহিক জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ফধ্বংস হয়ে যায়।

কেননা পবিত্র চরিত্রের লোকেরাই পবিত্র চরিত্রের জুড়ি গ্রহণ করে। আল্লাহ বলেন-

'দুশ্চরিত্রা নারী দুশ্চরিত্র পুরুষের জন্য এবং দুশ্চরিত্র পুরুষ চরিত্রহীনা নারীর জন্য। আর পবিত্র চরিত্রের নারী চরিত্রবান পুরুষের জন্য এবং চরিত্রবান পুরুষ পুতঃ চরিত্রের নারীর জন্য। (সূরা আন-নুর: ২৬)

আল-কুরআনের অপর একটি আয়াতেও ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিনীদের বিয়ে করতে মুমিনদেরকে স্পষ্টভাবে নিষেধ করা হয়েছে। (সূরা আন-নূর: ৩)

কেবল সম্পদ বা রূপ-সৌন্দর্য্যের দিক বিবেচনা করে পাত্র-পাত্রী নির্বাচন এবং দীনদারি বা আল্লাহ ভীরুতার প্রতি লক্ষ্য না রেখে পাত্র, পাত্রী নির্বাচন করলে মুমিনদের দাম্পত্য জীবন সুখময় হয় না। কারণ, জাগতিক কামনা- বাসনার সীমাহীন অতৃপ্তি সব সময়ই তাদের দংশন করতে থাকে। আর এ ধরনের দম্পতিদের দ্বারা ইসলামী পরিবারও গঠিত হয়না। এজন্য কুরআন আরেকটি মূলনীতি দিয়েছে যে,

'মুমিন নারী যদি দাসী ও হয়ে থাকে, তবুও মুশরিক অপরূপ সুন্দরীর চেয়ে উত্তম। (সূরা আল-বাকারা: ২২১)

এমনি করে মুমিন মহিলাদেরকে সম্পদ ও রূপের অধিকারী ঈমানহীন মুশরিক পুরুষকে বিয়ে করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং ঈমানদার দাস হলেও তাকে অগ্রাধিকার দিতে বলা হয়েছে। (সূরা আল- বাকারা: ২২১)

পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে আল কুরআনে বংশীয় শ্রেষ্ঠত্বের কথাও সম্পূর্ণরূপে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তবে, যদি বংশ বা গোত্র-ঈমান, শিক্ষা, সভ্যতা, নৈতিকতা ও তাকওয়ার দিক থেকে অগ্রসর থাকে তবে সে বংশ বেছে নেওয়া উত্তম। সুতরাং পাত্র-পাত্রী নির্বাচনকালে উপরোল্লিখিত গুণ ও মর্যাদাবান গোত্র বা বংশের সন্ধান করে বিবাহ কার্য সম্পাদন করা দুষণীয় নয়।

কাজেই ঈমানদার ব্যক্তিকে এমন ঈমানদার মহিলা বিয়ে করতে হবে যিনি স্বামীকেও ঈমানের পথে চলতে সাহায্য করতে পারেন।

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন, 'যখন এমন কাউকে জুড়ি হিসেবে গ্রহণ করার ব্যাপারে তোমাদের কাছে প্রস্তাব আসে যার দীন ও চরিত্র তোমরা পছন্দ কর, তবে তাকে জুড়ি হিসেবে গ্রহণ করবে। যদি এমনটি না করো তবে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি হবে। (তিরমিযি) 

অপর এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, 'তোমরা কেবল রূপ-সৌন্দর্য্য দেখেই নারীদের বিয়ে করো না। কারণ, রূপ-সৌন্দর্য্য তাদের বিপদগামীও করে দিতে পারে। আর তাদের ধন-সম্পদের প্রাচুর্য্য দেখেও বিয়ে করো না কারণ, ধন-সম্পদ তাদের বিদ্রোহী ও অবাধ্য করে দিতে পারে। তোমরা বরং নারীদের দীনদারী দেখে বিয়ে করো। মনে রেখো, যদি সে দীনদার হয়, তবে একটি কালো দাসী অন্যদের তুলনায় উত্তম। (ইবনে মাজাহ ও বায়হাকী )

কাজেই ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের জন্যে যে মূলনীতি আমরা পাই তা হল-

 ১. বর ও কনে নির্বাচনে প্রথম বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত তাদের ঈমান, দীনদারী, তাকওয়া ও নৈতিক চরিত্র।

 ২. ঈমান ও দীনদারীর সাথে রূপ-সৌন্দর্য সম্পদ ও বংশ মর্যাদা থাকা ভাল।

৩. ঈমান ও দীনদারীবিহীন রূপ-সৌন্দর্য, সম্পদ ও বংশ মর্যাদা ইত্যাদি বিয়ের ব্যাপার মুমিনদের জন্যে কাম্য হওয়া উচিত নয়। তবে উপরোক্ত বিষয়গুলো দীনদারীর সাথে একত্রে পাওয়া গেলে তা হবে কল্যাণকর এবং তখন পাত্র নির্বাচন করা দোষের কিছু নয় বরং উত্তম।

৪. পুণ্যবান স্বামী-স্ত্রী একে অপরের জন্যে সর্বোত্তম নিয়ামত।

.দীনতার চরিত্রবান, নারী-পুরুষ জুড়ি হিসেবে গ্রহণ না করলে দাম্পত্য জীবনে বিরাট বিপর্যয় ডেকে জানতে পারে। 

৬. জীনদার চরিতদান নারী-পুরুসের রূপ-সৌন্দর্য না থাকলেও তাদেরকেই পাত্র বা পাত্রী হিসেবে নির্বাচন করা উত্তর।

৭. মুমিন নারী-পুরুষ এর জন্য কোন অবস্থাতেই কাফির, মুশরিক, নাস্তিক, অমুসলিম, ব্যভিচারী ও এভিএধানদের জুড়ি হিসেবে গ্রহণ করা বৈধ নয়।

আরো পড়ুন: ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ ও পরিবার এবং মানুষের মর্যাদা

পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে একে অপরকে দেখে নেয়া

বিয়ে উপলক্ষে পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে একে অপরের সম্পর্কে জানা ও দেখে নেওয়া ইসলাম জরুরি মনে করে। এ দেখা-দেরি ইসলামে শুধু বিধি সম্মতই নয় বরং এজন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। এই দেখার মধ্যে ৩টি গুরুত্ব রয়েছে। যথা

১. এর ফলে বিয়ের পর অনুতাপ করতে হয় না ও হতাশায় ভুগতে হয় না।

২. এতে পাত্র-পাত্রী একে অপরকে পছন্দ করে নিতে পারে। উভয়ে উভয়ের প্রতি আকর্ষিত হয় এবং বিবাহের প্রতি আগ্রহ জন্মে।

৩. এর ফলে বিয়ের পূর্বেই একে-অপরকে জানা ও বুঝার সুযোগ হয়। এতে উভয়ের মধ্যে সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়। এতে অনাকাক্ষিত ও অনৈসলামিক কোন অঘটন ঘটানো বিধি সম্মত নয়।

ইসলাম কেবল বিয়ে করার উদ্দেশ্যেই এই দেখা-দেখির অনুমতি দেয়। অন্যথা পর-পুরুষ ও অপর নারীর প্রতি দেখাকে নিষিদ্ধ করে।

ইসলাম এই দেখার মাধ্যমে পাত্র-পাত্রী পছন্দ করাকে উৎসাহিত করে। কুরআনে এসেছে-

'নারীদের মধ্যে যারা তোমাদের ভাল লাগে তাদের তোমরা বিয়ে কর। (সূরা আন-নিসা: ৩)

মহানবী (স.) বলেছেন 'তোমাদের মধ্যে কেউ যখন কোন মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়, তখন সম্ভব হলে তার এমন কিছু অংশ দেখে নেওয়া উচিত, যা তাকে বিয়ে করতে উদ্বুদ্ধ করবে।'

প্রস্তাবিত ছেলে প্রস্তাবিত বনের অভিভাবকদের জানিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এই দেখাদেখি হতে পারে। আর ভালের কিছু না জানিয়ে গোপনে আড়াল থেকে দেখাশুনা ও খোঁজ-খবর নিলে দোষের কিছু নেই। তবে দেখা দেখির ব্যাপারে অতিরঞ্জিত কোন কিছু করা উচিত নয় বা অপ্রীতিকর কোন কাজ করা বৈধ নয়। এ ব্যাপারে শালীনতা বজায় রাখা কর্তব্য।

কনের মতামত

পুরুষদের যেমন কনে বাছাই করার অধিকার রয়েছে, অধিকার আছে পছন্দসই মেয়ে বিয়ে করার, তেমনি এ অধিকার মেয়েদেরও আছে। কলের অনুমতি ছাড়া অভিভাবক তাকে বিয়ে দিতে পারে না। মহানবী (স.) বলেছেন 'বিরবার বিয়ে তার স্পষ্ট অনুমতি ছাড়া হতে পারে না। আর কুমারীর সম্মতি ছাড়া তার বিয়ে হতে পারে না। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল। তার সম্মতি কীভাবে জানা যাবে? তিনি বললেন, তার চুল থাকাই তার সম্মতি। 

(বুখারী ও মুসলিম)

পিতা তার কন্যার অনুমতি ছাড়াই ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দিয়েছেন এমন বিয়ে রাসুলুল্লাহ (স) ভেঙ্গে দিয়েছেন। অথবা নিয়ে ভাংগা বিয়ে ঠিক রাখার ইখতিয়ার কন্যাকে দান করেছেন।

সারকথা

মানব জীবনে বিবাহ যেমন গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় বিষয় যেমনি বিবাহে পাত্র-পাত্রী নির্বাচন ও একটি গুরত্বপূর্ণ বিষয়। পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের ব্যাপার ইসলাম যে সকল বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে নির্দেশ করেছে তার মধ্যে চরিত্র, নৈতিকতা ও দীনদারী উল্লেখযোগ্য। পাত্রী দীনদার হওয়ার পর তার সম্পদ, বংশমর্যাদা ও সৌন্দর্যের বিষয়গুলো বিবেচনা করা যেতে পারে। ব্যভিচারী নারী মুমিন পুরুষকে এবং মুমিন নারী ব্যভিচারী পুরুষকে বিবাহ করতে পারবে না। কোন মুসলিম নারী কোন অমুসলিম পুরুষকে বিবাহ করতে পারবে না। মুসলিম পুরুষ একজন অমুসলিম নারীকে মুসলমান হওয়ার পরই বিবাহ করতে পারে। কালো ক্রীতদাসী মুমিন রূপসী চরিত্রহীন নারী হতে উত্তম এবং অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। বিবাহে পুরুষ যেমন নারীকে দেখে শুনে পাত্রী হিসেবে নির্বাচন করবে তেমনি একজন নারীরও অধিকার রয়েছে পাত্রকে দেখে শুনে পছন্দ করার। কন্যার অনুমতি ছাড়া বিবাহকার্য সম্পাদন করা ইসলামী নীতি বিরুদ্ধ কাজ। কন্যা ইচ্ছা করলে এ বিবাহ ভেঙ্গে দিতে পারে।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url