ইসলামে পরিরবার পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে বলতে পারবেন ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবার পরিকল্পনার নীতি বর্ণনা করতে পারবেন।জন্মনিয়ন্ত্রণ না করে বিবাহের প্রতি ইসলাম গুরুত্ব দেয়- তা বলতে পারবেন। জন্যনিয়ন্ত্রণের নামে গর্ভপাত বা ভ্রূণ হত্যা বৈধ নয়, তা বলতে পারবেন। জন্মনিয়ন্ত্রণের কুফল বর্ণনা করতে পারবেন। ইসলাম জন্মনিয়ন্ত্রণ সমর্থন করে না, তা আলোচনা করতে পারবেন।ইসলামী অর্থ ব্যবস্থাই জন্মনিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য সফল করতে পারে- তা আলোচনা করতে পারবেন।

ভূমিকা

পরিবার পরিকল্পনা হচ্ছে পরিকল্পিত পরিবার গঠনের কার্যক্রম। বর্তমান প্রচলিত অর্থে জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করার উদ্দেশ্যে জন্মহার হ্রাস করার প্রচেষ্টাকে পরিবার পরিকল্পনা বলা হয়। ব্যাপক অর্থে পরিবারের আয় ও পরিবারের সদস্য সংখ্যার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে পরিকল্পিত উপায়ে পরিবারের সদস্য সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ছোট পরিবার গড়ে তোলাই পরিবার পরিকল্পনার লক্ষ্য। সে অর্থে পরিবার পরিকল্পনা ও জন্ম নিয়ন্ত্রণ প্রায় সমার্থক শব্দ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞানুযায়ী পরিবার পরিকল্পনা জীবন-যাপনের এমন একটি চিন্তাধারা ও পদ্ধতি যা কোন ব্যক্তি বা দম্পতি স্বীয় জ্ঞান, দৃষ্টিভঙ্গি ও দায়িত্ববোধের প্রেক্ষিতে স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে গ্রহণ করে। পরিবার পরিকল্পনা বলতে বুঝায়, যা দ্বারা পরিকল্পিত, ছোট, সুখী, স্বাস্থ্যবান ও সমৃদ্ধশালী পরিবার গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। সন্তানের জন্মদান পরিকল্পনা অনুযায়ী হওয়াই পরিবার পরিকল্পনার মূল কথা।

আরো পড়ুন: বিবাহ ও এর প্রয়োজনীয়তা এবং  বিবাহ সম্পর্কে ইসলামের বিধান 

ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবার পরিকল্পনা

ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় পরিবারই হলো মানুষ গড়ার মূল কেন্দ্র এবং সমাজ গঠনের প্রধান ও স্থায়ী ভিত্তি। এ জন্য পরিবার গড়ার ব্যাপারে ইসলামের বিধান রয়েছে। পরিবার গড়ার ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলার ব্যাপক পরিকল্পনা বর্ণিত হয়েছে। পারিবারিক জীবনকে সর্বাঙ্গীণ সুন্দর করার জন্য ইসলাম যত বিস্তারিত বিধান দিয়েছে, সমাজ ও রাষ্ট্রের কোন অঙ্গনের জন্যে এত ব্যাপক বিধি-বিধান দেওয়া হয়নি। ইসলামী রাজনীতি ও ইসলামী অর্থনীতির জন্য কতক মৌলিক বিধান দিয়ে তারই আলোকে যত আইন দরকার তা তৈরি করার সুযোগ আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন। কিন্তু পরিবারের বেলায় অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে পূর্ণাঙ্গ বিধান দিয়ে দেওয়া হয়েছে ঘাতে ব্যক্তি ও সমাজ গঠনের এ মূল সংস্থাটি সকল রকম ভুল ভ্রান্তি থেকে রক্ষা পায়। সন্তান জন্মদান, লালন- পালন, শিক্ষাদান, বিবাহ, তালাক, ফারায়েয বা সম্পদ বন্টন নীতি, স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্য, পিতা-মাতা ও সন্তানের সম্পর্ক, বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য, অক্ষম ভাই-বোন ও নিকট আত্মীয়দের প্রতি কর্তব্য, মৃত ব্যক্তির প্রতি কর্তব্য ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে ইসলাম চিরস্থায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

ইসলাম পরিবারকে স্থিতিশীল ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বিবাহ করার প্রতি উৎসাহিত করেছে। ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে পরিকল্পিত পরিবার গড়ার জন্যে তিনটি মূলনীতি বর্ণিত হয়েছে, যে মূলনীতি উপেক্ষা করলে সমাজে দারিদ্র্য, অশান্তি, পরিবার ধ্বংস ও মানব প্রজন্মের ক্রমধারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য।

মূলনীতি

১ বিয়ে সবচেয়ে সহজলভ্য হতে হবে। বিয়ের ব্যাপারে জটিলতা সৃষ্টি করা যাবে না। মোটামুটি পাত্র-পাত্রী জুটে গেলেই বিবাহের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে বিবাহযোগ্য নারী পুরুষের নৈতিকমান বহাল থাকে এবং মানব প্রজন্ম ধারায় অপবিত্রতার স্পর্শ লাগতে না পারে।

২. বিবাহ ছাড়া নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার সকল পথ বন্ধ করে দিতে হবে। নারী-পুরুষ যাতে অবৈধ পন্থায় যৌন সম্ভোগ করতে না পারে। আজকের পৃথিবীতে নারী সম্ভোগ সহজ লভ্য হওয়ায় এবং জন্মনিয়ন্ত্রণের সরঞ্জামাদি হাতের কাছে থাকায় পুরুষরা সহজে বিয়ের বোঝা মাথায় নিতে চায় না। এতে ইসলামের পরিকল্পিত পরিবার বাধা গ্রস্থ হচ্ছে। ঘরে ঘরে একাধিক মেয়ে অবিবাহিত অবস্থায় পড়ে আছে। এতে মা-বাবার উপর তাদের ভরণ-পোষণের চাপ পড়ছে। কখনো কখনো মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা হলেও যৌতুক লোভী পাত্রের কারণে পিতার অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।

৩. নারীর সতীত্ব রক্ষার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে, যাতে সমাজে অবৈধ সন্তান জন্ম লাভ করতে না পারে। অবৈধ সন্তান জন্ম হওয়া গোটা পরিবার ধ্বংসের সামিল। কেননা অবৈধ সন্তান জন্ম নিলে আর তা প্রমাণিত হলে সামাজিক বাধার সম্মুখীন হতে হয়। কোর্টে মামলা হয়, ফলে উভয় পরিবার আত্ম মর্যাদাবোধ হারিয়ে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। ফলে পরিকল্পিত পরিবারের রূপরেখা বলতে যা বুঝায় সব কিছুতেই ধ্বংস নেমে আসে।

বর্তমানে জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি সমূহ বাধাহীনভাবে বিবাহিত-অবিবাহিত নির্বিশেষে গ্রহণের ফলে গ্রামাঞ্চলে পর্যন্ত ব্যভিচারের মতো ব্যাধির প্রসার ঘটেছে। আজ উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে অবিবাহিত মেয়েরা ব্যাপক হারে গর্ভপাত ঘটাচ্ছে। তা ছাড়া গ্রাম্য চিকিৎসকগণ ও গর্ভপাত ঘটানোতে সহায়তা করছে। ফলে এসকল যুবতী-অবিবাহিত মেয়েরা বিবাহিত হওয়ার পর অধিকাংশই মা হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এতে স্বামী-স্ত্রীর পারিবারিক জীবনে পতন নেমে আসছে।

আরো পড়ুন: পরিবার কি পরিবারের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

জন্মনিয়ন্ত্রণের নামে ভ্রূণ হত্যা ও গর্ভপাত

গর্ভপাত একটি বেআইনী ও নিষিদ্ধ কাজ। ইসলাম গর্ভপাতের নামে ভ্রূণ হত্যাকে মানব হত্যার পর্যায়ভুক্ত মনে করে এবং একই দন্ড প্রদান করেছে। তা সত্ত্বেও আমাদের দেশে অবাধে গর্ভপাত ঘটানো হচ্ছে। "এম আর" এর নামে সর্বত্র গর্ভপাত চলছে। "এম আর" এর অর্থ হচ্ছে Meanstration Regulation বা বন্ধ মাসিক ঋতু চালু করা। গর্ভধারণ করলে ঋতু বন্ধ হয়ে যায় বলেই গর্ভপাতের জন্য এ নাম চালু করে এত বড় অপকর্ম সমাধা করা হচ্ছে। পরিকল্পিত পরিবার গড়ার জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং এর সাজ-সরঞ্জাম সহজলভ্য হওয়া মূলত পরিবার ভাঙ্গারই প্রকৃত পরিকল্পনা। নিরাপদ ব্যভিচারের সুযোগ থাকায় অবৈধ যৌন সম্পর্ক সহজ হয়ে পড়েছে। চরিত্রহীন স্বামী-স্ত্রী নিজেদের পছন্দসই নারী-পুরুষের সাথে পরকীয়া প্রেমে পড়ে সংসার ধ্বংস করে দিচ্ছে। এর প্রভাব সমাজের বিভিন্ন পরিবারের মধ্যে লক্ষ করা গেছে। সমাজের এ করুণ পরিণতিতে অনেক স্বামী-স্ত্রী আজ পরস্পর আস্থা হারিয়ে ফেলছে।

জন্মনিয়ন্ত্রণের কুফল

একটি মুসলিম সমাজে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার এ জাতীয় প্রচলন পরিবারের গোটা কাঠামো চুরমার করে দেবে। সমাজ বন্ধনের সকল বিধি পদদলিত হয়ে পাশ্চাত্যের ন্যায় বিবাহ প্রথা উঠে যাবে। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পরিবার গঠনে অনীহা প্রকাশ পাবে। আশংকা দেখা দেবে বয় ফ্রেন্ড ও গার্ল ফ্রেন্ড বিয়ের স্থান দখল করে নেয়ার। ছেলে-মেয়েরা নিজেদের পছন্দমত জনকে নিয়ে বিবাহ ব্যতীত লিভ টুগেদার চালু করবে। সুতরাং ইসলাম তার পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিবার ও সমাজ গঠন করার যে মূলনীতি পেশ করেছে তা সমাজে বাস্তবায়ন করে আদর্শ পরিবার ও পরিকল্পিত পরিবার সৃষ্টি করা যায়। যে উদ্দেশ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্যে কাজ করা হচ্ছে পরিকল্পিত পরিবার গঠনের মাধ্যমে একই উদ্দেশ্য সাধিত হবে। সীমিত সম্পদের মাধ্যমে সীমিত সংখ্যক সদস্য প্রতিপালন করাই যদি পরিবার পরিকল্পনা বা জন্মনিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে ইসলাম পরিবার প্রতিপালনের যে নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে তা যথেষ্ট কার্যকর বলে প্রমাণিত। পরিবার পরিকল্পনার নামে সমাজে অনৈতিকতার প্রসার ঘটাতে দেওয়া যায় না। মানব বংশের ক্রমধারা পবিত্রভাবে অব্যাহত রাখার জন্য এবং অর্থনৈতিক সচ্ছলতা লাভের জন্য ইসলাম পরিবার প্রতিপালনের যে বিধি মালা তৈরি করে দিয়েছে তার অনুশীলন যথেষ্ট।

আরো পড়ুন: ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ ও পরিবার এবং মানব সৃষ্টি

ইসলাম ও জন্মনিয়ন্ত্রণ

১. পরিবার প্রতিপালনের জন্য আল্লাহ তা'আলা স্বাভাবিকভাবে দুইটি প্রধান জিনিসের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। একটি হচ্ছে খাদ্য এবং অপরটি হচ্ছে বংশবৃদ্ধি। খাদ্যের ব্যবস্থা এজন্য করেছেন যে, পৃথিবীতে যত মানুষ আসবে তাদেরকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখা এবং তাদের মধ্যে শক্তি ও কর্মক্ষমতা সঞ্চার করা। এই জন্য মহান আল্লাহ তা'আলা বিশ্ব জগতের একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে মানুষসহ সকল প্রাণির খাদ্য সৃষ্টি করে দিয়েছেন। বিশ্বস্রষ্টার নিকট ব্যক্তির জীবন অপেক্ষা জাতির জীবন অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ব্যক্তির জন্য তার আয়ু খুবই সীমিত, আর জাতির জীবন অনন্ত। কাজেই এই সমাজ পরিচালনার জন্য ব্যক্তির মৃত্যুর পূর্বেই তার স্থলাভিষিক্ত অন্য ব্যক্তির প্রস্তুত হওয়া অপরিহার্য। এই উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য বিশ্ব প্রকৃতিতে বংশ বৃদ্ধির স্বাভাবিক ব্যবস্থা করা হয়েছে। বস্তুত মহান স্রষ্টা আল্লাহর এ উদ্দেশ্য যাতে সঠিকভাবে কার্যকর হয়, ইসলাম তারই অনুকূল নীতিমালা পেশ করেছে। প্রথম ব্যবস্থা বা খাদ্যদ্রব্য সম্পর্কে ইসলামের ঘোষণা এই যে,

'ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণকারী সকলের জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহরই'। (সূরা হুদ: ৬)

২. আল্লাহ যে অনেক অনেক বেশি মানুষ ও জীবকে খাদ্য দিয়ে বাঁচাতে পারেন এবং তা আল্লাহর পক্ষে কিছুমাত্র কঠিন বিষয় নয়- তাতে যে আল্লাহর খাদ্য ভান্ডারে কোন অভাব পড়ে না, তাতে এক বিন্দু সন্দেহ থাকতে পারে না। মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন-

'হে আমার বান্দাগণ। তোমাদের আগের ও পরবর্তীকালের লোকেরা এবং তোমাদের সমস্ত মানুষ ও জীন্ন যদি একটি কাঠের উপর দাঁড়িয়ে আমার নিকট প্রার্থনা করে এবং আমি প্রত্যেকের প্রার্থনা অনুযায়ী দান করি, তা হলে আমার নিকট রক্ষিত সম্পদ হ্রাসপ্রাপ্ত হবে না- হবে শুধু এতটুকু পরিমাণ যেমন- সমুদ্রে ডুবানো সুঁচ উঠালে যতটুকু পানি উঠবে। (হাদীসে কুদসী: মুসলিম)

এরূপ ব্যবস্থা সমাজে প্রচলিত থাকায় মানব বংশ ধ্বংস করার নীতি ও মনোবৃত্তির তীব্র প্রতিবাদ করে কুরআন মাজীদে বলা হয়েছেঃ

 'তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে দারিদ্রের ভয়ে হত্যা করো না। তাদেরকে আমিই 'রিক' দান করে থাকি এবং তোমাদেরকেও। নিশ্চয় তাদের হত্যা করা মহাপাপ। (সূরা বনী ইসরাইল: ৩১) 

বস্তুত যারাই বংশ বৃদ্ধির পথ বন্ধ করতে চেষ্টা করেছে, তারা বিভিন্ন দিক দিয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। তারা এক দিকে খাদ্য উৎপাদনকারী যুবশক্তি নির্মূল করছে, অন্যদিকে খাদ্যোৎপাদনে অক্ষম লোকদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে সমাজকে একেবারে অচল করে দিচ্ছে। বৃদ্ধ, পঙ্গু, অক্ষম ও অকর্মণ্য লোকদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে সমাজকে এক কঠিন সমস্যার সম্মুখীন করে দেওয়া হচ্ছে। অর্থনীতির দৃষ্টিতে এটা এক ভয়াবহ পরিস্থিতি, সন্দেহ নেই।

৩. কুরআন মাজীদের নিম্নলিখিত আয়াতে ঠিক এ কথাই বলা হয়েছে।

'যারা অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতার কারণে নিজেদের সন্তান-সন্ততিকে হত্যা করে এবং আল্লাহ প্রদত্ত জীবিকাকে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা রচনা করার উদ্দেশ্যে নিষিদ্ধ গণ্য করে তারা তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা অবশ্যই বিপথগামী হয়েছে এবং তারা সৎপথ প্রাপ্ত ছিল না।' (সূরা আল-আনআম: ১৪০)

বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমেও বিশ্বমানবের সম্মুখে আজ এই সত্যটি উদঘাটিত হয়েছে যে, জন্মনিয়ন্ত্রণ বা জনসংখ্যাবৃদ্ধির পথ রুদ্ধ করা-অর্থনীতির দৃষ্টিতে মারাত্মক ভুল। আর জনসংখ্যা হ্রাস করা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের (Economical Depression) মূল কারণসমূহের অন্যতম। কেননা মানুষের জন্মহার হ্রাস পেলে উৎপাদন ও উপার্জনক্ষম লোকদের (Producing population) সংখ্যা ব্যয়কারী লোকদের (consuming population) অপেক্ষা অনেক কম হয়ে পড়বে। এর অনিবার্য পরিণতিতে জনসমাজে বেকার সমস্যা দেখা দিবে। ফলে সমষ্টিগতভাবে ব্যয়কারী লোকদের সংখ্যাও অত্যধিক কম হয়ে পড়বে, উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রী ক্রয়কারী লোকদের সংখ্যাও হ্রাস পাবে, শ্রমিকগণ কাজ কম পাবে। এর অনিবার্য পরিণতিতে মানব জাতির অগ্রগতি মারাত্নকরূপে ব্যাহত হবে। জার্মানী ও ইটালীর অর্থনীতিবিদগণ এ জন্যই জনসংখ্যা বৃদ্ধির উপর খুব বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

আরো পড়ুন:  উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্য এবং সংবিধান প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন পদ্ধতি 

ইসলামী অর্থব্যবস্থাই জন্মনিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য সফল করতে পারে

ইসলামী অর্থনীতি প্রথমত একদিকে পুঁজিবাদের মূলোৎপাটন করেছে, সুদকে চিরতরে হারাম করেছে, সাধারণভাবে একচেটিয়া ব্যবসায় ও নিরংকুশ ইজারাদারী নিষিদ্ধ করেছে, জুয়া, প্রতারণামূলক ব্যবসায় ও ধন- সম্পদ বিনা কারণে আটক করে রাখাকে কঠিন পাপ বলে ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে যাকাত ও উত্তরাধিকারী আইন জারি করে অর্থনৈতিক অসাম্য ও সহায় সম্পত্তির একস্থানে পুঞ্জীভূত হয়ে যাওয়ার সকল পথ স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। কাজেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির ধুয়া তুলে ইসলামী সমাজে অবাধ জন্মনিয়ন্ত্রণ বা ভ্রূণ হত্যার প্রচলন করা কিছুতেই সঠিক নয়। ইসলামী সমাজে জনসংখ্যা বৃদ্ধি কোন দিনই কোন সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে না, ইসলামী রাষ্ট্র এই বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যাকে উৎপাদনকারী শক্তি হিসেবে প্রয়োগ করে বিশ্বস্রষ্টার অফুরন্ত ধনভান্ডার-এই বিশ্বপ্রকৃতিকে 'জয়' করবে। বস্তুত ধনসম্পদ ও খাদ্য-পণ্য উৎপাদনের যত উপায় ও উপকরণই দুনিয়ায় রয়েছে, তার সবগুলোকেই মানুষের বুনিয়াদী প্রয়োজন পূর্ণকরার কাজে ব্যবহার করা ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম কর্তব্য। এর ফলে ধন ও খাদ্যোৎপাদনের পরিমাণ ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাবে, উৎপন্ন খাদ্যপণ্য কোনক্রমেই অপচয় বা নষ্ট করা হবে না বলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রকৃত হার কোনদিনই খাদ্যাভাব ঘটানোর কারণ হবে না। দ্বিতীয়ত ধনসম্পত্তির ও খাদ্যপণ্যের সুবিচারপূর্ণ বন্টন করা হবে বলে প্রয়োজনীয় জীবিকা হতে কেহই বঞ্চিত থাকবে না। এবং তৃতীয়ত ইসলামী সমাজের লোকদের পরস্পরের মধ্যে গভীর সহানুভূতি ও শুভেচ্ছার বাঁধন বর্তমান থাকবে বলে তথায় কেউ কারো ওপর জুলুম বা শোষণ করবে না। বরং বিশ্বস্রষ্টার বিধান অনুযায়ী তাঁর প্রকৃত উদ্দেশ্য পূর্ণ করাই হবে ইসলামী অর্থনীতির মূল লক্ষ্য।

সবচেয়ে বড় কথা এই যে, ইসলামী অর্থনীতি কার্যকর ও বাস্তব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হবে যে রাষ্ট্রব্যবস্থার মারফতে, সেই রাষ্ট্রব্যবস্থা দেশ ও রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি মানুষ তথা প্রত্যেকটি প্রাণির অপরিহার্য জৈবিক প্রয়োজন পূর্ণ করার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। এই জন্য ইসলামী রাষ্ট্র জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনুসারে প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য উৎপাদনের পরিমাণও বৃদ্ধি করতে থাকবে। খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি না করে মানুষের বংশ ধ্বংস করার ব্যবস্থা গ্রহণ করার দিকে তার কোন প্রবণতাই থাকবে না।

বস্তুত যে রাষ্ট্র-ব্যবস্থা মানুষের বংশ ধ্বংস করার জন্য উদ্যোগী হয়, ক্রমবধিষ্ণু মানুষের জন্য খাদ্যোৎপাদনের ব্যবস্থা করে না সে রাষ্ট্রব্যবস্থা বিশ্বস্রষ্টার মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থী এবং অস্বাভাবিক।

এরূপ রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা ও ইসলামী অর্থনীতির মাধ্যমে উৎপাদন ব্যবস্থা জোরদার ও সুষম বন্টন নীতির মাধ্যমে মানুষের অর্থনৈতিক দূরাবস্থা দূর করা যায়। মানুষ আসলে সম্পদের অভাবে দরিদ্র নয়। মানুষ দরিদ্র হচ্ছে শিক্ষার অভাবে, উৎপাদননীতি ও সুষম বন্টনের অভাবে। আল্লাহ তা'আলা মানুষকে যে জ্ঞান-বিজ্ঞান দান করেছেন তার সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে পৃথিবীতে খাদ্যশস্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদানের কোন অভাব পড়বে না। বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার পৃথিবীর মানুষকে ক্রমেই উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। মানুষের প্রয়োজনীয় অভাব অনটন দূর করে মানুষের মনে হাসি ফোটাবে। বিজ্ঞানের গবেষণার মাধ্যমে আল্লাহর অফুরন্ত ভান্ডার উন্মোচিত হবে এবং মানুষ তার সুফল ভোগ করবে। তাই পৃথিবীতে যুদ্ধ-বিগ্রহ, হানাহানি, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করতে হবে। বিভিন্ন রাসায়নিক মারনাস্ত্রের ব্যবহার এবং এর পরীক্ষা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা মানবতার জন্যই প্রয়োজন।

সারকথা

ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় পরিবারই হলো মানুষ গড়ার মূল কেন্দ্র এবং সমাজ গঠনের প্রধান ও স্থায়ী ভিত্তি। এ জন্য পরিবার গড়ার ব্যাপারে ইসলামের বিধান রয়েছে। পরিবার গড়ার ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলার ব্যাপক পরিকল্পনা দান করেছেন। পারিবারিক জীবনকে সর্বাঙ্গীণ সুন্দর করার জন্য ইসলাম যত বিস্তারিত বিধান দিয়েছে, সমাজ ও রাষ্ট্রের কোন অঙ্গনের জন্যে এত ব্যাপক বিধি-বিধান দেওয়া হয়নি। ইসলামী রাজনীতি ও ইসলামী অর্থনীতির জন্য কতক মৌলিক বিধান দিয়ে তারই আলোকে যত আইন দরকার তা তৈরি করার সুযোগ আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন। কিন্তু পরিবারের বেলায় অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে পূর্ণাঙ্গ বিধান দিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে ব্যক্তি ও সমাজ গঠনের এ মূল সংস্থাটি সকল রকম ভুল ভ্রান্তি থেকে রক্ষা পায়। সন্তান জন্মদান, লালন-পালন, সন্তানের শিক্ষাদান, বিবাহ, তালাক, ফরায়েয বা সম্পদ বন্টন নীতি স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্য, পিতা-মাতা ও সন্তানের সম্পর্ক, বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য, অক্ষম, ভাই-বোন ও নিকট আত্মীয়দের প্রতি কর্তব্য, মৃত ব্যক্তির প্রতি কর্তব্য ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে ইসলাম চিরস্থায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ইসলাম পরিবারকে স্থিতিশীল ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বিবাহ করার প্রতি উৎসাহিত করেছে। ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে পরিকল্পিত পরিবার গড়ার জন্যে তিনটি মুলনীতি বর্ণিত হয়েছে যে মূলনীতি উপেক্ষা করলে সমাজে দারিদ্র, অশান্তি, পরিবার ধ্বংস ও মানব প্রজন্মের ক্রমধারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url