বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত শরী'আতের পরিভাষা ও বিধান

বিবাহ বিচ্ছেদের পরিভাষাগুলো বলতে পারবেন পদ্ধতিগত দিক থেকে তালাকের প্রকারগুলোর বর্ণনা দিতে পারবেন শব্দগত দিক থেকে তালাকের প্রকারগুলোর বর্ণনা করতে পারবেনস্পষ্ট তালাক বিধানসহ বর্ণনা করতে পারবেন  ইংগিতপূর্ণ তালাক বিধানসহ বর্ণনা করতে পারবেন ধরন বা প্রকৃতির দিক থেকে তালাকের প্রকারভেদ বর্ণনা করতে পারবেন খুলা ও ঈলা সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারবেন

যে সকল পারিভাষার সাহায্যে বিবাহ বিচ্ছেদ সংগঠিত হয় সেগুলো নিম্নরূপ-

১ তালাক 

২. খুলা 

৩. তাফবীজ 

৪. ঈলা

তালাক

নির্দিষ্ট শব্দের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার বিবাহ বন্ধনকে ছিন্ন করার নাম হল তালাক। এ পরিভাষাগুলো ব্যবহার করে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে তালাক বা বিচ্ছেদ সংঘটিত হয় তা কয়েক ভাগে বিভক্ত।

পদ্ধতিগত দিক থেকে তালাক তিন প্রকার

১। সর্বোত্তম তালাক

২। উত্তম তালাক

৩। বিদআত বা সুন্নাত পরিপন্থি তালাক

আরো পড়ুন: ইসলামে সম্পদের উত্তরাধিকারের বিধান পুরুষদের  নারীদের নির্ধারিত অংশ 

সর্বোত্তম তালাক

স্বামী তার স্ত্রীকে এমন পবিত্রাবস্থায় এক তালাক প্রদান করে যে পবিত্রাবস্থায় তার সঙ্গে যৌনমিলন হয়নি এবং এরপর তিন মাস পর্যন্ত স্ত্রীকে তার ইদ্দত (তালাকের পর নির্দিষ্ট সময় অপেক্ষা করা) পূর্ণ করা পর্যন্ত ঐ অবস্থায় রেখে দেবে। এ পদ্ধতিতে তালাক প্রদানকে সর্বোত্তম তালাক বলে।

এ তালাকের বিধান

ইদ্দত তথা স্ত্রী কর্তৃক অপেক্ষার তিন মাস শেষ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ তালাকটি এক তালাকে রাজয়ী হিসেবে গণ্য হবে। এ সময়ের মধ্যে স্বামী তার স্ত্রীকে বিশেষ পদ্ধতিতে (পূর্বের পাঠে বর্ণিত হয়েছে) ফিরিয়ে নিলে সে স্ত্রী হিসেবেই গণ্য হবে। আর যদি ইদ্দতকাল তথ্য তিন মাস শেষ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত স্ত্রীকে ফিরিয়ে না নেওয়া হয়, তাহলে এ তালাকটিকে এক তালাক বায়েন হয়ে যাবে। উক্ত স্ত্রীকে স্ত্রী হিসেবে পুনরায় পেতে হলে বিবাহ নবায়ন করে নিতে হবে।

বা উত্তম পন্থায় তালাক

স্বামী তার স্ত্রীকে পরপর তিন তহরে (পবিত্রাবস্থায়) এক এক করে তিন তালাক প্রদান করাকে উত্তম তালাক বলে।

এ তালাকের বিধান

প্রথম তহুরের (পবিত্রাবস্থায়) তালাক প্রদান করার পর দ্বিতীয় তত্ত্বে আর এক তালাক প্রদানের পূর্ব পর্যন্ত তা এক তালাকে রাজয়ী হিসেবে গণ্য হবে। এর মধ্যে স্বামী তাকে ফিরিয়ে নিলে সে পুনরায় স্ত্রী হিসেবে গণ্য হবে। আর যদি দ্বিতীয় তহুরে (পবিত্রাবস্থায়) ফিরিয়ে না নিয়ে দ্বিতীয় তালাক প্রদান করে তাহলে দু' তালাকে রাজয়ী হিসেবে গণ্য হবে। তৃতীয় তহুরে তৃতীয় তালাক প্রদানের পূর্বে স্বামী তাকে ফিরিয়ে নিলে সে স্ত্রী হিসেবে গণ্য হবে। আর যদি তৃতীয় তালাক প্রদান করে ফেলে তাহলে নতুন করে পুনঃ বিবাহ ছাড়া তাকে স্ত্রী হিসেবে গণ্য করা যাবে না। তিন তালাক এর পর স্ত্রীকে পুনরায় পেতে হলে কি পদ্ধতি রয়েছে তা পূর্বের পাঠে আলোচিত হয়েছে।

তালাকে বেদয়ী

 বেদয়ী তালাক বলতে বুঝায় স্বামী তার স্ত্রীকে একই সঙ্গে তিন তালাক প্রদান করবে বা এক তত্ত্বরে তিন তালাক প্রদান করবে। অথবা একই তহুরে একসঙ্গে দুই তালাক প্রদান করা অথবা ঋতুস্রাব অবস্থায় তালাক প্রদান করা অথবা এমন তহুরে তালাক প্রদান করা যে তহুরে উভয়ের মধ্যে যৌন মিলন হয়েছে।

এ তালাকের বিধান 

এ তালাকের বিধান হল, অধিকাংশ ফিকহবিদদের মতে তালাকই হয়ে যাবে এবং যে সংখ্যক তালাক দিয়েছে তাই সংঘটিত হবে। 

কারও মতে যেহেতু শরী'আত সম্মত পদ্ধতি অনুযায়ী হয়নি তাই কোন তালাকই সংঘটিত হবে না।

মতান্তরে যেহেতু তালাক শব্দটি উচ্চারিত হয়েছে তাই এক তালাক সংঘটিত হবে। (নাইলুল আওতার আল্লামা শওকানী)

শব্দগত দিক থেকে তালাকের প্রকার 

তালাক প্রদানের জন্য যে শব্দাবলী ব্যবহৃত হয় সে দৃষ্টিকোণ থেকে তালাক দু' প্রকার। 

১. সারীহ্ বা স্পষ্ট তালাক

২. কেনায়াহ বা ইঙ্গিত মূলক তালাক

সারীহ বা স্পষ্ট তালাক

সারীহ বা স্পষ্ট তালাক বলতে এমন তালাককে বুঝায় যে তালাক প্রদানের ক্ষেত্রে শুধু তালাকের জন্য ব্যবহৃত শব্দ প্রয়োগ করা হয় যেমন স্বামী তার স্ত্রীকে বলবে তুমি তালাক/তালেক, তোমাকে তালাক দিলাম ইত্যাদি শব্দ। কেনায়াহ তালাকঃ কেনায়াহ (ইঙ্গিতবহ) তালাক বলতে এমন তালাককে বুঝায় যে তালাক প্রদানের ক্ষেত্রে এমন শব্দ প্রয়োগ করা হয় যে শব্দ স্পষ্টভাবে তালাকের অর্থ প্রদান করে না। তবে তালাকের প্রতি ইঙ্গিত করে।

সারীহ প্রকাশ্য তালাকের জন্য ব্যবহৃত কতিপয় শব্দ 

১ তুমি তালাক

২. তুমি তালেক

৩. তুমি তালাক প্রাপ্তা

৪. আমি তোমাকে তালাক দিলাম ইত্যাদি। 

এ তালাকের বিধান

উপরোক্ত শব্দসমূহ ব্যবহার করে কোন সংখ্যা উল্লেখ না করে কেউ যদি তালাক প্রদান করে তাহলে এক তালাকে রাজয়ী অনুষ্ঠিত হবে।

আর যদি এক বা দুই সংখ্যা উল্লেখ করা হয় তাহলে এক তালাক/দুই তালাক রাজয়ী অনুষ্ঠিত হবে। তালাক শেষে ইদ্দতের সময় কালের মধ্যে স্ত্রীকে স্বামী ফিরিয়ে নিতে পারবে। এ সময় কালের মধ্যে যদি ফিরিয়ে না নেয় তাহলে এক / দুই তালাক বায়েন হয়ে যাবে, তখন স্ত্রীকে পেতে হলে বিবাহ নবায়ন করতে হবে। আর যদি তিন তালাক প্রদান করে তাহলে এর বিধান যেদয়ী তালাকের বিধান এর অনুরূপ হয়ে যাবে। এ পাঠেই আলোচিত হয়েছে। 

সারীহ তালাকে ফোন প্রকারের নিয়াতের প্রয়োজন হয় না। কেননা এ তালাকের শব্দসমূহ প্রকাশ্য তালাকের অর্থ দহন করে।

কেনায়া তালাকের জন্য ব্যবহৃত শব্দসমূহ

(১) তুমি একা, (২) তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই, (৩) তুমি আমার থেকে পৃথক, (৪) তুমি দায়মুক্ত, (৫) তুমি মুক্ত, (৬) তুমি তোমার বাবার বাড়িতে চলে যাও, (৭) তোমার সিদ্ধান্ত তুমি নাও, (৮) যের হয়ে যাও, (৯) তোমার দায়িত্ব তোমার উপর ইত্যাদি।

এ তালাকের বিধান

সাধারণত এ শব্দগুলো দ্বারা তালাক হয় না। এ শব্দগুলা দ্বারা তালাক কার্যকর হওয়ার জন্য তালাকের নিয়াত থাকতে হবে। অন্যথায় তালাক অনুষ্ঠিত হবে না। তালাকের নিয়্যত থাকলে এক তালাকে বায়েন অনুষ্ঠিত হবে। (কুদুরী)

ধরন বা প্রকৃতির দিক থেকে তালাকের প্রকার। তালাকের ধরণ বা প্রকৃতির দিক থেকে তালাক তিন প্রকার।

১. তালাক রাজয়ী (প্রত্যাবর্তনযোগ্য তালাক)

২. তালাক বায়েন (পৃথককারী তালাক)

৩. তালাক মুগাল্লাযা (কঠিন তালাক)

তালাক রাজয়ী

যে তালাক প্রদান করার পর স্বামী তার স্ত্রীকে ইদ্দতের মধ্যে ফিরিয়ে নিতে পারে তাকে তালাক রাজয়ী বলে। যথা এক তালাক বা দুই তালাক বলে তালাক প্রদান করলে তা এক/দুই তালাক রাজয়ী হিসেবে গণ্য হবে।

তালাক বায়েন

যে তালাকের পর স্ত্রীর উপর স্বামীর অধিকার থাকে না, এ ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হলে তাদের বিবাহকে নবায়ন করতে হবে। যথা- এক/দুই তালাক রাজয়ী প্রদান করার পর ইদ্দতের মধ্যে যদি স্ত্রীকে ফিরিয়ে না নেয়া হয় তাহলে তা এক/দুই তালাক রাজয়ী হিসেবে গণ্য হবে।

আরো পড়ুন: ইসলামে পরিরবার পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

খুলা তালাক 

স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদের আর একটি পদ্ধতি হল "খুলা", যাকে খুলা তালাক বলে। 'খুলা তালাক' মানে, স্ত্রী স্বামীর সাথে থাকতে রাজি নয়, সেজন্যে সে তালাক নিতে চায়; কিন্তু স্বামী তালাক দিতে ইচ্ছুক নয়। এরূপ অবস্থায় স্ত্রী কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে স্বামীকে তালাক দিতে রাযী করে নেয়। ইসলামে একে বলা হয় 'খুলা তালাক' এবং শরী'আতে এরূপ তালাকের অবকাশ রয়েছে। কেননা স্ত্রী যদি কোনমতেই স্বামীর সাথে থাকতে প্রস্তুত নয়, আর স্বামীও তাকে তালাক দিতে রাজি নয়। এ অবস্থা একজন নারীর পক্ষে অত্যন্ত মর্মান্তিক। তাই সুযোগ রাখা হয়েছে, স্ত্রী যদি স্বামীকে টাকা-পয়সা দিয়ে তালাক দিতে বাধ্য করতে পারে এবং সে তালাক দিয়ে দেয়, তবে স্ত্রীর মুক্তিলাভের পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়। এ পর্যায়ে কুরাআন মাজীদের নিম্নোক্ত আয়াতটিকে সামনে রাখতে হবে। আল্লাহ তা'আলা বলেন।

'তোমরা তোমাদের স্ত্রীকে যা প্রদান করেছ তা থেকে কোন কিছু গ্রহণ করা তোমাদের জন্য বৈধ হবে না। অবশ্য যদি তাদের উভয়ের আশংকা হয় যে, তারা আল্লাহর সীমারেখা রক্ষা করে চলতে পারবে না এবং তোমরা যদি আশংকা কর যে, তারা আল্লাহর সীমারেখা রক্ষা করে চলতে পারবে না, তবে স্ত্রী কোন কিছুর বিনিময়ে নিষ্কৃতি পেতে চাইলে তাতে তাদের কারো কোন অপরাধ নেই। (সূরা আল-বাকারা: ২২৯)

এ আয়াত থেকে খুলা তালাকের সুযোগ প্রমাণিত হয় এবং এও প্রমাণিত হয় যে, স্ত্রী যদি টাকা-পয়সার বিনিময়ে স্বামীর কাছ থেকে তালাক গ্রহণ করে এবং স্বামী সে অর্থ গ্রহণ করে তবে তাতে কোন দোষ হবে না। তাবেয়ী ইকরামাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: 'খুলা তালাকের কোন ভিত্তি আছে কি?

তিনি বললেন, হযরত ইবন আব্বাস (রা) বলতেনঃ

'ইসলামী সমাজে প্রথম 'খুলা' তালাক অনুষ্ঠিত হয়েছিল আবদুল্লাহ ইবনে উবাই'র বোন সাবিত ইবনে কায়সের স্ত্রীর ব্যাপারে।'

মনে রাখতে হবে, খুলা তালাকের অবকাশ ইসলামে আছে একথা ঠিক। আর এর সুযোগ রাখা হয়েছে এমন সব স্ত্রীর মুক্তিলাভের উপায় ও পন্থা হিসেবে, যাদের পক্ষে স্বামীর সাথে একত্রে থাকার কোন উপায়ই থাকে না। ইসলামে এর প্রতি কিছুমাত্র উৎসাহিত করা হয়নি। শুধু এতটুকুই নয়, সত্যি কথা এই যে, ইসলামে তালাক দানের মতই স্ত্রীর পক্ষে খুলা তালাক গ্রহণকেও অত্যন্ত খারাপ মনে করা হয়েছে। এ পর্যায়ে রাসূলে করীম (স)- এর বাণী হল:

 কোন দুঃসহ কারণ ছাড়া যে মহিলা তার স্বামীর কাছে তালাক চাইবে, তার জন্যে জান্নাত সম্পূর্ণ হারাম হবে

' যাবে।' অতএব এ কাজ কোন নারীরই করা উচিত নয়। নারী ও পুরুষ- সকলেরই কর্তব্য ইসলামী সমাজের পরিবার- দুর্গকে সুরক্ষিত করে রাখা এবং এ দুর্গকে কোনরূপ ক্ষতিগ্রস্ত বা বিপর্যয়ের সম্মুখীন না করা।

তাফবীজ

তাফবীজ মানে ক্ষমতা প্রদান করা। এর মধ্যে স্বাধী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ সংঘটিত হয়ে থাকে। শরী'আতের পরিভাষায় তাফবীজ হচেছ স্বামী যদি যে কোন সময়ের জন্য তার স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা প্রদান করে আর স্ত্রী এ ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাকে তালাক তাফবীজ বলে। যেমন আমাদের দেশে বিবাহের কাবিন নামায় এ ধরনের ক্ষমতা প্রদানের কথা উল্লেখ থাকে। স্বামী যদি এতে সম্মত হয় তাহলে স্ত্রী এ তালাক প্রদানে অধিকার রাখে।

ঈলা পরিভাষা

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার বৈবাহিক সম্পর্ককে ঈলা নামক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চিহ্নিত করা যায়। এটা উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদ সংঘটিত করার ব্যাপারে তালাকেরই অনুরূপ।

ঈলার পরিচয়

ঈলা শব্দের অর্থ শপথ, পারিভাষিক অর্থে চারমাস বা ততোধিক সময়ের জন্য স্ত্রীর নিকটবর্তী হওয়া থেকে বিরত থাকার শপথ করার নাম ঈলা।

এর বিধান

যদি কেউ এ জাতীয় শপথ করে এবং চার মাসের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মিলন সাধিত না হয় তা হলে তা তালাকে বায়েন হিসেবে প্রযোজ্য হবে। আর যদি চার মাসের মধ্যে তাদের উভয়ের মধ্যে মিলন অনুষ্ঠিত হয় তা হলে ঈলা বাতিল বলে গণ্য হবে। তবে শপথের কাফফারা দিতে হবে।

ঈলার কাফ্ফারা

দশ জন মিসকীনকে ন্যায় সঙ্গতভাবে একবেলা খাওয়াতে হবে বা পরিধানের বস্ত্র প্রদান করতে হবে। এটা করা সম্ভব না হলে তিন দিন রোযা রাখতে হবে।




এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url