মাতা-পিতা ও সন্তানের সম্পর্ক

সন্তানের সাথে পিতা-মাতার সম্পর্ক নির্ণয় করতে পারবেন।পিতা-মাতার সাথে সন্তানের সম্পর্ক বর্ণনা করতে পারবেন।পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে আলোচনা করতে পারবেন।


ভূমিকা

মানুষকে আল্লাহ তা'আলা আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব ও স্বীয় প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। আর তাকে দিয়েছেন সুন্দরতম আকার-আকৃতি। আল্লাহ তা'আলা মানুষকে সর্বোত্তম পন্থায় জীবন যাপনের পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন। তিনি মানুষকে দান করেছেন পিতা-মাতা, স্ত্রী, স্বামী, সন্তান-সন্ততি এবং অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন। সকলে মিলে সুন্দরভাবে জীবন যাপন করার জন্য তিনি তাদের দান করেছেন হাজারো নিয়ামত, বিশেষ করে সন্তান-সন্ততি। পিতা-মাতার জন্য সন্তান-সন্ততি যেমন বড় নিয়ামত তেমনি সন্তানের জন্য মাতা-পিতাও উত্তম নিয়ামত। তাই মুসলিম পরিবারে মাতা-পিতা ও সন্তানের সম্পর্ক হবে সুমধুর। আর এই মধুর সম্পর্ক যথার্থভাবে বজায় রাখার জন্য সন্তানের প্রতি মাতাপিতার দায়িত্ব বা ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। প্রত্যেক মাতা-পিতাকে এ কথা স্মরণ রাখতে হবে যে সন্তান তার কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে আমানত স্বরূপ। এ আমানত যথার্থভাবে রক্ষা করার মাধ্যমেই মাতা-পিতা ও সন্তানের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। মাতা-পিতা ও সন্তানের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য সন্তানকে যেমন মাতা-পিতার অকৃত্রিম ভালবাসা ও আদর-যত্ন দিয়ে বড় করে তোলা প্রয়োজন তেমনি মা-বাবার প্রতি সন্তানেরও সুম্পর্ক বজায় রাখা অবশ্য কর্তব্য। পিতা-মাতা ও সন্তানর সম্পর্ক মানে পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার করণীয় কি তা বুঝায়। নিম্নে তাদের দায়িত্ব ও সম্পর্ক সম্পর্কে আলোকপাত করা হল।

আরো পড়ুন: পরিবার কি পরিবারের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

সন্তানের সাথে পিতা-মাতার সম্পর্ক

মায়ের উদরে সন্তানের আবির্ভাব হওয়ার পর থেকেই স্বামী-স্ত্রী তাদের ভবিষ্যত সন্তান লাভের আশায় মাতৃগর্ভে সন্তান যাতে সুস্থ থাকে সে ব্যাপারে সচেতনতা অবলম্বন করেন। সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তার ডান কানে আযান ও বাম কানে ইকামাত দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। সন্তানের ভাল নাম রাখেন। কথা বলা শিখার সময়ে তাকে প্রথমে কালিমা তাইয়্যেবা শিক্ষা দেন। লেখাপড়া করার বয়সে তাকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞান ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেন। মা-বাবা তাদেরকে মিথ্যা কথা বলা, প্রতারণা করা, কাউকে গালি দেওয়া ইত্যাদি অসৎ আচরণ করা থেকে বিরত রাখেন। মা-বাবা সন্তানের সামনে রাগ করা, মিথ্যা বলা, গালি দেওয়া, প্রতারণা করা প্রভৃতি কাজ থেকে বিরত থাকেন। তা ছাড়া সন্তানকে উত্তমরূপে লালন-পালন করে আদর-যত্ন দিয়ে বড় করে তুলেন, ফলে সন্তানও মাতা-পিতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়; মা-বাবাকে কষ্ট দেওয়া, কর্কশ আচার- আচরণ করা, গালি-গালাজ করা প্রভৃতি খারাপ আচরণ থেকে বিরত থেকে তাদের সাথে উত্তম আচরণ করার চেষ্টা করে। সন্তান-সন্ততি হল কাঁদা মাটির ন্যায়। কাঁদা মাটিকে যেভাবে ইচ্ছা একজন মানুষ সেভাবেই তাকে আকৃতি দিতে পারে। সন্তানকেও যেভাবে আদব-কায়দা শিক্ষা দিবে তাকে যেভাবে লালন-পালন করবে সন্তানও ঠিক তেমনি আচার-আচরণ মা-বাবার সাথে করবে।

সন্তানের ভাল নাম না রাখা, কুরআন ও ইসলামের শিক্ষা দান না করা এবং পূর্ণ বয়সের সময় তার বিবাহের ব্যবস্থা না করা পিতা-মাতার জন্যে অপরাধের মধ্যে গণ্য। এসব কাজ না করলে পিতা-মাতার পারিবারিক দায়িত্ব পালিত হতে পারে না। ফলে সন্তানরাও পিতা-মাতার সাথে সুম্পর্ক বজায় রাখে না। এ সম্পর্কে একটি উদাহরণ প্রদান করা হল- একবার এক ব্যক্তি হযরত উমর ফারুক (র)-এর কাছে একটি ছেলেকে নিয়ে হাযির হয়ে বলল- হুজুর এ আমার ছেলে। কিন্তু সে আমার সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। তখন হযরত উমর (রা) ছেলেটিকে বললেন- তুমি কি আল্লাহকে ভয় করো না? পিতা-মাতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা বড় গুনাহের কাজ: তা কি জান না? সন্তানের উপর পিতা-মাতার যে অনেক হক্ব আছে তা তুমি কিভাবে অস্বীকার করতে পার?

ছেলেটি তখন বলল- আমীরুল মুমিনীন। পিতা-মাতার উপরও কি সন্তানের কোন হক আছে? হযরত উমর বললেন- অবশ্যই। তখন ছেলেটি বলল- আল্লাহর শপথ, আমার এ পিতা আমার এ হক্বগুলোর একটিও পালন করেনি। তখন হযরত উমর (রা) সেই লোকটিকে বললেন- তুমি বলছো, তোমার ছেলে তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। আসলে তুমিই তার থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করেছ। পিতা-মাতা যদি সন্তানের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন তা হলে সন্তানও তাঁদের সাথে সুসম্পর্ক বজায়ে রাখতে চেষ্টা করবে।

আরো পড়ুন: বিবাহ ও এর প্রয়োজনীয়তা এবং  বিবাহ সম্পর্কে ইসলামের বিধান 

পিতা-মাতার সাথে সন্তানের সম্পর্ক 

আল্লাহ তা'আলার ইবাদাতের পরেই পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। পিতা- মাতা সন্তানকে যেভাবে আদর-যত্ন দিয়ে নিজে কষ্ট করে, নিজে না খেয়ে না পড়ে এক কথায় সকল সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়ে সন্তানের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন। সন্তানের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসার ব্যবস্থা করে সন্তানের সাথে উত্তম সম্পর্ক বজায় রাখেন, সন্তানের জন্য এটা অপরিহার্য যে তারা তাদের পিতা-মাতাকে শ্রদ্ধা করবে, তাদের বাসস্থান, আহার, চিকিৎসা ও অন্যান্য প্রয়োজনাদি পূরণ করবে। মাতা-পিতার সাথে কটু ও কর্কশ বাক্য বিনিময় করবে না। পিতা-মাতার বৈধ আদেশ পালন করবে, তাদের সাথে সৎ ব্যবহার করবে, তাদের সন্তুষ্টি অর্জন করার চেষ্টা করবে। এভাবে সন্তান-সন্ততি তাদের পিতা-মাতার সাথে উত্তম সম্পর্ক বজায় রাখবে। পিতা- মাতার সাথে উত্তম সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য সন্তানের যে সকল কর্তব্য পালন করা অপরিহার্য তা নিম্নে উল্লেখ করা হল।

১. পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার: পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করা নফল নামায, সাদাকা, উমরা এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করার চেয়েও উত্তম। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা'আলা বলেন-

"আল্লাহ ছাড়া অপর কারো দাসত্ব করোনা এবং পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার করবে। (সূরা আল-বাকারা: ৮৩) 

২. বার্ধক্যে পিতা-মাতার সেবাযত্ন করা: পিতা-মাতা বার্ধক্যে উপনীত হলে তাঁদের বিশেষভাবে সেবা যত্ন করা প্রয়োজন। তাঁদের সাথে রাগ করে কথা বলা, তাঁদের আচার-আচরণে বিরক্ত হওয়া কোন মতেই উচিত নয়। আল্লাহ তা'আলা বলেন

'তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তবে তাদের প্রতি উফ্ বলো না এবং তাদের ধমক দিও না, তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বলবে। মমতাবশে তাদের প্রতি নম্রতার পক্ষপুট অবনিমিত করে দিও এবং বল, হে প্রভু! তাদের উপর রহম কর, যেমন শিশুকালে তারা আমাকে লালন-পালন করেছিলেন।' (সূরা বনী ইসরাঈল: ২৩-২৪)

তাফসীরকার মুজাহিদ (র.) এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন: পিতা-মাতা তোমার সামনে বার্ধক্যে পৌছলে তাঁদেরকে ময়লার মধ্যে ফেলে রাখবে না এবং যখন তাঁদের পায়খানা পেশাব পরিষ্কার করবে। কখনো তাদের প্রতি কোনরূপ ক্ষোভ দেখাবে না- অপমানকর কথা বলবে না- যেমন করে তারা তোমার শৈশবকালে তোমার পেশাব-পায়খানা পরিষ্কার করত- ঠিক তেমনি দরদ দিয়ে তোমরা তাদের সেবা করবে।

৩. পিতা-মাতার ভরণপোষণ করা: পিতা-মাতা দরিদ্র বা অসহায় হলে তাঁদের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করতে হবে। বিশেষ করে বৃদ্ধাবস্থায় তাদের পূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হবে। আল্লাহ তা'আলা বলেন-

বলুন, তোমরা যে সম্পদ ব্যয় কর, তা তোমাদের পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের জন্য ব্যয় করবে। (সূরা আল-বাকারা: ২১৫)

কুরআন ও হাদীসে যেভাবে মাতা-পিতার খিদমত, আনুগত্য এবং সুন্দর আচরণের গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, তেমনি মাতা-পিতার উপর খরচ না করে ধন-সম্পদ বাঁচানো সঠিক নয় বলেও তাকিদ দেওয়া হয়েছে। বরং সর্বপ্রথম তাদের জন্য খরচ করতে হবে। যদি খিদমত ঠিকই করে কিন্তু অর্থ খরচ করতে কুণ্ঠাবোধ করে তাও ঠিক নয়। যেভাবে সন্তানের উপর তাদের অধিকার আছে, তেমনি সন্তানের সম্পদের উপরও তাদের অধিকার রয়েছে। 

৪. সেবা-যত্ন : পিতা-মাতার অসুখ-বিসুখ হলে যত্ন সহকারে সেবা-শুশ্রূষা করা প্রয়োজন। রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন:

'যদি কোন ব্যক্তি নিজের আয়ু বাড়াতে এবং জীবিকার প্রশস্ততা চায় তাহলে সে যেন নিজের পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করে এবং আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখে। (আহমদ)

মাতা-পিতার সেবা যত্ন ও খিদমতের বিনিময়ে দীর্ঘ জীবন লাভ এবং সচ্ছলতা আল্লাহর এক বিরাট নিয়ামত। মানুষ যাতে আরও কিছু ভালো কাজ করে নেকী বৃদ্ধি এবং মাতাপিতার খিদমত করে আল্লাহর রহমতের হকদার হয়, তারই সুযোগ এ দুনিয়ায় করে দেওয়া হয়েছে।

৫. পিতা-মাতার আহ্বানে সাড়াদান: পিতা-মাতা ডাক দেওয়া মাত্র সাড়া দিতে হবে। সকলের আগে তাঁদের কথা পালন করতে হবে। তাঁদের আহবানে বিরক্তি প্রকাশ করা যাবে না। খুশী মনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেবার মনোভাব নিয়ে ডাকে সাড়া দেবে।

৬. কর্কশ ভাষায় কথা না বলা: তাঁদের সামনে অশালীন-অমর্যাদাকর ও বেফাঁস কথা-বার্তা বলা উচিত নয়। পিতা-মাতার সাথে কর্কশ ভাষায় কথা বলা, তাদেরকে গালমন্দ করা, অভিসম্পাত করা তা নিজে করুক বা নিজের কারণে অপর কোন মানুষ দ্বারা করাক তা সবই হারাম বা কবীরাহ গুনাহ। হাদীসে এসেছে।

'কোন ব্যক্তি অপর কোন ব্যক্তির পিতাকে গালি দিলে সে যেন নিজের পিতাকেই গালি দিল। এমনিভাবে যদি কেউ অপর ব্যক্তির মাকে গালাগাল করে তবে সে ব্যক্তি যেন এ প্রথম ব্যক্তির মাকেই গালি দেয়। (বুখারী ও মুসলিম)

আরো পড়ুন: ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ ও পরিবার এবং মানব সৃষ্টি

অপর এক হাদীসে আছে-

'কারো নিজের বাপ-মায়ের ওপর অভিসম্পাত করা সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহ। (বুখারী ও মুসলিম)

৭. কৃতজ্ঞতা প্রকাশ: আল্লাহর পরে সন্তানের উপর সবচেয়ে বড় অধিকার হল পিতা-মাতার। তাই ইসলামে আল্লাহর শোকর গুজারির সাথে সাথে মাতা-পিতার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর নির্দেশ নিম্নরূপ-

'আর তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাঁকে ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করবে না এবং পিতা- মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করবে। (সূরা বনী ইসরাঈল: ২৩)

৮. পিতা-মাতাকে সন্তুষ্ট রাখা: পিতা-মাতা যাতে সুখে-শান্তিতে জীবন যাপন করতে পারেন সন্তানের সেদিকে সুদৃষ্টি রাখতে হবে। সন্তানের এমন কোন কাজ করা উচিত নয় যাতে পিতা-মাতার মনে আঘাত লাগে। কেননা, হাদীসে আছে:

'আল্লাহর সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টির মধ্যে এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টির মধ্যে নিহিত।' (তিরমিযী, হাকিম)

মহানবী (স.) আরো বলেন: 'মাতা-পিতা তোমার বেহেশত এবং দোযখ স্বরূপ অর্থাৎ পিতা-মাতার সেবা-যত্ন করলে জান্নাত লাভ করা যাবে আর পিতা-মাতার অবাধ্য হলে জাহান্নামে যেতে হবে।

বস্তুত কোন ব্যক্তি পিতা-মাতা থেকে মুখাপেক্ষিহীন হতে পারে না। সামাজিক জীবনে তাঁদের গুরুত্ব ছাড়াও পরকালীন জীবনের মুক্তি ও সাফল্যের দিক থেকেও তাঁদের গুরুত্ব অপরিসীম। সুতরাং তাঁদের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার ও আনুগত্য করে এবং তাঁদেরকে সন্তুষ্ট রেখে সন্তান জান্নাতের পথ সুগম করতে পারে। অপর দিকে তাঁদের অধিকার পদদলিত করে অসন্তুষ্টির কারণে জাহান্নামের ইন্ধন হতে পারে।

৯. পিতা-মাতার সেবা-যত্ন করা: সন্তানকে সর্বাবস্থায় পিতা-মাতার খিদমতে নিয়োজিত থাকতে হবে। সন্তানসুলভ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক তাদের খিদমত করতে পেরে গৌরব অনুভব করা উচিত আর সাথে সাথে এ খিদমতের সুযোগ লাভে আল্লাহর শোকর আদায় করা দরকার। মন-প্রাণ দিয়ে তাঁদের খিদমত করতে হবে ও এ খিদমতকেই নিজের মুক্তির মাধ্যম মনে করতে হবে। এ দিকে ইঙ্গিত করেই মহানবী (স.) বলেন-

 'মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত।' (নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ)

কুরআন ও হাদীসের ভাষ্য থেকে বুঝা যায়, সচ্ছল অবস্থায় সন্তানের কর্তব্য হচ্ছে গরীব পিতামাতাকে আর্থিক সাহায্য দান। আল্লামা শাওকানী বর্ণনা করেছেন: 'দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত পিতামাতার জন্য অর্থ ব্যয় করা সচ্ছলাবস্থার সন্তানদের জন্য ওয়াজিব- এ সম্পর্কে শরী'আতবিদদের ইজমা হয়েছে।' (নাইলুল আওতার)

১০. ক্ষমা প্রার্থনা ও দু'আ করা: মাতা-পিতাকে অসহায় ও দুর্বল বয়সে এবং মৃত্যুর পরে নিজের শৈশবের কথা স্মরণ করে ভালবাসা ও রহমতের আবেগে বারবার আল্লাহর দরবারে তাঁদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা ও দু'আ করতে হবে এই বলে-

'হে আমার প্রভু। তাদের উপর রহম কর, যেমন শিশুকালে তারা আমাকে লালন-পালন করেছিল।' (সূরা বনী ইসরাঈল: ২৪)

আল্লাহ তা'আলা আরও শিখিয়ে দিয়েছেন:

'হে আমাদের প্রভু। তুমি আমাকে ও আমার পিতামাতাকে এবং বিশ্বাসী নর-নারীকে হিসাব-নিকাশের দিন ক্ষমা করে দিও।' (সূরা ইবরাহীম: ৪১)

১১. ওয়াদা, ওসিয়ত ও ঋণ আদায় করা: মাতা-পিতার মৃত্যুর পর তাঁদের দাফন-কাফনের পর তাঁদের ওয়াদা-অসিয়ত এবং ঋণ থাকলে তা আদায় করা সন্তানের কর্তব্য। হাদীসে আছে হযরত আবু উসাইদ (রা.) বলেন- আমরা নবী (স.) এর খিদমতে উপস্থিত ছিলাম। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল। মাতা- পিতার মৃত্যুর পরও কি এমন পদ্ধতি সম্ভব যে, আমি তাদের সাথে সুন্দর আচরণ অব্যাহত রাখতে পারি। মহানবী (সা) বললেন- জী হ্যাঁ, চারটি পদ্ধতি রয়েছে: মাতা-পিতার জন্য দো'আ ইসতিগফার, তাদের কৃত ওয়াদাসমূহ এবং বৈধ ওসিয়াত পূরণ, পিতার বন্ধু-বান্ধব এবং মাতার বান্ধবীদের ইজ্জত ও সম্মান করা এবং তাদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ও সুন্দর আচরণ করা যারা মাতাপিতার দিক থেকে তোমাদের আত্মীয় হোন।" (আদাবুল মুফরাদ)

১২. পিতা-মাতার আত্মীয় ও বন্ধুদের সাথে ভাল ব্যবহার: পিতা-মাতার অবর্তমানে পিতা-মাতার বন্ধু- বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে সুন্দর ব্যবহার করাও সন্তানদের কর্তব্য। কুরআন হাদীসের দৃষ্টিতে পিতামাতার সাথে তো বটেই! তাঁদের বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয় স্বজনের সাথেও ভাল ব্যবহার করার নির্দেশ রয়েছে। বলা হয়েছে-

'পিতার বন্ধু-বান্ধবের সাথে সদাচরণ করা অধিক নেকের কাজ।' (সহীহ মুসলিম) অপর এক হাদীসে আছে:

'পিতামাতার বন্ধুদের সম্মান করাও উত্তম কাজ।' (আবু দাউদ)

পরম করুণাময় আল্লাহর পক্ষ হতে সন্তানের জন্য সেরা উপহার হলো পিতা-মাতা। পিতা-মাতা, সন্তানের বেহেশত-দোযখ। তাই আল্লাহর পরেই তাঁদের স্থান। সুতরাং ইসলাম নির্দেশিত পন্থায় পিতা-মাতার খিদমত, সম্মান, মহব্বত করা এবং তাঁদের সাথে সুন্দর আচরণের মাধ্যমে আল্লাহর ভালবাসার সাথে সাথে ইহ-পরকালীন সৌভাগ্য হাসিল করা প্রতিটি সন্তানের কর্তব্য।

সারকথা

সন্তানের কছে পিতা-মাতা যেমন আল্লাহর পক্ষ থেকে বিরাট নিয়ামত পিতা-মাতার কাছে সন্তান ও আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিরাট নিয়ামত। আল্লাহ তা'আলার এ নিয়ামতকে ধরাপৃষ্ঠে সমুন্নত রাখার জন্য একে অপরের প্রতি অনেক দায়-দায়িত্ব রয়েছে। এই দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্য কেউ অস্বীকার করতে পারে না। পিতা-মাতা তার ছোট্ট শিশুটিকে পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যেমন স্নেহ, মায়া-মমতা দিয়ে আন্তরিকতার সাথে লালন-পালন করেন তেমনি সন্তানকে পিতা-মাতার প্রতি দয়াশীল হতে হবে। তাঁদের বৃদ্ধাবস্থায় সেবা-যত্ন দ্বারা তাদেরকে সন্তুষ্ট রাখতে হবে। তাঁদের মনে কোন কষ্ট দেওয়া যাবে না। তাঁদের জন্য চিকিৎসা, বাসস্থান ও জামা-কাপড়ের ব্যবস্থা সন্তানকে করতে হবে। পিতা-মাতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহ তা'আলা সন্তুষ্ট হন। পিতা-মাতাকে গালমন্দ করা যাবে না। পিতা-মাতার অবর্তমানে তাদের বন্ধুবান্ধবদের সেবা-যত্ন করা ইসলামের বিধান। পিতা-মাতার মৃত্যুর পর তাদের জন্য দু'আ করা ইসলামের নির্দেশ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url