মানব সমাজের উৎপত্তি ও বিকাশ
মানব সমাজের উৎপত্তি সম্বন্ধে বলতে পারবেন।মানব সমাজের বিকাশ কীভাবে হয়েছে তা বর্ণনা করতে পারবেন।ইসলামী সমাজের সদস্য হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বিষয় সম্পর্কে বলতে পারবেন।ইসলামের দৃষ্টিতে বিশ্বজনীন সমাজের রূপরেখা দিতে পারবেন।
মানব সমাজের উৎপত্তি ও বিকাশ
'দুনিয়ার সকল মানুষ একই বংশোদ্ভূত'- এ মতের উপরই ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপিত। আল্লাহ তা'আলা সর্বপ্রথম এক জোড়া মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তারপর সে জোড়া হতে দুনিয়ার সকল মানুষের জন্ম হয়েছে। প্রথম দিক দিয়ে এক জোড়া মানুষের সন্তানগণ দীর্ঘকাল পর্যন্ত একই দল ও একই সমাজের অন্তর্ভুক্ত ছিল। যেমন পবিত্র কুরআনের ঘোষণা:
'হে মানব। আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। (সূরা আল-হুজুরাত: ১৩)
সুতরাং, তাদের জীবন যাপন পদ্ধতি একই প্রকারের ছিল। তাদের ভাষাও ছিল এক। কোন প্রকার বিরোধ- বৈষম্য তাদের ছিল না। কিন্তু তাদের সংখ্যা যতই বৃদ্ধি পেতে লাগল, ততই তারা পৃথিবীর নানা দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল এবং এই বিস্তৃতির ফলে তারা অতি স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন বংশ, গোত্র, জাতিতে বিভক্ত হয়ে পড়ল। তাদের ভাষা বিভিন্ন হয়ে গেল। পোশাক-পরিচ্ছদের দিক দিয়ে অনেক বৈষম্য ও বৈচিত্র্য দেখা দিল। দৈনন্দিন জীবনযাপনের রীতি-নীতিও আলাদা হয়ে গেল এবং বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন আবহাওয়া তাদের রং, রূপ ও আকার-আকৃতি পর্যন্ত বদলিয়ে দিল। এসব পার্থক্য একেবারেই স্বাভাবিক, বাস্তব দুনিয়ায়ই এটা বর্তমান। কাজেই ইসলামও এসবকে ঠিক একটা বাস্তব ঘটনা হিসেবেই গ্রহণ করেছে। ইসলাম এসবকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেবার পক্ষপাতি নয় বরং এ সবের দ্বারা মানব সমাজের পারস্পরিক পরিচয় সহজ করা যায় বলে ইসলাম এগুলোকে স্বীকার করে নিয়েছে।
কিন্তু এই পার্থক্য ও বৈষম্যের উপর ভিত্তি করে মানব সমাজে বর্ণ, বংশ, ভাষা, জাতীয়তা এবং স্বদেশীকতার যে হিংসা-বিদ্বেষ উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে, ইসলাম তা কিছুতেই সমর্থন করতে পারে না। ইসলামের দৃষ্টিতে এটা সম্পূর্ণরূপেই ভুল। মানুষ এবং মানুষের মধ্যে শুধু জন্মের ভিত্তিতে উঁচু-নীচু, আশরাফ-আতরাফ এবং আপন পরের যে পার্থক্য করা হয়েছে, ইসলামের দৃষ্টিতে তা একেবারেই জাহেলিয়াত, একেবারেই মুর্খতাব্যঞ্জক। ইসলাম সমস্ত বিশ্ববাসীকে সম্বোধন করে বলেছে যে- তোমরা এক মাতা ও এক পিতার সন্তান, তোমরা পরস্পর ভাই ভাই এবং মানুষ হওয়ার কারণে তোমরা সকলেই সমান।
আরো পড়ুন: ইসলামে সম্পদের উত্তরাধিকারের বিধান পুরুষদের নারীদের নির্ধারিত অংশ
মানুষ সম্পর্কে এ ধারণা গ্রহণ করার পর ইসলাম বলে যে, মানুষে মানুষে কোন পার্থক্য যদি হতে পারে তবে তা বংশ, বর্ণ, ভৌগোলিক সীমা রেখা এবং ভাষার ভিত্তিতে নয়, বরং তা হতে পারে মনোভাব, চরিত্র ও জীবনাদর্শের দিক দিয়ে। এক মায়ের দু'সন্তান বংশের দিক দিয়ে যতই এক হোক না কেন, তাদের মনোভাব, চিন্তাধারা এবং চরিত্র যদি বিভিন্ন রকমের হয়, জীবনের কর্মক্ষেত্রে তাদের পথও সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন হয়ে যাবে। চিড়ান্তরে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই দূর সীমান্তের অধিকারী প্রকাশ্যে যতই দূরবর্তী হোক না কেন, তাদের মত। বিশ্বাস ও চিন্তাধারা যদি এক রকমের হয়, তাদের চরিত্র যদি এক প্রকারের হয়, তবে তাদের জীবনের পাত সম্পূর্ণ এক হবে, এতে সন্দেহ নেই। এ মতের ভিত্তিতে ইসলাম দুনিয়ার সকল বংশ এবং আঞ্চলিক ও জাতীয়তার বুনিয়াদে গঠিত বিবিধ সমাজের সম্পূর্ণ বিপরীত এক আদর্শিক সমাজ গঠন করেছে, যার চিন্তাধারা, বিশ্বাস, মত, চরিত্র ও জীবনাদর্শ সম্পূর্ণ আলাদা। এ সমাজে মানুষ ও মানুষের মিলনের ভিত্তি শুধু জন্মগত নয় বরং তা হচ্ছে নির্দিষ্ট একটা বিশ্বাস এবং জীবনের একটা আদর্শ।
যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলাকে নিজের মালিক ও প্রভু বলে স্বীকার করবে এবং নবীর প্রচারিত বিধানকে নিজ জীবনের একমাত্র জীবন বিধান বলে গ্রহণ করবে সেই ব্যক্তিই এ সমাজের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে। হোক সে আফ্রিকার অধিবাসী কিংবা আমেরিকার, আর্য হোক কিংবা অনার্য, কালো হোক কিংবা গোরা, হিন্দি ভাষাভাষী হোক কিংবা আরবী ভাষাভাষী। আর যে সব মানুষ এ সমাজে প্রবেশ করবে তাদের সকলের অধিকার ও সামাজিক মর্যাদাও সম্পূর্ণ সমান হবে। তাদের মধ্যে বংশীয়, জাতীয় অথবা শ্রেণীগত বৈষম্যের কোন স্থানই থাকবে না। সেখানে কেউ উঁচু আর কেউ নীচু নয়, কোন প্রকারের ছুৎমার্গ তাদের মধ্যে থাকবে না। কারো হাতের স্পর্শে কারো অপবিত্র হয়ে যাবার আশংকা থাকবে না। বিবাহ-শাদী, খানা-পিনা, বৈঠকী মেলা মেশার ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোন বাধা বিপত্তি থাকবে না। কেউ নিজ জন্ম বা পেশার দিক দিয়ে নিচ কিংবা ছোট জাত বলে পরিগণিত হবে না। কেউ নিজ জাত কিংবা পরিবারের ভিত্তিতে কোন বিশেষ অধিকার লাভ করতে পারবে না। শুধু বংশ কিংবা ধন-দৌলতের কারণে কারো শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত হবে না। যার চরিত্র অধিকতর ভাল এবং অন্যান্য লোক অপেক্ষা যার মনে আল্লাহর ভয় অনেক বেশী, মানব সমাজে একমাত্র তারই শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত হবে।
যেমন কুরআন বলেছে:
'তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তি অধিক সম্মানিত যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকী।' (সূরা আল- হুজুরাত: ১৩)
আরো পড়ুন: গৃহ পরিচারক ও গৃহকর্তার সম্পর্ক
বিশ্বজনীন সমাজের রূপরেখা
ইসলাম বিশ্বজনীন সমাজের রূপরেখা নির্দেশ করেছে। বিশ্বজনীন সমাজের বৈশিষ্ট্য এই যে, এটা বংশ ও ভাষার সমস্ত বৈষম্য এবং ভৌগলিক সীমারেখা চূর্ণ করে পৃথিবীর সর্বত্র বিস্তৃত হতে পারে এবং এর ভিত্তিতে দুনিয়ার নিখিল মানুষের এক বিশ্বজনীন সমাজ ও বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ব স্থাপিত হতে পারে। বংশীয় এবং আঞ্চলিকতার বুনিয়াদে স্থাপিত সমাজগুলোতে শুধু সে লোকেরাই শামিল হতে পারে, যারা নির্দিষ্ট একটি বংশে কিংবা নির্দিষ্ট কোন দেশে জন্ম লাভ করে। তার বাইরের লোকদের পক্ষে এ ধরনের সমাজের দুয়ার চিরতরে বন্ধ হয়ে থাকে। কিন্তু ইসলামের আদর্শের ভিত্তিতে গঠিতসমাজে একত্ববাদে বিশ্বাসী প্রত্যেকটি মানুষই প্রবেশ লাভ করতে পারে। আর যারা এ বিশ্বাস ও চরিত্র নীতিকে সমর্থন করে না, ইসলামী সমাজ তাদেরকে নিজের মধ্যে শামিল করে নিতে পারে না বটে কিন্তু তাদের সাথে মানবোচিত ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপন করে এবং তাদেরকে মানবোচিত অধিকার দান করতে সদা প্রস্তুত থাকে।
এটা সুস্পষ্ট কথা যে, এক মায়ের দু'সন্তান যদি মত, বিশ্বাস ও চিন্তাধারার দিক দিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়, তবে অবশ্য তাদের জীবন যাপন পদ্ধতিও ভিন্ন ভিন্ন হবে। কিন্তু এর অর্থ নিশ্চয়ই এটা নয় যে, তারা একে অপরের ভাই-ই নয়। এভাবে সমগ্র মানব বংশের দু'টি দল কিংবা এক দেশের অধিবাসী লোকদের দু'টি দলও যদি ধর্মমত এবং চরিত্রনীতির দিক দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন হয়, তবে তাদের সমাজও নিশ্চয়ই ভিন্ন হবে। কিন্তু মানবতার দিক দিয়ে তারা অবশ্যই সম্পূর্ণ এক ও অভিন্ন থাকবে। সম্মিলিত মানবতার ভিত্তিতে যে সর্বোচ্চ ও সর্বাধিক অধিকার দেয়ার ধারণা করা যেতে পারে ইসলামী সমাজ তা সবই অমুসলিম সমাজকে দিতে প্রস্তুত।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url