স্বামী-স্ত্রীর অধিকার ও কর্তব্য
আজ এই আর্টিকেলটিতে স্বামী-স্ত্রীর অধিকার ও কর্তব্য ইসলামের দৃষ্টিতে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কিরূপ হওয়া উচিত তা বর্ণনা করতে পারবেন।
ভূমিকা
মানব সমাজে বৈধভাবে নর-নারীর একত্রে বসবাসকে দাম্পত্য জীবন বলে। এ মধুর দাম্পত্য জীবনে পুরুষ হয় স্বামী আর নারী হয় স্ত্রী। স্বামীর জন্য স্ত্রী মহান আল্লাহ পাকের পক্ষ হতে এক মহান নিয়ামত আর স্ত্রীর জন্য স্বামীও আল্লাহ পাকের অপার রহমত। একজনের অভাবে অপরজন অসম্পূর্ণ ও অর্ধাঙ্গ। এ কারণেই স্ত্রী স্বামীর অর্ধাঙ্গিনী, জীবন সঙ্গিনী ও সহধর্মিনী। অপর দিকে স্বামী-স্ত্রীর জন্য সঙ্গী, রক্ষক ও নিরাপদ আশ্রয়স্থল। তারা একটি পাখির দু'টি ডানার ন্যায় একে অপরের সহযোগী ও সম্পূরক। একজনকে ছাড়া আর একজনের কল্পনা করা যায় না। মানব সৃষ্টির প্রথম প্রভাতে যখন আদম (আ) একাকী ছিলেন, বেহেশতের মধ্যে তখন তাঁর সহচরী হিসেবে বিবি হাওয়া (আ)-কে সৃষ্টি করা হল। যাতে তিনি খোঁজে পান দোসর, আর তাঁর কাজে ও চিন্তায় পান সঙ্গিনী। এভাবে আল্লাহ তা'আলা হযরত আদম (আ)-এর পার্শ্বে বিবি হাওয়াকে প্রতিষ্ঠিত করে শান্তি সাধনার যুগ্ম ধারার উদ্বোধন করলেন। নারী শাস্তি দায়িনী এক শক্তির আধার এবং কল্যাণের উৎস। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম করেছেন-
'জগতের যত বড় বড় জয়, বড় বড় অভিযান
মাতা-ভগ্নী ও বধুদের ত্যাগে হইয়াছে মহিয়ান।'
জননী, জায়া, কন্যারূপে সেবার মহত্ত্বে মানব জীবন সুশোভিত করে তোলে নারী। প্রকৃতপক্ষে নারীই পুরুষের সকল কাজের শক্তির উৎস। বিশ্বের যা কিছু মঙ্গল তা নারীর সহযোগিতায় সাধিত হয়েছে। কবি বলেছেন-
'বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।'
আরো পড়ুন: ইসলামী সমাজে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পর্কের গুরুত্ব
নারী তার পরশে কঠোর মরুময়জীবনে স্নেহমায়া-মমতা ও করুণার ঝর্ণধারা নামিয়ে এনে দুর্বিষহ দুঃখকেও করে তোলে সুখময়, তখন জীবন-যুদ্ধে পরাজিত মানুষ বাঁচার উৎসাহ পায়। তাছাড়া জীবন-যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার শক্তি পায়। যে মহাপুরুষ আজ দেশ শাসন করছে, কাল সে শিশু ছিল মায়ের কোলে। মা তার লালনে, বলনে, চলনে, ধরনে তাকে মানুষ করে তুলছে বলেই বিশ্বে আজ সে পরিচিত, মানব-সেবায় নিয়োজিত। নারীর মর্যাদা রক্ষার ব্যাপারে সর্বজনীন ধর্মবিধি ইসলাম শ্রেষ্ঠত্বের মহিমায় উন্নীত করার নির্দেশ দিবে এতে বিচিত্র কি? ইসলামের নবী নারীর মর্যাদা সমুন্নত করে সমগ্র মানবজাতির কলঙ্ক মোচনের দায়িত্ব গ্রহণ করে মানবতার জয়গান গেয়েছেন।
ইসলাম স্বামী-স্ত্রী নির্বিশেষে উভয়ের মর্যাদা ও অধিকার সংরক্ষণের জন্য কতিপয় অধিকার ও দায়িত্ব কর্তব্য বেঁধে দিয়েছে, যাতে তাদের দাম্পত্য জীবন সুখী থেকে আরো সুখকর ও মধুময় হয়ে উঠে। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর এবং স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য রয়েছে। পারিবারিক বা গার্হস্থ্য জীবনের এ এক প্রধান অঙ্গ। আদর্শ স্বামী সম্বন্ধে মহানবী (স.) বলেন: 'সে-ই সবচাইতে ভাল লোক, যার স্ত্রী তাকে ভাল বলে।' স্ত্রী সম্বন্ধে বর্ণিত হয়েছে 'তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের ভূষণস্বরূপ, তোমরাও তাদের ভূষণস্বরূপ।' এ ভূষণ যত মার্জিত ও সুন্দর হয়, সংসার ততই সুন্দর ও বাসোপযোগী হয়ে উঠে।
স্বামীর প্রতি স্ত্রীর যেমন কর্তব্য আছে, তেমনি স্ত্রীর প্রতিও স্বামীর কর্তব্য রয়েছে। সংসারে স্বামীর যা কর্তব্য তাই স্ত্রীর অধিকার এবং স্ত্রীর যা কর্তব্য তাই স্বামীর অধিকার। উভয়ের প্রতি উভয়ের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। আর এ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের মাধ্যমেই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক মধুর হয়ে গড়ে উঠে ও অধিকার নিশ্চিত হয়। নিম্নে মুসলিম পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর দায়িত্ব-কর্তব্য ও অধিকারসমূহ তুলে ধরা হল-
১. স্ত্রীকে জীবন সঙ্গীরূপে গ্রহণ করা: পারিবারিক জীবনে স্বামীর প্রধান কর্তব্য হলো, স্ত্রীকে জীবনের প্রিয়তমা সাথী হিসেবে গ্রহণ করে নিজের সুখ-শান্তি, আনন্দ-বেদনায় সমানাধিকার দান করা। এ মর্মে আল্লাহ পাকের ঘোষণা-
'নারীদের তেমনি ন্যায়সংগত অধিকার রয়েছে, যেমন স্বামীদের রয়েছে তাদের উপর।' (সূরা আল- বাকারা: ২২৮)
মহানবী (স.) বলেছেন-
'নিশ্চয় তোমার উপর তোমার স্ত্রীর অধিকার রয়েছে।'
২. স্ত্রীর ভরণ-পোষণ দান: স্বামী স্ত্রীর ভরণ-পোষণ, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা করবে এবং এ সম্পর্কে যাবতীয় ব্যয়ভার নির্বাহ করবে। এতে স্বামী কর্তব্যে কোনরূপ অবহেলা করতে পারবে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা'আলার বাণী হচ্ছে-
'তোমরা তোমাদের সামর্থ অনুযাযী যে সব ঘরে বাস কর, তাদেরকেও সেরূপ ঘরে বাস করতে দিবে।' (সূরা আত-তালাক: ৬)
মহানবী (স.) এ প্রসঙ্গে বলেন-
'তুমি যা খাবে, স্ত্রীকেও তা খাওয়াবে এবং তুমি যা পরবে স্ত্রীকেও তা পরতে দেবে।' (আবু দাউদ)
৩. উত্তম আচরণ: জীবনের সকল অবস্থায়ই স্বামী তার স্ত্রীর সাথে উত্তম ব্যবহার করবে। তাকে কখনো ঘৃণা করবে না, তার সাথে অযথা ঝগড়া বিবাদ করে পরিবেশ বিষময় করে তুলবে না। এ মর্মে মহান আল্লাহর ঘোষণা
'তোমরা তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার কর।' (সূরা আন-নিসা: ১৯)
৪. প্রয়োজনীয় শিক্ষাদান: স্ত্রী যদি অশিক্ষিতা হয়, তবে স্বামী তাকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা দান করবে এবং নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, হালাল-হারাম, পাক-নাপাক, অনু-গোসল ইত্যাদি জরুরি ও নিত্য প্রয়োজনীয় মাসয়ালা শিক্ষা দেবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক বলেন-
'হে মুমিনগণ। তোমরা নিজদিগকে ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন হতে বাঁচাও।' (সূরা আত-তাহরীম :৬)
৫. অন্যায়কে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে বিবেচনা করা: যদি স্ত্রী কখনো অনিচ্ছাকৃতভাবে কিংবা ভুলবশত কোন অন্যায় করে ফেলে, তবে স্বামী তা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এবং সংশোধন করে দেবেন। স্ত্রীর কোন ত্রুটি লক্ষিত হলে সেদিকে না তাকিয়ে তার সদগুণের দিকে তাকিয়ে খুশী হতে হবে। এ মর্মে আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছে
'তোমরা যদি তাদের অপছন্দ কর, তাহলে এমন হতে পারে যে, তোমরা এমন একটা জিনিসকে অপছন্দ করছ, যাতে আল্লাহ বিপুল কল্যাণ নিহিত রেখে দিয়েছেন।' (সূরা আন-নিসা: ১৯)
আরো পড়ুন: ইসলামে সম্পদের উত্তরাধিকারের বিধান পুরুষদের নারীদের নির্ধারিত অংশ
আল্লাহ তা'আলা আরো বলেন-
'তবে তোমরা যদি তাদের মার্জনা কর, তাদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা কর এবং ক্ষমা করে দাও, তাহলে জেনে রেখ, আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়াবান।' (সূরা আত-তাগাবুন: ১৪)
এ প্রসঙ্গে মহানবী (স.) বলেছেন-
'যদি স্ত্রীর কোন ব্যবহারে স্বামী অসন্তুষ্ট হয়, তবে অন্য ব্যবহারে সন্তুষ্ট হবে।' (মুসলিম)
৬. মাহর আদায় করা: মোহরানা স্ত্রীর একটি প্রধান অধিকার এবং স্বামীর জন্য এটা একটা বড় ঋণ। সুতরাং এ মোহরানা আদায় করা স্বামীর পক্ষে অবশ্য কর্তব্য। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ তা'আলা বলেন-
'আর তোমরা স্ত্রীদের মাহর সন্তুষ্টচিত্তে আদায় কর।' (সূরা আন-নিসা: ৪)
আল্লাহ তা'আলা আরো বলেন-
'তাদের নির্ধারিত মাহর আদায় কর। মাহর নির্ধারিত হওয়ার পর কোন বিষয়ে পরস্পর রাযী হলে তোমাদের কোন দোষ নেই।' (সূরা আন-নিসা: ২৪)
৭. স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখা: সংসার জীবনে স্বামী ও স্ত্রী একে অপরের পরিপূরক। সুতরাং কোন অবস্থাতেই একে অপরের মর্যাদা ক্ষুন্ন করা চলবে না। এ মর্যাদা সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন-
'তারা তোমাদের ভূষণ এবং তোমরা তাদের ভূষণ।' (সূরা আল-বাকারা: ১৮৭)
৮. অসৌজন্য মূলক-আচরণ না করা: স্বামী স্ত্রী একে অপরের সাথে কখনো রুক্ষ এবং কর্কশ ব্যবহার ও অসদাচরণ করবে না, বরং সর্বদা হাসি মুখে আমোদ-প্রমোদে উৎফুল্ল থাকার চেষ্টা করবে। স্ত্রীদের প্রতি অত্যাচার জুলুম করা, উৎপীড়ন করা বা কোন রকম কষ্ট দেয়া যাবে না। তাছাড়া স্বামীর সাথেও কোন অসদাচরণ করা চলবে না। স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে অযথা ঘৃণা করা যাবে না। মহান আল্লাহ এ বিষয়ে বলেন, 'তোমরা তাদের সাথে মুৎভাবে জীবন যাপন করবে, যদি তোমরা তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে এমন হতে পারে যে, যাতে আল্লাহ অনেক কল্যাণ নিহিত রেখেছেন, তোমরা তাকেই অপছন্দ করছ।' (সূরা আন-নিসা: ১৯)
যেমন কুরআনের ঘোষণা-
'কিন্তু তাদের ক্ষতি করে সীমালংঘনের উদ্দেশ্যে তোমরা তাদের আটক করে রেখো না। যে এরূপ করবে, সে নিজের উপরই যুলুম করবে। আর তোমরা আল্লাহর আয়াতকে খেলনার বস্তুতে পরিণত করো না।' (সূরা আল- বাকারা: ২৩১)
৯. একে অপরের গোপনীয়তা রক্ষা করা: স্ত্রীর গোপন কথা স্বামীর নিকট সর্বশ্রেষ্ঠ আমানত তেমনি স্বামীর গোপন কথা ও স্ত্রীর নিকট সর্বশ্রেষ্ঠ আমানত। সুতরাং কোন অবস্থাতেই স্ত্রীর গোপনীয় বিষয় প্রকাশ করা যাবে না। এ সম্পর্কে হাদীসে নিষেধ বাণী রয়েছে। মহানবী (স.) বলেছেন-
'কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে ঐ ব্যক্তি সবচেয়ে নিকৃষ্ট বলে বিবেচিত হবে, যে তার স্ত্রীর নিকট গমন করে এবং স্ত্রীও তার নিকট গমন করে। তারপর সে তার স্ত্রীর গোপন বিষয়াদি অপরের কাছে প্রকাশ করে।' (মুসলিম)
১০. সুষম ব্যবহার: স্বামী-স্ত্রী একে অপরের প্রতি সুষম ব্যবহার করবে যথাসম্ভব সব ব্যাপারে একে অপরের মর্যাদা রক্ষা করে চলবে।
১১. সামগ্রিকভাবে স্বামীর-স্ত্রীর অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হওয়া: স্ত্রীর সকল অধিকার এমন সুষ্ঠুভাবে আদায় করতে হবে, যাতে তার সন্দেহের উদ্রেক না হয়। কারণ, ইসলাম স্ত্রীকে স্বামীর চরিত্রের সার্টিফিকেট প্রদানের অধিকার দিয়েছে। এ মর্মে নবী করীম (স.) বলেন-
'তোমাদের মধ্যে তারা উত্তম, যারা তাদের স্ত্রীর নিকট উত্তম।' (তিরমিযী ও আহমদ)
১২. স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য আত্মীয়-স্বজনের সাথে ভাল ব্যবহার কাম্য: স্বামী-স্ত্রী একে অপরের আত্মীয়-স্বজনদের সম্মান করবে মর্যাদা দান করবে। কেউ কারো আত্মীয়-স্বজনকে অবজ্ঞা, ঘৃণা ও নিকৃষ্ট মনে করবে না। উভয়ে উভয়ের আত্মীয়-স্বজনের সাথে ভাল ব্যবহার করা স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের কর্তব্য।
১৩. মঙ্গল কামনা: একে অপরের জন্য সকল সময় কল্যাণ ও মঙ্গল কামনা করা স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের কর্তব্যের মধ্যে অন্যতম কর্তব্য। রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন-
'আর যদি তোমাদের সঙ্গী (স্বামী বা স্ত্রী) মারা যায়, তাহলে তার কল্যাণের জন্য তোমরা অবশ্যই দু'আ করবে।'
১৪. সমমর্যাদা দান: ইসলামী পরিবারে স্বামী-স্ত্রী একটি পাখির দুটো ডানার ন্যায়। কাজেই একে অপরকে নিজের মত সমান মর্যাদার ভিত্তিতে আচরণ করতে হবে। কারও মর্যাদা ক্ষগ্ন করা বৈধ নয়।
১৫. পরস্পর সদুপদেশদান: স্ত্রীকে সদুপদেশ দান করা স্বামীর কর্তব্য আবার স্ত্রী যদি জ্ঞানী গুণী ও ধার্মিক হয় আর স্বামী তার বিপরীত হয় তবে স্বামীকে সদুপদেশ দান করা স্ত্রীর কর্তব্য। ভাল কাজের জন্য স্ত্রীকে উদ্বুদ্ধ করে মানবীয় গুণাবলীর বিকাশে প্রেরণা যোগাতে হবে। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
'তোমরা যদি তোমাদের স্ত্রীদের অবাধ্যতার ভয় কর, তবে তাদের সদুপদেশ দাও।' (সূরা আন-নিসা: ৩৪)
১৬. স্ত্রীদের সম্পদ অবৈধভাবে আত্মসাৎ না করা: স্ত্রীর মোহরানার অর্থ অথবা পিতা-মাতা থেকে প্রাপ্ত সম্পদ অথবা চাকরি বা ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জনকৃত সম্পদ কিংবা অন্য যে কোন সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করা স্বামীর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। আর স্ত্রীর এসব সম্পদ কখনো গ্রাস করা যাবে না। স্বামীর অনুপস্থিতিতে স্ত্রী তার স্বামীর সকল সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকবেন। স্ত্রী যদি খুশী মনে দেয় তাহলে তা নেওয়া যায়। অন্যথা নয়। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
'পুরুষগণ যা উপার্জন করে তা তাদের প্রাপ্য। আর নারীগণ যা উপার্জন করে তা তাদের প্রাপ্য।' (সূরা আন- নিসা: ৩২)
১৭. চরিত্রবান হওয়া: পরিবারের সুখ-শান্তি নির্ভর করে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের উত্তম চরিত্রের উপর। স্বামী চরিত্রবান না হলে স্ত্রীর ভালবাসা ও শ্রদ্ধা পায় না অপর দিকে স্ত্রী অসতী হলে সংসারে ধ্বংস নেমে আসে। সংসার তখন জলন্ত অগ্নিকুন্ডে পরিণত হয়। কাজেই স্বামী-স্ত্রী উভয়কে চরিত্রবান হওয়া একান্ত অপরিহার্য। নবী করীম (স.) বলেন-
'যার চরিত্র সবচেয়ে ভাল সে সবচেয়ে পরিপূর্ণ ঈমানদার।' (তিরমিযী)
তিনি আরও বলেন-
'তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভাল লোক সে, যে তার পরিবার ও স্ত্রী পরিজনের কাছে ভাল। আর আমি আমার নিজের পরিবারবর্গের কাছে তোমাদের তুলনায় অনেক ভাল।'
১৮. নির্দোষ হাসি-তামাশা করা: স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রগাঢ় ভালবাসা ও প্রীতির বন্ধনকে সুদৃঢ় করার জন্য স্ত্রীর সাথে গম্ভীর হয়ে না থেকে নির্দোষ-হাসি তামাশা করা, খেলা-ধূলা করা দূষণীয় নয়। বরং এতে উভয়ের মধ্যে দূরত্ব কমে আসে এবং একে অপরের প্রিয় হয়ে উঠে।
১৯. উপহার-উপঢৌকন: মাঝে মাঝে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে উভয়কে উপহার উপঢৌকন দেওয়ার চেষ্টা করা। এতে প্রেম ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়। রাসূলুল্লাহ বলেন-
'তোমরা পরস্পর উপহার-উপঢৌকন দেবে, এতে প্রেম-প্রীতি ভালবাসা বৃদ্ধি পাবে।' অপর এক হাদীসে আছেঃ
'তোমরা পরস্পর উপহার-উপঢৌকন আদান-প্রদান করবে এতে তোমাদের অন্তরের ক্লেদ ও হিংসা দূর হয়ে যাবে।' (তিরমিযী)
২০. দীর্ঘ দিন একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন না থাকা: স্বামী এক নাগাড়ে চার মাসের বেশি দিন প্রবাসে থাকা অনুচিত। এতে স্ত্রীর অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। হযরত উমর (রা) চারমাসের অধিক স্ত্রীকে বিরহে রাখতে নিষেধ করেছেন। স্ত্রীও স্বামীকে ছেড়ে প্রয়োজনে বাইরে গেলে দীর্ঘ দিন না থাকা উত্তম। স্ত্রী-স্বামীকে রেখে দীর্ঘদিন বাইরে থাকলে স্বামীর অধিকারও ক্ষুণ্ণ হয়।
আরো পড়ুন: ইসলামে পরিরবার পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
২১. উত্তরাধিকারের নিশ্চয়তা বিধান: স্বামীর মৃত্যু হলে যাতে স্ত্রী তার সম্পদ থেকে উত্তরাধিকার পেতে পারে সে নিশ্চয়তা দেওয়া। কোন মতেই স্ত্রীকে স্বামীর উত্তরাধিকার হওয়া থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
২২. তালাকের অধিকার দান: স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অমিল দেখা দিলে এবং আপোস-মীমাংসার সম্ভাবনা না থাকলে উভয়ে উভয়কে শরী'আত সম্মতভাবে তালাক প্রদানের অধিকার দিয়ে দেবে। তালাক না দিয়ে অনর্থক বিবাদ জিইয়ে রাখা ঠিক নয়। এতে সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটে।
২৩. স্বামী-স্ত্রী পরামর্শের সাথে কাজ করবে: পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করা এবং স্ত্রীর নিকট থেকে তার মতামত গ্রহণ করা একটি উত্তম কাজ। তাছাড়া স্ত্রী
ও স্বামীর পরামর্শ ছাড়া কোন কিছু করবে না। এ ব্যাপারে কুরআনে এসেছে। তাদের সাথে পরামর্শ করে নেবে।' (সূরা আলে-ইমরান: ১৫৯)
আল-কুরআনে আরো বলা হয়েছে-ا.
'কিন্তু যদি তারা পরস্পরের সম্মতি ও পরামর্শক্রমে দুধ পান বন্ধ রাখতে চায় তবে তাদের কারো কোন অপরাধ নেই।' (সূরা আল-বাকারা: ২৩৩)
২৪. স্বামী-স্ত্রীর সম্মতিতে সন্তান দান: স্বামী-স্ত্রী উভয়ে একে অপরের প্রতি ভালবাসা স্থাপন করে সন্তান জন্মদান করবে। স্ত্রী-স্বামীর প্রতি ভালবাসার নির্দশন স্বরূপ স্নেহ-মায়া, মমতা দিয়ে সন্তান লালন-পালন করবে। সন্তানকে স্তন্য দুগ্ধ দান করে তার খাদ্য চাহিদা পূরণ করবে।
পরিশেষে বলতে হয়, ইসলাম পারিবারিক জীবনকে মধুময় করার জন্য পারস্পরিক যেসব বিধি-নিষেধ ও দায়িত্ব-কর্তব্য আরোপ করেছে, সেগুলোর মাধ্যমেই যথাযথভাবে শান্তি, শৃঙ্খলা ও সুখ অর্জিত হতে পারে এবং স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সুগভীর ও মধুময় হতে পারে। আর ঠিক তখনই স্বর্গীয় সুখ আমাদের এ কুটিরে এসে ধরা দেবে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সুসম্পর্ক ও এর স্থায়িত্ব বজায় রাখার জন্য উপরোক্ত কাজগুলো যৌথভাবে পালন করা আবশ্যক।
সারকথা
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মধুময় দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রাখা ইসলামের বিধান। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ হওয়া কাম্য নয়। স্বামী-স্ত্রী সদা সর্বদা একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া বাঞ্চনীয়। একজন আরেকজনকে হেয় প্রতিপন্ন করা বা একে অপরের দোষ চর্চা করা ইসলাম নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। এমনকি স্বামী-স্ত্রীর গোপন কথা বা স্ত্রী-স্বামীর গোপন কথা কারও কাছে ফাঁস করে দিতে পারবে না। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের আত্মীয়-স্বজনকে সম্মান ও মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখবে। একে অপরের সাথে পরামর্শ করে সংসারের উন্নয়নে কাজ করবে। একে অপরের অধিকারে যত্নবান হবে। তা হলে উভয়ের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকবে।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url