কল্যাণমুখী সমাজ প্রতিষ্ঠায় ইসলাম
কল্যাণমুখী সমাজ প্রতিষ্ঠায় ইসলাম কল্যাণমুখী সমাজের পরিচয় দিতে পারবেন। কল্যাণমুখী সমাজ প্রতিষ্ঠায় ইসলামের অবদান উল্লেখ করতে পারবেন।
কল্যাণমুখী সমজের পরিচয়
ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার ইতিহাস সুপ্রাচীন। সর্বকালের মানব সমাজের জন্য মহান আল্লাহ তা'আলা যে একটি মাত্র জীবন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন তা হল ইসলাম। আর ইসলামী শিক্ষা ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে সমগ্র বিশ্বব্যাপী যে সমাজ প্রতিষ্ঠিত তাই কল্যাণমুখী আদর্শ ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা।
অন্যভাবে, আল্লাহর সাথে পূর্ণ সম্পর্ক রেখে জাতির কল্যাণ, সেবা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বিধান যে সমাজ ব্যবস্থায় রয়েছে তাই কল্যাণমুখী ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা।
ব্যাপক অর্থে-কল্যাণমুখী আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা বলতে এমন এক সমাজ ব্যবস্থাকে বুঝায় যা তাওহিদ বা একত্ববাদের সুমহান শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ। যেখানে মানুষের আকীদা বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগী, রাষ্ট্রীয় আইন কানুন, রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা, চরিত্র, ব্যবহারিক জীবন, মোটকথা জীবনের প্রতিটি দিকের উপরই ইসলাম বাস্তব সম্মতভাবে ক্রিয়াশীল।
সুতরাং যে সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা, জীবন, সম্পদ ও ইজ্জত আবরুর নিরাপত্তার জন্য আইন কানুন কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে রচিত ও পরিচালিত, যেখানে নেই কোন বর্ণ বৈষম্যের ভেদাভেদ, প্রত্যেক মুসলমান যেখানে ভাই ভাই আর অমুসলিমদের রয়েছে পূর্ণ নিরাপত্তা। মূলত সেই সমাজ ব্যবস্থাই হচ্ছে কল্যাণমুখী ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা। এজন্যই মহান আল্লাহর ঘোষণা-
'নিশ্চয় মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমাদের ভাইদের মধ্যে শান্তি স্থাপন কর।'
(সূরা আল-হুজুরাত:১০)
কল্যাণমুখী সমাজ প্রতিষ্ঠায় ইসলামের অবদান
ইসলাম হচ্ছে আদর্শবাদী জীবনব্যবস্থার নাম। এ ইসলামই সর্ব প্রথম ধ্বংসোন্মুখ ও বিপথগামী সমাজকে কল্যাণমুখী সমাজে রূপায়িত করে। কল্যাণমুখী সমাজ প্রতিষ্ঠায় ইসলামের অবদানসমূহ এখানে তুলে ধরা
আরো পড়ুন: জীবনের নিরাপত্তা বিধানে ইসলামী সমাজ
জীবনের নিরাপত্তা
আদর্শহীন সমাজ ব্যবস্থায় নিরাপত্তার কথা কল্পনাও করা যায় না। ইসলামই সর্বপ্রথম যে কোন ব্যক্তিকে সমাজে বেঁচে থাকার পূর্ণ নিরাপত্তা প্রদান করেছে। অন্যায়ভাবে সবলরা দুর্বলের ওপর নির্যাতন করলে ইসলামে যেমন কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। তেমনি কেউ কাউকে হত্যা করলে বিনিময়ে হত্যাকারীকে হত্যা বা 'দিয়াত' (রক্তপণ) নেয়ার বিধান রয়েছে। এ মর্মে আল্লাহর বাণী-
'নিহতদের ব্যাপারে তোমাদের কিসাসের বিধান দেয়া হয়েছে।' (সূরা আল-বাকারা: ১৭৮)
'হে জ্ঞানীগণ। তোমাদের জন্য কিসাসের মধ্যে রয়েছে জীবন।' (সূরা আল-বাকারা: ১৭৯)
'কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম।' (সূরা আন-নিসা: ৯৩)
বাসস্থানের নিরাপত্তা
সমাজে মানুষ নিরাপত্তা ও শান্তির সাথে নিজগৃহে বসবাস করতে চায়। আর এটাই কল্যাণমুখী সমাজের দাবি। তাই ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিটি মানুষের বাসস্থানের নিরাপত্তার দায়িত্ব হাতে নিয়েছে। মহানবী (সা.) ঘোষণা করেছেন- ইসলাম এক প্রতিবেশীর প্রতি অপর প্রতিবেশীর দায়িত্ব নির্ধারণ করেছে, বিনা অনুমতিতে কারো ঘরে প্রবেশ নিষেধ করেছে। পর্দা প্রথা মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছে। কোন বাড়িতে আলো-বাতাস প্রতিরোধমূলক কাজ করতে নিষেধ করেছে।
হাদীসে এসেছে-
'মুসলমান সেই ব্যক্তি যার কথা ও হাত থেকে অপর মুসলমানগণ নিরাপদ।'
স্বাধীনভাবে জীবন যাপনের ব্যবস্থা
সমাজে মানুষকে একত্রে বসবাস করতে হয়। পারস্পরিক সহানুভূতি ও সহযোগিতা ছাড়া সমাজে বাস করা যায় না। এ কারণে মানুষ যাতে সমাজে শান্তিতে বসবাস করতে পারে সে জন্য কেউ যেন কাউকে উৎপীড়ন না করে, কষ্ট না দেয় এ ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশ রয়েছে। মহানবী (সা.) বলেনঃ 'যার উৎপীড়ন থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয় সে বেহেশতে প্রবেশ করবে না।' মহানবী আরো বলেন- 'যার অনিষ্ট থেকে পাড়া-প্রতিবেশী নিরাপদ নয় সে মুমিন নয়।' (বুখারী, মুসলিম)
আরো পড়ুন: ইসলামে সম্পদের উত্তরাধিকারের বিধান পুরুষদের নারীদের নির্ধারিত অংশ
মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা
ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় সমাজের প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করে। ইসলাম মানুষকে তার মন ও মতের স্বাধীনতা। জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা, ভাত-কাপড়-বাসস্থান ও বেঁচে থাকার অধিকার দিয়েছে।
সামাজিক বিচার ব্যবস্থায় সাম্য
আইনের শাসন এবং সুবিচার না থাকলে যেকোন সমাজেই মানুষের জীবনে অশান্তির কালো ছায়া নেমে আসে এবং জীবন হয়ে পড়ে বিপন্ন। ন্যায় বিচারই ইসলামের আদর্শ। ইসলাম বিচারের ক্ষেত্রে অন্যায় এবং স্বজনপ্রীতিকে প্রশ্রয় না দিয়ে প্রকৃত অপরাধীর যথাযোগ্য শাস্তির ব্যবস্থা করে। কেননা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে-
'আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা ও সদাচরণের নির্দেশ দেন।' (সূরা আন-নাহল: ৯০)
মান-সম্মানের নিরাপত্তা
সমাজে মানুষ তার আত্মসম্মান, ইজ্জত-আবরু ইত্যাদি নিয়ে গৌরবের সাথে বসবাস করতে চায়। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা মানুষকে আত্মসম্মান নিয়ে গৌরবের সাথে জীবন যাপনের নিরাপত্তা বিধান করে।
রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন- চারের চেয়ে গীবত মারাত্মক।'
মত ও ধর্মের স্বাধীনতা
ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় মানুষকে তার মতামত ও ধর্মীয় জীবনের স্বাধীনতা দিয়েছে। কাউকে জোর করে ধর্ম পালনে বাধ্য করা ইসলাম নিষেধ করেছে। প্রত্যেকে তার নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। যেমন আল্লাহর বাণী- لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ দীনের ব্যাপারে জবরদস্তি নেই।' (সূরা আল-বাকারা ২৫৬) কিন্তু স্বেচ্ছায় ধর্ম গ্রহণ করার পর কোন বিধান লঙ্ঘন করার অধিকার ইসলাম কাউকে দেয় না।
অধিকার প্রদানে সাম্য
ইসলামের চোখে সমাজের সকল মানুষই সমান। মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে ইসলাম সকলের প্রতি সমান আচরণ করে থাকে। তাই ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় কোন লোক তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় না। কেউ কোনভাবে নিগ্রহের শিকার হয় না। ফলে সমাজ জীবন শান্তিময় হয়ে উঠে।
অপরাধমূলক কার্যকলাপ দমন
ইসলাম মানব সমাজকে সর্ব প্রকার নৈতিক অধঃপতন, অবক্ষয়, পাপ ও অপবিত্রতার পঙ্কিলতা হতে সম্পূর্ণ নিষ্কলুষ ও পবিত্র করতে চায়। সে জন্য ইসলাম মদ্যপান হারাম করেছে, চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার, জুয়া, মিথ্যাচার, হত্যা- নির্যাতনকে অপরাধ ও কঠিন পাপ বলে ঘোষণা করেছে। তেমনিভাবে অনাচার, উজ্জ্বললতা ইসলামী সমাজে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং এ সমস্ত কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আরো পড়ুন: গৃহ পরিচারক ও গৃহকর্তার সম্পর্ক
নৈতিক শিক্ষা
নৈতিক মান উন্নত করার জন্য সুশিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মানুষ যাতে তাদের নৈতিক মান উন্নত ও উৎকর্ষ সাধন করতে পারে, সে জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা ইসলামী সমাজে রয়েছে। কেননা একজন উন্নত নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষ দ্বারা কখনো অপরের অনিষ্ট হতে পারে না। তাই ইসলাম মানুষের নৈতিক চরিত্র উন্নত করার মাধ্যমে আদর্শ সমাজ জীবন গড়ে তুলতে চায়। মহানবী (সা.)-এর সুন্নাতের অনুশীলনের মাধ্যমে জীবনের নৈতিক মান উন্নত করা যায়। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
'তুমি অবশ্যই মহান চরিত্রের উপর অধিষ্ঠিত।' (সূরা আল-কালাম ৪)
সম্পদের সুষম বণ্টন
কল্যাণমুখী সমাজ প্রতিষ্ঠায় ইসলামের আর একটি অন্যতম অবদান হচ্ছে সম্পদের সুষম বণ্টন। সমাজে সম্পদের সুষম বণ্টন ব্যবস্থা না থাকলে মানুষের মধ্যে হাহাকার, অভাব ও অনটন লেগেই থাকে। কারণ সম্পদ মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হস্তগত হয়ে যায়। তাই ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে সমাজের সমগ্র সম্পদ যাতে পুঞ্জিভূত না হয় সে জন্য দুস্থ ও অসহায়দের মধ্যে সম্পদ বণ্টন করে দিতে নির্দেশ দিয়েছে।
অপব্যয় রোধ
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেন-নিশ্চয়ই অপবায়কারীরা শয়তানের ভাই।' (সূরা বনী ইসরাঈল ২৭)
তাই সম্পদ ও টাকা পয়সাকে রক্ষার জন্য ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় অপব্যয়কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইসলাম ঘোষণা করেছে। স্বেচ্ছায় সম্পদ বিনষ্ট করা কুফরের শামিল।
যাকাত ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা
কল্যাণমুখী সমাজ প্রতিষ্ঠায় ইসলাম যাকাত ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা প্রবর্তন করে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সম্পদশালীদের উপর ইসলাম যাকাত ফরয করে দিয়েছে। যেমন আল্লাহর বাণী-
'তোমরা সালাত প্রতিষ্ঠা কর ও যাকাত দাও।' (সূরা আল-বাকারা :৪৩)
কোন বিত্তবান ব্যক্তির মৃত্যু ঘটলে তার সম্পদের বণ্টন নিয়ে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ এমন কি হত্যাকান্ডও ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রে উত্তরাধিকার আইন ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় ন্যায়পরায়ণতা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করেছে।
চুরি-লুণ্ঠন প্রতিরোধ
প্রাক-ইসলামী যুগে সম্পদের কোন নিরাপত্তা ছিল না। তখন মানুষ 'জোর যার মুল্লুক তার' এ নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি ইত্যাদি কঠোর হস্তে নিষিদ্ধ করে এসব অপরাধীদের জন্য কঠিন ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান করা হয়েছে।
সারকথা
যেহেতু ইসলাম বিশ্ব মানবতার কল্যাণে একটি শাশ্বত জীবন দর্শন সেহেতু ইসলামই একটি কল্যাণমুখী সমাজ উপহার দিতে সক্ষম। ইসলামী সমাজের প্রতিটি মানুষের বৈশিষ্ট্য কেউ কাউকে ঘৃণা করবে না কারো উপর অত্যাচার করবে না সকল মুসলমান পরস্পরের ভাই।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url