রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের বৈশিষ্ট্য গুণাবলী ও ক্রটি

রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে পারবেন। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের গুণাবলী সম্পর্কে আলোচনা করতে পারবেন। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো বলতে পারবেন।


ভূমিকা

আইনবিভাগ ও শাসন বিভাগের সম্পর্কের ভিত্তিতে আধুনিক গণতান্ত্রিক সরকারগুলোকে সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার এবং রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার এ দু'শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় শাসন ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে মন্ত্রিপরিষদের উপর। মন্ত্রিসভার সদস্যগণ আইন সভার নিকট দায়ী থাকেন। মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের মূল কথা হল এই যে শাসন বিভাগ এর কার্যাবলীর জন্য আইন বিভাগের নিকট দায়ী থাকবে।

রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারে চূড়ান্ত শাসন ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত থাকে। রাষ্ট্রপতি তাঁর কাজকর্মের জন্য আইনসভার নিকট দায়ী থাকেন না। এ ধরণের শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি প্রকৃত শাসক, তাঁকে সাহায্য করার জন্য একটি মন্ত্রিপরিষদ থাকে। এ মন্ত্রিপরিষদের দায়-দায়িত্ব শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতির নিকট। শাসনতন্ত্র কর্তৃক রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও মর্যদা সংরক্ষিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বর্তমান বিশ্বে গণতন্ত্রের এ দু'টি রূপই বর্ণর্যকর রয়েছে।

আরো পড়ুন: গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ গণতন্ত্র

রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের বৈশিষ্ট্য

রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার কতগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা একে অন্য ব্যবস্থা থেকে পৃথক করেছে। যেমন।

এই শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি একাধারে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধান। রাষ্ট্রপতিই প্রকৃত শাসক এবং আইনগত দিক থেকে তিনি প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী।

রাষ্ট্রপতি আইনসভার সদস্য নন এবং আইন সভার নিকট দায়িত্বশীলও নন। তবে আইন সভার গৃহীত বিলে ভেটো দানের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন।

সাধারণত: রাষ্ট্রপতি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি। তিনি জনগণের কাছেই দায়ী থাকেন। এ ব্যবস্থায় মূলত: রাষ্ট্রপতি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হন। কেবলমাত্র শাসনতন্ত্রের লঙ্ঘন, গুরুতর অসদাচরণের দায়ে কিংবা শারীরিক বা মানসিক অসামর্থের কারণে রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসিত (impeached) করা যায়।

রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ক্ষমতার মূলত: স্বতন্ত্রীকরণ নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগ তাদের পৃথক পৃথক অস্তিত্ব বজায় রাখে।

এ ব্যবস্থায় সংবিধান সাধারণত লিখিত ও দুষ্পরিবর্তনীয় হয়ে থাকে।

এ শাসন ব্যবস্থায় মন্ত্রিপরিষদ রাষ্ট্রপতির বিশ্বস্ত কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তাঁরা আইন সভার কাছে দায়ী নন। মন্ত্রীরা তাঁদের কাজ কর্মের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে দায়ী থাকেন।

রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের গুণাবলী

রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের গুণাবলী নিম্নে আলোচিত হল:

রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের প্রধান গুণ হল যে, তা শাসন বিভাগকে অধিক স্থায়ীত্ব বিধান করে। স্থায়ীত্বের কারণে সরকার দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারে। এর ফলে উন্নয়নের গতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায়।

এ ব্যবস্থায় আইন পরিষদের সদস্যগণ শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে আইন প্রণয়নে দক্ষতার পরিচয় দিতে পারে।

জাতীয় সংকট, যুদ্ধ, অর্থনৈতিক মন্দা ইত্যাদি জরুরি অবস্থায় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার বিশেষভাবে কার্যকর। এ ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে অধিকতর নৈপুণ্য ও দক্ষতার সাথে সরকারী নীতি কার্যকর করতে সক্ষম। যেমন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন ও রুজভেল্ট ক্ষিপ্রতার সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। তাই বলা হয় এ শাসন ব্যবস্থা দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রতীক।

এ শাসন ব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ ও ভারসাম্য নীতির সুফল পাওয়া যায়। সংবিধানে শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার ব্যবস্থা থাকায় সাধারণত ক্ষমতার অপব্যবহার হয় না।

রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের দলীয় কোন্দল ও সংঘর্ষ হ্রাস পায়। লর্ড ব্রাইসের মতে, সংসদীয় সরকারের তুলনায় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারে দলীয় মনোভাবের প্রতিফলন কম প্রাধান্য লাভ করে। এর ফলে শাসন বিভাগের দক্ষতা বৃদ্ধি পায় ও প্রশাসন যন্ত্র পেশাদারী মনোভাব নিয়ে কাজ করতে পারে।

আরো পড়ুন: সর্বজনীন ভোটাধিকার: প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্বাচন

রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের ত্রুটি

রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো নিম্নে আলোচিত হল:

এ শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি শাসন বিভাগের সর্বময় কর্তা এবং আইন পরিষদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত। তিনি একনায়ক ও স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে পারেন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সঠিকভাবে প্রেসিডেন্টের উপর ন্যস্ত হওয়ায় স্বৈরাচারের পথ প্রশস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এ সরকারকে দায়িত্বহীন সরকার বলেও আখ্যায়িত করা হয়। কারণ, রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার আইন সভার কাছে দায়ী নন।

এ শাসন ব্যবস্থায় অন্যতম প্রধান ত্রুটি হচ্ছে আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যেকার নিত্যদিনের বিরোধ। এ ব্যবস্থায় আইন পরিষদ ও শাসন বিভাগকে সম্পূর্ণভাবে পৃথক রাখা হয়। ফলে আইন প্রণয়নে বিঘ্ন সৃষ্টি আর শাসন ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিতে পারে। অবশ্য শাসনকার্য সুন্দর ভাবে পরিচালনার জন্য সরকারের এ দু'টি বিভাগের মধ্যে কার্যকর সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের মধ্যে দূরত্ব বিদ্যামান থাকায় আইন প্রণয়নে জটিলতার সৃষ্টি হয়।

রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থা নমনীয় প্রকৃতির। এ প্রকার শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে বেজহটের বক্তব্য খুবই প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, "জনগণ এমন সরকারকে নির্বাচিত করেন, যেই সরকারের নীতি ও কাজ, আচার আচরণ তাদের আশা আকাঙ্খার সাথে খাপ খাওয়াতে পারুক আর নাই পারুক, আইনত তা সহ্য করতে হয়।" রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গার্নার উল্লেখ করেন যে, "আইন পরিষদ যত কিছুই করুক না কেন কিন্তু রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিক ক্ষমতা এবং ভোটের সময় নির্বাচক মন্ডলীর রায় ছিনিয়ে নিতে পারেন না।"

এ শাসন ব্যবস্থায় আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে নেতৃত্বের অভাব পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্রপতি এবং তার মন্ত্রীরা আইন সভার কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন না।

সারকথা

রাষ্ট্রপতি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি বিধায় বিভিন্ন দোষ থাকার পরের রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় স্থায়ী ও দক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। জাতির দুর্দিনে এ ব্যবস্থা তড়িৎ গতিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url