স্থানীয় সরকার কি স্থানীয় সরকার ও তার ক্রমবিকাশ সম্পর্কে বিস্তারিত

স্থানীয় সরকার ও তার ক্রমবিকাশ স্থানীয় সরকার কাকে বলে তা বলতে পারবেন। স্থানীয় সরকারের সাথে কেন্দ্রীয় সরকারের পার্থক্য বর্ণনা করতে পারবেন মোগল তথা ব্রিটিশ শাসনামলে স্থানীয় সরকারের ধারণা সম্পর্কে বলতে পারবেন। পাকিস্তান শাসনামলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার রূপ ব্যাখ্যা করতে পারবেন।


ভূমিকা

স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। প্রশাসনকে সাধারণ মানুষের অতি নিকটে পৌছে দিতে স্থানীয় পর্যায়যে প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়, সেটাই স্থানীয় সরকার। অতীত কাল থেকে এ অঞ্চলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চালু রয়েছে।

স্থানীয় সরকার কাঠামোর ইতিহাস অনেক পুরোনো। প্রাচীন যুগেও ভারতীয় উপমহাদেশে এক ধরনের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চালু ছিল। মুগল শাসনামলের গ্রাম পঞ্চায়েত ব্যবস্থা তারই পরিবর্তিত রূপ। বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার কাঠামোর স্তর চারটি। 

তবে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা আলোচনা করতে গেলে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী শাসনামলে স্থানীয় সরকারের বিকাশ ও কাঠামো নিয়ে আলোচনা করা অপরিহার্য। মূলত ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার কাঠামোর বিকাশ ঘটেছে।

স্থানীয় সরকার আলোচনায় প্রসঙ্গক্রমেই স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন কিংবা স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার নিয়েও আলোচনা বাঞ্চনীয়। একই সাথে উন্নয়ন প্রশাসনের আলোচাও এসে যায়। প্রিয় শিক্ষার্থী সুতরাং স্থানীয় সরকার অধ্যায়কে চারভাগে সাজানো হয়েছে। প্রথম ভাগে থাকছে স্থানীয় সরকার ও তার ক্রমকিবাশ, দ্বিতীয় ভাগে থাকছে বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের কাঠামো। তৃতীয় ও চতুর্থভাগে কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন এবং উন্নয়ন প্রশাসন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

বর্তমান যুগে রাষ্ট্রের পরিধি ও কর্মকান্ড ব্যাপক। রাষ্ট্রকে শুধুমাত্র দেশের শাসনকার্যই পরিচালনা করতে হয় না বরং কল্যাণমূলক অনেক কাজ করতে হয়। যেমন উন্নয়নমূলক কাজ। একটি কেন্দ্র থেকে সরাসরি শাসনকার্য পরিচালনা এবং উন্নয়ন কাজ তদারকি করা সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। এ জন্যই রাষ্ট্র তার প্রশাসনিক ও উন্নয়নমূলক কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত করে সে সব অঞ্চলের জন্য আলাদা প্রশাসনিক ব্যাবস্থা গড়ে তোলে। যেমন বলা যেতে পারে রাজধানী থেকে ২০০ কিংবা ৩০০ মাইল দূরের একটি গ্রামের কথা। উক্ত গ্রামের উন্নয়নকাজ কিংবা প্রশাসনিক কাজ সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করার জন্য স্থানীয়ভাবে একটি প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়। এ প্রশাসনিক কাঠামোই স্থানীয় সরকার নামে পরিচিত। স্থানীয় সরকার শুধুমাত্র উন্নয়নশীল দেশে রয়েছে তা নয়, যুক্তরাষ্ট্রের মত উন্নত দেশেও স্থানীয় সরকারের কাঠামো রয়েছে। স্থানীয় পরিষদের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ের কাজকর্ম পরিচালনা করে। গ্রাম পর্যায়ে কিংবা অঞ্চল ভিত্তিতে যে প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে, তা দেশের সামগ্রিক প্রশাসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

স্থানীয় সরকার দু'ধরনের হতে পারে। যথা-স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার। সকল স্থানীয় সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের স্থানীয় প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে কাজ করে। অন্যদিকে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার স্থানীয় লোকদের দ্বারা নির্বাচিত হয় এবং কাজকর্মে ক্ষেত্রে অনেকটা স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা ভোগ করে থাকে।

স্থানীয় সরকার হলো স্থানীয় ভাবে নির্বাচিত একটি প্রশাসনিক ইউনিট বা প্রশাসনিক কাঠামো। এ প্রশাসনিক কাঠামোকে সাধারণত স্থানীয় জনগণ ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে। তারা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়ে স্থানীয় জনগণের উন্নয়নমূলক বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করে থাকে। যেমন স্কুল নির্মাণ, কিংবা পুল- কালভার্টের সংস্কার ইত্যাদি। প্রায় ক্ষেত্রেই স্থানীয় সরকারের আয়ের নিজস্ব উৎস থাকে। স্থানীয় পর্যায় থেকে এরা আংশিক অর্থ উপার্জন করে থাকে। একই সাথে রাষ্ট্র প্রতিবছরে তাদের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের জন্য কিছু বরাদ্দ দিয়ে থাকে। স্থানীয় সরকারের আবার বিভিন্ন পর্যায় থাকে। গ্রাম পর্যায়ে যে স্থানীয় সরকার থাকে, তার সাথে জেলা পর্যায়ের স্থানীয় সরকারের নামের যেমনি পার্থক্য রয়েছে, ঠিক তেমনি এদের কর্মকান্ডেরও পার্থক্যও রয়েছে।

স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা নানা ধরনের মন্তব্য করেছেন। ডুয়ান লকার্ড Duane Lockard এর মতে "স্থানীয় সরকার এমন এক ধরনের সংস্থা যা স্থানীয়ভাবে ক্ষমতা পরিচালনা করে।" স্থানীয় সরকারকে তিনি পিরামিডের ন্যায় একটি শাসন কাঠামোর সর্বনিম্ন সরকারী স্তর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যেখানে জাতীয় সরকার হচ্ছে সর্বোচ্চ স্তর। অন্যদিকে জাতিসংঘ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে এমন একটি ব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যা রাষ্ট্রের আইন দ্বারা গঠিত হয় এবং এ সংস্থা স্থানীয় পর্যায়ে কর আদায়সহ স্থানীয় পর্যায়ের সকল কর্মকান্ড পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে।

স্থানীয় সরকারের সাথে কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের পার্থক্য উল্লেখ্য করা প্রয়োজন। স্থানীয় সরকার স্থানীয় জনগণের ভোটে নির্বাচিত। এরা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। প্রয়োজনে কিংবা বিশেষ সময়ের প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকার কখনো কখনো স্থানীয় সরকারে সরাসরি মনোনয়ন দিতে পারে। কিন্তু তা স্থায়ী নয়। সাময়িক সময়ের জন্য সরকার এ কাজটি করে। যখন স্থানীয় পরিষদ ভেংগে যায়, কিংবা এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, যখন রাষ্ট্র স্থানীয় সরকার ভেংগে দিতে বাধ্য হয়, তখন সরকার সাময়িক সময়ের জন্য কেন্দ্র থেকে স্থানীয় সরকার নিয়ন্ত্রন করে। কিন্তু পরে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হয়। তবে স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত পরিষদকে সহযোগিতা করার জন্য সব সময় কিছু সরকারী কর্মচারী থাকেন। এরা কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী। এরা বেতন পান কেন্দ্রীয় সরকার থেকে। অপরদিকে স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত ব্যক্তিরাও সরকার থেকে একটি ভাতা পেয়ে থাকেন। তবে স্থানীয় সরকারের সাথে স্থানীয় স্বায়ত্বশাসিত সরকারের একটি পার্থক্য রয়েছে। স্থানীয় স্বায়ত্ত্বশাসিত সরকার স্ব-শাসিত। যেমন ইউনিয়ন পরিষদ। কিন্তু যেখানে সরকারের প্রতিনিধি রয়েছে, তা স্ব-শাসিত নয়। এখানে সরকারের কর্তৃত্ব রয়েছে। জেলা পরিষদ সরকারি কর্মকর্তারা রয়েছেন।

বাংলাদেশে সাধারণত দু'ধরনের স্থানীয় পরিষদ রয়েছে। এক ধরনের রয়েছে গ্রামকেন্দ্রিক অপরটি শহর কেন্দ্রিক। প্রশাসনিক পুনঃগঠনের লক্ষ্যে ১৯৮২ সালে স্বাধীনতা পূর্বকালের ১৯টি জেলাকে ৬৪টি জেলায় উন্নীত করা হয়। বর্তমানে ৬৪টি জেলায় ৪৯৯টি থানা রয়েছে। ১৯৮২ সালে থানাগুলোকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাথে সাথে ১৯৯২ সালে উপজেলাগুলোকে পুনরায় থানায় পরিণত করা হয়। সরকার ১৯৯৭ সালে আবার উপজেলা পদ্ধতি বহাল রেখেছে। থানা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা প্রভৃতি স্থানীয় সরকারের অন্তর্গত।

আরো পড়ুন: সামাজিক অনাচার প্রতিরোধে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা

স্থানীয় সরকারের ক্রমবিকাশ

আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় স্থানীয় সরকার প্রশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও, এ অঞ্চলে বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস খুঁজলে জানা যায় এখানে স্থানীয় সরকারের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকে। ব্রিটিশরা বর্তমানে বিদ্যমান স্থানীয় সরকারের কাঠামোর গোড়াপত্তন করলেও, খ্রিষ্টপূর্ব এক হাজার বছর আগেও এ অঞ্চলে গ্রাম পরিষদের অস্তিত্ব ছিল। মৌর্য যুগে ও মৌর্যপূর্বযুগে (খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৪-১৮৩) গ্রামকেন্দ্রিক যে প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, তা পরিচালিত হত গ্রামের প্রবীণ ব্যাক্তিদের দ্বারা। গুপ্ত শাসনামলে (৩২০-৫৩৫ খৃষ্টাব্দ) স্থানীয় সরকার কাঠামোর একটি চিত্রও আমরা পাই, যেখানে স্থানীয় সরকারেকে ছ'টি ইউনিটে ভাগ করা হয়েছিল। যেমন ভূক্তি (Bhukti) বিষয় (Vishay) মন্ডল (Mandal) বীথি (Beethi) গ্রাম (Gram) ইত্যাদি। আধুনিক যুগে এগুলোই বিভাগ, জেলা, মহাকুমা, উপজেলা (বা থানা) এবং গ্রাম নামে বিকশিত হয়েছে। ঐসব প্রশাসনিক ইউনিটের শাসনভার যাদের হাতে অর্পন করা হয়েছিল, তারাও এক এক নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন। যেমন ভুক্তির প্রশাসক উপরিক বা উপরিক মহারাজা নামে অভিহিত হতেন। তার নেতৃত্বে একটি প্রশাসনিক পরিষদও ছিল।

পাল শাসনামলেও এ ধারা বজায় থাকে এবং একটি শক্তিশালী আমলাতন্ত্রের জন্ম হয়। পাল রাজত্বের পর বাঙলায় সেন বংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐ সময় স্থানীয় সরকার কাঠামোয় কোন পরিবর্তনের খবর পাওয়া যায় না। সেন বংশের শাসনামলের শেষ দিকে বাঙলায় মুসলিম শাসন বিস্তার লাভ করে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে আধুনিক যুগে প্রশাসনের একটি শক্তিশালী ইউনিট হিসেবে স্থানীয় সরকারের বিকাশ ঘটলেও প্রাচীন যুগ থেকে এ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। যদিও এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তেমন একটা পাওয়া যায় না। প্রাচীন আমলেও গ্রাম পরিষদ ছিল। তার প্রধান ছিলেন গ্রামপাল, যারা প্রধানত উত্তরাধিকার সূত্রে ঐ পদ পেতেন। গ্রামের প্রশাসনের সাথে সম্পর্কিত সব কাজই তারা করতেন। এমনকি কর আদায়, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, জমিজমার তদারকি, ধর্মীয় অনুষ্ঠানের তদারকি ইত্যাদি সব কাজই তারা করতেন। বলাই বাহুল্য, গ্রামই ছিল মূল শক্তি। প্রাচীন আমলে শহরের সংখ্যা কম ছিল। মুগলদের শাসনামলে শহরের সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। আর সে কারণে নগর প্রশাসনও গড়ে তোলা হয়। সৃষ্টি করা হয় নতুন নতুন পদ। যেমন নগর কোতোয়াল বা কোতোয়াল যার উপর নগর প্রশাসনের দায়িত্ব অর্পন করা হয়। শান্তিরক্ষা, কর আদায় ইত্যাদি তার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিলো।

মুগল শাসনামলে স্থানীয় সরকার কাঠামোকে নতুন করে ঢেলে সাজানো হয়। শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার্থে মুগলরা বাঙলাকে বিভিন্ন প্রশাসনিক ইউনিটে ভাগ করেন। যেমন পরগণা, থানা, মৌজা, মহল্লা ইত্যাদি এবং প্রতিটি প্রশাসনিক ইউনিটে একজন করে প্রশাসক নিযুক্ত করেন। মুগল শাসনামলে গ্রামে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। এ পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ছিল গ্রাম প্রশাসনের মূল কেন্দ্রবিন্দু। এ গ্রাম পঞ্চায়েতে একজন গ্রাম প্রধান ছিলেন। তিনি কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। তিনি চাষীদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতেন এবং তা কেন্দ্রে পাঠাতেন।

আরো পড়ুন: সামাজিক অপরাধ প্রতিরোধে ইসলামের শাস্তির বিধান

ব্রিটিশ শাসনামলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা

ব্রিটিশ শাসনামলে স্থানীয় সরকার ব্যাবস্থায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়। উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনে প্রতিষ্ঠিত হবার পর ব্রিটিশরা মুগল আমলে যে স্থানীয় সরকার ব্যাবস্থা চালু ছিল, তাতে কিছু পরিবর্তন আনেন। ১৮৭০ সালে ব্রিটিশ সরকার বেঙ্গল চৌকিদারী আইন চালু করেন। এতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে গ্রাম পর্যায়ে পাঁচব্যক্তির সমন্বয়ে একটি পঞ্চায়েত কমিটি গঠন করার ক্ষমতা দেয়া হয়। পঞ্চায়েতের হাতে গ্রামের শাস্তি ও শৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব ও চৌকিদার নিয়োগের ক্ষমতা দেয়া হয়। পঞ্চায়েত গ্রামবাসীদের কাছ থেকে স্থানীয় কর আদায় করতে পারতো। ১৮৮২ সালে লর্ড রিপন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সুষ্ঠভাবে পরিচালনার জন্য কিছু সংস্কার আনেন। আর এ লক্ষে ১৮৮৫ সালে স্থানীয় স্বায়ত্বশাসন আইন পাস হয়। এ আইনের ফলে গ্রামাঞ্চলে তিনস্তর বিশিষ্ট স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। এতে প্রতি জেলায় জেলাবোর্ড, মহাকুমা পর্যায়ে লোকাল বোর্ড ও কয়েকটি গ্রামের জন্য ইউনিয়ন কমিটি গঠন করা হয়।

জেলা বোর্ডের সদস্য সংখ্যা ছিল জেলার আয়তন ও লোকসংখ্যা অনুযায়ী ১৮ থেকে ৩৪ জন। এর অর্ধেক লোকাল বোর্ড কর্তৃক নির্বাচিত, বাকী অর্ধেক সরকারী কর্মচারী। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন জেলা বোর্ডের সভাপতি। কার্যকাল ছিল ৫ বছর। স্থানীয় কর, ফি, সরকারি অনুদান ছিল জেলা বোর্ডের আয়ের উৎস। স্কুল প্রতিষ্ঠা, রাস্তাঘাট নির্মান ইত্যাদি ছিল জেলা বোর্ডের কাজ। লোকাল বোর্ড ও ইউনিয়ন কমিটি ছিল জেলা বোর্ডের উপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে লোকাল বোর্ডের সদস্য সংখ্যা ছিল ন্যূন্যতম ছয়জন, যার ভেতর দুই-তৃতীয়াংশ নির্বাচিত হতেন। বাকীরা সরকার কর্তৃক মনোনীত হতেন। চেয়ারম্যান সদস্যদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হতেন ও সরকারকে তা অনুমোদন করতে হত। লোকাল বোর্ডের নিজস্ব কোন ক্ষমতা ছিলো না। জেলা বোর্ড যে সমস্ত ক্ষমতা অর্পণ করতো, লোকাল বোর্ড তা পালন করতো। লোকাল বোর্ড আবার ইউনিয়ন কমিটির কার্যকলাপ তদারকি করতো। ইউনিয়ন কমিটির সদস্যসংখ্যা ছিল কমপক্ষে ৫ জন, ও সর্বাধিক ৯ জন। ইউনিয়নের সদস্যদের মধ্যে থেকে সদস্য নির্বাচত করা হত।

কোন কোন ক্ষেত্রে বিভাগীয় কমিশনারও সদস্য নিয়োগ করতে পারতেন। মূল আইনে (১৮৮৫ সালের আইনে) চেয়ারম্যানের কোন পদ ছিল না। পরে ১৯০৮ সালে সংশোধনী আইন পাস করা হয় ও সদস্যদের মধ্যে থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগ করার বিধান করা হয়। ইউনিয়ন কমিটি গ্রামবাসীদের কাছ থেকে স্থানীয় কর আদায় করতে পারতো এবং স্থানীয় পর্যায়ে রাস্তা ঘাট নির্মান, পুকুর-জলাশায় রক্ষাণাবেক্ষন, প্রাথমিক শিক্ষা ইত্যাদি তদারকি করতো। উল্লেখ্য, উক্ত আইন বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতিত বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় এই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। 

১৮৮৫ সালের স্থানীয় স্বায়ত্বশাসন আইনে বেশ কিছু ত্রুটি ছিল। এর একটি ছিল স্থানীয় পর্যায়ে জনসাধারণের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা। ফলে ১৯০৯ সালের মার্লি মিন্টো সংশোধনী প্রস্তাবে ভারতে প্রতিনিধিত্বমূলক স্থানীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ করা হয়। পরবর্তীতে ১৯১৮ সালে আরো কিছু সংশোধনী আনা হয় মন্টেগু চেমসফোর্ড রিপোর্টে। ১৯১৯ সালে অপর একটি স্থানীয় পরিষদ আইন পাস হয়। এই আইনে ইউনিয়ন কমিটিগুলো বিলুপ্ত করে ইউনিয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়। বোর্ড গঠিত হয় ৬ থেকে ৯ জন সদস্য নিয়ে, যার দুই-তৃতীয়াংশ নির্বাচিত, এক তৃতীয়াংশ মনোনীত। নির্বাচনের পর সদস্যদের মধ্যে থেকে পেসিডেন্ট ও ভাইস-প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হত। বোর্ডের কার্যকলাপ মূলত আগের মতই ছিল। ১৯১৯ সালের আইনে লোকাল বোর্ডের ত্রুটি সংশোধন করা না হলেও জেলা বোর্ডের ত্রুটি সংশোধন করা হয়। সদস্যদের দুই তৃতীয়াংশ নির্বাচিত ও এক তৃতীয়াংশ মনোনয়নের ব্যবস্থা করা হয়। মহিলাদের কোন ভোটাধিকার ছিল না। বিভাগীয় কমিশনার মনোনীত সদস্যদের নিয়োগ করতেন। পরে তা স্থানীয় সরকার দফতরের মন্ত্রীদের হাতে অর্পিত হয়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতেন। কিন্তু ১৯২১ সালের পর থেকে সদস্যদের মধ্যে থেকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতেন। আর প্রাদেশিক গর্ভনর তা অনুমোদন করতেন। চেয়ারম্যানের অপসারণের অধিকার সরকারের ছিল। জেলা বোর্ডকে শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য, করারোপ ইত্যাদি কিছ দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল।

আরো পড়ুন:  বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত শরীয়াতের পরিভাষা ও বিধান

পাকিস্তান আমলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা

১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপ-মহাদেশের বিভক্তি এ অঞ্চলে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন ও স্বার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। স্বাধীনতার পর পাকিস্তান ব্রিটিশ আমলে প্রণীত ও চালু থাকা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা অব্যাহত রাখে। ১৯৫৯ সালের এক অধ্যাদেশ অনুযায়ী পাকিস্তানে মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। ঐ ব্যবস্থায় পাঁচ ধরনের স্থানীয় সরকার কাঠামোর প্রস্তাব করা হয়েছিল। এগুলো হচ্ছেঃ (১) ইউনিয়ন কাউন্সিল (২) থানা কাউন্সিল (৩) জেলা কাউন্সিল (৪) বিভাগীয় কাউন্সিল (৫) প্রাদেশিক উন্নয়ন উপদেষ্টা কাউন্সিল। ১৯৬২ সালের সংবিধানে মৌলিক গণতন্ত্রী ব্যবস্থাকে সাংবিধানিক রূপ দেওয়া হয়। তবে তাতে প্রাদেশিক উন্নয়ন উপদেষ্টা কাউন্সিল বাদ দিয়ে মোট চার স্তর বিশিষ্ট স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। এর আওতা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের লোক সংখ্যার ভিত্তিতে দেশটিকে কয়েকটি নির্বাচনী ইউনিটে ভাগ করা হয়। প্রথমদিকে এ নির্বাচনী ইউনিটের সংখ্যা ৪০ হাজার থাকলেও, পরবর্তীতে তা ৮০ হাজারে উন্নীত করা হয়। প্রতিটি নির্বাচনী ইউনিটের অর্ন্তগত জনগন প্রত্যক্ষ ভোটে তাদের একজন প্রতিনিধি নির্বাচন করতেন, যারা মৌলিক গণতন্ত্রী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এরা আবার ভোট দিয়ে রাষ্ট্রপতি, প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের সদস্যদের নির্বাচিত করতেন। অর্থাৎ প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের সদস্যরা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতে পারতেন না। এরা নির্বাচিত হতেন পরোক্ষ ভোটে, ঐ মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভোটে।

ইউনিয়ন কাউন্সিল সাধারণত পনের জন সদস্য নিয়ে গঠিত হত। এর মাঝে দুই-তৃতীয়াংশ ছিল নির্বাচিত। আর এক- তৃতীয়াংশ ছিল সরকার কর্তৃক মনোনীত। ১৯৬২ সালের পর মনোনয়ন প্রথা বাতিল করা হয়। এরপর সদস্যরা নিজেদের মধ্যে থেকে একজনকে চেয়ারম্যান ও একজনকে ভাইস-চেয়ারম্যান নির্বাচিত করতেন।

সাধারণত পুলিশ ষ্টেশনের অর্ন্তভূক্ত এলাকা নিয়ে থানা কাউন্সিল গঠিত হয়েছিল। এর অর্ন্তভুক্ত ছিল ৮ থেকে ১৫ টি ইউনিয়ন কাউন্সিল। থানা কাউন্সিলে জনপ্রতিনিধি ও সরকারী কর্মচারী উভয় শ্রেণী অর্ন্তভুক্ত ছিল। মহাকুমা প্রশাসক পদাধিকার বলে থানা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হতেন, আর ভাইস চেয়ারম্যান হতেন সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন)। থানার অর্ন্তগত কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মৎস ও সমবায় বিভাগের কর্মকর্তারা কাউন্সিলের সদস্য (সরকারী) হতেন। অন্যদিকে থানার অর্ন্তভূক্ত ইউনিয়ন কাউন্সিল ও টাউন কমিটির চেয়ারম্যানরা পদাধিকার বলে থানা কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। থানা কাউন্সিলের অর্ন্তভূক্ত বিভিন্ন ইউনিয়নের কাজের সমন্বয় করাই ছিল এর কাজ।

জেলা কাউন্সিলও একইভাবে সরকারী ও নির্বাচিত সদস্যদের দ্বারা গঠিত হয়েছিল। সদস্যসংখ্যা ছিল ৩০ থেকে ৫০ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। জেলা প্রশাসক পদাধিকার বলে ছিলেন জেলা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে থেকে নির্বাচিত হতেন। সরকার কর্তৃক যারা জেলা কাউন্সিলের সদস্যপদে মনোনীত হতেন, তারা হচ্ছেন মহাকুমা প্রশাসক, নির্বাহী প্রকৌশলী (সিএন্ডবি ও ওয়াপদা), জেলা কৃষি ও বন অফিসার, সিভিল সার্জন, আনসার এডজুট্যান্ট, সমবায় সমিতির সহকারী নিবন্ধক প্রমূখ। অন্যদিকে জেলার অর্ন্তগত ইউনিয়ন কাউন্সিল ও টাউন কমিটির চেয়ারম্যানরা জেলা কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত করতেন। সরকার কর্তৃক একজন আমলা সদস্য সচিব হিসেবে জেলা কাউন্সিলে কাজ করতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ক্ষমতাবান। বিভাগীয় কাউন্সিল ছিল স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সর্বোচ্চ স্তর। এখানেও সরকারি ও বেসরকারি সদস্যরা ছিলেন। বিভাগের অর্ন্তভুক্ত জেলা কাউন্সিলের সদস্যদের মধ্যে থেকে বিভাগীয় কাউন্সিলের বেসরকারি সদস্যরা নির্বাচিত হতেন। অন্যদিকে বিভাগের শীর্ষ স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তারা (জেলা প্রশাসক গণপূত বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, বিভাগীয় স্কুল ইন্সপেক্টর, বন অফিসার ইত্যাদি) বিভাগীয় কাউন্সিলে মনোনীত সদস্য ছিলেন। বিভাগীয় কাউন্সিলের কোন নির্দিষ্ট ভূমিকা ছিল না। প্রধান কাজ ছিল জেলা কাউন্সিল, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড, পৌরসভার কার্যাবলী সমন্বয় করা। তাদের কর ধার্য করার কোন ক্ষমতা ছিল না। কাউন্সিলের নিজস্ব কোন তহবিলও ছিল না।

মূলত মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার আলোকেই এ স্থানীয় সরকার কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল। এই ব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল, যাতে করে ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থানরত ব্যক্তির, অর্থাৎ দেশের প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাকে আরো পাকাপোক্ত করা যায়। ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্য ও চেয়ারম্যানরা জেলা কাউন্সিল, প্রাদেশিক পরিষদ ও জাতীয় পরিষদ এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিতেন। এসব নির্বাচনে সাধারণ মানুষের কোন অংশগ্রহণ ছিল না। তাদের অধিকার এখানে খর্ব করা হয়েছিল। সরকার খুব সহজেই ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্য চেয়ারম্যানদের প্রভাবিত করতে পারতেন।

একই সাথে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে সরকারি কর্মচারীদের আধিক্য থাকায় সরকারের একটা প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ ছিল। জনগণের প্রত্যেক অংশগ্রহণ না থাকায় স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা পাকিস্তান শাসনামলে জনপ্রিয়তা পায়নি। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খানের পতন ঘটলে এ ব্যবস্থাও ভেঙ্গে যায়।

সারকথা

রাষ্ট্রের পরিধি বেড়ে যাওয়ায় সুষ্ঠ পরিচালনা ও উন্নয়ন সাধনের জন্য রাষ্ট্রে স্থানীয় সরকার কাঠামো গড়ে তুলেছে। প্রাচীন কালেও ভারতীয় উপমহাদেশে এক ধরনের স্থানীয় সরকার ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে স্থানীয় সরকারের আধুনিক রুপ দেয়া হয়। পাকিস্তান শাসনামলে এক ধরনের স্থানীয় সরকারের বিকাশ ঘটলেও, তাতে জনগণের অংশ গ্রহণ ছিল সীমিত। ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্যই এ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url