জাতিসংঘের গঠন পদ্ধতি
জাতিসংঘের গঠন কাঠামো সম্পর্কে আলোচনা করতে পারবেন: এ ছয়টি শাখার গঠন ও ভূমিকা সম্পর্কে বলতে পারবেন; জাতিসংঘের অধীনে যে বিশেষ সংস্থা রয়েছে, সেই সংস্থাগুলো সম্পর্কে একটা ধারণা পাবেন।
সনদ অনুযায়ী জাতিসংঘের ৬টি শাখা রয়েছে। এই শাখাগুলো হচ্ছে-
- সাধারণ পরিষদ (General Assembly)
- নিরাপত্তা পরিষদ (Security Council)
- অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ (Economic and Social Council)
- অছি পরিষদ (Trusteeship Council)
- আর্ন্তজাতিক বিচারালয় (International Court of Justice)
- সচিবালয় (Secretariat)
সাধারণ পরিষদ
জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত প্রতিটি দেশ সাধারণ পরিষদের সদস্য। প্রতিটি দেশের একটি করে ভোট রয়েছে। সাধারণ পরিষদে মূলত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা হয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে শান্তি ও নিরাপত্তার প্রশ্নে, নতুন সদস্য অর্ন্তভূক্তির প্রশ্নে, বাজেট সংক্রান্ত অন্যান্য প্রশ্নে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী সাধারণ পরিষদ যেসব কাজ করে, তা নিম্নরূপ:
- নিরস্ত্রীকরণ সম্পর্কিত যে কোন আলোচনা ও সুপারিশ করা:
- আর্ন্তজাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা সম্পর্কিত যে কোন আলোচনা, তবে শর্ত থাকে যে, বিষয়টি নিয়ে ইতিপূর্বে নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা হয় নি, এবং বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদের বিবেচনাধীনও নয়;
- জাতিসংঘের যে কোন অঙ্গ সংগঠনের কাজ বা ক্ষমতা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করা ও সুপারিশ পেশ করা।
- আর্ন্তজাতিক সহযোগিতা জোরদার করার লক্ষ্যে যে কোন সুপারিশ পেশ করা, আন্তর্জাতিক আইন উন্নয়ন, মানবাধিকার, ও সবার জন্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধির ব্যাপারে সুপারিশ করা।
- নিরাপত্তা পরিষদসহ সংগঠনের অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের রিপোর্ট গ্রহণ করা ও সেই রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা করা।
- জাতিসংঘের বাজেট নিয়ে আলোচনা ও তা অনুমোদন করা। সদস্য দেশগুলোর চাঁদার হার নির্ধারণ করা।
- নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যদের ও সেই সাথে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ এবং অছি পরিষদের সদস্যদের নির্বাচিত করা। নিরাপত্তা পরিষদের সাথে এক সাথে আর্ন্তজাতিক আদালতের সদস্যদের নির্বাচিত করা এবং নিরাপত্তা পরিষদের সুপারিশের ভিত্তিতে জাতিসংঘের জন্য একজন মহাসচিব নির্বাচিত করা।
- আর্ন্তজাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে এমন কোন কাজে বা দেশের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদ যদি কোন কার্যকরী ব্যাবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে এ ক্ষেত্রে সাধারণ পরিষদ পদক্ষেপ নিতে পারে।
প্রতিবছরের সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় মঙ্গলবারে সাধারণ পরিষদের নিয়মিত অধিবেশন শুরু হয়, এবং তা চলে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। প্রতিটি নিয়মিত অধিবেশনের আগে একজন সভাপতি, ২১ জন সহ-সভাপতি ও পরিষদের ছয়টি প্রধান কমিটির চেয়ারম্যানরা নির্বচিত হন। প্রধান কমিটিগুলো নিরূপ:
- নিরস্ত্রীকরণ ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটি (প্রথম কমিটি)।
- অর্থনীতি ও আর্থিক বিষয় সম্পর্কে কমিটি (দ্বিতীয় কমিটি),
- সামাজিক, মানবকল্যাণ ও সংস্কৃতি বিষয়ক কমিটি (তৃতীয় কমিটি):
- বিশেষ রাজনৈতিক ও উপনিবেশ বিলোপ কমিটি (চতুর্থ কমিটি);
- প্রশাসনিক ও বাজেট বিষয়ক কমিটি (পঞ্চম কমিটি)।
- আইন বিষয়ক কমিটি (ঘষ্ট কমিটি)।
সাধারণ পরিষদের সভাপতি সাধারণত প্রতিবছর আফ্রিকা, এশিয়া, মধ্য ইউরোপ, ল্যাতিন আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ- এই পাঁচটি গ্রুপের মধ্যে থেকে পালাক্রমে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। সাধারণ পরিষদের সভাপতি, ২১ জন সহ-সভাপতি ও ছয়টি প্রধান কমিটির চেয়ারম্যানদের নিয়ে আবার একটি সাধারণ কমিটি রয়েছে। যেহেতু প্রতিবছর সাধারণ পরিষদে আলোচনার জন্য বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়, সেহেতু আলোচনার সুবিধার্থে বিষয়গুলো উপরে উল্লেখিত ছয়টি কমিটির উপর ন্যাস্ত করা হয়। কিছু কিছু বিষয় কমিটিতে আলোচনা না হয়ে পূর্ণাঙ্গ সভায় আলোচিত হয়। কমিটিগুলোতে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় কোন সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কখনও ধ্বনী ভোটেও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তবে পরিষদে গৃহীত কোন সিদ্ধান্ত মানতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে সাধারণ পরিষদ বাধ্য করতে পারে না।
নিরাপত্তা পরিষদ
জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিষদের মূল দায়িত্ব হচ্ছে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা। নিরাপত্তা পরিষদের বর্তমান সদস্য সংখ্যা হচ্ছে ১৫। এর মাঝে ৫টি (যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য) হচ্ছে স্থায়ী সদস্য। বাকি দশটি সদস্য রাষ্ট্র অঞ্চল ভিত্তিতে সাধারণ পরিষদ কর্তৃক দুই বছর মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হয়ে থাকে। এদের মেয়াদ শুরু হয় জানুয়ারী থেকে, এবং শেষ হয় পরের বছরের ডিসেম্বর মাসে। নিরাপত্তা পরিষদে প্রতিটি রাষ্ট্রের একটি করে ভোট রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পাঁচটি স্থায়ী পরিষদের ভোটসহ মোট ৯টি ভোটের প্রয়োজন হয়। স্থায়ী সদস্যদের একটি বিশেষ ক্ষমতা আছে। এই বিশেষ ক্ষমতাকে বলা হয় ভেটো। পাঁচটি স্থায়ী সদস্যের যে কোন একটি রাষ্ট্র যে কোন প্রস্তাবের সাথে দ্বিমত পোষণ করে ভেটো প্রয়োগ করে ওই প্রস্তাবের মৃত্যু ঘটাতে পারে। অস্থায়ী সদস্যদের কোন ভেটো ক্ষমতা নেই। জাতিসংঘের অন্যান্য সংস্থা বা শাখা (যেমন সাধারণ পরিষদ) যেখানে সরকারগুলোর কাছে সুপারিশ পেশ করতে পারে, সেখানে নিরাপত্তা পরিষদ সে সব সিদ্ধান্ত মানতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে বাধ্য করতে পারে। জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিষদের ক্ষমতা ও কাজ নিম্নরূপ:
- আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা;
- সংঘর্ষ, বিবাদ ও উত্তেজনার জন্ম দিতে পারে, এমন সব বিষয়ের তদন্ত করা এবং শান্তির প্রতি হুমকি ও আগ্রাসনকে চিহ্নিত করা। এসব বিষয়ে কি ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যায়, তার সুপারিশ করা:
- সমরাস্ত্রের মজুদ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা;
- আগ্রাসী কোন শক্তির প্রয়োজনে সেই শক্তির বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা:
- সামরিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো উপর কিছু বিষয়ক চুক্তি অনুমোদন ও তার পরিবর্তন করা;
- জাতিসংঘের মহাসচিবের মনোনয়ন চূড়ান্ত করা ও নিয়োগের জন্য তাঁর নাম সাধারণ পরিষদে সুপারিশ করা এবং সাধারণ পরিষদের সাথে একযোগে মিলে আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারকদের নিয়োগ করা।
জাতিসংঘ সনদে নিরাপত্তা পরিষদকে আগ্রাসী কোন শক্তির বিরুদ্ধে প্রয়োজনে সামরিক ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার দিলেও, নিরাপত্তা পরিষদ সব ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থা নেয় না। শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার আশংকা দেখা দিলে নিরাপত্তা পরিষদ প্রথমে বিবাদমান পক্ষগুলোকে শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানায়। কখনও মধ্যস্থতা করে, কখনও গোলযোগপূর্ণ এলাকায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠিয়ে উত্তেজনা প্রশমনের উদ্যোগ নেয়। চূড়ান্ত পর্যায়ে নিরাপত্তা পরিষদ সামরিক ব্যবস্থা নেয়। কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া, বিশ্ব সভা থেকে সেই রাষ্ট্রকে বহিষ্কার করার ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদ সাধারণ পরিষদকে সুপারিশ করতে পারে।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ
এই সংস্থাটি জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাজকর্মের সমন্বয় করে থাকে। পরিষদের সদস্য সংখ্যা ৫৪। প্রথম দিকে এই সদস্য সংখ্যা ছিল ১৮। ১৯৬৫ সালে সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে করা হয় ২৭, আর ১৯৭৩ সালে তা আরো বাড়িয়ে করা হয় ৫৪। সদস্যরা তিন বছরের জন্য নির্বাচিত হয়ে থাকে। প্রতিবছর ১৮টি সদস্য রাষ্ট্র তিন বছরের জন্য নির্বাচিত হয় এবং যে ১৮টি রাষ্ট্রের তিন বছরের মেয়াদ শেষ হয়, তাদের স্থান পূরণ করে নতুন ১৮টি রাষ্ট্র। সংখ্যাগরিষ্ট ভোটে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের কাজ ও ক্ষমতা নিম্নরূপ।
- আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে সমীক্ষা ও প্রতি বছর এই সমীক্ষা রির্পোট পেশের ব্যবস্থা করা:
- মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার বিকাশ লাভের জন্য সুপারিশ করা;
- এর অন্তর্ভুক্ত বিষয়ের উপর আর্ন্তজাতিক সম্মেলন ডাকা ও সাধারণ পরিষদে পেশ করার জন্য খসড়া নীতিমালা তৈরী করা।
- জাতিসংঘের সাথে বিশেষ প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পর্ক স্থাপন করা এবং সাধারণ পরিষদের দ্বারা অনুমোদিত হয়ে জাতিসংঘের সদস্যদের জন্য এবং অনুরোধ করা হলে বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কাজ করা।
- রিষদ যেসব বিষয় নিয়ে কাজ করে সেসব বিষয় নিয়ে বেসরকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে মত বিনিময় করা।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন সহায়ক প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন কমিশন ও বিভিন্ন কমিটি দ্বারা পর্ষদ তার কাজকর্ম পরিচালনা করে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে পরিসংখ্যান কমিশন, জনসংখ্যা কমিশন, সামাজিক উন্নয়ন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, নারী অধিকার কমিশন ও মাদকদ্রব্য বিষয়ক কমিশন, আফ্রিকা, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, ইউরোপ, ল্যাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চল, ও পশ্চিম এশিয়ার জন্য পৃথক পাঁচটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন। যে ছয়টি স্থায়ী কমিটি রয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে কর্মসূচী ও সমন্বয় কমিটি, প্রাকৃতিক সম্পদ কমিটি, বেসরকারী সংস্থা বিষয়ক কমিটি, আন্তঃসরকারী এজেন্সিগুলোর সঙ্গে আলাপ আলোচনা সংক্রান্ত কমিটি, বহুজাতিক কর্পোরেশন সংক্রান্ত কমিশন ও মানব বসতি বিষয়ক কমিশন। একই সাথে অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়ন পরিকল্পনা বিষয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং বিপজ্জনক দ্রব্য পরিবহনের মত বিষয়ের উপর বেশ কয়েকটি স্থায়ী বিশেষ প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
পরিষদ বছরে দুবার অধিবেশনে মিলিত হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, জাতিসংঘের সনদে বিশেষ সংস্থার কথা উল্লেখ রয়েছে। এসব সংস্থা জাতিসংঘের সাথে বিশেষ চুক্তিতে আবদ্ধ হলেও, এরা স্বায়ত্তশাসিত। এসব সংস্থা প্রতিবছরে অর্থনৈতিক ও
সামাজিক পরিষদের কাছে তাদের কাজের হিসেব দাখিল করে। এ ধরনের মোট ১৯টি সংস্থা রয়েছে। এগুলো হচ্ছে
- আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO
- আন্তর্জাতিক খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO)
- জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (UNESCO)
- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)
- আন্তর্জাতিক পূণর্বাসন ও উন্নয়ন ব্যাংক (IBRD)
- আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সমিতি (IDA)
- আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থা (IFC)
- বহুপক্ষীয় বিনিয়োগ গ্যারান্টি সংস্থা (MIGA)
- আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF)
- আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা (ICAO)
- বিশ্ব ডাক ইউনিয়ন (UPU)
- আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন (ITU)
- বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (WMO)
- আন্তর্জাতিক সমুদ্র চলাচল সংস্থা (IMO)
- বিশ্ব বুদ্ধিবৃত্তি সম্পদ সংস্থা (WIPO)
- কৃষি উন্নয়ন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক তহবিল (IFAD)
- জাতিসংঘ শিল্প উন্নয়ন সংস্থা (UNIDO)
- আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA)
- শুল্ক ও বাণিজ্য বিষয়ক সাধারণ চুক্তি (GATT)
আরো পড়ুন: সরকার কি সরকারের গতানুগতিক শ্রেণীবিভাগ
অছি পরিষদ
জাতিসংঘ গঠিত হবার পর ঐ সব অঞ্চলের দায়িত্বভার জাতিসংঘের উপর বর্তায় যে সব অঞ্চল তখন পর্যন্ত স্বাধীনতা লাভের জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠে নি। জাতিসংঘের দায়িত্ব পড়লো ঐ সব অঞ্চলগুলোকে স্বাধীনতার জন্য তৈরী করা। আর এ কারণেই জাতিসংঘ ঐ সব অঞ্চল প্রশাসনের জন্য অছি পরিষদ গঠন করে। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী অছি ব্যবস্থার উদ্দেশ্য হল নিম্নরূপ:
- আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা;
- অছি ব্যবস্থার অন্তর্গত অঞ্চলগুল্যে অধিবাসীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষার উন্নতি সাধন করে সেই সব অঞ্চলকে স্বায়ত্তশাসনের জন্য তৈরী করা।
- ওই সব অঞ্চলের জনগণের মানবিক অধিকার নিশ্চিত করা।
সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করেছিল, ঐ সব উপনিবেশের প্রত্যেকটিতে অছি পরিষদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিজিত অক্ষ শক্তির অধিকার থেকে যেসব অঞ্চল মুক্ত হয়েছিল, সেই সব অঞ্চলের উপরই অছি পরিষদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
অছি পরিষদ সাধারণ পরিষদের অধীনে কাজ করে। তবে সাময়িকভাবে গুরুত্বপূর্ণ যে সব অঞ্চল রয়েছে, সেখানে অছি পরিষদ নিরাপত্তা পরিষদের কর্তৃত্বাধীনে কাজ করে। অছি পরিষদের নির্দিষ্ট কোন সদস্য ছিল না। এর অর্ধেক প্রতিনিধিত্ব করতো অছিভুক্ত অঞ্চল থেকে। বাকী অর্ধেক অন্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে থেকে নেয়া হত। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা কমছে। বর্তমানে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যভুক্ত পাঁচটি দেশ এর সদস্য। সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৯৪ সালের নভেম্বরে পোলান্ড-এর স্বাধীনতার মধ্যে দিয়ে অছি পরিষদের কর্মকান্ডের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে। এখন প্রয়োজন বোধেই যে অছি পরিষদ মিলিত হয়।
আন্তর্জাতিক বিচারালয়
আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের ধারণাটি অনেক পুরানো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লীগ অর নেশনস এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে একটি স্থায়ী আন্তর্জাতিক বিচারালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরে জাতিসংঘ যখন গঠিত হয়, তখনও এর উদ্যোক্তারা এ ধরনের একটি আন্তর্জাতিক বিচারালয় প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। সে অনুযায়ী জাতিসংঘের সনদে এই বিচারালয় গঠন করার কথা উল্লেখ করা হয়। এটি এখন জাতিসংঘ সনদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত সকল রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের সদস্য। যে সকল রাষ্ট্র জাতিসংঘের সদস্য নয়, তারাও এ বিচারালয়ের সদস্য হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিষদের সুপারিশক্রমে সাধারণ পরিষদ এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।
কোন রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের কেবল মাত্র বিচার প্রার্থী হতে পারে, কোন ব্যক্তি বিশেষ বিচার প্রার্থী হতে পারে না। তাছাড়া একাধিক রাষ্ট্রের মধ্যে যে বিবাদ, সেই বিবাদ আন্তর্জাতিক বিচারালয় নিজ উদ্যোগে মীমাংসা করতে পারে না। একমাত্র বিবাদমান রাষ্ট্রগুলোর সম্মতির পরই আন্তর্জাতিক বিচারালয় কোন বিবাদ মীমাংসার উদ্যোগ নিতে পারে। বিবাদ মীমাংসার জন্য প্রয়োজন উভয় পক্ষের অনুমতি আর এ অনুমতি আসবে চুক্তি থেকে। বিভিন্ন রাষ্ট্র চুক্তি করে সিদ্ধান্ত নেবে যে, তারা বিবাদ মীমাংসার জন্য আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের শরনাপন্ন হবে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিচারালয় বিরোধ মীমাংসা করবে। বিরোধ মীমাংসার সময় বিচারালয় যেসব বিষয় বিবেচনা করবে তা হচ্ছে:
- আন্তর্জাতিক প্রচলিত বিধি বিধান।
- আন্তর্জাতিক প্রথাকে গৃহীত আইন হিসেবে গ্রহণ করা।
- বিভিন্ন জাতি কর্তৃক স্বীকৃত আইন কানুন।
- বিভিন্ন দেশের বিশিষ্ট আইনবিদদের বিচার সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত।
তবে আন্তর্জাতিক আদালত উপদেশ দেয়ার ক্ষমতাও রাখে। আইনগতভাবে এটি করতেও বাধ্য নয়। উপদেশ দেয়ার ক্ষমতা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাধীন।
আন্তর্জতিক বিচারালয়ের বিচারকের সংখ্যা ১৫ জন। সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদ পৃথক পৃথক ভাবে ভোটে এদের নির্বাচিত করে। এদের বাছাই করা হয় যোগ্যতার ভিত্তিতে। একই দেশ থেকে দু'জন বিচারপতি থাকতে পারেন না। বিচারকরা নয় বছরের জন্য নির্বাচিত হন, এবং পুনঃনির্বাচিত হতে পারেন। তাদের চাকরির মেয়াদকালে তাঁরা অন্য কোন পেশা গ্রহণ করতে পারবেন না। যারা আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের বিচারক হিসেবে নিযুক্ত হবেন, তাঁদেরকে নিজ নিজ দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার যোগ্যতা থাকতে হবে। প্রতি বছর এক তৃতীয়াংশ বিচারক অবসর গ্রহণ করেন এবং তাঁদের স্থানে নতুন বিচারক নির্বাচিত হন। আন্তর্জাতিক বিচারালয় নেদারল্যান্ডের হেগ শহরে অবস্থিত।
সচিবালয়
সচিবালয়ের মাধ্যমে জাতিসংঘের দৈনন্দিন কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। জাতিসংঘ সনদের প্রণেতারা এটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, জাতিসংঘ যে বিশাল কর্মকান্ড পরিচালনা করতে যাচ্ছে, তার জন্য একটি কেন্দ্রীয় সচিবালয় দরকার। সচিবালয় প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব তারা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। আর এ জন্যই জাতিসংঘ সনদে সচিবালয়কে জাতিসংঘের অন্যতম কেন্দ্রীয় সংস্থার মর্যাদা দেয়া হয়েছিল। জাতিসংঘের দৈনন্দিন প্রশাসন পরিচালনা করা ও অন্যান্য সংস্থাকে সাহায্য করাই হচ্ছে সচিবালয়ের প্রধান কাজ। সচিবালয়ের মুখ্য ব্যক্তি হচ্ছেন মহাসচিব। মহাসচিবকে সাহায্য করার জন্য কয়েকজন উপ-মহাসচিব ও সহকারী মহাসচিব রয়েছেন। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের প্রধান সচিবালয় অবস্থিত। এর বাইরে জেনেভা, নাইরোবী সহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি স্থানে জাতিসংঘের আঞ্চলিক অফিস রয়েছে। মোট ৬০ হাজার লোক জাতিসংঘের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন শাখায় কাজ করে থাকেন।
জাতিসংঘের মহাসচিব এ সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি। নিরাপত্তা পরিষদের সুপারিশক্রমে তিনি সাধারণ পরিষদ কর্তৃক নিযুক্ত হন। মহাসচিব মনোনয়নে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের ভূমিকাই তাই বেশী। জাতিসংঘের সচিবালয় সাধারণত দাপ্তরিক কাজ-কর্ম সমাধান করে। বিভিন্ন সংস্থায় তথ্য প্রেরণ করার দায়িত্ব সচিবালয়ের। সচিবালয় বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করে থাকে। ব্যাখ্যা, অনুবাদ, বিভিন্ন সংস্থার কার্য-বিবরণী লিপিবদ্ধ করা, খসড়া প্রণয়ন ইত্যাদি কাজও সচিবালয় করে থাকে।
জাতিসংঘ সচিবালয়ে কাজ যাতে সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন হয়, সেজন্য সচিবালয়ের কয়েকটি বিভাগ রয়েছে। যেমন, নিরাপত্তা পরিষদের কার্যাবলী সংক্রান্ত বিভাগ, অর্থনীতি সংক্রান্ত বিভাগ, সামাজিক বিভাগ, জনসংযোগ বিভাগ, সম্মেলন ও সাধারণ কার্যাবলী, প্রশাসনিক ও আর্থিক বিভাগ, আইন বিভাগ, কারিগরী সহায়তা বিভাগ। প্রতিটি বিভাগের আবার কয়েকটি উপবিভাগ রয়েছে। এ সমস্ত বিভাগ ও উপবিভাগের মাধ্যমে সচিবালয় তার কার্যাবলী সম্পন্ন করে থাকে।
সারকথা
মোট ৬টি শাখার মাধ্যমে জাতিসংঘ তার কর্মকান্ড পরিচালনা করে। তবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রতিটি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব থাকলেও, নিরাপত্তা পরিষদে প্রতিটি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব নেই। নিরাপত্তা পরিষদে রয়েছে ৫টি স্থায়ী সদস্য ও ১০টি অস্থায়ী সদস্য। স্থায়ী সদস্যদের ভেটো ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু অস্থায়ী সদস্যদের ভেটো ক্ষমতা নেই। অস্থায়ী সদস্যরা দুই বছরের জন্য নির্বাচিত হয়। জাতিসংঘের মূল ক্ষমতা নিরাপত্তা পরিষদের হাতে ন্যস্ত। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সমিতি কিংবা বিশ্ব খাদ্য সংস্থার মত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সরাসরিভাবে জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন না হলেও, বিশেষ সংস্থা রূপে জাতিসংঘের সাথে জড়িত।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url