জাতিসংঘের সাফল্য ও ব্যর্থতা
জাতিসংঘের অতীত ভূমিকা সম্পর্কে বলতে পারবেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে জাতিসংঘের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করতে পারবেন। একুশ শতকের জাতিসংঘের ভূমিকা কি হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে ধারণা পাবেন। কোন কোন ক্ষেত্রে জাতিসংঘ ব্যর্থ হয়েছে, সে ব্যাপারে বলতে পারবেন।
জাতিসংঘের সাফল্য ও ব্যর্থতা
১৯৪৫ সালে মাত্র ৫১টি দেশ নিয়ে যে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই প্রতিষ্ঠানটির বয়স আজ চুয়ান্ন বছর। এই চুয়ান্ন বছরে সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রের সংখ্যা ৫১ থেকে ১৮৬তে এসে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘের ইতিহাসে সাফল্য যেমনটি রয়েছে, তেমনি রয়েছে ব্যার্থতা। তবে জাতিসংঘের প্রয়োজনীয়তা যেমন অতীতে ছিল, এখনও ঠিক তেমন রয়ে গেছে। জাতিসংঘের এ দীর্ঘ যাত্রাপথে জাতিসংঘের ব্যর্থতার পাশাপাশি জাতিসংঘের সাফল্যও রয়েছে। তবে ব্যর্থতার চেয়ে জাতিসংঘের সাফল্যই বেশী।
জাতিসংঘের গঠনের উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ উদ্দেশ্যে দুই বা ততোধিক রাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তিতে ও সেখানে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টিতে জাতিসংঘ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। আফগানিস্তান, কম্বোডিয়া ও এল সালভাদরে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের ভূমিকা এখানে উল্ল্যেখ করা যেতে পারে। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে আফগানিস্তানে সোভিয়েত সামরিক হস্তক্ষেপের পর জাতিসংঘ আফগানিস্থান থেকে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহার ও সেখানে রাজনৈতিক নিষ্পত্তির পক্ষে কাজ করে। ১৯৮৮ সালের ১৪এপ্রিল জেনেভায় জাতিসংঘের উদ্যোগে একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়, যা জেনেভা চুক্তি নামে পরিচিত। বিবাদমান দেশগুলো এতে সাক্ষর করে। এতে সেখানে ত্রান ও মানবিক সাহায্য পাঠানোর সুযোগের সৃষ্টি হয়।
১৯৮৮ সালে গঠিত হয় UNGOMAP যা আফগানিস্তান ও পাকিস্তান জাতিসংঘ মধ্যস্থতা মিশন। UNGOMAP এর উদ্দেশ্য ছিল আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারে তদারকি করা। ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী এই কাজ সম্পন্ন হয়। ১৯৯০ সালে কম্বোডিয়ার জন্য গঠিত হয় UNTAG বা জাতিসংঘ আন্তবর্তীকালিন কর্তৃপক্ষ। UNTAG সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠান, পুলিশ পর্যবেক্ষণ, মানবাধিকার উন্নয়ন, সাড়ে তিন লাখের বেশি শরণার্থী ও তাদের প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসনের দায়িত্ব সম্পন্ন করে। নামিবিয়ায় জাতিসংঘ অন্তবর্তীকালিন সহায়তা গ্রুপ UNTAA শান্তিপূর্ন ভাবে দেশটির স্বাধীনতা লাভ নিশ্চিত করে। মধ্য আমেরিকার এল-সালভাদরে সেখানকার সরকার ও বিদ্রোহী কারাবুন্দো মাল্টি ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের FMLN মধ্যে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ১৯৯২ সালের ১৬ জানুয়ারী মেক্সিকো সিটিতে একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এর ফলে দেশটিতে সংঘাতের অবসান ঘটে। নামিবিয়ার স্বাধীনতার প্রশ্নেও জাতিসংঘ একটি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। নামিবিয়া পূর্বে দক্ষিণ পশ্চিম আফ্রিকার নিয়ন্ত্রনাধীনে ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকা দেশটি শাসন করতো। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ নামিবিয়ার স্বাধীনতা সংক্রান্ত একটি পরিকল্পনা গ্রহন করে ১৯৭৮ সালে এবং সে অনুযায়ী জাতিসংঘ আন্তবর্তীকালীন সহায়তা গ্রুপ UNTAG গঠন করা হয়। UNTAG সেখানে নির্বাচনের ব্যাবস্থা করে। ১৯৮৯ সালের ৭-১১ নভেম্বর সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এবং তাতে সোয়াপো দল বিজয়ী হয়। ১৯৯০ সালে ৯ ফেব্রুয়ারী সর্বসম্মতিক্রমে একটি নয়া সংবিধান অনুমোদিত হয়। আর দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৯০ সালের ২১ মার্চ। জাতিসংঘের জন্য নামিবিয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কাজটি ছিল কঠিন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সমাধান, যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ,ও সেখানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার স্বার্থে জাতিসংঘের উদ্যোগে শান্তিবাহিনী গঠন ও মোতায়েন করা হয়েছিল।
আরো পড়ুন: জাতিসংঘের গঠন পদ্ধতি
১৯৬৪ সালের মার্চে সাইপ্রাসে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী UNFICYP গঠন করা হয়। ১৯৮৮ সালের ৯ আগষ্ট গঠন করা হয়েছিল জাতিসংঘ ইরান-ইরাক সামরিক পর্যবেক্ষক গ্রুপ UNIIMOG মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিনী সংকটকে কেন্দ্র করে জাতিসংঘ জরুরি বাহিনী UNEF, 1956 যুদ্ধ বিরতি তত্ত্বাবধায়ক সংস্থা UNTSO, 1948 জাতিসংঘ জরুরি বাহিনী UNEFI, 1973 জাতিসাগ প্রত্যাহার পর্যবেক্ষক বাহিনী UNDOF, 1974 লেবাননে অন্তবর্তীকালিন জাতিসংঘ বাহিনী UNIFIL, 1978 ইত্যাদি গঠন করা হয়।
জাতিসংঘের উদ্যোগে গঠিত শান্তিরক্ষা বাহিনী এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত। ১৯৪৫ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে ১৩টি শান্তিরক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ২২টি নতুন শান্তিরক্ষা কর্যক্রম গঠিত হয়েছে। যেমন UNOMIG জর্জিয়া, ১৯৯৩, UNOMIL, লাইবেরিয়া, ১৯৯৩, UNMIH (হাইতি), INAMIR (রুয়ান্ডা, ১৯৯৩), UNMOT (তাজিকিস্তান, ১৯৯৪) ইত্যাদি। জাতিসংঘের নিজস্ব কোন শান্তিরক্ষা বাহিনী নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে শান্তিরক্ষা বাহিনীর জন্য সদস্য সংগ্রহ করা হয়। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীও জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে। ১৯৮৮ সালে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। নিরস্ত্রীকরণের ব্যাপারেও জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ১৯৫৯ সালের অ্যান্টার্কটিক চুক্তিতে অ্যান্টকিটিকায় অসামরিকীকরণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ১৯৬৭ সালে মহাশূন্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে মহাশুন্যে অথবা মহাশূন্যের অন্যান্য স্থানে পারমানবিক ও অন্যান্য গণবিধ্বংসী অস্ত্র মোতায়েন ও মজুত নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৬৭ সালে ল্যাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলকে পারমানবিক অস্ত্রমুক্ত অঞ্চলে পরিণত করা হয় (লাটে লোনকো চুক্তি)। ১৯৬৮ সালে প্রথম বারের মত স্বাক্ষরিত হয় পারস্পরিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি। ১৯৭১ সালে সমুদ্র তলদেশে, সমুদ্র পৃষ্টে পারমানবিক ও অন্যান্য গণবিধ্বংসী অস্ত্র বসানো চুক্তি ও ১৯৭২ সালে জীবানু ও রাসায়নিক অস্ত্র উন্নয়ন, উৎপাদন, মজুত নিষিদ্ধ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৮১ সালে প্রচলিত অস্ত্রের (মাইন, বুবি ট্রাপ ইত্যাদি) ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৮৫ সালে স্বাক্ষরিত হয় দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় পরমাণু অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল।
পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের ব্যাপারে জাতিসংঘের ভূমিকা লক্ষ্য রাখার মত। ১৯৭২ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে স্টকহোমে পরিবেশগত প্রথম বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের রেশ ধরেই ১৯৯২ সালের জুন মাসে ব্রাজিলের রিওডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম ধরিত্রী সম্মেলন। শতধিক রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা এতে যোগ দেন। রিও সম্মেলনে যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার একটি হচ্ছে আবহাওয়া পরিবর্তন কনভেশন বা Framework Convention on Climate Change, এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে জীব বৈচিত্র কনভেনশন বা Biological Diversity Convention আবহাওয়া পরিবর্তন কনভেনশনের প্রধান দিকগুলো হলোঃ
- বায়ুমণ্ডলে গ্রীন হাউজ গ্যাসের পরিমাণ এমন একটি স্তরে স্থির রাখা, যার ফলে পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া এড়ানো সম্ভব হয়। সাধারণত কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাসকে গ্রীন হাউজ গ্যাস বলা হয়।
- গ্রীন হাউজ গ্যাসের উদ্দ্গীরণ ১৯৯০ সালের মাত্রায় স্থির রাখা।
- উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে পরিবেশের দিক থেকে গ্রহণযোগ্য কারিগরী জ্ঞান সরবরাহ করবে।
অন্যদিকে জীব বৈচিত্র্য কনভেনশন চুক্তিতে রয়েছে।
- জীব প্রজাতির আবাস এবং ইকো সিসটেমের বিনাস কমাবার জন্য প্রত্যেক দেশের জাতীয় পরিকল্পনায় কার্যকর ব্যবস্থা রাখা।
- অগ্রাধিকার ও বিশেষ সুবিধার ভিত্তিতে কারিগরী জ্ঞান হস্তান্তর করা।
- প্রত্যেক দেশে বেশ কিছু সংরক্ষিত এলাকা সৃষ্টি করা।
- বন্যপ্রাণী ও সম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবস্থাপনা।
এছাড়া এজেন্ডা ২১ গৃহীত হয়েছিল, যা আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। রিও সম্মেলনের পর দ্বিতীয় বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলল (বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলন ৫) অনুষ্ঠিত হয়েছিল নিউইয়র্কে ১৯৯৭ সালের জুন মাসে, আর ডিসেম্বরে (১৯৯৭) জাপানের কিয়োটোতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্ব তাপমাত্রা রোধ সম্পর্কিত শীর্ষ সম্মেলন। কিয়োটোতে একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে। তাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১৯৯০ সালের কার্বনডাই অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণের মাত্রার চেয়ে ৮ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্র ৭ শতাংশ, জাপান ৬ শতাংশ হ্রাস করবে। তাছাড়া সার্বিকভাবে ৫২ শতাংশ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের আইনগত বাধ্যবাধকতা নির্ধারণ করা হয়েছে। আবার একুশটি শিল্পোন্নত দেশও অনুরূপ বিধিবদ্ধ মাত্রা অর্জন করবে। সবগুলো দেশকে ২০০৮-১২ সালের মধ্যে গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে।
বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়া শরনার্থীদের সাহায্য করা জাতিসংঘের কর্মসূচির একটি অন্যতম দিক। এ লক্ষ্যে জাতিসংঘ কাজ করে আসছে। এবং এখনও করছে। এছাড়া বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে জাতিসংঘ উন্নয়ন সহযোগিরূপে কাজ করে আসছে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘ চারটি অগ্রাধিকারের ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে। এগুলো হচ্ছে দারিদ্র ও ক্ষুধা নির্মূল, আন্তর্জাতিক মাদক নিয়ন্ত্রক কর্মসূচী UNDCP শিশু তহবিল UNICEF ইত্যাদি। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মানবাধিকার সম্পার্কিত সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা স্বাক্ষরিত হয়। এতে বিশ্বের সকল মানুষের সমমর্যাদা ও অধিকার স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। জাতি, গোত্র, বর্ণ, নারী পুরুষ, ভাষা, ধর্ম ভেদে সকলের অধিকার ও স্বাধীনতা জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী এক ও অভিন্ন। ১৯৬৩ সালে সাধারণ পরিষদে সর্বপ্রকার জাতিগত বৈষম্য বিলোপ সংক্রান্ত জাতিসংঘ ঘোষণা গৃহীত হয়। ১৯৪৬ সালে আন্তর্জাতিক আদালত প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত সদস্য রাষ্ট্রগুলো এই আদালতে ৬৫টির বেশী মামলা পেশ করেছে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ২০টি পরামর্শমূলক মতামতের জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। চারটি ব্যতীত সবগুলো মামলার উপরই আদালত চূড়ান্ত রায় প্রদান করে।
আপাত দৃষ্টিতে জাতিসংঘের সাফল্য বেশি বলে মনে হলেও, জাতিসংঘ প্রতিটি ক্ষেত্রে যে সফল হয়েছে, তা বলা যাবে না। বেশ কিছু ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ব্যর্থতাও লক্ষ্য করার মত। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা জাতিসংঘের অন্যতম উদ্দেশ্য। অথচ দেখা গেল বিভিন্ন দেশের মধ্যে যেসব যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল, বিশেষ করে ইরান-ইরাক যুদ্ধ, চীন-ভিয়েতনাম যুদ্ধ, আফগানিস্তানে সোভিয়েট ইউনিয়নের আগ্রাসন, ভিয়েতনাম কর্তৃক কম্পুচিয়া আগ্রাসন কিংবা কিউবার উপর যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক চাপ- এসব প্রতিরোধ করতে জাতিসংঘ ব্যর্থ হয়েছিল। উপরন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুইটি বৃহৎ শক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে আন্ত প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে যে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হয়েছিল, সেই স্নায়ুযুদ্ধ রোধ করা কিংবা উত্তেজনা হ্রাস করার ব্যাপারে জাতিসংখ কোন কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। পারস্পরিক অস্ত্র উৎপাদন হ্রাস করা ও পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা কমিয়ে আনার ব্যাপারেও জাতিসংঘের ব্যর্থতা লক্ষ্য করার মত। জাতিগত বৈষম্য বিলোপ সংক্রান্ত জাতিসংঘ ঘোষণা গৃহীত হলেও, বিগত বছরগুলোতে ধনী ও গরিব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ব্যবধান আরো বেড়েছে। গরিব দেশগুলোর ঋণের পরিমাণ দিনে দিনে বাড়লেও, জাতিসংঘ দ্বন্দ্বের কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে আফ্রিকায় রুয়ান্ডা-বুরুন্ডিতে কিংবা ইউরোপে বসনিয়া হার্জেগোভিনা ও কসভোতে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ও লক্ষ লক্ষ মানুষের দেশান্তরিত হওয়ার রোধ করার ব্যাপারে জাতিসংঘ আদৌ কোন পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এমনকি জাতিসংঘ এসব দেশে গণহত্যার সাথে যারা জড়িত, তাদের সবাইকে বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে সোপর্দ করতে পারেনি।
প্যালেস্টাইনের উপর ইসরাইলের নগ্ন-আগ্রাসনের ব্যাপারে জাতিসংঘ অদ্যাবাধি কোন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। গণবিধ্বংসী অস্ত্র গোপন রাখার অভিযোগে ইরাকের উপর বুশ সরকারের অন্যায় আক্রমণের প্রশ্নেও জাতিসংঘ কোন কার্যকর ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে বলেই কার্যত মনে হয়। জাতিসংঘের ব্যাপারে বড় অভিযোগ এই সংস্থাটি মূলত বড় দেশ, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করে। জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত গ্রহনকারী প্রক্রিয়ায় উন্নয়নশীল বিশ্বের কোন প্রতিনিধিত্ব নেই। বিশ্বের প্রায় ১০৮টি দেশ উন্নয়নশীল বিশ্বের অন্তর্গত। এই দেশগুলোর মোট জনসংখ্যা ২০০ কোটির বেশী। অর্থাৎ পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের কিছু কম। অথচ এই বিপুল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী দেশগুলোর ক্ষমতা জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থায় একদম নেই। অর্থ্যাৎ জাতিসংঘের মূল ক্ষমতা নিরাপত্তা পরিষদের হাতে। আর নিরাপত্তা পরিষদ নিয়ন্ত্রণ করে স্থায়ী ৫টি দেশ। এ জন্যই নিরাপত্তা পরিষদের কাঠামো পরিবর্তনের দাবী উঠেছে। জাতিসংঘকে একুশ শতকের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাঠামোর পরিবর্তন, উন্নয়নশীল বিশ্বের ঋনের বোঝা কমানো, নারী উন্নয়ন ইত্যাদি ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। তবে এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর জাতিসংঘের প্রয়োজনীয়তা যেমন ছিল, আজ তেপ্পান্ন বছর পর এই সংস্থাটির প্রয়োজনীয়তা ঠিক তেমনি রয়ে গেছে।
সারকথা
প্রতিটি সংস্থারই সাফল্য যেমনি রয়েছে, তেমনি রয়েছে ব্যর্থতা। জাতিসংঘের ক্ষেত্রেও এই কথাটা প্রযোজ্য। জাতিসংঘের সাফল্য যেমনি রয়েছে, তেমনি রয়েছে এর ব্যর্থতাও। তবে তুলনামূলক বিচারে জাতিসংঘের সাফল্য বেশী। বিশেষ করে শান্তিরক্ষা, পরিবেশ কার্যক্রম, কিংবা উন্নয়ন কর্মকান্ডের সাথে জড়িত হয়ে জাতিসংঘ উন্নয়নশীল বিশ্বের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষী পাঠিয়ে জাতিগত দ্বন্দ্বের অবসানের উদ্যোগ নিয়েছে জাতিসংঘ। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে বৃহৎ শক্তিগুলোর একটি ভূমিকা ও কর্তৃত্ব করার প্রবনতা লক্ষ্য করা যায়। আর তাই দাবী উঠেছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাঠামোগত সংস্কারের।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url