চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী কি চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর শ্রেণীবিন্যাস ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ভূমিকা

আজ এই আর্টিকেলটিতে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী কি তা বলতে পারবেন। অধ্যাপক আলমন্ড ও পাওয়েলের চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর শ্রেণীবিন্যাস ও ব্যাখ্যা করতে পারবেন, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ভূমিকা আলোচনা করতে পারবেন।

ভূমিকা

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হল স্বেচ্ছামূলক সংগঠিত গোষ্ঠী। অধ্যাপক আলমন্ড এদেরকে এক ধরনের স্বার্থকামী গোষ্ঠী বলে অভিহিত করেছেন। আধুনিক রাষ্ট্রে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী ভিত্তিক পদ্ধতি ও কলাকৌশল অবলম্বন করে স্বার্থ আদায় করে থাকে। উন্নত ও উন্নয়নশীল সকল রাষ্ট্রেই সরকারের বিভিন্ন বিভাগের উপর এদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। আধুনিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলের ন্যায় চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আরো পড়ুন: জাতিসংঘের সাফল্য ও ব্যর্থতা

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সংজ্ঞা ও নামকরণ নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মত পার্থক্য রয়েছে। অনেকে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী না বলে একে স্বার্থকামী গোষ্ঠী নামে অভিহিত করেছেন। অনেকে আবার এরূপ গোষ্ঠীকে রাজনৈতিক গোষ্ঠী, মনোভাবকেন্দ্রিক গোষ্ঠী বলেও উল্লেখ করেছেন। অধ্যাপক ফাইনার চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীকে লবি (Lobby) এবং এলান পটার এটাকে সুসংবদ্ধ গোষ্ঠী বলে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন-শিক্ষক সমিতি, ব্যবসায়ী সমিতি, ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রমিক সংঘ ইত্যাদি। অধ্যাপক এলান আর বল চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী সমভাবাপন্ন সদস্যগণের সমন্বয়ে গঠিত গোষ্ঠীকে বুঝাতে চেয়েছেন। তিনি চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীকে দুভাগে ভাগ করেছেন যেমন স্বার্থকারী (Interest Group) গোষ্ঠী এবং সমদৃষ্টিসম্পন্ন (Attitude Group) গোষ্ঠী। অধ্যাপক মাইরন উহনারের বক্তব্য খুবই প্রণিধানযোগ্য, তিনি বলেন, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হল কোন স্বেচ্ছামূলক সংগঠিত গোষ্ঠী যা সরকারী কাঠামোর বাইরে থেকে সরকারী কর্মকর্তাদের মনোনয়ন ও নিয়োগ, সরকারী নীতি গ্রহণ, পরিচালনা বা নির্ধারনের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে।

অধ্যাপক অ্যালমন্ড ও পাওয়েল চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী এক ধরণের স্বার্থকামী গোষ্ঠী বলে অভিহিত করেছেন। তারা সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলোকে চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত করছেন। যেমনঃ-

  • স্বতঃস্ফূর্ত স্বার্থকামী গোষ্ঠী
  • সংগঠন ভিত্তিক স্বার্থকামী গোষ্ঠী
  • অসংগঠিত স্বার্থকামী গোষ্ঠী
  • প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থকামী গোষ্ঠী

১. স্বতঃস্ফুর্থ স্বার্থকামী: স্বতঃস্ফুর্থ স্বার্থকামী গোষ্ঠী কোন একটি বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভাবাবেগ দ্বারা চালিত হয়ে হঠাৎ করে হিংসাত্মক কার্যকলাপের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করে থাকে। আবেগ এদেরকে সংঘবদ্ধ করে। দাঙ্গা হাঙ্গামা এবং বিক্ষোভ প্রদর্শন এ ধরণের চাপগোষ্ঠীর প্রধান বৈশিষ্ট্য।

২. সংগঠনভিত্তিক স্বার্থকামী গোষ্ঠী: যে চাপগোষ্ঠী নিজস্বার্থ উদ্ধারের উদ্দেশ্যে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে তাকে সংগঠনভিত্তিক স্বার্থকামী গোষ্ঠী বলে। এই গোষ্ঠী গোষ্ঠীস্বার্থ সংরক্ষণের এক বিশেষ উপায় হিসেবে স্বীকৃত। এ গোষ্ঠী কোন হঠকারী আচরণ করেনা। বরং সুপরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হয়ে থাকে। এরা বিভিন্ন চ্যানেলে নিজেদের স্বার্থের কথা, আইনসভা, রাজনৈতিক দল ও গণমাধ্যমে পেশ করে। শ্রমিক সংগঠন, কৃষক সংগঠন, ব্যবসায়ী সমিতি, শিল্পপতিদের সমিতি এবং অন্যান্য পেশাজীবী সংগঠন এ ধরণের স্বার্থকামী গোষ্ঠীর উদাহরণ।

৩. অসংগঠিত স্বার্থকামী গোষ্ঠী: অসংগঠিত স্বার্থকামী গোষ্ঠী তেমন কোন সুসংহত বা সুসংগঠিত গোষ্ঠী নয়। এদের সাংগঠনিক দুর্বলতা সুস্পষ্ঠ। গোষ্ঠী বিশেষ ব্যক্তি, পরিবার, ধর্মনেতা, অঞ্চল প্রধান প্রভৃতির মাধ্যমে দাবি পেশ ও আদায়ের চেষ্টা করে। বিভিন্ন উপজাতীয় গোষ্ঠী, ধর্মগুরুর অনুসারী গোষ্ঠী এরূপ স্বার্থকামী গোষ্ঠী প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সরকারী ব্যবস্থায় এদের চাপ প্রয়োগ তেমন জোরদার হয় না। ফলে দাবী আদায়ের ব্যর্থতা ফুটে উঠে। বংশ, বর্ণ, অঞ্চল প্রভৃতি শ্রেণীর ক্ষুদ্রতর বিন্যাসের ভিত্তিতে গড়ে উঠা চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীকে অসংগঠিত স্বার্থকামী গোষ্ঠী বলা হয়।

৪. প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থকামী গোষ্ঠী: উন্নয়নশীল দেশ প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থকামী গোষ্ঠী ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ন। সরকার এবং সরকারের বাইরে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত গোষ্ঠী যখন তাদের পেশা সংশ্লিষ্ট স্বার্থ আদায়ের জন্য সংঘবদ্ধ হয় তখন প্রতিষ্ঠানিক স্বার্থগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে। এদের সাংগঠনিক ভিত্তি খুবই মজবুত হয়ে থাকে। নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এদের উদ্ভব ঘটে। আইন পরিষদ, আমলাতন্ত্র, সেনাবাহিনী, প্রভৃতি এধরণের স্বার্থকামী গোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। সম্মিলিত সংস্থা হিসাবে এ গোষ্ঠী সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাজ সম্পাদন করে।

আরো পড়ুন: যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক প্রবণতা ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সাফল্যের শর্তাবলী

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ভূমিকা

আধুনিককালে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বিভিন্ন কলাকৌশল অবলম্বন করে বিভিন্ন পদ্ধতিতে তাদের স্বার্থ হাসিল করে থাকে। সরকারী নীতিমালা নির্ধারণ, প্রণয়ন, পরিবর্তন এবং সরকারী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে চাপ প্রয়োগকারী সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। নিম্নে এদের কার্যাবলি বা ভূমিকা আলোচনা করা হল। 

আমলাদের উপর প্রভাব: সরকারী কাজকর্ম সাধারণত আমলারাই পরিচালনা করে থাকে। নীতিনির্ধারণ ও তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। উচ্চপর্যায়ের আমলারা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী তাদের প্রভাবিত করে থাকে। উল্লেখ্য যে যুক্তরাজ্যের প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে নীতি নির্ধারণী কমিটিতে প্রায়ই চাপ প্রয়োগকারী সদস্যদের স্থান দেওয়া হয়।

আইন ও শাসন বিভাগের উপর প্রভাব: চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী আইন পরিষদকে প্রভাবিত করে থাকে। চাপ প্রয়োগকারী সংস্থার নেতৃবৃন্দ আইন পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের কাছে তাদের দাবি দাওয়া তুলে ধরে এবং তাদের অনুকূলে আইন পাশ করার ব্যবস্থা করে। সাধারণত: শাসন বিভাগের উপর চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর প্রভাব অধিক মাত্রায় প্রতিফলিত হয়। স্বার্থকামী গোষ্ঠীগুলো মন্ত্রিপরিষদকেও প্রভাবিত করে। এমন কি প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে শাসন বিভাগের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।

বিচার বিভাগের উপর প্রভাব: চাপ প্রয়োগকারী গোষ্ঠী বিচার বিভাগকেও প্রভাবিত করে থাকে। বিচারকদের নিয়োগকালে চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী শাসন বিভাগ বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে এমনভাবে প্রভাবিত করে থাকে যাতে তাদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ব্যক্তিকে বিচারক পদে নিয়োগ করা হয়। আইনজীবি সংগঠন (Bar Association) এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। অন্যদিকে আইন সম্পর্কে শাসন বিভাগ যে ব্যাখ্যা প্রদান করে গোষ্ঠীগুলো তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করে যুক্তি প্রদর্শন করে বিচারকের রায়কে প্রভাবিত করতে পারে।

রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রভাবিতকরণ: আধুনিককালে রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে সরকার পরিচালিত হয়ে থাকে। রাজনৈতিক দল স্বার্থ একত্রীকরণের সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম। এ কারণে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো সরকারী নীতি ও সিদ্ধান্তকে তাদের স্বার্থের অনুকূলে রাখার জন্য রাজনৈতিক দলকে বিভিন্ন সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে প্রভাবিত করতে সচেষ্ট হয়। রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলোর দাবীপূরণ করে থাকে।

সারকথা

চাপপ্রয়োগকারী গোষ্ঠী একই ধরণের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতির স্বার্থের ভিত্তিতে সংঘবদ্ধ জনগোষ্ঠী। উদার নৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বর্তমানে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এটা একটি অপরিহার্য অঙ্গরূপে বিবেচিত হয়। উন্নত ও অনুন্নত সব রাষ্ট্রেরই সরকারের শাসন আইন ও বিচার বিভাগের উপর চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url