আমলাতন্ত্রের ভূমিকা ও এর নিয়ন্ত্রণ

আজ এই আর্টিকেলটিতে  আমলাতন্ত্রের ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে পারবেন, আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে আলোচনা করতে পারবেন।


ভূমিকা 

আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এবং সরকারী প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় আমলাতন্ত্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের কার্যক্রম প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে আমলাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। জনগণের সার্বিক কল্যাণ সাধনে আধুনিক রাষ্ট্রগুলোতে আমলাদের ভূমিকা নিম্নে আলোচনা করা হল।

আরো পড়ুন: জাতিসংঘের গঠন পদ্ধতি

আমলাতন্ত্রের ভূমিকা ব্যাখ্যা 

আইনসভাকে প্রভাবিতকরণ: আমলাগণ আইনসভাকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থা, আইন সভার কমিটির সদস্যদের প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সরচবরাহ করে থাকে। অনেক সময় আমলাগণ তাঁদের স্ব স্ব বিভাগের ক্ষেত্রে উপদেশ প্রদানের জন্য আইন সভার বিভিন্ন কমিটিগুলোতে উপস্থিত থাকেন। এর ফলে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের একটি গরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়।

আইন কার্যকরকরণ: আমলাগণ শুধু যে আইন প্রণয়নেই সহযোগিতা কর তাই নয়, বরং আইনকে তারা কার্যকরী করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে আইন কার্যকরী করবার ক্ষেত্রে এর প্রভাব অধিক পরিমাণ লক্ষণীয়। আমলাগণ বিশেষ ক্ষমতাবলে আইন বাস্তবায়ন করে থাকেন। এভাবে আমলাতন্ত্র আইন ও শাসন বিভাগের মধ্যে সেতু হিসাবে কাজ করে থাকনে।

সামাজিক পরিবর্তন আনয়ণে ভূমিকা: আধুনিকীকরণে ও আমলাতন্ত্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য। গণতান্ত্রিক সরকারের স্থায়িত্ব নির্ভর করে পরিবর্তনশীল সামাজিক চাহিদা মেটানোর উপর। আমলাতন্ত্র প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার যোগান দিয়ে থাকে। এভাবে আমলাতন্ত্র সামাজিক ইতিবাচক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।

শাসনকার্যের নিরবিচ্ছিন্নতা বজায় রাখা: গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার ঘন ঘন পরিবর্তিত হওয়ায় রাজনৈতিক শাসনকদের পক্ষে শাসনকার্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব নয়। সরকারের উত্থান পতনের মধ্যে শাসন কার্যের নিরবিচ্ছিন্নতা বা ধারাবাহিকতা বজায় রাখে সরকারি কর্মচারী বা আমলাগণ।

তথ্যাদি প্রদান: সংবাদ ও তথ্যাদি আদান প্রদানের ব্যাপারে আমলাগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। শাসকবৃন্দ ও আইনসভা বিভিন্ন প্রশাসন কর্তৃক প্রদত্ত তথ্যাদির উপর ভিত্তি করে সরকারি নীতি নির্ধারণ ও আইন প্রণয়ন করে থাকেন।

সরকারী দৈনন্দিন কার্য পরিচালনা: আমলাতন্ত্র সরকারী দৈনন্দিন কার্যাবলী পরিচালনা করে থাকেন। যেমনঃ শিক্ষা, জনহিতকর কার্যাবলী, সামাজিক নিরাপত্তা, আইন শৃঙ্খলা রক্ষা, সংস্থাপন, কর ব্যবস্থা ইত্যাদি সবকিছুই আমলাদের সহায়তা ব্যতীত এক মূহুর্ত চলতে পারে না।

প্রতিযোগিতামূলক স্বার্থের মূল্যায়ন: আমলাগণ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক স্বার্থের মূল্যায়ন কাজে নিয়োজিত থাকেন। কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জনস্বাথের যৌক্তিক প্রয়োগ করে থাকেন। এ পর্যায়ে আমলাদেরকে বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী স্বার্থের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হয়। কোন সিদ্ধান্ত জনগণের স্বার্থরক্ষা করবে, এবং কোনটি তা করবে না সেটি পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন আমলারা।

আইন প্রণয়ন: আইনসভায় যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিল উত্থাপিত হয় কার্যত: প্রশাসনিক বিভাগই অধিকাংশ বিলের প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পন্ন করে থাকে। তাই আইন প্রণয়ন ও নতুন বিল পাশের ক্ষেত্রে আমলাদের ভূমিকা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

বিচার কার্যসম্পাদন: কিছু কিছু বিচারকার্য সাধারণত আদালতে হয় না। বরং তা সম্পাদন করে প্রশাসনিক সংস্থান। এর ফলে আমলাগণ বিচার কার্য সম্পাদনের সুযোগ পায়। যেমন জমি ক্রয় বিক্রয়ের রেজিস্ট্রেশন এবং ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদি।

যোগাযোগ স্থাপন: আমলা ব্যবস্থার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল যোগাযোগ স্থাপন। উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ থেকে অর্থাৎ মন্ত্রী থেকে শুরু করে নিম্ন পর্যন্ত যোগাযেগের সেতুবন্ধন হল আমলাগণ। দপ্তরের সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হয় অন্যদিকে অধস্তন কর্মচারীদেরও জানাতে হয়।

আরো পড়ুন: সংসদীয় সরকার সংসদীয় সরকারের বৈশিষ্ট্য  সংসদীয় সরকারের গুণাবলী ও ত্রুটি 

আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ

আমলাদের ব্যপক ক্ষমতা ও দায়িত্ব বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। রিচার্ড ক্রসম্যান যথার্থই বলেছেন, "অনিয়ন্ত্রিত আমলাতন্ত্র গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ।" আমলাদের কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সে বিষয়ে নিম্নে আলোচনা করা গেল।

১. রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ: রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ হলো বাহ্যিকভাবে আমলাদের নিয়ন্ত্রণের একটি পদ্ধতি। রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বলতে আইনসভা, মন্ত্রিসভা, রাজনৈতিক দল এবং চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে আয়োজিত নিয়ন্ত্রণকে বোঝায়।

২. আইনসভা কর্তৃক নিয়ন্ত্রণ: আইনসভা কয়েকটি উপায়ে আমলাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যেমনঃ-

  • আইনসভা কর্তৃক প্রশ্ন, অতিরিক্ত প্রশ্ন উত্থাপনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ।
  • আইনসভায় বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ।
  • একাউন্টিং এবং অডিটিং সংস্থার মাধ্যমে, প্রস্তাবিত নতুন আইনের শুনানীর মাধ্যমে, প্রচলিত আইনের সংশ্লেষণের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ। এভাবে আইনসভা আমলাব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ চর্চা করতে পারে।

৩. বিচার বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ: আমলাদের প্রশাসনিক কার্যে আদালত সাধারণত: ছয়টি পদ্ধতি অবলম্বন করে নিয়ন্ত্রণমূলক কাজ করে থাকে।

এগুলো হলঃ

  • কো ওয়ারেন্টো রিট
  • হেবিয়াস কর্পাস রিট
  • সাটি ওয়ারী রিট
  • ম্যানডাম্যাম রিট
  • ইনজাংশন
  • প্রহিবিশন

৪. নাগরিক নিয়ন্ত্রণ: আমলাদের ন্যায়নিষ্ঠা ও সততা অনেকাংশে নির্ভরশীল নাগরিকদের ব্যাপকভাবে সরকারী কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের উপর। আমলা ব্যবস্থার পর নাগরিক নিয়ন্ত্রণ নিম্নোক্তভঅবে কার্যকর করা যেতে পারে:

  • প্রগতিশীল নীতি ও নেতৃত্বের মাধ্যমে।
  • বিভিন্ন বোর্ড ও কমিশনের মাধ্যমে।
  • নাগরিক উপদেশ প্রদানকারী কমিটির মাধ্যমে এবং
  • বিভিন্ন স্বার্থকামী গোষ্টীর মাধ্যমে।

৫. সরকার প্রধান কর্তৃক নিয়ন্ত্রণ: সরকারী কার্যক্রম দ্বারা নাগরিকগণ উপকৃত এবং সন্তুষ্ট হয়েছে কিনা তা চূড়ান্তকরে বিচার বিশ্লেষলণ করেন রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীকর্তা রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী। তিনি প্রশাসনিক কর্মকর্তাবৃন্দের প্রতি বিশেষ নির্দেশ প্রদান করে তাদের কার্যাবলি ও আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হন।

৬. ক্ষমতা ও দায়িত্ব যথাযথভাবে বিকেন্দ্রীকরণ: ক্ষমতা ও দায়িত্ব নির্দিষ্ট কেন্দ্রে একীভূত না করে বরং বিকেন্দ্রীকরণ নীতি প্রয়োগ করতে পারলে স্বাভাবিকভাবেই আমলারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।

৭. প্রশাসনিক আত্মনিয়ন্ত্রণ: সর্বোপরি আমলা ব্যবস্থার শক্তি যদি নিজেরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করেন সেটাই তাদের নিয়ন্ত্রণ করবার কার্যকর পদ্ধতি হতে পারে। কোন প্রকার বল প্রয়োগ করে তা সম্ভব নয়। বরং প্রশাসকগণ যদি সঠিকভাবে এবং আইনানুগভাবে কাজ করতে প্রস্তুত থাকেন তবে তা সম্ভব। এ জন্য উন্মুক্ত প্রশিক্ষণ কার্যকর রাখা যেতে পারে।

সারকথা 

আধুনিক রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কর্মকান্ডে আমলাতন্ত্র হচ্ছে কেন্দ্রবিন্দু। মূলত: তাঁদের মেধা, কর্ম তৎপরতা, সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত, ক্ষমতা, অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে। উন্নয়নশীল দেশের সমাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতি সাধনে আমলাতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আসীন। আমলারা আইন প্রণয়নে অংশগ্রহণ করেন, মন্ত্রীদের সহায়তা করেন এবং প্রয়োজনীয় কার্য সম্পাদন করেন। একথা সর্বজন স্বীকৃত যে আমলাদের সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য তাদেরকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে রাখতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url