জাতীয়তাবাদ কি জাতীয়তাবাদের বিকাশ আন্তর্জাতিকতাবাদ কি ও বিশ্বসভ্যতা

আজ এই আর্টিকেলটিতে  জাতীয়তাবাদ কি বলতে পারবেন, জাতীয়তাবাদের বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করতে পারবেন। আন্তর্জাতিকতাবাদের সংজ্ঞা দিতে পারবেন, জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় করতে পারবেন, লাস্কির আন্তর্জাতিকতাবাদ তত্ত্ব সম্পর্কে বলতে পারবেন, বিশ্ব সভ্যতায় জাতীয়তাবাদের সুফল ও কুফল বর্ণনা করতে পারবেন।


জাতীয়তাবাদ কি 

জাতীয়তাবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং আলোড়ন সৃষ্টিকারী আদর্শ বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। আধুনিক কালে রাজনীতির প্রধান চালিকা শক্তি হচ্ছে জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই উদ্ভব হয়েছে জাতীয়-রাষ্ট্রের।

জাতীয়তাবাদ একটি চেতনা, এক ধরনের মানসিকতা এবং অনুভূতি। দেশাত্মবোধ এবং দেশপ্রেম হচ্ছে জাতীয়তাবাদের প্রধান স্তম্ভ। অধ্যাপক হ্যারন্ড জে, লাস্কির মতে "জাতীয়তাবাদ সাধারণত এক প্রকার মানসিক ঐক্যবোধে উদ্বুদ্ধ জনসমাজ এবং এই ঐক্যবোধ উক্ত জনসমাজকে অন্য মানবসমাজ থেকে পৃথক করে"। হ্যানস কোহ্ন বলেন, "জাতীয়তাবাদ হল মূলত এক মানসিক অবস্থা, চেতনার এক কার্যক্রম।"

অধ্যাপক ক্লাইডার বলেন, "জাতীয়তাবাদ হল ইতিহাসের এক বিশেষ পর্যায়ে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ভাবপ্রবণতার ফল। একটি সৃনির্দিষ্ট ভূখন্ডে বসবাসকারী জনসাধারণের মানসিকতা, অনুভূতি ও চেতনার ফল"। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হায়েস তার Essays on Nationalism গ্রন্থে বলেন জাতীয়তা ও দেশপ্রেম এ দুটি প্রাচীন ভাবের আধুনিক এক আবেগময় অনুভূতিপ্রবণ সমিশ্রণ ও অতিরঞ্জন"। (Nationalism consists of modern emotional fusion and exaggeration of two very old phenomena of nationality and patriotism.)

জাতীয়তাবাদ মূলত একত্রিত ব্বার এবং একত্রে বসবাস করার মানসিক প্রবণতা। জাতীয়তাবাদ জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠে জাতীয়-রাষ্ট্র গঠনই জাতীয়তাবাদের চরম সার্থকতা। জাতীয়তাবাদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। একটি সামাজিক অন্যটি রাজনৈতিক। সামাজিক দিক থেকে একটি জনসমাজ জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেদের আলাদা অস্তিত্ব খুঁজে পায় এবং রাজনৈতিক দিক থেকে 'one Nation one state'-এর ভিত্তিতে সংগঠিত সমাজ সৃষ্টির প্রয়াস পায়।

আরো পড়ুন: স্থানীয় সরকার কি স্থানীয় সরকার ও তার ক্রমবিকাশ সম্পর্কে বিস্তারিত

জাতীয়তাবাদের বিকাশ

মানব সমাজের ইতিহাস ক্রমবির্তনের ইতিহাস। এই ক্রম বিবর্তনের পথ ধরে অনেক উত্থান ও পতনের মধ্য দিয়ে আমরা নগররাষ্ট্র থেকে উপনীত হয়েছি আধুনিক রাষ্ট্রে। আধুনিক রাষ্ট্রগুলো মূলত জাতীয় রাষ্ট্র। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভের জন্য আহ্বর এর বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করব।

প্রাচীন কালে কেবল মাত্র গ্রীক ও হিব্রুদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের সন্ধান লাভ করা যায়। কালের বিবর্তনে গ্রীসের নগর রাষ্ট্রগুলোর অধঃপতন ঘটে এবং রোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। জন্মলাভ করে বিশ্বজনীন সাম্রাজ্যবাদের ধারণা। মধ্যযুগে খ্রিষ্টান ধর্মের প্রভাবে রষ্ট্র পরিচালিত হতে থাকে। শাসন ব্যবস্থায় গীর্জার কর্তৃত্ব পরিলক্ষিত হয়। এ সময় বিভিন্ন দেশে বংশানুক্রমিক রাজস্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজতন্ত্রের অধীনে সাধারণ মানুষ উৎপীড়িত ও লাঞ্ছিত হতে থাকে। অত্যাচারিত ও নির্যাতিত মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। বিভিন্ন জাতি আপন স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন হয়েউঠে। পরবর্তীকালে গীর্জা এবং রাজার মধ্যকার ক্ষমতার লড়াইয়ে রাজার কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। রাজার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে।

ষোড়শ শতকের শুরুতে জাতীয়াবাদের প্রথম বিকাশ ঘটে। ইতালির চিন্তাবিদ ম্যাকিয়াভেলী জাতীয়-রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণের ফলে জাতীয়তাবাদ কুনভাবে প্রাণ লাভ করে। তিনি আধুনিক অর্থে 'রাষ্ট্র' শব্দটিকে বিশ্লেষণ ও ব্যবহার করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়। জাতীয়তাবাদের ইতিহাস বেশ প্রাচীন হলেও বিশেষ অর্থে জাতীয়তাবাদ বলতে যা বুঝায় চা আধুনিক যুগের সাথে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত। প্রকৃত পক্ষে ১৭৭২ সালে অস্ট্রিয়া, রাশিয়া ও প্রুশিয়া কর্তৃক পোলান্ডের ভাগাভাগি এবং ১৭৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লবের ফলে জাতীয়তাবাদের চেতনা সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। ফরাস বপ্লব শুধু সাম্য, স্বাধীনতা ও ভ্রাতৃত্বের আদর্শই প্রচার করে নি, এর আরেকটি মহান আদর্শ হচ্ছে দেশপ্রেম। এই দেশত্মবোধই কালক্রমে জাতীয়তাবাদে রূপান্তরিত হয়।

 সব আদর্শকে কেন্দ্র করে সংঘঠিত হয়েছিল তার মধ্যে জাতীয়তাবাদ অন্যতম। চিন্তাবিদ হ্যান্স কোহন যথার্থই বলেছেন যে, ফরাসী বিপ্লবের অনুপ্রেরণার ফলে জাতীয়তাবাদের চেতনা সুসংহত রূপ লাভ করে। ফরাসী বিপ্লবের ফলেই জাতীয়তাবাদের চিন্তা পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় এবং একটি রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। জাতীয়তাবাদী আদর্শ ক্রমে ক্রমে ইউরোপ এবং আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর মানচিত্রে সূচিত হয় বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ইউরোপবাসীরা ফরাসী বিপ্লব থেকে এই শিক্ষা লাভ করে যে, সমাজ ও রাষ্ট্রের পুনর্গঠনে জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র হচ্ছে অপরিহার্য মূলনীতি।

নেপোলিয়ন সমগ্র ইউরোপকে ফ্রান্সের অধীনে এনে জাতীয় অনুভূতি বিকাশের পথ প্রশস্ত করেন। তিনি প্রতিবেশী দেশগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করার ফলে ঐ সব দেশের জনসাধারণ জাতীয় ঐক্যের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠে। তাঁর আক্রমণের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ এসব অঞ্চলে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটতে থাকে এবং গণঅভ্যুত্থানের সূচনা হয়। ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রে একের পর এক বিপ্লব সংঘটিত হতে থাকে। ১৮১৫ সাল ভিয়েনা কংগ্রেস বেলজিয়ামকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে হল্যান্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করায় বেলজিয়াম জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয় এবং ১৮৩১ সালে হল্যান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

উনবিংশ শতাব্দীর ইতিহাস রক্তাক্ত বিপ্লবের ইতিহাস। বিংশ শতাব্দী জাতীয়তাবাদের গৌরবোজ্জ্বল যুগ। জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে ১৯১৯ সালে ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চেক, গোল্যান্ড ও পাভ জাতিগুলো রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ লাভ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এশিয়া ও আফ্রিকায় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বহু রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটে। ভারত, পাকিস্তান, কোরিয়া, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফলে ১৯১৭ সালে সোভিয়েত রাষ্ট্র জাতিগত ধারণার নতুন সংযোজন ঘটাতে চায়। কিন্তু ১৯৯০ সালের ঘটনার পর গতানুগতিক জাতি ভিত্তিক চেতনা আবার প্রবল হয় এবং সোভিয়েতের স্থলে একাকি রাষ্ট্র গড়ে ওঠে।

আরো পড়ুন: সামাজিক অনাচার প্রতিরোধে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা

আন্তর্জাতিকতাবাদ  কি

আন্তর্জাতিকতাবাদ হল বিশ্বের সকল জাতি ও সম্প্রদায়ের সাথে সংহতি ও মিলনের অনুভূতি। আন্তর্জাতিক মতবাদ হল এমন এক রাজনৈতিক দর্শন যা রাষ্ট্রের সংহতি, বিভিন্ন জাতির মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এবং বিশ্বশান্তির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে। আন্তর্জাতিকতাবাদ সেই ধরনের মানসিকতা ও চেতনা যা জাতীয়তাবাদের উর্দ্ধে উঠে বিশ্বের সকল জাতি ও সম্প্রদায়ের বিশ্বজনীন কল্যাণের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। জাতীয় স্বার্থের সাথে মানুষ যখন বিশ্বমানবের কল্যাণ ও মঙ্গলের প্রতি যত্নবান হয় তখনই তা আন্তর্জাতিকতাবাদে রূপ লাভ করে।

জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের সম্পর্ক

জাতীয়তাবাদ যেখানে নির্দিষ্ট কোন জাতির কল্যাণ, মর্যাদা ও সুখ-সমৃদ্ধি নিয়ে চিন্তা করে আন্তর্জাতিকতাবাদ সেখানে সমগ্র বিশ্বব্যাপী মানব জাতির চিন্তায় মগ্ন।

উগ্র বা বিকৃত জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার বিরোধী। কিন্তু সুস্থ জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার বিরোধী নয়। জার্মানীর হিটলার ও ইটালীর মুসোলিনির জাতীয়তাবাদ উগ্র জাতীয়তাবাদের দৃষ্টান্ত। উগ্র জাতীয়তাবাদ সর্বাত্মকবাদের নামান্তর এবং গণতন্ত্র বিরোধী।

জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ একে অপরের পরিপূরক। জাতীয়তাবাদী চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে মানুষ নিজের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে। এই চেতনা আন্তর্জাতিকতাবাদের মহতী চিন্তা-চেতনায় রূপান্তরিত হলে বিশ্ব মানবতার কল্যাণ সাধিত করে। তাই বলা হয়, যিনি দেশ ও জাতির মঙ্গলের কথা ভাবতে পারেন তিনিই বিশ্ব মানবের কল্যাণের কথা চিন্তা করতে পারেন। একথা সত্য যে, মানুষ জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ ও বিশ্বাসী হয়েও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গৌরবমন্ডিত অবদান রাখতে সমর্থ হয়। মূলত এটা মানসিক ব্যাপার।

তত্ত্বগত ভাবে জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। আন্তর্জাতিকতাবাদে জাতীয়তাবাদ বিলুপ্ত হয় না। আন্তর্জাতিকতা সকল জাতির স্বকীয়তা বজায় রেখে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ যখন সঠিক পথে পরিচালিত হয় তখন একে অপরের সহায়ক হিসেবে কাজ করে।

আধুনিক কালে জাতীয়তাবাদ বহুলাংশে আন্তর্জাতিকতাবাদে রূপ লাভ করেছে। মানুষ নিজের প্রয়োজনের তাগিদে আন্তর্জাতিকতার ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হচ্ছে। মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারিত হওয়ার ফলে জাতীয়তাবাদী চেতনার সাথে আন্তর্জাতিক চিন্তাভাবনাও সম্প্রসারিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা জাতিসংঘ (UN.O) এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। বিশ্বের অধিকাংশ জাতি কোন না কোন জোটের অন্তর্ভুক্ত। বিদ্যুৎ নির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশ্বকে অতিদ্রুত আজ একে অপরের নিকটে এনে দিচ্ছে।

জাতীয়তাবাদের একটি উগ্র বা বিকৃত রূপ রয়েছে যা বিভেদ ও সংঘাতে ভরপুর। জাতীয়তাবাদ যখন চরমভাবে আত্মপ্রকাশ করে তখন জাতিতে জাতিতে সংঘর্ষ ও হানাহানি শুরু হয়। জাতীয়তাবাদের বিকৃত রূপ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ। অতীতে জাতীয়তাবাদের দোহাই দিয়ে হিটলার ও মুসোলিনী বিশ্বের বুকে ধ্বংসযজ্ঞের সূচনা করে বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত করেছিল। তাই বলা যায়, জাতীয়তাবাদের চরম রূপ আন্তর্জাতিকতার পরিপন্থী। উগ্র জাতীয়তাবাদকে কেন্দ্র করেই সংঘটিত হয়েছিল প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। উগ্র জাতীয়তাবাদকে বিশ্বসভ্যতার প্রতি হুমকি স্বরূপ মনে করা হয়।

আরো পড়ুন: সামাজিক অপরাধ প্রতিরোধে ইসলামের শাস্তির বিধান

লাঙ্কির আন্তর্জাতিকতাবাদ তত্ত্ব

অধ্যাপক লাস্কি বলেন যে, জাতীয় সার্বভৌম রাষ্ট্রের ধারণা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিভেদ ও বৈষম্যের সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন জাতির মধ্যে সৃষ্টি করেছে শত্রুতা। রাষ্ট্রের এই ধারণাই লীগ অব নেশনসকে ধ্বংস করেছে। এমনকি জাতিসংঘের কার্যক্রমকেও দারুণভাবে ব্যাহত করেছে। অধ্যাপক লাস্কি তার Grammar of Politics গ্রন্থে বলেন, "নিরঙ্কুশ, স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের ধারণার সঙ্গে মানবজাতির সার্বিক স্বার্থের কোন সঙ্গতি খুঁজে পাওয়া যায় না।" কারণ এই রাষ্ট্র নাগরিকদের কাছ থেকে শর্তহীন আনুগত্য দাবী করে। তিনি বলেন, "কোন রাষ্ট্র নয়, বরং বিশ্বই হচ্ছে মানুষের যথার্থ আনুগত্যের দাবীদার।" বর্তমানে বিশ্বে এমন অনেক সমস্যা বিদ্যমান যা কোন একক রাষ্ট্রের পক্ষে সমাধান সম্ভব নয়। ঐক্যবদ্ধ বিশ্বই এই সমস্যার সমাধান করতে পারে। ঐক্যবদ্ধ বিশ্ব সংস্থা বলতে তিনি এমন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থাকে বোঝাতে চেয়েছেন যেখানে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের অধিকাংশই জাতীয়-রাষ্ট্রের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে। লাস্কি তার আন্তর্জাতিকতাবাদ তত্ত্বে দেশাত্মবোধ ও দেশপ্রেমকে একটি স্বাভাবিক ও সহজাত প্রবৃত্তি বলে স্বীকার করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, খাঁটি আন্তর্জাতিকতাবাদী হতে হলে প্রত্যেকটি মানুষকে খাঁটি জাতীয়তাবাদী হতে হবে।

বিশ্ব সভ্যতায় জাতীয়তাবাদের সুফল ও কুফল

জাতীয়তাবাদের প্রভাবে বিশ্ব সভ্যতা কখনো ত্বরান্বিত হয়েছে আবার কখনো অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফলে বিশ্বের বহু নির্যাতিত জাতি রাজনৈতিকভাবে সজাগ ও সচেতন হয়েছে এবং স্বাধীনতা অর্জন করেছে। বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের অনুপ্রেরণায় সংগঠিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ এর উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত। জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনে এবং জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে বিশ্বের মানবসমাজকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদের প্রেরণায় পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্র আবার শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। জাতীয়তাবাদের জয়গান গেয়ে জার্মান দার্শনিক হেগেল এবং ইতালীর দার্শনিক ম্যাকিয়েভেলী জাতীয়-রাষ্ট্রকে মানবীয় সংগঠনের শ্রেষ্ঠতম ফল বলে প্রচার করেছেন। চিন্তাবিদ হায়েস বলেন যে, জাতীয়তাবাদ যখন দেশপ্রেমের সুমহান আদর্শের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে তখন তা বিশ্বসভ্যতার জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ হয়ে উঠে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ক্রমবিকাশে জাতীয়তাবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। জাতীয়তাবাদ জাতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অক্ষুন্ন রেখে বিশ্বসভ্যতার প্রসার ঘটিয়েছে। জাতীয়তাবাদের সমর্থকগণ মনে করেন যে, বিশ্বসংস্কৃতির ধারক ও বাহক হচ্ছে জাতীয়তাবাদ। উনিশ শতকের শেষের দিকে জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্র ধর্মে পরিণত হয়।

জাতীয়তাবাদের উল্লেখযোগ্য গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও এর বিকৃত রূপ খুবই ভয়ংকর। আর এ কারণে মানব সভ্যতা বারবার হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার 'Nationalism' গ্রন্থে জাতীয়তাবাদকে নিন্দা করেছেন। তিনি বলেন, "জাতীয়তাবাদ হল রাষ্ট্রনীতির কুচক্র স্বার্থপ্রণোদিত রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা।" এটা শেষ পর্যন্ত নিপীড়ক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।

রাষ্ট্রচিন্তাবিদ লেনিন তাঁর' সাম্রাজ্যবাদ' গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, পুঁজিবাদ নিজের স্বার্থ সংরক্ষণার্থে দেশের জনসাধারণকে জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করে সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়ানক রূপে ব্যবহার করে।

জাতীয়তাবাদ বিশ্বজুড়ে অনৈক্য ও বিভেদের সৃষ্টি করেছে। এক রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্য রাষ্ট্রের এবং জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ ও ঘৃণার জন্ম দিয়েছে। অর্থনৈতিক দিক দিয়েও জাতীয়তাবাদ সভ্যতার পরিপন্থী। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ একদিকে ক্ষুধার তাড়নায় জর্জরিত, অন্যদিকে চলছে মারণাস্ত্রের চরম প্রতিযোগিতা। এভাবে মানবিক মূল্যবোধ ও মানবতা লাঞ্ছিত ও পদদলিত। জাতীয়তাবাদ অনেক সময় গোঁড়ামীর জন্ম দেয়। মনুষ্যত্ব থেকে মানুষকে পশুত্বে নিক্ষেপ করে। সেখানে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও চিন্তার স্বাধীনতা থাকেনা।

সারকথা

জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের মধ্য দিয়ে মানব সভ্যতা উগ্র জাতীয়তাবাদের চরম বিপর্যয়। থেকে রক্ষা পেতে পারে। জাতীয়তাবাদকে পবিত্র মানবিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

জাতীয়তাবাদ হচ্ছে একটি চেতনা বা অনুভূতি। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই উদ্ভব হয়েছে জাতীয় রাষ্ট্রের। জাতীয় রাষ্ট্র গঠনই জাতীয়তাবাদের চরম স্বার্থকতা।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url