সার্বভৌমত্ব কি প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য সার্বভৌমত্বের বিকাশধারা
সার্বভৌমত্বের কি প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা বলতে পারবেন। সার্বভৌমত্বের প্রকৃতি বা স্বরূপ বর্ণনা করতে পারবেন। সার্বভৌমত্বের-অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক দিক সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। প্রাচীন যুগের সার্বভৌমত্বের ধারণা সম্পর্কে আধুনিক বলতে পারবেন। জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভবের ফলে সার্বভৌম ক্ষমতা প্রকৃতি ও ধরন সম্পর্কে আলোনা করতে পারবেন।
ভূমিকা
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হচ্ছে সার্বভৌমত্ব। রাষ্ট্র গঠনের জন্য যে সব মৌল উপাদান প্রয়োজন সার্বভৌমত্ব তাদের মধ্যে অন্যতম। সার্বভৌমত্বকে রাষ্ট্র নামক রাজনৈতিক সংগঠনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু বলা হয়ে থাকে। এটি এমন এক ক্ষমতা যার ফলে নাগরিক ও অন্যান্য সংঘ রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে এবং সে সাথে রাষ্ট্র কোন বৈদেশিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত ও স্বাধীন থাকে।
রাষ্ট্রকে যদি দেহের সঙ্গে তুলনা করা যায় তাহলে রাষ্ট্র নামক দেহের প্রাণ হচ্ছে সার্বভৌমত্ব। কাজেই এর স্বরূপ বা প্রকৃতি এবং অবয়ব সম্পর্কে আমাদের ধারণা থাকা একান্ত আবশ্যক। যুগে যুগে সার্বভৌমত্বের ধারণা পরিবর্তিত হয়েছে এবং আধুনিক কালে এসে এ ধারণা এক চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করেছে। এ ইউনিটে আমরা সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা, স্বরূপ বা প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য, বিভিন্ন তত্ত্ব ও মতবাদ, সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করতে সচেষ্ট হয়েছি।
আরো পড়ুন: জাতীয়তাবাদ কি জাতীয়তাবাদের বিকাশ আন্তর্জাতিকতাবাদ কি ও বিশ্বসভ্যতা
সার্বভৌমত্ব কি
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হচ্ছে সার্বভৌমত্ব। সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ক্ষমতাকে নির্দেশ করে। এটি রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সার্বভৌমত্ব ছাড়া রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কল্পনা করা সম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও স্বরূপ বহুলাংশে সার্বভৌম ক্ষমতার প্রকৃতি ও অবস্থানের উপর নির্ভর করে।
বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উইলোবী (Willoughby) সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, "রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ইচ্ছাই হলো সার্বভৌমত্ব" (Sovereignty is the ultimate will of the state) আধ্যাপক বার্জেস (Burgess) এর মতে, সার্বভৌমত্ব হচ্ছে "প্রত্যেক প্রজার এবং প্রজাদের সব ধরনের সংঘের উপর মৌলিক, চরম, অসীম ও সর্বাত্মক ক্ষমতা"। ব্যাকষ্টোনের কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, "সার্বভৌম ক্ষমতা সর্বোচ্চ, অপ্রতিরোধ্য, চূড়ান্ত ও অনিয়ন্ত্রিত কর্তৃত্বকে বোঝায়”। (Sovereign power means the supreme, irresistable, absolute and uncontrolled authority)
ফরাসী দার্শনিক জ্যান বদিন (Jean Bodin) সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা নির্দেশ করেছেন এভাবে-নাগরিক ও প্রজাদের উপর আরোপিত রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ও আইন দ্বারা অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা হচ্ছে সার্বভৌম ক্ষমতা।" এছাড়াও অপর একজন ফরাসী লেখক দুগুইয়ের (Duguit) মতে, সার্বভৌম ক্ষমতা রাষ্ট্রের আদেশ প্রদান করার ক্ষমতা, এটি রাষ্ট্র হিসেবে সংগঠিত জাতির ইচ্ছাস্বরূপ, এটি রাষ্ট্রাভ্যন্তরে সকল ব্যক্তিকে নিঃশর্ত আদেশ প্রদান করার ইচ্ছা।"
সার্বভৌমত্বের উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করলে এটি স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, সার্বভৌম ক্ষমতা রাষ্ট্রের চরম ও পরম ক্ষমতা। এটি রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ক্ষমতা। যার স্বরূপ পরিবর্তনের সাথে রাষ্ট্রের প্রকৃতির পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
সার্বভৌমত্বের দু'টো দিক রয়েছে অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব এবং বাহ্যিক সার্বভৌমত্ব। অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের সেই চূড়ান্ত ক্ষমতা যার ফলে রাষ্ট্র সকল নাগরিক ও সংঘের কাছ থেকে আনুগত্য দাবি করতে পারে। এটি রাষ্ট্রের চূড়ান্ত আইনগত কর্তৃত্ব নির্দেশ করে।
আরো পড়ুন: নাগরিকতা কি নাগরিকতা অর্জন ও বিলুপ্তির গুণাবলী প্রকারভদ অধিকার ও কর্তব্যে
অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সার্বভৌমত্ব
অভ্যন্তরীণ সার্বভৌম বলতে বুঝায় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরস্থ অর্থাৎ নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ডের মধ্যে সব কিছুর উপর সর্বময় কর্তৃত্ব। অপরদিকে, বাহ্যিক সার্বভৌমত্ব অনুসারে রাষ্ট্র অপর কোন বৈদেশিক রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ও আধিপত্য থেকে মুক্ত ও স্বাধীন। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে অবশ্যই বিদেশের সঙ্গে চুক্তি ও সন্ধির ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকতে হবে। অন্যথায় এর সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন হতে বাধ্য। শুধু তাই নয় পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণের বেলায়ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের ইচ্ছাই থাকবে চূড়ান্ত। এক কথায় বাহ্যিক সার্বভৌমত্বের অর্থ হচ্ছে জাতীয় স্বাধীনতা। অধ্যাপক লাস্কী তাই বলেছেন, "আধুনিক রাষ্ট্র সার্বভৌম রাষ্ট্র। অন্যান্য সম্প্রদায় হতে এটি স্বাধীন। এটি তার নিজস্ব ইচ্ছাকে সত্যিকার অর্থে অন্যান্য অভ্যন্তরীণ সম্প্রদায়ের উপর আরোপ করতে পারে যা অপর কোন বাহ্যিক শক্তি দ্বারা প্রভাবিত হবে না।
সার্বভৌম ক্ষমতার সাথে রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগ ক্ষমতার (Coercive power) সামঞ্জস্য বিদ্যমান। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সরকার নাগরিকদের রাষ্ট্রীয় আইন ও বিধি বিধান মেনে চলতে বাধ্য করতে পারে। কাজেই রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা রক্ষা এবং আইন প্রবর্তন ও প্রয়োগের যে পূর্ণ ক্ষমতা তাকেই সার্বভৌম ক্ষমতা বলে আখ্যায়িত করা যায়। সকল নাগরিকই সার্বভৌম ক্ষমতার অধীন।
সার্বভৌমত্বের বৈশিষ্ট্
সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে এর কতিপয় বৈশিষ্ট্য প্রতিভাত হয়ে উঠে। বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ:
• সর্বজনীনতা: সার্বভৌমত্বের ধারণা সর্বজনীন। রাষ্ট্রের সকল ব্যক্তি ও সংঘ এর অধীন। এটি চিরন্তন। এতদসত্বেও সার্বভৌম ক্ষমতা আইন দ্বারা সীমিত।
• চরমতা: সার্বভৌম ক্ষমতা চরম ও চূড়ান্ত ক্ষমতা। রাষ্ট্রের আদেশ ও নিষেধ সকল নাগরিকের জন্য অবশ্য পালনীয়। অন্যকোন শক্তিই রাষ্ট্রের এ ক্ষমতার উপর হস্তক্ষেপ করতে পারে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বন্ধুন্টলী (Bluntschli) অবশ্য বলেন যে, রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা বাহ্যিক দিক দিয়ে অপরাপর রাষ্ট্রের অধিকার এবং অভ্যন্তরীণ দিক দিয়ে এর নিজস্ব প্রকৃতি ও ব্যক্তিবর্গের অধিকার দ্বারা সীমিত।
• অবিভাজ্যতা: সার্বভৌমত্বের অপর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, এটিকে বিভক্ত করা সম্ভবপর নয়। আমরা জানি যে, ঐক্যবদ্ধ জনসমাজই রাষ্ট্র, আর সে জন্য সার্বভৌম ক্ষমতাকে বিভক্ত করলে জনসমষ্টি ঐক্যসূত্রে গ্রথিত হয়ে জনসমাজে পরিণত হতে পারে না।
• হস্তান্তর অযোগ্যতা: সার্বভৌম ক্ষমতা হস্তান্তরের অযোগ্য। অর্থাৎ একে হস্তান্তর করা যায় না। সার্বভৌম ক্ষমতা রাষ্ট্রের প্রাণস্বরূপ, এ ক্ষমতার উপরই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নির্ভরশীল। এর অনুপস্থিতি ঘটলে রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটে। কোন রাষ্ট্রের পক্ষে এ ক্ষমতা হস্তান্তর করা আত্মহত্যারই সামিল।
• স্থায়ীত্ব: স্থায়ীত্ব সার্বভৌমত্বের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সাথে সার্বভৌমত্বের অস্তিত্ব বিদ্যমান। সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিবর্গের পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু এতে করে সার্বভৌমত্বের বিলুপ্তি ঘটে না।
• এককত্ব: সার্বভৌম ক্ষমতা একক ক্ষমতা। রাষ্ট্রের মধ্যে কেবলমাত্র একটি সার্বভৌম ক্ষমতা থাকতে পারে। একই রাষ্ট্রের একাধিক সার্বভৌম ক্ষমতা থাকা সম্ভবও নয়, বাঞ্ছনীয়ও নয়। একক সার্বভৌম ক্ষমতার অভাবে রাষ্ট্রের সংহতি, ঐক্য এবং স্থায়িত্ব বিনষ্ট হবে এটাই স্বাভাবিক। অবশ্য বহুত্ববাদীরা ভিন্ন কথা বলেন।
• ব্যাপকতা: রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সার্বভৌম ক্ষমতা সর্বত্রই বিরাজমান। সার্বভৌম ক্ষমতা রাষ্ট্রের মধ্যকার সকল ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং প্রতিষ্ঠানের উপর সমভাবে প্রযোজ্য। আইন অমান্য করে রাষ্ট্র কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উপর নিজের ইচ্ছ্য চাপিয়ে দিতে পারে না।
আরো পড়ুন: রাষ্ট্রবিজ্ঞান কি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি বা বিষয়বস্তু
সার্বভৌমত্বের বিকাশধারা
সার্বভৌমত্বের বিকাশ ধীরে ধীরে সাধিত হয়েছে। যদিও প্রাচীন যুগে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সম্পর্কে বিভিন্ন দার্শনিক তাঁদের রাষ্ট্র দর্শনে আলোচনা করেছেন তবু কেউই সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোন ধারণা ব্যক্ত করেন নি। গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল অবশ্য আইনের সার্বভৌমত্বের কথা বলেছেন। তিনিই সর্বপ্রথম রাষ্ট্রের ক্ষমতার কথা বলেছেন। তথাপি তার এ ধারণা তখন তেমন সুস্পষ্ট হয়ে উঠে নি। অবশ্য প্রাচীন রোমে সার্বভৌমত্বের ধারণা অপেক্ষাকৃত অধিক পরিমাণে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যখন রোমান চিন্তাবিদগণ জনগণকে সার্বভৌম ক্ষমতার উৎসরূপে বর্ণনা করতে সচেষ্ট হন।
মধ্যযুগে এসে সার্বভৌমত্বের উপরোক্ত ধারণা পুনরায় স্থবির হয়ে যেতে থাকে। কেননা, তখন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা গীর্জার পোপ এবং সামন্তবাদীদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদিকে সম্রাট এবং অপরদিকে গীর্জার পোপের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এতে শেষ পর্যন্ত সম্রাট জয় লাভ করলে জনগণ সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে থাকে। ধীরে ধীরে সম্রাটের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রসার ঘটতে থাকে। মধ্যযুগের অবসানাস্তে জনগণ মুক্তি পাগল হয়ে উঠলে ওকহ্যামের ইউলিয়ম (William of Ocham) এবং পাদুয়ার মার্সিলিও (Marsilio of Padua)-এর মত চিন্তাবিদদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় জনগণের সার্বভৌমত্বের কথা।
ইউরোপে নবজাগরণের সূচনার সঙ্গে সঙ্গে সম্রাটের নেতৃত্বে জাতি রাষ্ট্র (Nation State) গঠনের উদ্যোগ সফলকাম হয়। আর সেই সঙ্গে সার্বভৌম ক্ষমতার উদ্ভব ঘটে। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক যুগের শুরুতে তথা ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভে জাতি রাষ্ট্র ও সার্বভৌম ক্ষমতা পরিপূর্ণতা লাভ করে।
ষোড়শ শতাব্দীতে ইটালিতে মেকিয়াভেলীর (Machiavelli) রাষ্ট্রচিন্তার মধ্য দিয়ে আধুনিক জাতি রাষ্ট্র তথা সার্বভৌমত্বের ধারণা বিকাশিত হয়। মেকিয়াভেলী নিরঙ্কুশ সার্বভৌম ক্ষমতার সমর্থক ছিলেন। তৎকালীন ইটালীরভৌগলিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা অবলোকন করে তিনি সংযুক্ত ইটালি এবং শক্তিশালী জাতি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তিনি সকল প্রকার গণতান্ত্রিক পথ পরিহার করে এক স্বৈরাচারী ও নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের মতবাদ প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করতে পরামর্শ দেন। মেকিয়াভেলী সে জন্য সার্বভৌম শাসককে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী করেন। তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার একটি বিশেষ দিক হলো তিনি উদ্দেশ্যের মাধ্যমে যে কোন কাজের মূল্যায়ন করা যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করেন। এ ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি সার্বভৌম শাসককে ইটালির একত্রীকরণ ও শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে যে কোন অন্যায় আচরণ, বিশ্বাসঘাতকতা করার পরামর্শ প্রদান করেন। এ ভাবে মেকিয়াভেলী আধুনিক রাজনৈতিক দর্শনে সার্বভৌমত্বের ব্যাখ্যা দেন এবং তাঁর দর্শনে তিনি শাসককে চরম সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী করে তোলেন।
মেকিয়াভেলীর অব্যবহিত পরেই ফ্রান্সে জিন বদিনের (Jean Bodin) আবির্ভাব ঘটে (১৫৩০-১৫৯৬ খ্রীঃ) তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা পান্ডিত্যবাদ ও রক্ষণশীলতার প্রতিভূ হওয়া সত্বেও রেনেসাঁর অনুপ্রেরণায় তিনি বাস্তব রাষ্ট্রনীতির ভিত্তিতে এ শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন।
বদিনের মতে সার্বভৌম ক্ষমতার উপস্থিতি রাষ্ট্রকে অন্যান্য সংঘ থেকে পৃথক করে এবং সে অনুসারে তিনি নাগরিকতাকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধীন বলে মনে করেন। সার্বভৌমত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বদিন বলেন, "আইনের প্রতিবন্ধকতা ব্যতীত নাগরিক ও প্রজাদের উপর সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকারই হচ্ছে সার্বভৌমত্ব" "Sovereignty is the supreme power over citizens and subjects unrestrained by the laws'। এ ধারণা থেকে সার্বভৌমত্বের দু'টো রূপ স্পষ্ট হয়ে উঠে। প্রথমত, এ ক্ষমতা বলে রাষ্ট্র অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সকল ব্যক্তি ও সংঘের উপর চরম ক্ষমতা প্রয়োগ করতে সক্ষম। দ্বিতীয়ত: এ ক্ষমতার মাধ্যমে রাষ্ট্র সব ধরনের বৈদেশিক নিয়ন্ত্রণ ও আক্রমণ থেকে নিজেকে মুক্ত ও স্বাধীন রাখতে সক্ষম।
জিন বদিনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সপ্তদশ শতাব্দীর ইংরেজ দার্শনিক টমাস হবস সার্বভৌমত্বের ধারণাকে অধিকতর সুস্পষ্ট ও প্রাণবন্ত করে তোলেন। তাঁর মতে, জনগণ যেহেতু চুক্তির মাধ্যমে তাদের সকল অধিকার একজন ব্যাক্তির হাতে ছেড়ে দিয়েছে কাজেই সেই ব্যক্তি তার ইচ্ছানুসারে রাষ্ট্রীয় শাসনকার্য পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করেন। অর্থাৎ তিনি হবেন সার্বভৌম শক্তির আধার। এই সার্বভৌম শক্তির বিরুদ্ধে জনগণ কোনরূপ অভিযোগ করতে পারবে না এবং সার্বভৌম শাসককে ক্ষমতাচুাতও করতে পারবে না। এ ভাবে হবস সার্বভৌম শাসকের হাতকে অত্যন্ত শক্তিশালী করতে এবং তাকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী করতে বলেন।
হবসের অব্যবহিত পরে সপ্তদশ শতাব্দীর অপর একজন ইংরেজ দার্শনিক জন লক সার্বভৌত্ব সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ধারণা ব্যক্ত করেন। প্রকৃতপক্ষে লকের সামাজিক চুক্তির স্বরূপ থেকেই সার্বভৌম ক্ষমতার স্বরূপ প্রতিভাত হয়ে উঠে। তাঁর সামাজিক চুক্তির বিশ্লেষণ থেকে এটি স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, এ চুক্তি প্রথমত সমগ্র জনগণের মধ্যে এবং দ্বিতীয়ত তা জনগণ এবং শাসকের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। এতে করে শাসক যেহেতু চুক্তির অংশে পরিণত হন কাজেই তাঁর পক্ষে আর স্বৈরাচারী হয়ে উঠা সম্ভবপর ছিল না। কেননা জনগণ তাদের হাতে শাসককে ক্ষমতাড়াত করার ক্ষমতা রেখে দিল। ফলে শাসক জনগণের নিকট দায়ী থাকতে বাধ্য হলেন। এ ভাবে তার রাষ্ট্রদর্শনে সার্বভৌম শাসককে জনগণের সম্মতির উপর নির্ভরশীল করে তোলেন।
অতঃপর অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফবাসী দার্শনিক রুশোর রাষ্ট্র দর্শনে সার্বভৌম ক্ষমতার ধারণা অধিকতর স্পষ্ট হয়ে উঠে। এ ক্ষেত্রে তিনি জন লককে অনেকাংশে অনুসরণ করেন। রুশো জনগণকে সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস বলে ঘোষণা করেন। তার মতে, সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট রাজনৈতিক সমাজই প্রকৃতপক্ষে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে সকলেই তাদের অধিকার সকলের নিকট সমর্পণ করে এবং 'সাধারণ ইচ্ছার' অধীনে আসে যা মানুষের প্রকৃত ইচ্ছার সমষ্টি। রুশোর মতে, এই 'সাধারণ ইচ্ছাই' হলো সার্বভৌম। আর সাধারণ ইচ্ছা হলো সকলের কল্যাণের লক্ষ্যে পরিচালিত ইচ্ছা।
এভাবে প্রাচীন গ্রীক যুগ থেকে শুরু করে মধ্যযুগ পেরিয়ে আধুনিক যুগে এসে লাভ করেছে। সে সার্বভৌমত্ব তার পরিপূর্ণ অবয়বে। বিকাশ
সারকথা
সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ক্ষমতার নির্দেশক। অর্থাৎ রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ইচ্ছাই সার্বভৌমত্ব। এ ক্ষমতার দু'টো দিক রয়েছে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক। এ ক্ষমতা বলেই রাষ্ট্র সকল নাগরিক ও সংঘের কাছ থেকে আনুগত্য দাবি করতে পারে আবার রাষ্ট্র উপর অন্য কোন বৈদেশিক রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ও আধিপত্য হতে মুক্ত ও স্বাধীন থাকতে পারে। সর্বজনীনতা, চরমতা, অবিভাজ্যতা, হস্তান্তর অযোগ্যতা, স্থায়ীত্ব, ব্যাপকতা ইত্যাদি সার্বভেৌমত্বের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ঠ।
সার্বভৌম ক্ষমতার বিকাশ একদিনে হঠাৎ করে সাধিত হয় নি। এর বিকাশ ধারায় সুদীর্ঘ সময়। এ লেগেছে। প্রাচীন যুগে সার্বভৌমত্বের ধারণা তেমন স্পষ্ট হয়ে উঠে নি। রোমান যুগে তা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠলেও ও মধ্যযুগের সূচনায় তা ধুনিককালে জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভবের স্থবির হয়ে পড়ে। অবশ্য ক্রমে তা এক সুনির্দিষ্ট রূপ পরিগ্রহ করতে থাকে। তবে আধুনিককালে জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভনের ফলে সার্বভৌমত্বের ধারণা পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url