সাম্যে কি সাম্যের প্রকারভেদ সাম্য ও স্বাধীনতা

সাম্যের সংজ্ঞা বলতে পারবেন,সাম্যের প্রকারভেদ করতে পারবেন, সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক নির্ণয় করতে পারবেন, সাম্যের উপস্থিতি যে স্বাধীনতার জন্য কতটুকু অপরিহার্য সে বিষয়ে ধারণা লাভ করতে পারবেন।


সাম্যের সংজ্ঞা

স্বাধীনতার মত সাম্যও আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার এক মহান আদর্শ। সাধারণ অর্থে সাম্য বলতে বোঝায় যে, সমাজের সকল মানুষই পরস্পর সমান এবং অভিন্ন। মানুষে মানুষে কোন পার্থক্য নেই, নেই কোন ভেদাভেদ। জন্মগতভাবে সকল মানুষই সমান।

১৭৭৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণায় বলা হয়েছে যে, সকল মানুষই সমান হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। অনুরূপভাবে ১৭৮৯ সালে ফরাসী পার্লামেন্টের মানবাধিকার ঘোষণায়ও বলা হয়েছে যে, মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে এবং তারা তাদের অধিকারও নিয়ত স্বাধীন ও সমানভাবে ভোগ করবে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সীমাহীন ও অনিয়ন্ত্রিত সাম্যের কোন স্থান নেই। বাস্তব জীবনেও সীমাহীন ও অবারিত সাম্যের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। বাস্তব জীবনে বরং মানুষে মানুষে অধিক মাত্রায় পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। কেবল কর্মশক্তি আর বিদ্যা-বুদ্ধিতেই নয়, দৈহিক গঠন ও আকার-আকৃতির দিক থেকেও মানুষে মানুষে পার্থক্য পরিদৃষ্ট হয়। এমনকি একই পিতা-মাতার ঔরসজাত দু'টো শিশুর মধ্যেও দৈহিক আকৃতি, শক্তি ও মননের দিক থেকে ভিন্নতা থাকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে উভয়ের বুদ্ধি, জ্ঞান ও ক্ষমতার দিক থেকে পার্থক্যও বাড়তে থাকে। কাজেই একথা বলা যায় যে, মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই অসম।

উনবিংশ শতাব্দীর উদারনৈতিক দার্শনিকগণ আইনের চোখে সকলের সমতা, ভোট প্রদান ও নির্বাচিত হওয়ার সমঅধিকার এবং সামাজিক ক্ষেত্রে সমান সুযোগ লাভের অধিকারকে সাম্য বলে মনে করতেন। আধুনিককালে গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক ধারণার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে সাম্যের অর্থও ব্যাপকতর হয়ে উঠে। সাম্য বলতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও সকলের সমান অধিকারের উপস্থিতি নির্দেশ করে। অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তির নিজ নিজ ব্যক্তিত্ব বিকাশের পরিপূর্ণ সুযোগ থাকার অর্থই হলো সাম্য। অন্যভাবে বলা যায়, সাম্যের অর্থ হলো জন্ম, বংশ, সামাজিক পদমর্যাদা ও স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে কোন বিশেষ সুযোগ-সুবিধার অনুপস্থিতি।

আরো পড়ুন: আইনের সংজ্ঞা, উৎস, তাৎপর্য ও শ্রেণীবিভাগ

সাম্যের প্রকারভেদ

সাম্যের বিভিন্ন রূপ রয়েছে। আর এ বিভিন্ন রূপের ধারণা ও প্রকৃতি থেকে সাম্যের যথাযথ স্বরূপ ও প্রকৃতি উপলব্ধি করা যায়। নিম্নে সেগুলো উল্লেখ করা হলোঃ

• প্রাকৃতিক সাম্য: প্রকৃতি সকল মানুষকে সমানভাবে সৃষ্টি করে নি। বিভিন্ন দিক থেকে মানুষে মানুষে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও লক্ষ্য রাখা উচিত যাতে করে সমাজে বসবাসকারী মানুষ কোনরূপ কৃত্রিম বৈষম্য সৃষ্টি না করে। কোন প্রকার কৃত্রিম বৈষম্য থাকলে সমাজে সাম্যের উপলব্ধি ব্যাহত হতে বাধ্য।

• আইনগত সাম্য: রাষ্ট্রীয় আইনের অধীনে মানুষ যে সমান অধিকার ভোগ করে সেটিই আইনগত সাম্য নামে অভিহিত। আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান এটিই হলো আইনগত সাম্যের প্রকৃত অর্থ। রাষ্ট্রের আইন যদি সকলকে সমান দৃষ্টিতে দেখে তাহলেই আইনগত সাম্য বিদ্যমান আছে বলে মনে করা যায়। অবশ্য আইনগত সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য সামাজিক বৈষম্যের অপসারণ করাও একান্ত প্রয়োজন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে আইন সকলের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য

• নাগরিক সাম্য: রাষ্ট্রের সকল নাগরিক যখন সমানভাবে নাগরিক স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার ভোগ করার সুযোগ লাভ করে তখনই নাগরিক সাম্যের অস্তিত্ব আছে বলে ধরে নেয়া যায়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সম্পদ, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশিষে এ সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হয়। রাষ্ট্র কোন নাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করলে নাগরিক সাম্য ব্যাহত হতে বাধ্য।

• সামাজিক সাম্য: সামাজিক সাম্য সমাজের মধ্যে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য সমান সামাজিক সুযোগ-সুবিধাদির উপস্থিতি নির্দেশ করে। সামাজিক ক্ষেত্রে কোনরূপ বিশেষ সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান থাকবে না এটিই সামাজিক সাম্যের মূল কথা। রাষ্ট্র ও সমাজ কারও জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদান করবে না।

• রাজনৈতিক সাম্য: সকল নাগরিকের সমান রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করার সুযোগ-সুবিধার উপস্থিতি নির্দেশ করে রাজনৈতিক সাম্য। সকল নাগরিক যাতেকরে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারে তা নিশ্চিত করা উচিত। উপযুক্ত যোগ্যতা সাপেক্ষে প্রতিটি নাগরিকেরই ভোট প্রদানের অধিকার, নির্বাচিত হওয়ার অধিকার, সরকারী চাকুরী লাভের অধিকার ইত্যাদি ক্ষেত্রে সমান সুযোগ থাকা একান্ত আবশ্যক'। অন্যথায় রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া সুদূরপরাহত।

• অর্থনৈতিক সাম্য: অর্থনৈতিক সাম্য বলতে বোঝায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের সমান অধিকারের উপস্থিতি। রাষ্ট্রের সকল সম্পদের উপর জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশষে সকল নাগরিকের সমান অধিকার থাকবে। এক্ষেত্রে কোন ভেদাভেদ থাকবে না। প্রকৃতপক্ষে অর্থনৈতিক সাম্য সকল প্রকার অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান ঘটাতে সচেষ্ট হয়। সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য বিরাজমান থাকলে প্রকৃত সাম্যের উপলব্ধি সম্ভবপর হয় না। এর ফলে কেবল বিত্তবানরাই সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে আর বিত্তহীনরা সকল দিক থেকে হয় বঞ্চিত। বস্তুত অর্থনৈতিক সাম্য ব্যতীত রাজনৈতিক সাম্য অর্থহীন হয়ে পড়ে।

আরো পড়ুন: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংঙ্গা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের  প্রকৃতি

সাম্য ও স্বাধীনতা

সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। সাম্য ছাড়া স্বাধীনতা হয়ে পড়ে অর্থহীন। প্রকৃতপক্ষে জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও সাম্য পাশাপাশি অবস্থান গ্রহণ করে। এতদসত্ত্বেও সাম্য ও স্বাধীনতা সর্বকালে এবং সর্বস্থানে সমানভাবে গৃহীত হয় নি। কখনো কখনো কোন সমাজে স্বাধীনতার উপর অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে; আবার কখনো বা সাম্যের উপর বেশী গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সাম্য ও স্বাধীনতার এ পার্থক্য বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্র চিন্তার বিকাশ, প্রসার এবং জাতিগত বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়।

সাম্য ও স্বাধীনতার পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুটো পরস্পর বিরোধী মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। একটি মতবাদ অনুসারে বলা হয় যে, সাম্য স্বাধীনতাকে সীমিত করে। আর অপর মতবাদ অনুসারে বলা হয় যে, অসমতা স্বাধীনতাকে সীমিত করে। এ দু'টো পরস্পর বিরোধী অভিমতকে ঢেলে সাজালে যা দাঁড়ায় তাহল:

ক. 'স্বাধীনতা ও সাম্য পরস্পর বিরোধী' ('Liberty and equality are antithetical")

খ. 'স্বাধীনতা ও সাম্য পরস্পর সম্পূরক' ('Laiberty and equality are complementary)

ক. স্বাধীনতা ও সাম্য পরস্পর বিরোধী এবং আপোসহীন। একটির উপস্থিতি অপরটির মৃত্যু ঘটায়। লর্ড এ্যাকটন (Lord Acton) এ মতবাদে বিশ্বাসী। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, সাম্য ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। তাঁর নিজের কথায়, "সাম্যের আকাঙ্ক্ষা স্বাধীনতার আশাকে ব্যর্থ করে দেয়।" (The passion for equality makes vain the hope for liberty) তাঁর মতে, প্রকৃতিগতভাবেই মানুষে মানুষে অসমতা বিরাজমান। কাজেই সমাজে সাম্যের উপস্থিতি আশা করা বাতুলতা মাত্র।

বলা বাহুল্য, লর্ড এ্যাকটেনের এ মতবাদ গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা, তাঁর মতানুসারে স্বাধীনতার অর্থ দাঁড়ায় নিয়ন্ত্রণবিহীন স্বাধীনতা যা প্রকৃত প্রস্তাবে স্বেচ্ছারিতারই নামান্তর। আর সাম্য বলতে বোঝায় সুযোগের সমতা; সকল মানুষ সমান তা নয়।

খ. উপরোক্ত মতবাদের বিপরীতে যে মতবাদটি সুপ্রচলিত ও বহুলভাবে সমর্থিত সেটি হচ্ছে 'স্বাধীনতা ও সাম্য পরস্পর সম্পূরক। অর্থাৎ সাম্য ও স্বধীনতা পরস্পর বিরোধী নয়। একটি অপরটির পথে অন্তরায় তো নয়ই বরং উভয়ে পরস্পর সহায়ক ও সম্পূরক। স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করলে দেখা যায় যে, অন্যের অনুরূপ স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করে স্বীয় ইচ্ছানুসারে সবকিছু বরার যে ক্ষমতা সেটিই স্বাধীনতা। কাজেই এটি স্পষ্ট যে, সাম্য ব্যতীত স্বাধীনতা কার্যকর হতে পারে না। অসাম্য স্বাধীনতার অন্তরায় এবং এর বিনষ্টকারী। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠিত না হলে নাগরিক স্বাধীনতা বিনষ্ট হতে বাধ্য। জি, ডি, এইচ, কোল (G. D. H. Cole) এবং আর, এইচ টনী (R. H. Tawny) উভয়ে এ মতবাদে বিশ্বাসী। তাঁরা সাম্যের উপস্থিতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রকান্ত অপরিহার্য বলে মনে করেন। হার্বার্ট এ, ডীন (Herbert A. Deane) যথার্থই বলেন, "স্বাধীনতা ও সাম্য একে অপরের বিরোধী নয়, এমনকি এ দুটো পরস্পর বিচ্ছিন্নও নয় বরং একই আদর্শের ভিন্ন বিষয় মাত্র।" "Liberty and equality are not in conflict nor even separate but are different facts of the same ideal" বস্তুত স্বাধীনতা ও সাম্য পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং সহায়ক এ ধারণাই সর্বজনস্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য। আধুনিক গণতান্ত্রিক যুগে এটি এক অনন্য সত্য।

সারকথা

সাধারণ অর্থে সাম্য বলতে সকল মানুষই পরস্পর সমান একথা বোঝায়। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এ ধরনের সীমাহীন ও অনিয়ন্ত্রিত সাম্যের কোন স্থান নেই। বরং প্রত্যেক ব্যক্তির নিজ নিজ ব্যক্তিত্ব বিকাশের পরিপূর্ণ সুযোগ থাকার অর্থই হচ্ছে সাম্য। অর্থাৎ সাম্য মানে জন্ম, বংশ, সামাজিক পদমর্যাদা ও স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য সমান সুযোগ- সুবিধার উপস্থিতি। এককথায় সাম্য হচ্ছে সুযোগের সমতা।

সাম্যের বিভিন্ন রূপ রয়েছে। যেমন- প্রাকৃতিক সাম্য, নাগরিক সাম্য, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সাম্য। মনে রাখা প্রয়োজন যে, অর্থনৈতিক বৈষম্য সমাজে বিরাজমান থাকলে রাজনৈতিক সাম্য অর্থহীন হয়ে পড়ে। সাম্য ও স্বাধীনতার মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগসূত্রে পরিলক্ষিত হয়। উভয়ে পরস্পর সহায়ক ও সম্পূরক।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url