জাতি কি জাতীয়তার সংজ্ঞা ও উপাদান সমূহ
আজ এই আর্টিকেলটিতে জাতীয়তা কি তা ব্যাখ্যা করতে পারবেন, জাতীয়তার সংজ্ঞা দিতে পারবেন, জাতীয়তার উপাদানগুলো বর্ণনা করতে পারবেন।
ভূমিকা
জাতি হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত এক জনসমাজ। জাতীয়তাবোধ সম্পন্ন জনসমষ্টি রাজনৈতিক সংগঠনের সংস্পর্শে এসে জাতি রাষ্ট্রে পরিণত হয়। জাতীয়তা ঐক্যবোধের এক বিশেষ অনুভূতি। এই অনুভূতিই মানবজাতির একটি অংশকে আর একটি অংশ থেকে আলাদা করে। জাতির ভাব হচ্ছে জাতীয়তাবাদ। যে সব আদর্শ, চিন্তা ও ধ্যান- ধারণা মানব সমাজকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে জাতীয়তাবাদ তাদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই উদ্ভব হয়েছে আধুনিক রাষ্ট্রের। জাতীয়তাবাদ আধুনিককালের রাজনীতির প্রধান চালিকা শক্তি।
আরো পড়ুন: সাম্যে কি সাম্যের প্রকারভেদ সাম্য ও স্বাধীনতা
জাতি কি
জাতি একটি বাস্তব ধারণা। একটি জাতীয় জনসমাজের মধ্যে যখন রাজনৈতিক চেতনা গভীর হয়ে উঠে তখন জাতির উদ্ভব ঘটে। জাতি বলতে একটি রাষ্ট্রে বসবাসকারী রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন জনসমাজকে বুঝায়। জাতি ও জাতীয়তা শব্দ দুটির ইংরেজী প্রতিশব্দ Nation ও Nationality। ল্যাটিন শব্দ Natio ও Natus থেকে এদের উৎপত্তি হয়েছে। এর অর্থ জন্ম। উৎপত্তির দিক দিয়ে জাতি ও জাতীয়তা বলতে একই বংশোদ্ভূত জনসমষ্টিকে বুঝায়। কিন্তু সাধারণত জাতি ও রাষ্ট্রকে একই অর্থে ব্যবহার করা হয়।
লর্ড ব্রাইস সুন্দরভাবে জাতির সংজ্ঞা নির্দেশ করেছেন। তাঁর মতে, "জাতি হচ্ছে রাজনৈতিক ভাবে সংগঠিত এমন এক জনসমাজ যা স্বাধীন বা স্বাধীন হতে সচেষ্ট।" ম্যাকাইভার জাতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, "জাতি হল ঐতিহাসিক পরিস্থিতির দ্বারা সৃষ্ট, আধ্যাত্ম চেতনার দ্বারা সমর্থিত, একত্রে বসবাস করার মনোভাবসম্পন্ন জনসমাজ, যারা নিজেদের জন্য সাধারণ শাসন ব্যবস্থা গঠন করতে চায়।" রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্জেসের মতে, "একই ভূখন্ডে বসবাসকারী কোন জনসমাজ একই ভাষা-সাহিত্য, একই ইতিহাস ও ঐতিহ্য, আচার ব্যবহার, ন্যায়-অন্যায়বোধ, সুখ-দুঃখের সমচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয় তখন তাকে জাতি বলে।"
সুতরাং জাতি বলতে কতকগুলো সাধারণ ঐক্যবোধে আবদ্ধ ও সংগঠিত জনগোষ্ঠীকে বুঝায়।
আরো পড়ুন: আইনের সংজ্ঞা, উৎস, তাৎপর্য ও শ্রেণীবিভাগ
জাতীয়তার সংজ্ঞা ও উপাদান
জাতীয়তা একটি মানসিক ধারণা। ফরাসী চিন্তাবিদ রেনান বলেন, "জাতীয়তা একটি সজীব মানসিকতা"। অধ্যাপক লাস্কি বলেন, "জাতীয়তা একটি মানসিকতার ব্যাপার যা তাদেরকে অবশিষ্ট মানবজাতি থেকে আলাদা করে।" তিনি আরও বলেন, "জাতীয়তার ভাব সাধারণভাবে আধ্যাত্মিক ব্যাপার। জাতীয়তা মূলত মানসিক ঐক্যবোধ।
জাতি ও জাতীয়তার উৎপত্তি একই উৎস হতে। জাতীয়তার একাধিক উপাদান রয়েছে। জাতীয়তার বাহ্যিক উপাদানগুলো হল: বংশগত ঐক্য, ভৌগোলিক ঐক্য, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ধর্ম, ইতিহাস-ঐতিহ্য ইত্যাদি। জাতীয়তার গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো নিম্নরূপ:
• ভৌগোলিক ঐক্য: জাতি গঠনের জন্য কোন জন সমষ্টিকে একটি সুনির্দিষ্ট ভূখন্ডে বসবাস করতে হয়। রামজে ম্যুর উল্লেখ করেন যে, একটি স্বতন্ত্র জাতি সাধারণত একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডে বসবাস করে। দীর্ঘ দিন যাবত একটি ভূখন্ডে বাস করার ফলে একটি জনসমাজ তাদের মতপার্থক্য দূর করে এক এবং অভিন্ন ভাবধারায় গড়ে উঠে। এটা জাতীয়তার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তবে বিভিন্ন দেশে বসবাস করেও একই জাতীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে পারে এমনও দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রয়েছে। যেমন, ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হবার পূর্বে ইহুদীরা বিভিন্ন দেশে বসবাস করেও মানসিক ঐক্যসূত্রে বাঁধা ছিল এবং একটি জনসমাজ বলে পরিগণিত হত। ভৌগোলিক দূরত্ব এবং বিচ্ছিন্নতা জাতীয়তাবাদের প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে।
• বংশগত ঐক্য: রক্তের সম্পর্ক পরস্পরকে ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করে এবং মানুষের মধ্যে একাত্মতার বন্ধন সৃষ্টি করে। বংশগত ঐক্য জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে। তবে নৃতত্ত্ববিদগণ জাতি গঠনে বংশগত ঐক্যকে একান্ত অপরিহার্য উপাদান বলে মনে করেন না। যেমন আরব জাতি একই বংশোদ্ভূত হয়েও একটি জাতিতে পরিণত হতে পারে নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বহু বংশের লোকের বসবাস সত্ত্বেও তারা একই জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ এবং অনুপ্রাণিত।
ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐক্য: ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ভাব প্রকাশের বাহন হিসেবে কাজ করে। ভাবের আদান প্রদান জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন বাঙালির জাতীয় চেতনায় অগ্রণী ও তাৎপর্যমন্ডিত অবদান রেখেছিল। তবে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মধ্যেও জাতীয়তাবোধ গড়ে উঠতে পারে। সুইজারল্যান্ড ও বেলজিয়ামের জনগণ কয়েকটি ভাষায় কথা বললেও তারা জাতীয়তাবোধে ঐক্যবদ্ধ। অন্যদিকে আরব দেশলোর ভাষা আরবি হওয়া সত্ত্বেও তারা একটি জাতিতে পরিণত হয় নি। তবে এটা সত্য যে, ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি জাতীয়তা গঠনের একটি শক্তিশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
• ধর্মীয় ঐক্য: ধর্মীয় অনুভূতি এবং বিশ্বাস থেকে অনেক জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। একই ধর্মে বিশ্বাসী লোকদের মধ্যে সহজে ঐক্যবোধ গড়ে উঠে। ১৯৪৭ সালে ইসলাম ধর্মকে কেন্দ্র করে ভারত উপমহাদেশের মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েম করেছিল। আবার ইহুদী ধর্মের ভিত্তিতে জন্ম হয়েছিল ইসরাইল রাষ্ট্রের। তবে ভৌগলিকভাবে সংলগ্ন একই ধর্মের মানুষের মধ্যেও জাতিবোধ থাকতে পারে। আরব দেশগুলো তার উদাহরণ।
ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ঐক্য: জাতীয়তাবোধ একটি মানসিক সত্ত্বা। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মধ্যে এর সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। জে, এস, মিল ও রামজে ম্যুর ইতিহাস ও ঐতিহ্যগত ঐক্যকে জাতীয়তার আবশ্যক উপাদান হিসেবে বর্ণনা করেছেন। জাতীয় উত্থান, অতীতের গৌরব, জয়-পরাজয় জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করে। সুতরাং কোন জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা জাতীয়তা গঠনে বলিষ্ঠ-ভূমিকা পালন করে। যেমন ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনে খুবই তাৎপর্যমন্ডিত ঘটনা। এটা জাতীয়তাবোধের ভাবধারা সৃষ্টি করেছে।
• রাজনৈতিক ঐক্য: রাজনৈতিক সামাজিকীরণের ফলে একক এবং অভিন্ন রাজনৈতিক কৃষ্টির বিকাশ ঘটে। একই রাজনৈতিক বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা ও আকাঙ্ক্ষা একটি জনসমাজকে শক্তিশালী জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করে। যেমন ১৯৬৬ সালের ছয় দফা ভিত্তিক স্বায়ত্ত শাসনের দাবি বাঙালিদেরকে পৃথক জাতিসত্ত্বার প্রকাশ ঘটাতে অনুপ্রাণিত করে ছিল।
• ভাবগত ঐক্য: জাতীয় ঐক্য মূলত ভাবগত। ভাবগত ঐক্য জাতীয়তাবাদের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অধ্যাপক স্পেংগলার-এর বক্তব্য খুবই প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, "জাতীয়তার উপাদান কুলগত বা ভাষাগত ঐক্য নয়। বরং তা ভাবগত ঐক্য"। (The element of nationalism is neither biological, nor linguistic unity, but a spiritual unity.)
সারকথা
জাতি বলতে একটি রাষ্ট্রে বসবাসকারী রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন জনসমাজকে বুঝায়। জাতিগঠনের জন্য কোন জনসমস্টিকে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাস করতে হয়। ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, ধর্ম, সাহিত্য সাংস্কৃতি জাতিগঠনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url