নাগরিকতা কি নাগরিকতা অর্জন ও বিলুপ্তির গুণাবলী প্রকারভদ অধিকার ও কর্তব্যে
নাগরিকতার প্রকৃত অর্থ কি তা বলতে পারবেন, নাগরিকতা অর্জন ও বিলুপ্তির পদ্ধতি আলোচনা করতে পারবেন, নাগরিকতার গুণাবলী সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারবেন, নাগরিক অধিকারের প্রকারভেদ করতে পারবেন, নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্যের সম্পর্ক কি তা ব্যাখ্যা পারবেন।
ভূমিকা
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নাগরিকতা এবং সে সম্পর্কিত জ্ঞান। প্রকৃতপক্ষে নাগরিকের ধারণা পরিবর্তিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাগরিকতার ধারণা এবং অবয়বও পরিবর্তিত হয়েছে। অতীতে গ্রিক নগর-রাষ্ট্রে নাগরিক বলা হতো সে ব্যক্তিকে যে নগররাষ্ট্রের এবং এর সাংগঠনিক কার্যে অংশগ্রহণ করত।
নাগরিকতার এ ধারণা আধুনিককালে সম্পূর্ণ অচল বলে পরিগণিত হয়েছে। আধুনিক বিশাল আয়তন বিশিষ্ট এবং বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত জাতীয় রাষ্ট্রে সকলের পক্ষে প্রত্যক্ষভাবে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করা সম্ভব নয়। কাজেই বর্তমানে নাগরিক ও নাগরিকতার ধারণা পরিবর্তিত হয়েছে। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তাই বলেন, সে ব্যক্তিই নাগরিক যে কোন রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করে, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য পোষণ করে, রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করে এবং রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে। এ সবকিছু নাগরিকদেরকে রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে বিশেষ মর্যাদা দান করে যাকে বলা যায় তার রাজনেতিক পদমর্যাদা। অধ্যাপক কেলসন (Kelson) যথার্থই বলেছেন, "রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে কোন ব্যক্তির পদমর্যাদাই নাগরিকতা।"
অধ্যাপক কেলসনের মত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গেটেল (Gattell) বলেন যে, "নাগরিক হচ্ছে সেই ব্যক্তিবর্গ যারা কতিপয় দায়িত্ব ও কর্তব্যের বন্ধনে আবদ্ধ এবং আনুগত্যের মাধ্যমে তার সুযোগ-সুবিধায় সমভাবে অংশীদার।" অধ্যাপক লাস্কী (Laski) তাই অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেন, "সর্বজনীন সুযোগ-সুবিধা ও কল্যাণের জন্য ব্যক্তির বিচার-বুদ্ধি যথাযথ প্রয়োগই হলো নাগরিকতা।"
নাগরিকতার অর্থ
অতি সম্প্রতি নাগরিকতার এ ধারণা ও অবয়বকে আরো অধিক পরিমাণে সম্প্রসারিত করে দেখার প্রচেষ্টা গৃহীত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে মিন্নিসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু'জন অধ্যাপক কোগান (Kogan) ও কুবোও (Kubow) তাঁদের এক আন্তঃজাতীয় এবং আন্তঃকৃষ্টিক গবেষণা কর্মে নাগরিক ও নাগরিকতার সাধারণ সংজ্ঞা ও কার্যকর সংজ্ঞা দিয়েছেন। তাঁদের সাধারণ সংজ্ঞানুসারে "নাগরিক হচ্ছে সমাজের একজন প্রয়োজনীয় সদস্য" "a constituent member of society"। আর পক্ষান্তরে "নাগরিকতা হচ্ছে নাগরিক হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কতিপয় বৈশিষ্ট্যের সমষ্টি।" "a set of characteristics of being a citizen."
নাগরিকতার এই সাধারণ সংজ্ঞা এর কার্যকরী সংজ্ঞার দিকে আমাদেরকে ধাবিত করে। এই সংজ্ঞানুসারে 'নাগরিকতা নাগরিকদের এমন কতিপয় বৈশিষ্ট্যের সমষ্টিকে নির্দেশ করে যার মধ্যে রয়েছে স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের শিক্ষাগত, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক-কৃষ্টিক দিক।' বলা বাহুল্য, আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাগুলো তাদের সুষ্ঠ কার্যক্রমের জন্য নাগরিকতার যথাযথ ধারণার উপর নির্ভর করে। এ ধারণা কোন দেশের সংবিধান, অধিকার বিল বা এ ধরনের অন্য কোন দলিলের মধ্যে সুস্পষ্টভাবে বিরাজ করতে পারে কিংবা তা জাতীয় প্রতিষ্ঠানাদি, দেশাচার বা ঐতিহ্যের মধ্যে সুপ্তভাবে থাতে পারে। তবে সচরাচর নাগরিকতার ধারণা এ দুইয়েরই এক সমন্বিত রূপ। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে নাগরিকতার ধারণা অবশ্যই জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও আচার-আচরণকে অন্তর্ভুক্ত করে যা আদর্শিকভাবে প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে থাকা উচিত।
আরো পড়ুন: রাষ্ট্রবিজ্ঞান কি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি বা বিষয়বস্তু
নাগরিকতা সম্পর্কে এরিস্টটলের ধারণা
গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল প্রদত্ত নাগরিকতার ধারণা তার 'দি পলিটিক্স' গ্রন্থে আলোচ্য বিষয়াদির মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য একটি বিষয়। তার মতে, কোন একটি রাষ্ট্রে জনন্মগ্রহণ করা, বসবাস করা বা বৈধ অধিকার ভোগ করা এগুলোর কোনটা নাগরিক তথা নাগরিকতার প্রকৃত অর্থ প্রদান করে না। এসবকে যদি নাগরিকতার সূচক হিসেবে ধরে নেয়া হয় তাহলে বিদেশী এবং দাস, শ্রমজীবী এবং কারিগর কাউকেই নাগরিকতা থেকে বাদ দেয়া যায় না। কিন্তু এরিস্টটল এদের কাউকেই নাগরিক বলেননি। অবশ্য তিনি গ্রীক নগররাষ্ট্রের আদর্শকে সামনে রেখে নাগরিকতার অর্থ প্রদান করেছেন। কাজেই, তার মতে 'সেই ব্যক্তিই নাগরিক যে বিচার সংক্রান্ত কাজে এবং শাসন সংস্থার সদস্য হিসেবে আইন সংক্রান্ত কাজে এবং রাষ্ট্রীয় সভার আলোচনায় অংশগ্রহণ করে।'। "A citizen is he who participates in the administration of justice and in legislation as a member of the governing body and takes part in the deliberation of state assemblies'
এরিস্টটলের নাগরিকতার ধারণা কেবলমাত্র ভোট প্রদান ক্ষমতার উপরই প্রতিষ্ঠিত নয়, এটি রাষ্ট্রীয় দায়-দায়িত্ব পালনের উপরও সমানভাবে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর মতে, নাগরিকতা হলো সার্বভৌম ক্ষমতা কার্যকরী করার ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ। এরিস্টটল প্রাচীন গ্রীসের বিধান অনুসারে বিদেশী, দাস এবং মহিলাদেরকে নাগরিক অধিকার প্রদানের পক্ষপাতী ছিলেন না। এছাড়া শ্রমজীবী এবং কারিগর শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গকেও তিনি নাগরিকতার আওতার বাইরে রেখেছেন।
এরিস্টটলের মতে, যাদের হাতে আইন, শাসন ও বিচার সংক্রান্ত কাজের ভার অর্পণ করা হবে তাদের সনাক্ত করার উপায় হলো তারা হবেন অত্যন্ত উন্নতমানের নৈতিকতা ও বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। তার প্রধান গুণ হবে ব্যবহারিক প্রজ্ঞা (Practical Wisdom)। আর এগুণ যেহেতু রাষ্ট্রের সকল অধিবাসীর মধ্যে পাওয়া সম্ভব নয় কাজেই সকল অধিবাসী নাগরিক হবার উপযুক্ত নয়। এছাড়া নাগরিক হতে হলে তাদের হাতে প্রচুর অবসর (Leisure) থাকা আবশ্যক যাতেকরে তারা রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ এবং রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনার সুযোগ লাভ করতে পারেন।
এরিস্টটল যুক্তি দিয়ে দেখান যে, কোন নির্দিষ্ট স্থানে বসবাস করলেই নাগরিকতা লাভ করা যায় না। যদি তাই হতো তাহলে বিদেশীরাও নাগরিক বলে গণ্য হতো। আবার আদালতে বিচার প্রার্থনা করার অধিকার ছাড়া অন্য কোন আইনগত অধিকার যে ব্যক্তি ভোগ করে না, সে ব্যক্তি প্রকৃত অর্থে নাগরিক নয়। এছাড়াও সকল অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু এবং বার্ধক্যজনিত কারণে অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিও নাগরিক হবার যোগ্যতা থেকে বঞ্চিত। এমনকি জন্মসূত্রেও নাগরিকতা অর্জন করা যায় না। নাগরিকতার প্রশ্নটিকে কেবল নাগরিকদের কার্যালীর মাধ্যমেই অনুধাবন করা যায়। এরিস্টটল মনে করেন যে, নাগরিক মাত্রেই রাজনৈতিক ভুবনের সক্রিয় সদস্য।
আরো পড়ুন: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংঙ্গা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি
নাগরিকতা অর্জনের পদ্ধতি
ইতোপূর্বে নাগরিকতা বলতে কি বোঝায় তা আমরা আলোচনা করেছি। নাগরিকতা কিভাবে লাভ করা যায় সে সম্পর্কে আমাদের জানা দরকার। দুটো ভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করে নাগরিকতা অর্জন করা যায়- ক. জন্মগত এবং খ. অনুমোদন সূত্রে। জন্মগতভাবে যারা নাগরিকতা অর্জন করে তাদেরকে বলা হয় জন্মসূত্রে নাগরিক। আর অনুমোদনের মাধ্যমে যারা নাগরিকতা অর্জন করে তাদেরকে বলা হয় অনুমোদনসূত্রে নাগরিক। নিম্নে এ দুটো পদ্ধতির উপর আলোকপাত করা হলো।
ক. জন্মসূত্রে নাগরিকতা অর্জন
জন্মসূত্রে নাগরিকতা অর্জনের ক্ষেত্রে আবার দুটো নীতি অনুসৃত হয়-১. জন্মনীতি এবং ২. জন্মস্থান নীতি। জন্মনীতি অনুসারে পিতা-মাতার নাগরিকত্বের দ্বারা সন্তানের নাগরিকত্ব নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ সন্তান যে দেশেই বা যে স্থানেই জন্মগ্রহণ করুক না কেন তার পিতামাতা যে দেশের নাগরিক সন্তানও সেই দেশের নাগরিক বলে পরিগণিত হবে। এই নীতি অনুসারে কোন বাংলাদেশী দম্পতির সন্তান বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের বাইরে জন্মগ্রহণ করলেও সে বাংলাদেশী নাগরিক বলে গণ্য হবে। ফ্রান্স, জাপান, ইটালি প্রভৃতি দেশ এই নীতি অনুসরণ করে। জন্মস্থাননীতি অনুসারে জন্মস্থানের মাধ্যমেই নাগরিকতা নির্ধারিত হয়। এই নীতি অনুসারে একজন শিশু যে দেশে জন্মগ্রহণ করবে সেই দেশেরই নাগরিকতা সে লাভ করবে। যদিও তার পিতা-মাতা অন্য দেশের নাগরিক। ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই নীতি অনুসৃত হয়।
খ. অনুমোদন সূত্রে নাগরিকতা অর্জন
অনুমোদনসূত্রে নাগরিকতা অর্জনের ক্ষেত্রে কতিপয় শর্ত পালন করতে হয়। শর্তগুলো হচ্ছে এরূপ- একজন ব্যক্তি যে রাষ্ট্রের নাগরিক হতে ইচ্ছুক সেই রাষ্ট্রের (অ) নাগরিককে বিয়ে করতে হয়, (আ) সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে হয়, (ই) সরকারি চাকরি করতে হয়, (ঈ) সম্পত্তি ক্রয় করতে হয়, (উ) সেই রাষ্ট্রের ভাষা জানতে হয়, (উ) সেই রাষ্ট্রে দীর্ঘকাল বসবাস করতে হয়।
কোন বিদেশীকে উপরোক্ত শর্তাদির এক বা একাধিক শর্ত পূরণ সাপেক্ষে অনুমোদনসূত্রে নাগরিকতা অর্জন করতে হলে তাকে যে রাষ্ট্রের নাগরিক হতে ইচ্ছুক সেই রাষ্ট্রের যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানাতে হয়। তবে দেশভেদে
শর্তাদির বিভিন্নতা বিদ্যমান রয়েছে। এছাড়াও কোন কোন সময় স্বদেশে নির্বাসিত হওয়ার ভয়ে যদি কোন ব্যক্তি অপর কোন দেশের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন তাহলে উক্ত দেশ তাকে নাগরিকত্ব প্রদান করে থাকে।
নাগরিকতা বিলুপ্তির কারণ
নাগরিকতা অর্জনের যেমনি কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে তেমনি আবার কয়েকটি কারণে এই নাগরিকতার বিলুপ্তি ঘটে।
এগুলো হচ্ছে নিম্নরূপ:
• স্বেচ্ছায় অধিকার বিসর্জন দিলে নাগরিকত্বের বিলুপ্তি ঘটে। অর্থাৎ যদি কোন নাগরিক স্বীয় ইচ্ছায় স্বীয় রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ত্যাগ করে অপর কোন রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে তাহলে তার পূর্ব নাগরিকত্ব লোপ পায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশের কোন নাগরিক যদি স্বেচ্ছায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে তাহলে তার বাংলাদেশের নাগরিকত্বের বিলুপ্তি ঘটবে।
• স্বীয় দেশ হতে দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকলে একজন নাগরিকের নাগরিকত্ব লোপ পেতে পারে।
• যদি কোন নাগরিক বিদেশী সরকারের অধীনে চাকরি গ্রহণ করে তাহলে সে তার স্বীয় রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব হারাতে পারে। তবে এক্ষেত্রে তা স্বীয় রাষ্ট্রের মনোভাবের উপর নির্ভর করে। এছাড়াও যখন কোন নাগরিক বিদেশের সেনাবাহিনীতে যোগদান করে বা বিদেশী রাষ্ট্রের উপাধি গ্রহণ করে তাহলে সে তার নিজস্ব রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব হারায়।
• এক রাষ্ট্রের স্ত্রীলোক যদি অন্য রাষ্ট্রের পুরুষকে বিয়ে করে তাহলে সেই স্ত্রীলোক নিজ দেশের নাগরিকত্ব হারায়। সেই স্ত্রীলোক তখন তার স্বামীর দেশের নাগরিকত্ব লাভ করে।
• একজন নাগরিক যখন স্বীয় রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, সংহতি এবং রাষ্ট্রীয় আদর্শের পরিপন্থী কোন কাজ করে তখন সে তার নিজ দেশের নাগরিকত্ব হারাতে পারে।
• যুদ্ধে জয়-পরাজয় এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় কোন চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমেও কোন ব্যক্তির নাগরিকত্ব লোপ পেয়ে থাকে। কোন বিজয়ী রাষ্ট্র যখন বিজিত রাষ্ট্রের কোন অংশ দখল করে নিয়ে তা স্বীয় রাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্ত করে ফেলে তখন দখলীকৃত অঞ্চলের জনগণ তাদের পূর্ববর্তী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব হারায়। এছাড়া চুক্তির মাধ্যমে কোন এলাকা বা অঞ্চল রাষ্ট্রের অর্ন্তগত হলে উক্ত এলাকা বা অঞ্চলের নাগরিকদের অপর রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করে থাকে।
• অনেক সময় উগ্র জাতীয়তাবোধের কারণে সরকার কর্তৃক বিতাড়িত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ তাদের স্বদেশের নাগরিকতা হারায়।
আরো পড়ুন: সামাজিক অনাচার প্রতিরোধে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা
নাগরিকতার গুণাবলী
যুক্তরাষ্ট্রের মিনিসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু'জন গবেষক মনে করেন যে, নাগরিকতার গুণাবলী রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রকৃতির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত। তবে সাধারণভাবে এসব গুণকে পাঁচটি গ্রুপে ভাগ করা যায়।
• একান্ততার ধারণা: নাগরিকতার এই উপাদানটি সচরাচর জাতীয় ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত হয়ে থাকে যদিও অনেক রাষ্ট্রেই একাধিক বা অনেকগুলো সম্পর্কযুক্ত একান্ততা বিদ্যমান থাকে যেমন স্থানীয়, গোত্রগত, কৃষ্টিগত, ধর্মীয় ও অন্যান্য। বিশেষকরে যেসব সমাজে বিভিন্ন কৃষ্টির অস্তিত্ব আছে সেখানে একান্ততার ধারণা যথেষ্ট ক্রিয়াশীল। যাহোক এই একান্ততার ধারণা থেকে উদ্ভূত হয় দেশপ্রেমের যা নাগরিকতার একটি আবশ্যকীয় উপাদান। তবে কোন কোন লেখক যুক্তি দেখান যে, কেবল জাতীয় নাগরিকতার ধারণা একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম নয় যখন সমগ্র বিশ্ব পরস্পর সংযুক্ত ও নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।
• অধিকার ভোগের ধারণা: নাগরিকতার দ্বিতীয় উপাদান হচ্ছে কতিপয় অধিকার ভোগ করা। নাগরিক হতে হলে কোন একটি গোষ্ঠীর সদস্য হতে হয় এবং উক্ত গোষ্ঠী কর্তৃক প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধাদি সে ভোগ করে। এই অর্থে নাগরিক মাত্রই বিদেশে ভ্রমণকালে নিজ সরকারের রক্ষণাবেক্ষণ দাবি করতে পারে। আর নিজ দেশে সে দেশের সংবিধান ও আইন অনুসারে তার অধিকার রক্ষার দাবি করতে পারে।
• কর্তব্য সম্পাদন: রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য সম্পাদন করা নাগরিকতার তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিক। কোন কোন লেখক মনে করেন যে, নাগরিকের অধিকার ভোগ করা কর্তব্য পালনকে অতিক্রম করে যায়। কাজেই নাগরিকদের কর্তব্য সম্পাদন করা গৌণ হয়ে পড়ে। নাগরিকরা কর্তব্য সম্পাদনে উদাসীনতা প্রদর্শন করে। যা হোক এটি সর্বজন স্বীকৃতি যে, নাগরিকতা অধিকার ভোগের পাশাপাশি কর্তব্য সম্পাদনের উপর জোর দেয়।
জনগণের কাজে অংশগ্রহণ: নাগরিকতার ধারণা জনগণের কাজে অংশগ্রহণের উপর গুরুত্বারোপ করে। একজন নাগরিককে ব্যক্তিগত জীবনে উত্তম কাজ করলেই চলে না তাকে রাষ্ট্রীয় তথা জনগণের কাজেও আত্মনিয়োগ করতে হয়।
• মৌল সামাজিক মূল্যবোধে আস্থা স্থাপন: এসব ঐক্যবোধ দেশভেদে বিভিন্ন হবে এটাই স্বাভাবিক। এগুলোকে কখনো কখনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংবিধানে উল্লেখ করা হয়। আবার কখনো অবর্ণিত অবস্থায় থাকে। তবে এদের অস্তিত্ব সর্বদাই অনুভূত হয়ে থকে। উদাহরণ হিসেবে বিশ্বাস, সহযোগিতা মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, অহিংসা প্রভৃতি উল্লেখ করা চলে। এই মৌলিক মূল্যবোধগুলো আদর্শ নাগরিকতার জন্য অপরিহার্য উপাদান হিসেবে স্বীকৃত।
আধুনিককালে নাগরিকতার এই পাঁচটি উপাদান নাগরিকতার ধারণাকে একমাত্রিক করার পরিবর্তে একে করেছে বহু মাত্রিক (Multidimensional)।
আরো পড়ুন: সামাজিক অপরাধ প্রতিরোধে ইসলামের শাস্তির বিধান
নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য
মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব। প্রতিটি নাগরিকই সমাজ ও রাষ্ট্রের সদস্য। এর বাইরে অবস্থান করে মানুষের পক্ষে সুন্দর ও সুখী জীবনযাপন করা সম্ভব নয়। সমাজ তথা রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে তারা কতিপয় অধিকার ভোগ করে এবং এসব অধিকারের বিপরীতে তাদেরকে রাষ্ট্রের প্রতি কতকগুলো কর্তব্য সম্পাদন করতে হয়।
রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে নাগরিকরা কি পরিমাণ অধিকার ভোগ করে তার উপরই প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের প্রকৃতি অনেকাংশে নির্ভর করে। অধ্যাপক লাস্কী (Laski) যথার্থই বলেছেন যে, "প্রতিটি রাষ্ট্রই এর অধিকার সংরক্ষণের দ্বারা পরিচিত হয়।" "Every state is known by the rights that it maintains" প্রকৃতপক্ষে আধুনিক রাষ্ট্রের মূল্যায়ন করা হয় নাগরিকদেরকে প্রদত্ত অধিকারের মাধ্যমে।
অধিকারের অর্থ
সাধারণভাবে বলতে গেলে বলা যায় যে, কোন অভিলাষ বা ইচ্ছা পূরণের শক্তি বা ক্ষমতা হলো অধিকার। কিন্তু আসলে ক্ষমতা ও অধিকার এক নয়। কেননা, ক্ষমতা এক ধরনের পাশবিক শক্তি নির্দেশ করে। আবার কোন কোন আইনজ্ঞ মনে করেন যে, রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্ট দাবি-দাওয়াই হলো অধিকার। কিন্তু আইনজ্ঞদের এ ধারণাও ঠিক নয়। কারণ, রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করে কোন ব্যক্তিকে হত্যা করার অভিলাষ কখনো অধিকার বলে পরিগণিত হতে পারে না। ক্ষমতা ও দাবি তখনই অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করবে যখন তা দিয়ে সামাজিক কল্যাণ সাধিত হবে। আমাদের অধিকার সমাজ বহির্ভুত বা সমাজ নিরপেক্ষ নয়। অধিকারের আসল প্রকৃতি হলো মূলত সমাজভিত্তিক।
নাগরিক কল্যাণ সাধনের শ্রেষ্ঠ সংস্থা হচ্ছে রাষ্ট্র। নাগরিকদেরকে যখন রাষ্ট্র তাদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের পূর্ণ সুযোগ প্রদান করে তখনই তারা অধিকার প্রাপ্ত হলো বলে মনে করা যায়।
অধিকারের প্রকারভেদ
অধিকারকে প্রথমত দু'ভাগে ভাগকরা যায়- নৈতিক অধিকার এবং আইনগত অধিকার। নৈতিক অধিকার মানুষের ন্যায়বোধ থেকে উৎসারিত, এ অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক প্রয়োগ করা হয় না। এ অধিকার অমান্য করলে রাষ্ট্র শাস্তি প্রদান করে না। পক্ষান্তরে, আইনগত অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদিত, স্বীকৃত এবং প্রযুক্ত হয়ে থাকে। এ অধিকারের লংঘনকারীকে রাষ্ট্র শাস্তি দিতে পারে।
আইনগত অধিকারকে আবার দু'ভাগে ভাগ করা যায় সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার। সামাজিক অধিকার বলতে সে সকল অধিকারকে বোঝায় যেগুলো ছাড়া মানুষ সমাজের সদস্য হিসেবে সুন্দর ও সভ্য জীবন যাপন করতে পারে না। জীবনের অধিকার, সংঘবদ্ধ হওয়ার অধিকার, স্বাধীন বিবেক ও ধর্মাচারণের অধিকার, শিক্ষা ভাষা ও সাংস্কৃতিক অধিকার, চুক্তির অধিকারে, আইনের দৃষ্টিতে সমানাধিকার ইত্যাদি নাগরিকদের সামাজিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।
এসব সামাজিক অধিকার ছাড়াও একজন নাগরিক আবার কতকগুলো রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করে। রাজনৈতিক অধিকার বলতে নাগরিকদের রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশ্রহণের সুযোগ-সুবিধাকে বোঝায়। ভোটাধিকার, নির্বাচিত হওয়ার অধিকার, সরকারী চাকুরী লাভের অধিকার, রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকার ইত্যাদি নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও বিদেশে নিরাপত্তার অধিকার, আবেদন করার অধিকার, বসবাসের অধিকার ইত্যাদিও রাজনৈতিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত।
নাগরিকের কর্তব্য
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে নাগরিকরা যেমন কতকগুলো অধিকার ভোগ করে তেমনি রাষ্ট্রের শাস্তি ও প্রগতির জন্য তাদেরকে আবার কতকগুলো কর্তব্যও পালন করতে হয়। বলা হয়ে থাকে যে, গণতান্ত্রিক সরকার যেমন অধিকার-প্রধান তেমনি তা কর্তব্য প্রধানও বটে। বলা বাহুল্য যে, রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদের যথাযথ কর্তব্য পালনের উপরই গণতন্ত্রের সাফল্য বহুলাংশে নির্ভরশীল।
কর্তব্যের প্রকারভেদ
অধিকারের মত নাগরিকদের কর্তব্যও প্রধাণত দু'প্রকার নৈতিক কর্তব্য এবং আইনগত কর্তব্য। নৈতিকতা নাগরিকদেরকে যেসব কর্তব্য পালনে উদ্বুদ্ধ করে সেগুলো হচ্ছে নৈতিক কর্তব্য। এগুলো রাষ্ট্র কর্তৃক সমর্থিত হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। পক্ষান্তরে আইনের অধীনে থেকে নাগরিকরা যে সকল কর্তব্য পালন করে এবং যেগুলো অবহেলা করলে তাদেরকে দণ্ড প্রদান করা হয় সেগুলো আইনগত কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। নাগরিকদের নৈতিক ও আইনগত কর্তব্যের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা, আইন মান্য করা, ভোটাধিকার ব্যবহার করা, সরকারী পদে অধিষ্ঠিত হওয়া, কর প্রদান করা, আইন-শৃঙ্খলায় সাহায্য করা প্রভৃতি। উপরন্তু নিজেদের সন্তান-সন্ততির শিক্ষাদান, বিভিন্ন ধরনের সেবামূলক কাজ এবং সমাজকল্যাণমূলক কাজ প্রভৃতিও নাগরিকদের কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত।
সারকথা
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নাগরিকতা। নাগরিকতার ধারণা সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে। অতীতে গ্রীক নগর রাষ্ট্রে সেই ব্যক্তিকেই নাগরিক বলে অভিহত করা হতো যে ব্যক্তি প্রত্যক্ষভাবে নগর-রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করত। কিন্তু আধুনিককালে নাগরিকতার এ ধারণা পরিবর্তিত হয়েছে। আধুনিক বিশালায়তন ও বিপুল জনসংখ্যা অধুষিত জাতীয় রাষ্ট্রে সকলের পক্ষে সরাসরি শাসন কার্যে অংশগ্রহণ করা সম্ভব নয়। কাজেই বর্তমানে সেই ব্যক্তিই নাগরিক যে কোন রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য পোষণ করে এবং রাষ্ট্র প্রদত্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করে ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে।
নাগরিকের বহুবিধ গুণের মধ্যে যে সব গুণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সেগুলো হচ্ছে- একাত্মতার ধারণা, অধিকার ভোগের ধারণা, কর্তব্য সম্পাদন, জনগণের কাজে অংশগ্রহণ, মৌল সামাজিক মূল্যবোধে আস্থা স্থাপন।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url