হযরত হুদ (আ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
আজ এই আটিকেলটিতে হযরত হুদ (আ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী আদ জাতি ধ্বংসের ঘটনা এবং হযরত হুদ (আ) এর মৃতু্র পরের ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো্।
পবিত্র কুরআনে হযরত হুদ (আ)-এর বর্ণনা
হযরত নূহ (আ)-এর বংশধরদের মধ্যে আদ নামক এক প্রবল ক্ষমতাশালী বাদশাহ ছিলেন। তার সমকক্ষ শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান ব্যক্তি সে যুগে অন্য আর কেউই ছিল না। এ বাদশাহর সন্তান-সন্ততি ও বংশধরগণও সবদিক দিয়ে শক্তিমান ও প্রতাপশালী ছিল। বাদশাহ আদের নামানুসারে এরা কওমে আদ বা আদ বংশীয় লোক নামে ইতিহাসে পরিচিত। এদের মধ্যে কোন কোন লোকের দেহের উচ্চতা ছিল চারশত গজ পর্যন্ত। এদের মধ্যম শ্রেণীর লোকদের উচ্চতা ছিল দু'শত গজ পর্যন্ত। আর যারা সবচেয়ে বেটে ছিল তাদের দেহ লম্বা ছিল সত্তর গজ পর্যন্ত। এরা সবাই যেমন ছিল সাহসী, তেমনই ছিল শক্তিশালী। সাহস ও শক্তির গৌরবে তারা আল্লাহ ও নবীকে ভুলে গিয়েছিল। কোন রকম সৎকাজের ধার ধারিত না; বরং শয়তানের কু-পরামর্শে দেবদেবীসমূহকে এবাদতের জন্য মনে করে তাদের মূর্তির পূজা করত।
আদ কওমের মধ্যে যখন এ অবস্থা প্রবল আকার ধারণ করল, তখন তাদেরকে হেদায়াত করার উদ্দেশ্যে আল্লাহ কওমে আদের মধ্য হতেই হুদ নামক এক ব্যক্তিকে আল্লাহ পাক নবীরূপে প্রেরণ করলেন; এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, আল্লাহ বলেন:
উচ্চারণঃ "অ ইলা আদিন আখাহুল হুদান ক্বালা ইয়া কাওমি' বুদুল্লাহা মা মালাকুম মিন ইলাহিন গাইরুহু ইন ইল্লা আনতুম মুফতারূন'।
অর্থাৎ আল্লাহ বলেন, আদ জাতির প্রতি তাদেরই বংশীয় ভাই হুদকে আমি নবীরূপে পাঠিয়েছিলাম। সে বলল, হে আমাদের স্বজাতীয়গণ! তোমরা এক আল্লাহর ইবাদাত কর, যিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন মাবুদ নেই। তোমরা এখন শুধু মিথ্যার উপরে রয়েছ।
কোরআনে পাকে আল্লাহ তায়ালা এর পরবর্তী ঘটনা উল্লেখ করেছেন। যথাঃ
কাযযাবাত আ'দুনিল মুরসালীন। ইয ক্বালা লাহুম আখুহুম হুদুন আলা তাত্তাকুন, ইন্নী লাকুম রাসূলুন আমিনুন। ফাত্তাকুল্লাহা অ আত্বীউন।'
অর্থাৎ আদ সম্প্রদায় পয়গাম্বরগণকে মিথ্যারোপ করল। যখন তাদের বংশীয় ভাই হুদ তাদেরকে বলল, তোমরা কি (আল্লাহকে) ভয় কর না? আমি তোমাদের জন্য বিশ্বস্ত নবী; সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার অনুগত হও।
এভাবে হুদ (আ) আদ জাতিকে আল্লাহর পথে আহ্বান করতে লাগলেন। তিনি তাদেরকে লক্ষ্য করে এভাবেও বলতেন:
উচ্চারণঃ 'কালু ইয়া হুদু মা জি'তানা বাইয়্যেনাতিউ অমা নাহনু বিতারিকি - আলিহাতিনা আন ক্বাওলিকা অমা নাহনু লাকা বিমু'মিনীন'।
অর্থাৎ 'হে হুদ! (তোমার খোদার সপক্ষে) তুমি কোন দলীল পত্র আন নি। আমরা শুধু মাত্র তোমার কথায়ই আমাদের উপাস্যগণকে ছেড়ে দিতে পারি না এবং তোমার কথায় বিশ্বাস আনতে পারি না।'
হযরত হুদ (আ) দীর্ঘদিন ধরে তাদেরকে পথে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করলেন; কিন্তু তাতে কোন ফলই হল না। মাত্র সত্তরজন লোককে তিনি কোনরূপে হেদায়াত করতে সক্ষম হলেন। তারাও কাফেরদের ভয়ে গোপনে আল্লাহর ইবাদাত করত, প্রকাশ্যে ইবাদাত করতে সাহস পেত না।
অবশ্য হুদ (আ) তবুও কাফেরগণকে একইভাবে ধর্মের পথে আহ্বান করতেছিলেন। আর আদ জাতি এভাবে তার উত্তর দিচ্ছিল, হে হুদ' তুমি কি আমাদের কাছে এ আশা করছ যে, আমরা তোমার কথামত বাপ-দাদার ধর্ম দেবদেবীর পূজা ত্যাগ করে এক খোদার উপাসনা করব? তা তুমি জেনে রাখ, আমরা তোমার খোদার এবাদত করব না। তুমি যে আমাদেরকে তোমার খোদার ভয় দেখাতেছ যদি তা সত্যিই হয়, তবে তা আমাদেরকে প্রত্যক্ষ করাও না কেন? না হলে আমরা তো তা বিশ্বাস করবই না; বরং আমরা তোমাকে জানে মেরে ফেলব।
আল্লাহ বলেন; -
অর্থাৎ : তোমার কি আমার সাথে ঐ সমস্ত মনগড়া নাম অর্থাৎ মূর্তি সমূহের সম্পর্কে ঝগড়া করছ? যাদেরকে তোমরা ও তোমাদের পূর্ব পুরুষেরা নিজের হাতে নির্মাণ করেছে। যাদের পুজনীয় হওয়ার পক্ষে তোমাদের নিকট আল্লাহ পাকের দেওয়া কোন নেই। এখন তোমরা অপেক্ষা কর, আল্লাহর আযাবের। আমিও তোমাদের সাথে প্রতীক্ষমান থাকব। (সূরা আ-রাফ-৭১)
হযরত হুদ (আ) এদের সম্পর্কে একেবারে নিরাশ হয়ে আল্লাহর দরবারে এরূপ দোয়া করলেন, 'হে মা'বুদ! এরা আমার কথার প্রতি ভ্রূক্ষেপই করছে না। বরং আমাকে প্রাণে মরার ভয় দেখাচ্ছে। আমার এমন শক্তিও নেই যে, আমি তাদের সাথে পেরে উঠব। তারা সকলেই আমার চেয়েও অধিক শক্তিশালী। আপনি আমাকে তাদের হাত হতে রক্ষা করুন।' বাদশাহ এমন বেশি শক্তির অধিকারী ছিল যে, সে যখন কোন পাথরের উপর দিয়ে হেটে যেত তার জানু পর্যন্ত ঐ পাথরের মধ্যে ডুবে যেত। শক্তির গর্বে আদ কওমের লোকেরা এরূপ বলত যে, কে আছে সারা জাহানের বুকে আমাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী?
হযরত হুদ (আ) তাঁর সত্তরজন মু'মিন উম্মত নিয়ে অন্য এলাকায় চলে যাওয়ার সময় আর একবার কাফেরদেরকে সত্যধর্মে আহ্বান করে বললেন, এখনও তোমরা আমার কথা মেনে নাও। না হলে কিন্তু অচিরেই তোমরা আল্লাহর গজবে ধ্বংস হয়ে যাবে।
আরো পড়ুন: হযরত ইলিয়াস (আ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
আদ জাতির ধ্বংসের ঘটনা
আদ জাতি হযরত হুদ (আ)-এর কথা শুনে তাকে ঠাট্টা ও বিদ্রূপ করল। যার ফলে আল্লাহ তায়ালা তাদের দেশে একাধারে তিন বছর বৃষ্টিপাত পর্যন্ত বন্ধ রাখলেন। দেশে কোন ফসলাদি জন্মিল না। ফলে সারাদেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। এমতাবস্থায় হযরত হুদ (আ) আবার তাদেরকে বললেন, হে আমার কওম! এখনও তোমরা তোমাদের প্রতিপালক মহান আল্লাহর নিকট গুনাহ হতে ক্ষমা ভিক্ষা চাও ও সৎপথে আস, তা হলে নিশ্চয়ই তিনি তোমাদের গুনাহ ক্ষমা করবেন ও তোমাদের প্রতি করুণার ধারা বর্ষণ করবেন।
জবাবে কাফেরগণ বলল, হুদ। আমরা তোমার কথায় বিশ্বাস করি না এবং তোমার খোদার প্রতিও আস্থা রাখি না, সুতরাং আমরা কোনভাবেই তওবাও করব না। একথার পর হযরত হুদ (আ)-এর আর তাদের কাছে কিছু বলার থাকল না।
আল্লাহর দরবার হতে আওয়াজ আসল। তোমরা আমার নিকট কি দোয়া করছ? মজীদ বলল, হে প্রভু! আমি যেন কোনদিন অনাহারী না থাকি আর লাকীম বলল, হে প্রভু! তুমি আমার আয়ু তিনহাজার বছর পর্যন্ত দীর্ঘ করে দাও। আল্লাহর তরফ হতে জওয়াব আসল, তোমাদের উভয়ের দোয়া কবুল করা হল।
তারপর কীল তার সত্তর হাজার সঙ্গী নিয়ে একত্রে দোয়া করল, ওহে প্রভু! আমাদের মধ্যে কখনও কারও রোগব্যাধি হয়নি যে, তোমার নিকট তার আরোগ্য দোয়া করব। আর নিজেও কখনও কোন বিপদে লিপ্ত হইনি যে, বিপদমুক্তির জন্য দোয়া জানাব। আমরা সকলে মিলে শুধু আদ জাতির জন্য তোমার নিকট বৃষ্টি কামনা করতে এসেছি।
তারা এভাবে দোয়া জানানোর অনুমান তিনঘণ্টা পরে আকাশের কোণে সাদা, কালো, লাল এ তিনবর্ণের মেঘ দেখা গেল।
মেঘের মধ্য হতে অদৃশ্য আওয়াজ শুনা গেল, হে কীল! এ তিন প্রকার মেঘের মধ্যে তুমি কোন প্রকার মেঘটিকে চাও?
কীল জানত যে, সাদা ও লাল মেঘে বৃষ্টিপাত হয় না; সুতরাং সে কালো মেঘকেই দোয়া করল। এরপর তারা মক্কা শরীফ হতে দেশে প্রস্থান করলে মেঘটিও তাদের সাথে সাথে চলল। একটু পরেই প্রবল ঝড় শুরু হল।
কাফেরগণ তখনও হযরত হুদ (আ)-কে বিদ্রূপ ও ঠাট্টা করতে ছাড়ল না। তারা বলল, হে হুদ! তুমি বলেছিলে যে, আমাদের প্রতি তোমার খোদার গজব নাযিল হবে, কিন্তু এখন কি দেখছ? শীঘ্রই বৃষ্টিপাত হয়ে আমাদের দেশে শান্তি ফিরে আসবে দুর্ভিক্ষ দূর হবে।
হযরত হুদ (আ) বললেন, 'আচ্ছা, তোমরা একটু ধৈর্যাবলম্বন কর।' এ কথা বলে তিনি তার উম্মতগণকে নিয়ে তাড়াতাড়ি সে স্থান ত্যাগ করলেন।
কিন্তু তারা মনে মনে যে ধারণাই পোষণ করুক না কেন, মুহূর্তের মধ্যে এমন প্রবল বেগে তুফান শুরু হল যে, দাম্ভিক আদ কওমের লোকদের সকল দাত মুহূর্তে ধূলিস্মাৎ হয়ে গেল। তাদের ঘর-বাড়ি প্রথম ঝাপটায়ই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। দ্বিতীয়বারে তাদের আশ্রয় জায়গা পাহাড়ের গুহাসমূহে বায়ু প্রবেশ করে তাদের সকলকে বাইরে উড়িয়ে এনে এমনভাবে আছাড় মারল যে, সাত লক্ষ মানুষের দেহগুলো যেন উৎপাটিত খেজুর গাছের মত নিষ্প্রাণদেহে ভূমিতলে পড়ে রইল।
তারপর প্রবল বায়ুর তান্ডব ধূলা-মাটি উড়িয়ে উক্ত লাশগুলোর উপরে এমনভাবে নিয়ে আসল যে, তাতে তারা চাপা পড়ে রইল।
এভাবে আদ জাতির প্রায় সমস্ত লোক আল্লাহর গজবে ধ্বংস হয়ে গেল এবং হযরত হুদ (আ) তার মুমিন উম্মতগণকে নিয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগলেন।
আরো পড়ুন: হযরত আইউব (আ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
হযরত হুদ (আ)-এর ইন্তেকালের পরে
কাফের আদ জাতির ধ্বংসের পরও হযরত হুদ (আ) চারশত বছর জীবিত ছিলেন। তারপর তিনি আল্লাহর মর্জী মোতাবেক নির্দিষ্ট সময়ে ইন্তেকাল করেন। হুদ (আ)-এর মৃত্যুর পরে তাঁর অনুসারী সত্যধর্মে প্রতিষ্ঠিত লোকজন প্রায় একশত বছর ধর্মকর্ম পালন করছিল।
এরপর একদিন পাপীষ্ঠ ইবলীস তাদের কাছে আগমন করে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কার ইবাদাত করছ? তারা জবাব দিল, আমরা একক নিরাকার আল্লাহর ইবাদাত করছি।
ইবলীস জিজ্ঞেস করল, তোমরা সে আল্লাহকে দেখতে পাও কি?
তারা উত্তর করল, না, আমরা তাকে কখনও দেখতে পাই না।
ইবলীস বলল, তবে তোমরা পাথরের দ্বারা আল্লাহর একটি মূর্তি তৈরি করে রেখে উপাসনা কর। তা হলে সে মূর্তিই রোজ কিয়ামতে তোমাদের জন্য আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করবে।
তারা বলল, কি রকম মূর্তি তৈরি করতে হবে তা তো আমাদের জানা নেই। তখন ইবলীস বলল, আচ্ছা, তা হলে তোমাদেয়াকে হযরত হুদের একটা মূর্তি তৈরি করে এনে দিচ্ছি। তোমরা প্রত্যেকে তদ্রূপ একটা করে মূর্তি বানিয়ে নিজ নিজ বাড়িতে রেখে তা সামনে রেখে উপাসনা করবে।
ইবলীস তাদেরকে একটা মূর্তি তৈরি করে দিল। তারা অতি যত্নের সাথে সেটিকে এক জায়গায় স্থাপন করে তার উপরে একটা বিরাট গম্বুজের ন্যায় তৈরি করল। এরপর দেশের সকলেই সে মূর্তিটিকে সিজদাহ করতে আরম্ভ করল।
এভাবে পাপীষ্ঠ ইবলীস আবার দুনিয়ায় নূতন করে মূর্তিপূজার প্রচলন শুরু করিয়ে দিল। বহুদিন এ অবস্থা চলার পর আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াবাসীকে হেদায়াত করার উদ্দেশ্যে হযরত ছালেহ (আ)-কে নবীরূপে পৃথিবীতে পাঠালেন।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url