হযরত শোয়ায়েব (আ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
আজ এই হযরত শোয়ায়েব (আ) এর বংশ পরিচয় হযরত শোয়ায়েব (আ) এর জাতি তার জাতির প্রতি আযাব ও তার ইন্তেকার সর্ম্পকে আলোচনা করা হলো।
হযরত শোয়ায়েব (আ) এর বংশ পরিচয়
হযরত শোয়ায়েব (আ) হযরত ছালেহ (আ)-এর বংশোদ্ভূত নবী ছিলেন। অবশ্য তাঁকে হযরত ইব্রাহীম খলীলুল্লাহ (আ)-এর বংশোদ্ভূত নবী বলেও বলা হয়ে থাকে। কেননা তিনি পারস্যের অন্তর্গত মাদইয়ান নগরীর নবী ছিলেন। মাদইয়ান নামকরণ হয়েছিল এভাবে যে, হযরত ইব্রাহীম (আ)-এর এক পুত্রের নাম ছিল মাদইয়ান আর সে মাদইয়ানের বংশোদ্ভূত নবী ছিলেন হযরত শোয়ায়েব (আ)। এদিক বিচার করে তাঁকে হযরত ইব্রাহীম (আ)-এর বংশোদ্ভূত নবী বলাই অধিক যুক্তিযুক্ত।
হযরত শোয়ায়েব (আ)-এর পিতার নাম ছিল কাহমিল। কাহমিলের পিতার নাম ছিল এছজার। এছজারের পিতার নাম ছিল মাদইয়ান এবং মাদইয়ান ছিলেন হযরত ইব্রাহীম খলীলুল্লাহর (আ) এক পুত্র। হযরত শোয়ায়েব (আ) নবীদের মধ্যে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল সুললিত। তিনি ভাষাজ্ঞানেও যথেষ্ট অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। নিজ দেশের ভাষা ব্যতীত অন্যান্য বহু দেশের ভাষায়ও তাঁর ব্যুৎপত্তি ছিল। অত্যন্ত বিশুদ্ধ ভাষায় তিনি ওয়াজ বক্তৃতা করতেন। এজন্যে আমাদের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স) হযরত শোয়ায়েবকে খতীবুল উম্মত বা নবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বক্তা নামে আখ্যাদান করেছেন।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত শোয়ায়েব (আ)-কে তাঁর নিজের কওমের মধ্যে ধর্ম প্রচার করতে পাঠিয়েছেন। কারণ ঐ যমানায় সেখানকার লোকজন বিভিন্ন পাপাচারে লিপ্ত ছিল। একটি মারাত্মক অন্যায় কাজ তথা বিক্রেতাগণ খরিদ্দারকে মাপে মাল কম দিয়ে তাদের নিকট হতে পুরা দাম আদায় করত। এছাড়া মাদইয়ানবাসীগণ দেশে জাল-মুদ্রা তৈরি করে তা ব্যাপকভাবে দেশে ছড়িয়ে দিত। ঐ সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে তখন চুরি ও ডাকাতি এবং লুণ্ঠনাদি ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছিল। আর ধর্মের দিক দিয়ে কওমের লোকজন প্রায় সকলেই দেব-দেবীর মূর্তিপূজা করত। আল্লাহকে তারা মানত, না এবং তাঁর নাখুশী শাস্তির ভয়ও করত না। হযরত শোয়ায়েব (আ) তাঁর এ ধরনের অসৎ ও পাপাচারী লোকদের মধ্যে হযরত ইব্রাহীম (আ)-এর ধর্ম প্রচার করতেন এবং তাদেরকে এরূপ নসিহত করতেন।
আারো পড়ুন: হযরত হুদ (আ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
হযরত শোয়ায়েব (আ)-এর জাতি
হযরত শোয়ায়েব (আ)-এর বলেন, তোমরা মাল ক্রয়-বিক্রয় করারকালে কারও নিকট হতে পুরাপুরি মূল্য আদায় করে মাপে তাকে মাল কম দিয়ে ঠকানোর নিয়ত করো না। কেননা এ আল্লাহ পাকের তরফ হতে কঠিন আযাব অবতীর্ণ হবার কারণ।
তাঁর এ প্রকার নসিহত ও হেদায়েতের ফলে বেশ কিছুসংখ্যক লোক সৎপথ অবলম্বন করে ধর্মকর্মে যথারীতি মনোনিবেশ করল; কিন্তু অধিক সংখ্যক লোকই তাদের কুপথ পরিত্যাগ করল না, অধিকন্তু অন্যান্য লোককে এরূপ বলতে লাগলঃ তোমরা কেউ শোয়ায়েবের নিকটবর্তী হইও না। সে যা বলে তার প্রতি আমল করো না। আমাদের মাল ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপারে আমরা যেমন ইচ্ছা তেমন করি, তাতে তার উপদেশ দেয়ার কি অধিকার? সে কি আমাদের কোন রাজা-বাদশাহ না কি যে, আমাদেরকে তার উপদেশ শুনতে হবে।
হযরত শোয়ায়েব (আ) এ সকল কথা শুনেও তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ না হয়ে বরং বলতে লাগলেন, দেখ!, তোমরা হযরত নূহ (আ), কওমে আদ, হযরত ছালেহ (আ), হযরত হুদ (আ) এবং কওমে লুতের যমানার ঘটনাগুলোর কথা স্মরণ কর যে, তাদের প্রতি আল্লাহর তরফ হতে কি কঠিন গজব নাযিল হয়েছিল। এখনও সময় আছে। এতদিন যা করে এসেছ, আল্লাহর দরবারে তওবা করে ক্ষমা ভিক্ষা করে ভবিষ্যতের জন্য পরিশুদ্ধ এবং বিপদমুক্ত হয়ে যাও। এখনও আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে খাঁটি ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ কর।
হযরত শোয়ায়েব (আ)-এর এ সমস্ত কথা তাদের দেহে আগুন জ্বালিয়ে দিত, তারা তাঁকে ভয় দেখিয়ে বলত যে, তোমাকে আমরা বার বার নিষেধ করেছি, এ ধরনের বাজে কথাগুলো আমাদের কাছে বলতে আসবে না; কিন্তু তুমি কিছুতেই বিরত হচ্ছ না। আবার তোমাকে সাবধান করে দিলাম। এরূপ বৃথা উপদেশ প্রদান করতে এসে তুমি অকালে তোমার প্রাণ বিসর্জন দিও না।
তাদের এ ধরনের কথা শুনে হযরত শোয়ায়েব (আ) তাদের সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিরাশ হয়ে পড়লেন, এমন সময় একদিন ফেরেশতা জিব্রাইল তাশরীফ এনে বললেন, হে আল্লাহর নবী! আপনার অবাধ্য কওমের প্রতি আল্লাহ তায়ালা অচিরেই বালা নাযিল করবেন। আপনি আপনার অনুসারী ও তাউহীদপন্থী লোকজনকে নিয়ে এদেশ হতে অন্যত্র চলে যান। যেহেতু সময় আসন্ন হয়েছে।
আারো পড়ুন: হযরত ইয়াকুব (আ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
হযরত শোয়ায়েব (আ) এর জাতির প্রতি আযাব
জিব্রাঈলের পরামর্শানুযায়ী হযরত শোয়ায়েব (আ) নিজের ধর্মভীরু পরিবার ও তাঁর ভক্ত অনুসারীদেরকে নিয়ে দেশ ত্যাগ করলেন। এ দেখে আল্লাহর অবাধ্যচারীগণ তাঁদেরকে উপহাস করে বলল, কি হে শোয়ায়েব। আমাদেরকে নানা প্রকার মিথ্যা ভয়ভীতি শুনিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেই লোকজন নিয়ে আমাদের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছ?
হযরত শোয়ায়েব (আ) জবাবে বললেন, আমি পালাচ্ছি না বরং আল্লাহর নির্দেশেই দেশত্যাগ করছি। কেননা এদেশে শীঘ্রই আল্লাহর গজব এসে পড়বে। তাঁর জবাব শুনে তারা আরও বেশী পরিমাণে বিদ্রূপ ও উপহাস করে করতালি দিয়ে হাসাহাসি ও বলাবলি করতে লাগল যে, দেখা, সে এখনও আমাদেরকে ফাঁকা গজবের ভয় দেখাচ্ছে।
হযরত শোয়ায়েব (আ) তাদের কথার কোন জবাব না দিয়ে তাঁর লোকজন নয়ে চলে গেলেন, এবং উক্ত শহর হতে অর্ধক্রোশ দূরবর্তী একটি জায়গায় গিয়ে বাস করতে লাগলেন।
তাঁর সঙ্গে সর্বমোট একহাজার সাতশত লোক ছিল।
হযরত শোয়ায়েব যেদিন দেশত্যাগ করলেন সেদিন দিনের শেষে রাত আসল। বাতটি নিরুপদ্রবে কেটে গেল। রাতে গিয়ে পরদিন ভোরেই আল্লাহর গজব এসে উপস্থিত হল। দোযখ হতে অগ্নির কিছু উত্তাপ ফেরেশতাগণ ঐ দেশের উপরে পৌঁছে দিলেন। তাতে সারাদেশ আগুনের মত উষ্ণ হয়ে গেল। ঘর-বাড়ী, পথ-ঘাট, মাঠ-প্রান্তর সবই বেশি উত্তাপে মানুষ দাঁড়ানোর অযোগ্য হয়ে পড়ল। লোকজন ঘরে টিকতে না পেরে দৌড়ে মাঠে গেল।
এমনি অবস্থায় ফেরেশতা জিব্রাঈল এসে এত জোরে এক হাঁক দিলেন যে, সে হাঁকের প্রবল গর্জনে লোকজন কেঁপে উঠে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল এবং সঙ্গে সঙ্গে মারা গেল।
এভাবে কিছুক্ষণের মধ্যে সমগ্র দেশটি জীবিত প্রাণীশূন্য একটি নির্জন মরুভূমিতে পরিণত হয়ে গেল। গজব নাযিল পরিসমাপ্তির পর হযরত শোয়ায়েব (আ) আল্লাহর দরবারে আরজ করলেন, হে মাবুদ। আমি কি এখন এখানেই বসবাস করব, না শহরে ফিরে যাব? আদেশ হল: তুমি এখন তোমার লোকজনসহ শহরে চলে যাও।
হযরত শোয়ায়েব (আ) শহরে ফিরে এসে দেখেন যে, তিনি তাঁর যে সকল মুমিন উম্মতদেরকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের ঘর-বাড়ীসমূহ সম্পূর্ণ ঠিক রয়েছে। শুধুমাত্র বিধর্মী ও অবাধ্য লোকদের ঘর-বাড়ীগুলোই জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে।
এরপর মুমিন উম্মতগণ তাদের নিজেদের বাড়ি-ঘরে বসবাস শুরু করলেন। কিছুদিনের মধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত মাদইয়ান নগরী আবার সমৃদ্ধ হয়ে উঠল।
এ ভীষণ ধ্বংসকাণ্ডের পর হযরত শোয়ায়েব (আ) তাঁর কওমের মধ্যে আবাদ বার বছরকাল ধর্ম প্রচার করছিলেন। তাঁর কওমটি এভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে মাঝে মাঝে প্রায়ই তিনি আল্লাহর দরবারে অতিমাত্রায় কাঁদতেন। কাঁদতে কাঁদতে তাঁর চক্ষু দুটি অন্ধ হয়ে গেছে।
একদিন ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ)-এসে বললেন, হে আল্লাহর নবী। আপনি কেন এত কাঁদছেন বলুন। যদি আপনি আপনার চক্ষুর জন্য কাঁদেন, তবে আল্লাহ তায়ালা তা ভাল করে দিবেন। আর যদি অন্য কোন ইচ্ছা থাকে, তাও পুরা করে দিবেন। যদি দোযখের ভয়ে কেঁদে থাকেন, তবে কান্না বন্ধ করুন। কেননা আল্লাহ আপনার জন্য দোযখ হারাম করে দিয়েছেন। আর যদি কোন পার্থিব উদ্দেশ্য সাধনের আকাঙ্ক্ষায় কাঁদেন, তবে কাঁদা বন্ধ করুন। কেননা আপনার যে কোন আকাঙ্ক্ষা আল্লাহ পূরণ করে দিবেন।
হযরত শোয়ায়েব (আ) বললেন, ভাই জিব্রাঈল! ওসব কিছুই আমি চাই না। আমি শুধু আল্লাহ তায়ালার দীদার কামনা করি। আল্লাহ তায়ালা যেন আমার এ ইচ্ছা পূর্ণ করেন।
ফেরেশতা জিব্রাঈল হযরত শোয়ায়েব (আ)-এর এ আকাঙ্ক্ষার কথা আল্লাহর দরবারে জানালেন। আল্লাহ তাঁকে বললেন, জিব্রাঈল! তুমি শোয়ায়েবকে জানিয়ে দাও, রোজ কিয়ামতে অবশ্যই আমি তাঁর এ ইচ্ছা পূর্ণ করব।
হযরত শোয়ায়েব (আ)-এর ইন্তেকাল
ফেরেশতা জিব্রাঈল আল্লাহ তায়ালার এ ওয়াদার কথা হযরত শোয়ায়েব (আ)-কে জানিয়ে দিলেন। এ শুনে হযরত শোয়ায়েব (আ) অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং তাঁর মনের চিন্তা দূর হয়ে গেল।
কিছুদিন পর হযরত মূসা (আ) হযরত শোয়ায়েব (আ)-এর নিকট আগমন করে কিছুদিন তাঁর সাহচর্যে অবস্থান করে বিদায় হয়ে গেলেন।
হযরত শোয়ায়েব (আ) অন্ধ অবস্থায় বার বছর জীবিত ছিলেন। তাঁর মোট আয়ুষ্কাল ছিল দু'শত বিশ বছর। হযরত মূসা (আ) তাঁর নিকট বিদায় নেয়ার পর সাত বছর চারমাস জীবিত ছিলেন। কোন কোন লেখকের মতে, মূসা (আ)-এর নবুয়ত লাভের চার বছর পর হযরত শোয়ায়েব (আ) পরলোক গমন করেন। তাঁর দাফন কাজ সমাধা হয়েছিল শাম-এর কোন এক জায়গায়।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url