হযরত সোলায়মান (আ) এর জীবনী
আজ এই আর্টিকেলটি হযরত সোলায়মান (আ) এর জীবনী হযরত সোলায়মান (আ)এর উত্তরাধিকারী কুরআনের হযরত সোলায়মান (আ)-এর বর্ণনা হযরত সোলায়মানের জিয়াফত হযরত সোলায়মান, রাণী বিলকীস ও হুদহুদ পাখী বিলকীস-এর নিকট হযরত সোলায়মান (আ)-এর পত্র পার্থিব সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে হযরত সোলায়মান (আ)-এর নামায বিস্মৃত হযরত সোলায়মান (আ)-এর বিপদের ঘটনা হযরত সোলায়মান (আ)-এর বিপদমুক্তির বিবরণ এবং হযরত সোলায়মান (আ)-এর ইন্তেকাল
হযরত সোলায়মান (আ)এর উত্তরাধিকারী
বিভিন্ন বর্ণনাকারীর মতে, হযরত দাউদ (আ)-এর নিরানব্বইজন স্ত্রী বর্তমান থাকাকালে তিনি আর একটি বিবাহ করেন এবং সে স্ত্রীর গর্ভের পুত্রের নাম ছিল হযরত সোলায়মান (আ)। তিনি হযরত দাউদ (আ)-এর ছোট পুত্র ছিলেন। তাঁর বড় পুত্রের নাম সলুম। সলুম তার পিতৃব্য পুত্রের হাতে পিতা হযরত দাউদ (আ)-এর জীবিতাবস্থায়ই নিহত হন।
হযরত দাউদ (আ)-এর মৃত্যুকালে তার পনেরজন পুত্র ছিলেন। এদের মধ্যে হযরত সোলায়মান (আ) যদিও সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন কিন্তু জ্ঞান-বুদ্ধি-চরিত্রের দিক দিয়ে তিনিই ভাইদের মধ্যে সর্বাধিক যোগ্য ছিলেন। এজন্যই হযরত দাউদ (আ) তাঁর মৃত্যুর পূর্বে হযরত সোলায়মান (আ)-কে সিংহাসনে বসিয়ে যান। পিতার মৃত্যুর পর আল্লাহ তায়ালা তাঁকে নবুয়ত দান করেন।
হযরত সোলায়মান শাহী আসনে ওঠার পূর্বেই বেহেশতের অলৌকিক আংটিটি পরিধান করেন। যার ফলে তিনি অসীম ক্ষমতার অধিকারী হন।
দেও-দানব, জ্বিন-পরী, পশু-পাখী এমন কি বায়ু পর্যন্ত তাঁর হুকুমের তাবেদার এবং অনুগত হয়ে গেল।
এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা কোরআন পাকে এরশাদ করেছেন: 'আর যখন হযরত সোলায়মান হযরত দাউদ (আ)-এর স্থলবর্তী হল, তখন সে বলল, হে লোকজন। 'আমি সমগ্র জীব-জন্তুর ভাষ। আয়ত্ত করেছি এবং আল্লাহ তায়ালা আমাকে দুনিয়ার প্রয়োজনীয় সবকিছুই দান করেছেন। নিশ্চয়ই এ আল্লাহর প্রকাশ্য
সুলায়মান (আঃ) আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেছিলেনঃ-
অর্থ:- হে পরওয়ারদেগার। আমাকে ক্ষমাকরুন এবং আমাকে এমন রাজত্ব দানকরুন। যা আমার পরে আর কারও জন্য সম্ভব না হয়। নিঃসন্দোহ আপনি পরমদাতা। (সূরা ছোয়াদ-৩৫)
হযরত সোলায়মানের জাঁকজমক ও শান-শওকতের পৃথিবীতে কোন তুলনা ছিল না। আর তাঁর মত এত বেশী প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা কোন বাদশাহরই ছিল না। তিনি যখন কোথাও রওয়ানা হতেন, বায়ু তাঁর সিংহাসন শূন্যে বহন করে নিত।
বিভিন্ন প্রকার অসংখ্য পাখী ঝাঁকে ঝাঁকে তাঁর মাথার উপরে উড়ে ছায়াদান করত। তাঁর ডানদিকে থাকত মানব জাতীয় সেনাগণ এবং বাম পাশে থাকত জ্বিন জাতীয় সেনাগণ। আর জীব-জন্তুরা চলত তাঁর পিছনে পিছনে। এ ছাড়া নানাজাতীয় প্রাণী তার সামনে থেকে পথ দেখিয়ে চলত। তাঁর সহচরগণও ইচ্ছা করলে তাঁর সাথে শূন্যমগুলে চলতে পারত। অবশ্য হযরত সোলায়মান (আ) তাদের সঙ্গে না থাকলে শূন্যে চলতে পারত না।
কোন কোন তাফসীরে বর্ণিত আছে যে, হযরত সোলায়মান (আ)-এর সিংহাসন এমন বিরাটাকৃতি বিশিষ্ট ছিল যে, হাজার হাজার মানব-দানব, জ্বিন-পরী ও জীবজন্তু তার আওতায় সফর করত।
আরব দেশের দক্ষিণ সীমান্তে অবস্থিত ইয়ামন হতে তার উত্তর সীমান্ত অবস্থিত সিরিয়ায় ঘোড়ায় চড়ে যেতে অন্ততঃ একমাস সময়ের প্রয়োজন হয়, কিন্তু হযরত সোলায়মান (আ) এ সুদীর্ঘ পথটি বায়ুর মাধ্যমে মাত্র অর্ধদিনে অতিক্রম করতেন।মার
কুরআনের হযরত সোলায়মান (আ)-এর বর্ণনা
এ প্রসঙ্গে কোরআনে পাকে আল্লাহর কালাম প্রণিধানযোগ্য। আল্লাহ বলেন:
(সূরা আম্বিয়া :৮১)
অর্থঃ আর আমি সুলায়মানের জন্য দ্রুত গতিশীল প্রবল বাতাসকে অবিনস্করে দিয়েছি। তার তাঁর আদেশে ঐ জমিনের উপর প্রবাহিত হত যাতে আমি বরকত দান করছিলাম। আর আমি সর্ববিষয়ে জ্ঞানী।
'আমি বায়ুকে সোলায়মানের অধীন করে দিয়েছিলাম। তাব সকালে সফর এক মাসের পথ এবং বিকালে সফর ছিল আর এক মাসের পথ। আমি তার জন্য গলিত তামার একটা প্রস্রবণ সৃষ্টি করে দিয়েছিলাম এবং অন্যতম দৈত্যকে তার খেদমতে নিযুক্ত করছিলাম।' কোরআন মজীদে আল্লাহ আরও বলেন যে-
'আমি দুষ্ট জ্বিনগণকে সোলায়মানের অধীন করে তার বাজমিস্ত্রি বানিয়ে দিয়েছিলাম যাবা উড়ে চলত।
হযরত সোলায়মান (আ) যেখানেই দুষ্ট জ্বিন বা দানব-দৈত্যের উপদ্রবের সংবাদ পেতেন, তিনি তাদেরকে ধরে এনে বন্দী করে সমুদ্রের গভীর তলদেশে নিক্ষেপ করতেন। আর তারা অনন্তকালের জন্য সেখানেই বন্দী অবস্থায় কাল কাটাত।
আরো পড়ুন: হযরত ইয়াহইয়া (আ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
হযরত সোলায়মানের জিয়াফত
হযরত সোলায়মান (আ)-কে আল্লাহ পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় বাদশাহ বানিয়েছিলেন এবং সর্বাধিক নেয়ামত দান করেছিলেন। এজন্য তাঁর মনে অবশ্য অহঙ্কার কিংবা অহমিকা ছিল না ঠিকই, কিন্তু অন্তরে এ বিরাটত্বের একটি স্বাভাবিক অনুভূতি ছিল। তিনি ভেবেছিলেন, আল্লাহ আমাকে যখন অসীম ক্ষমতা দান করেছেন, ইচ্ছা করলে, যে কোন কাজই আমি সমাধা করতে পারি। এ খেয়ালে একদিন আল্লাহর দরবারে এরূপ একটা আরজু করলেন যে, 'হে মাবুদ। আমি তোমার সারা দুনিয়ার সকল জীব-জন্তুকে একবেলা জিয়াফত খাওয়াবার আশা রাখি।
আল্লাহ তায়ালা বললেন, 'হে সোলায়মান। আমার সৃজিত জীবের সংখ্যা যে কত বেশী তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। তাই এরূপ আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ কর। আমার সৃষ্টজীবকে শুধু আমিই আহার দিতে সক্ষম, অন্য কারও পক্ষে সম্ভব নয় যে, আমার সৃষ্ট সকল জীবকে একবেলা আহার দিতে পারে।
হযরত সোলায়মান (আ) বললেন, 'হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে যে অফুরন্ত সম্পদ ও ক্ষমতা দান করেছ তাতে আমি তোমার সৃজিত সকল জীবকে একবেলা আহারের সাহস করছি। এ কাজটি আমার অন্তরের একান্ত কাম্য।
হযরত সোলায়মান (আ) বারবার আল্লাহর দরবারে এরূপ অনুরোধ করার কারণে আল্লাহ তাঁকে অনুমতি প্রদান করলেন।
হযরত সোলায়মান (আ) দুনিয়ার সকল জীবের একবেলা আহারের আয়োজন করতে লাগলেন।
এদিকে নিমন্ত্রিত সকল জীব-জন্তু, দুনিয়ার সর্বস্থল হতে আসতে শুরু করল। তাদের যে যেমন স্থানে বসার যোগ্য তার জন্য তদ্রূপ ব্যবস্থা পূর্বাহ্নেই করা হয়েছিল। উল্লিখিত সমুদ্র তীরের দিগন্ত বিহীন বিশাল প্রান্তরে ফরাস বিছয়ে মেহমানদের বসার ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছিল। ইতোমধ্যে অসংখ্য মেহমান আগমন করে উক্ত প্রান্তরে যার যার মত উপযুক্ত আসন গ্রহণ করেছিল।
এমনি সময়ে সমুদ্রের তলদেশ হতে চার পা বিশিষ্ট অথচ দেখতে মাছের মত বিরাট সামুদ্রিক জীব উঠে আসল। জীবটির আকার ছিল বিরাট এক পর্বতের মত, দীর্ঘ এবং উচ্চতা তার যে কতখানি ছিল, তা বর্ণনা করা অসম্ভব ব্যাপার।
মাছটি এসেই হযরত সোলায়মান (আ)-কে লক্ষ্য করে বলল, হে আল্লাহর নবী! আপনার জিয়াফত খেতে এসে আমি ক্ষুধার কষ্ট সইতে পারব না। অপর মেহমানদের সাথে আমার একত্রে ভোজন করা চলবে না। কেননা আমার ক্ষুধার উদ্রেক হয়েছে। আমাকে একটু আগেই খেতে দিন, আমি খেয়ে চলে যাই।
এরপর মাছটি আহার করতে বসল। দেও-দানবগণ তার খানা পরিবেশন করতে গেল। স্তূপীকৃত খানাসমূহ হতে কিছু পরিমাণ তার সামনে উপস্থিত করলে সে, বলল, তোমরা এমন আস্তে-ধীরে খানা আনছে কেন? একবারে অন্ততঃ এক লোকমা খানা তো হাজির করবে? তার কথা শুনে পরিবেশনকারীগণ আরও খানা সামনে দিল। কিন্তু মাছটি বলল, এক লোকমা এখনও হয়নি আরও আন। তখন খানা পরিবেশনকারীরা অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
মাছটি বলল, তাড়াতাড়ি কর। খেতে বসে এত দেরি সহ্য করা যায় না। তার কথা শুনে সারা দুনিয়ার জীব-জন্তুর জন্য যত খানা যোগাড় করা হয়েছিল, তা সব নিয়ে মাছটির সামনে রাখা হল। তখন মাছটি তা সব মুঠার মধ্যে নিয়ে এক লোকমায় সব মুখের মধ্যে দিল।
এভাবে প্রথম লোকমা আহার করে মাছটি বলল, খানা আন। তখন তারা বলল, খানা যা প্রস্তুত হয়েছিল, সবই তো তোমার সামনে দিয়েছি।
একথা শুনে মাছটি উঠে হযরত সোলায়মান (আ)-এর নিকট বলল, ওহে আল্লাহর নবী' আপনার বাড়ীর জিয়াফতের কথা শুনে খুবই আশা নিয়ে এসেছিলাম যে, দুনিয়ার সেরা বাদশাহ হযরত সোলায়মান (আ)-এর বাড়ীর দাওয়াত খেয়ে খুবই তৃপ্ত হতে পারব। কিন্তু আপনার পরিবেশনকারীগণ আমাকে মাত্র এক লোকমা খানা সরবরাহ করেই বলল যে, সবখানা নিঃশেষ হয়ে গেছে। এ আপনি কেমন জিয়াফত দিলেন? আল্লাহ তায়ালা দৈনিক আমাকে তিনটি লোকমা আহার যোগান। কিন্তু আপনার বাড়ীতে জিয়াফত খেতে এসে আজ আমাকে একটি লোকমা আহার করতে হল। আমার পেটের ক্ষুধা পেটেই রয়ে গেল। অথচ আপনার সব খাদ্য-খাদকই নিঃশেষ হল। আপনি পৃথিবীর সকল জীবজন্তুকে একবেলা আহার করার জন্য দাওয়াত করেছেন, তা দূরে থাকুক, সমুদ্রগর্ভে আমার তুল্য এবং আমার চেয়ে আরও বিরাট বহু জীব রয়েছে। তাদেরকে খানাও তো যোগাড় করা আপনার পক্ষে সম্ভব হল না। আর তাদের কথাই বা কেন বলছি? আমার একবার খানাইতো আপনি দিতে পারলেন না।
মাছটির কথা শুনে হযরত সোলায়মান চমকে উঠলেন এবং তখনি তার হুঁশ হল যে, হায়' আমি আল্লাহর সাথে বড় বেয়াদবী করেছি। তাঁর সৃষ্টিকুলের কথা চিন্তা-ভাবনা না করেই আমি আমার ক্ষমতাকে খুব বড় করে দেখেছি আর তার ফলে আল্লাহর নিকট তাঁর দয়া ও সহায়তা কামনা করেছি। এর মত চরম ধৃষ্টতা ও স্পর্ধা আর কি হতে পারে? তাই তো আল্লাহ তাঁর সৃষ্ট একটিমাত্র মাছ দ্বারাই আমার অন্যায় অহমিকা চূর্ণ করে দিলেন।
হযরত সোলায়মান (আ) সাথে সাথে আল্লাহর দরবারে সিজদায় গিয়ে সানুনয়ে তওবা করে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন, হে মাবুদ' আমি তোমার অসীম ক্ষমতা ও বিরাটত্ব সম্পর্কে কিছুই না জেনে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে গিয়ে যে ভুল করেছি নিজগুণে তুমি তা মাফ কর। আমি আর জীবনে কোনদিন এরূপ ভুল করব না।
হযরত সোলায়মান (আ)-এর মিনতিতে আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করলেন।
আরো পড়ুন: হযরত ইসহাক (আ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
হযরত সোলায়মান, রাণী বিলকীস ও হুদহুদ পাখী
একদিন হযরত সোলায়মান (আ) মানব-দানব, জ্বিন-পরীসহ সফরে বের হলেন। পথে একস্থানে তাঁর বাহন ভূমিতে অবতরণ করে তিনি নামায আদায় করে সঙ্গী-সাথীসহ পানাহার করলেন। এ অবসরে হুদহুদ পাখী সেখান হতে উড়ে অনার চলে গেল। তারপর বিশেষ ঘটনাবশতঃ সে যথাসময়ে ফিরে আসতে পারেনি। এদিকে হযরত সোলায়মান (আ)-এর সঙ্গে যে পানি ছিল তা শেষ হয়ে যাওয়ায় খুব অসুবিধা দেখা দিল। তখন হুদহুদ পাখীর প্রয়োজন দেখা দিল। কিন্তু তাকে পাওয়া গেল না। অন্যান্য পাখীর কাছে জিজ্ঞেস করলেন, সে কোথায় গেছে? কিন্তু কেউই বলতে পারেনি।
হযরত সোলায়মান (আ) তখন হুদহুদ পাখীর প্রতি অত্যন্ত রাগ হলেন। তিনি মনে মনে স্থির করলেন যে, হুদহুদ পাখীকে পাওয়া গেলে তাকে যবেহ করবেন। কিছু সময় অতিবাহিত হবার পর হঠাৎ হুদহুদ পাখী উপস্থিত হল। হযরত সোলায়মান (আ) তাঁর অনুপস্থিতির কারণ জিজ্ঞেস করলেন, এতক্ষণ কোথায় ছিলে?
হুদহুদ পাখী বলল, আমার অনুপস্থিতির কারণ অবাধ্যতামূলক নয়। আপনারই কাজে রত ছিলাম। আজ আমি একটি বিষয় জেনে এসেছি- যা আপনি অবগত নন।
হযরত সোলায়মান (আ) সে বিষয়টি কি জানতে চাইলে হুদহুদ পাখী বলল, আজ আমি আপনার জন্য সাবা সম্প্রদায়ের গোপনীয় সংবাদ আনয়ন করেছি। তার বিস্তারিত বিবরণ এই যে, সাবা নামক এক ব্যক্তির নামানুসারে সাবা সম্প্রদায়ের নামকরণ করা হয়েছে। তারা ইয়ামনে বাস করত। তারপর মাআরিফ নামক এক শহরে তারা বসবাস করতে শুরু করল। কালক্রমে সে শহরটিও সর্বত্র সাবা নামে পরিচিত হল।
উক্ত সাবার বিলকীস নামক এক রাণীর সাথে সাক্ষাত করেছি। সাবা বংশধরদের উপরে এ বিলকীসই দক্ষতার সাথে শাসন করে আসছেন।
রাজত্ব পরিচালনার জন্য তার প্রয়োজনীয় সব বস্তুই আছে। মূল্য এবং আকারের দিক হতে এক বিরাট ও মূল্যবান সিংহাসন আছে। অন্যান্য বাদশাহর সিংহাসনই তত বিরাট ও মূল্যবান নয়, এমনকি সোলায়মান (আ)-এর সিংহাসনও তদ্রুপ ছিল না।
হুদহুদ পাখী বিলকীসের ধর্মমত সম্পর্কেও উল্লেখ করে বলল যে, আমি তাদের ধর্মীয় বিষয়াদিও অবগত হয়ে এসেছি। দেখলাম সে ও তার সম্প্রদায়ের লোকের নিরাকার আল্লাহর বদলে সূর্যকে সিজদাহ করে শিবলীস তাদের কাছে বুফনী কার্যগুলোকে শোভনীয় করে রেখেছে। তারা সৎপথ ভ্রষ্ট হয়ে অসৎ পথে চলেছে।
হুদহুদ পাথার কথাগুলো শুনে হযরত সোলায়মান (আ) বললেন, তোমার কথা তো শুনলাম, এখন আমি তার সম্পর্কে বিশেষভাবে সন্ধান নিয়ে দেখছি। এরপর তিনি আরবী ভাষায় একখানা পত্র লিখে হুদহুদের নিকট দিয়ে বললেন, তুমি উক্ত রাণী বিলকীসের দরবারে গিয়ে এ চিঠিখানা তার সামনে রাখবে। এরপর তার খুব নিকটে না থেকে একটু দূরে গিয়ে তার কথাবার্তার দিকে কর্ণ নিয়োগ করে শুনবে, সে তার সভাষদগণের সাথে কি আলাপ করে।
হুদহুদ পাখীটি যেমন মানুষের ভাষায় কথাবার্তা বলতে পারত, তেমনি মানুষের কথাবার্তা বুঝতেও পারত। এ যে মূলতঃ হযরত সোলায়মান (আ) এরই নবুয়তী মু'জেযার নিদর্শন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
হযরত সোলায়মান (আ) হুদহুদ পাখীকে বলে দিলেন, তুমি বিলকীসের নিকট চিঠি পৌঁছে আবার এখানে প্রত্যাবর্তন করবে। যেহেতু আমার এ চিঠি পাওয়ার পর প্রতিক্রিয়া আমি তোমারই মাধ্যমে অবগত হব।
বিলকীস-এর নিকট হযরত সোলায়মান (আ)-এর পত্র
'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম'
অতঃপর হে বিলকীস! তোমরা কেউই আমার মোকাবিলায় গর্বিত ভাব প্রদর্শন করো না; বরং আনুগত্য স্বীকার করে আমার এখানে আগমন কর।' পত্রের মূল কথা এটুকুই ছিল। বিলকীস ইতোপূর্বেই হযরত সোলায়মানের পরিচয় অবগত হয়েছিলেন। তিনি পত্রখানা পাঠ করে পারিষদবৃন্দকে নিজের নিকট ডেকে তাদের সঙ্গে পরামর্শ শুরু করলেন। তিনি বললেন, হে পারিষদবৃন্দ। আমার নিকট একখানা বিশেষ সম্মানিত পত্র প্রেরিত হয়েছে। এ খুব সংক্ষিপ্ত অথচ এর ভাষা ও মর্ম উচ্চাঙ্গের। চিঠিখানা হযরত সোলায়মান (আ) কর্তৃক পাঠানো হয়েছে। বিলকীস অতঃপর তাদেরকে চিঠিখানা পড়ে শুনালেন। তারপর তিনি তাদেরকে বললেন, এখন তোমরা আমাকে পরামর্শ দাও, তাঁর সাথে আমার কিরূপ ব্যবহার দেখানো উচিত হবে? আমি তোমাদের সাথে পরামর্শ না করে কোন বিষয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব না।
পারিষদ বলল, আমরা আপনার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যদি কারও সাথে যুদ্ধ করার প্রয়োজন দেখা দেয় তবে আমরা শক্তি-সামর্থ্যের সাথেই সদা প্রস্তুত। এখন আপনার ইচ্ছা। বিলকীস বললেন, যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া ঠিক মনে করি না। কেননা একে তো তিনি বিশাল সাম্রাজ্যের শাসক, তদুপরি যুদ্ধের ইচ্ছা নিয়ে কেউ কোন দেশে পদার্পণ করলে সে দেশের অমঙ্গল অনিবার্য। তাঁর সাথে যুদ্ধ করলে আমাদের ক্ষতির পূর্ণ সম্ভাবনা। সুতরাং যুদ্ধের পরিকল্পনা পরিত্যাগ করা উত্তম মনে করি।
হযরত সোলায়মান (আ)-এর নিকট বিলকীসের পত্র ও উপঢৌকন প্রেরণ বিলকীস নিজের সিদ্ধান্ত মতই সোলায়মান (আ)-এর নিকট পত্রের জবাব এবং কিছু উপঢৌকন প্রেরণ করলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল যে, জবাব পত্রখানা পৌঁছার পর কি প্রতিক্রিয়া হয় তদনুযায়ী পরে যা দরকার তাই করব।
এরপর যথাসময়ে জনৈক দূত বিলকীসের পত্র এবং উপঢৌকন নিয়ে হযরত সোলায়মান (আ)-এর দরবারে উপস্থিত হল।
হযরত সোলায়মান (আ) পাঠানো উপঢৌকন দেখে মন্তব্য করলেন, তোমরা কি ধন-সম্পদ দ্বারা আমায় সাহায্য করার মনস্থ করেছ? বরং তোমরা জেনে রেখো, আল্লাহ আমাকে যা দান করেছেন, তা তিনি তোমাদেরকে যা দান করেছেন, তা হতে বহু গুণে উত্তম। তোমাদের নিকট রয়েছে শুধু দুনিয়া। পক্ষান্তরে, আমার নিকট দুনিয়া তো আছেই, তদুপরি দ্বীনও রয়েছে। অর্থাৎ আমার নিকট আছে উভয় বস্তু। সুতরাং আমি তোমাদের এ বস্তুর প্রতি লালায়িত নই। হে দূত। তুমি এ বস্তু নিয়ে ফিরে যেতে পার। তারা যদি আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং তাঁর দ্বীন গ্রহণ করে তবে খুবই ভাল। নতুবা আমি তাদের প্রতি এমন সেনাবাহিনী প্রেরণ করব যাদের সাথে তারা মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে না। তখন আমি তাদেরকে আমার অধীন এবং প্রজায় পরিণত করব এবং তাদেরকে উৎখাত করে দেব। তবে উৎখাত করে তাদেরকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়া হবে না। বরং তারা চিরতরে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে এবং নিজেদেরকে বিধ্বস্ত করে ফেলবে।
দূত হযরত সোলায়মানের প্রত্যাখ্যানকৃত উপঢৌকনাদিসহ রাণীর নিকট প্রত্যাবর্তন করল এবং তার নিকট সোলায়মান (আ)-এর ফরমান জ্ঞাপন করল।
রাণী বুদ্ধিমতি ছিলেন। দূত বর্ণিত সোলায়মান (আ)-এর প্রস্তাব শুনে তাঁর বুঝতে দেরি হল না যে, তিনি যেন-তেন লোক নন। তিনি একজন অত্যন্ত মহৎ, গুণী ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মহাশক্তিশালী ব্যক্তি। তাঁর প্রবৃত্তি পার্থিব লোভ-লালসার উর্ধে-দুনিয়ার কোন মোহ বা শক্তি তাঁকে পরাভূত করতে পারবে না। সাবার রাণী এ প্রকার চিন্তা করে আর কোন রকম ইতস্ততঃ না করে পারিষদবর্গের সাথে পরামর্শ করে হযরত সোলায়মানের প্রচারিত সত্য ধর্মে বিশ্বাসী হয়ে তাঁর আনুগত্য স্বীকার করলেন এবং সোলায়মান (আ)-এর সাথে সাক্ষাত করার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলেন।
হযরত সোলায়মানের দরবারে বিলকীস যাত্রা করার আগেই তাঁর নিকট সংবাদ পৌছে গেল যে, সাবা-রাণী বিলকীস আপনার দরবারে আগমন উদ্দেশ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ সংবাদ পৌঁছার পূর্বেই হযরত সোলায়মানের সংবাদ সংগ্রহ করার জন্য নিযুক্ত 'দেও' এসে তাঁকে রাণীর আকৃতি-প্রকৃতি সম্পর্কে বর্ণনা দিল। দেও বললঃ নারী গঠন প্রকৃতির বিপরীত রাণী বিলকীসের পায়ে ঘন-দীর্ঘ পশম রয়েছে। আর সে কিছুটা খাটো-বুদ্ধির মহিলা। কারণ সে জ্বিন জাতের, আর জ্বিন-জাতের বুদ্ধি-শুদ্ধি সাধারণতঃ কমই হয়ে থাকে। একথা বলে দেও-দূত সত্বর সেখান হতে সরে পড়ল। কারণ, রাণীর সম্পর্কে ব্যাখ্যার ব্যতিক্রম কিছু হযরত সোলায়মান (আ)-এর কাছে প্রকাশ পেলে তাকে অবশ্যই শাস্তি ভোগ করতে হতে পারে।
একশত দাস ও দাসীকে এ ধরনের পোশাক-পরিচ্ছদ এবং গহনাদি পরিধান করিয়ে এমনভাবে সজ্জিত করা হল যে, তাদের ভিতরে কারা দাস এবং কারা দাসী তা নির্ণয় করা সহজ ব্যাপার ছিল না। এ ছাড়া কতকগুলো নর ঘোটক এবং কতকগুলো মাদী ঘোটকীকে বস্ত্রাবৃত করে এমন- ভাবে সাজানো হল যে, কোনটি ঘোটক এবং কোনটি ঘোটকী তা বেছে বের করা দুরূহ ব্যাপার ছিল।
এরপর রাণী বিলকীস নিজের মনোনীত কাসেদকে বললেন, তুমি এগুলো সঙ্গে নিয়ে হযরত সোলায়মান (আ)-এর দরবারে গমন কর। তাঁকে বলিও, তিনি যেন এদের মধ্যকার দাস ও দাসী এবং ঘোটক ও ঘোটকীগুলোকে পৃথক করে দেন। তারপর তিনি কাসেদের কাছে একটি শিশি দিয়ে বললেন, তাঁকে আরও বলিও, তিনি যেন এমন জাতীয় পানির দ্বারা এ শিশিটি ভর্তি করে দেন, যে পানি আকাশ হতে পতিত কিংবা যমিনে অবস্থিত নদী-নালা কিংবা পুকুর প্রভৃতির না হয়।
এরপর কাসেদ উক্ত দাসদাসী, ঘোটক-ঘোটকী এবং শিশিটি সঙ্গে নিয়ে হযরত সোলায়মান (আ)-এর দরবারে উপনীত হল এবং রাণী বিলকীসের আদেশ মোতাবেক হযরত সোলায়মান (আ)-কে বলল, জাঁহাপনা! আপনি আমার সঙ্গে আনিত এ দাস-দাসী, ঘোটক-ঘোটকীগুলোর কে দাস, কে দাসী এবং কোনটি ঘোটক ও কোনটি ঘোটকী তা নির্ণয় করে দিন। কিন্তু শর্ত হল, তাদের কারও শরীরে হস্তার্পণ কিংবা অঙ্গাবরণ উন্মোচন করতে পারবেন না; বরং আপনার নির্ণয় করার পর তাদের অঙ্গের কাপড়াদি খুলে দেখা হবে, আপনার নির্ণয় সঠিক হল কিনা! তারপর এ শিশিটি আপনি এমন পানি দিয়ে ভর্তি করে দিবেন, যা আকাশ কিংবা যমিনের পানি তথা বৃষ্টি বা নদী-নালা বা খাল-পুকুরের পানি নয়। আমাদের মহারাণী বিলকীস আমার মাধ্যমে আপনার কাছে এ অনুরোধ করেছেন।
হযরত সোলায়মান (আ) আল্লাহ তায়ালার খাঁটি নবী ছিলেন; সুতরাং নবীসুলভ বিচক্ষণতার দ্বারা তিনি হাত ধৌত করার প্রক্রিয়ার দ্বারা দাসদাসীগণকে পৃথক করলেন এবং খাদ্যবস্তু আহার করার রীতির দ্বারা ঘোটক ঘোটকীগুলো নির্ণয় করলেন। এরপর তিনি একটি ঘোটককে প্রবল বেগে ধাবিত করলেন এবং তাতে ঘোটকটির শরীর হতে ঘর্মধারা নির্গত হতে লাগল। উক্ত ঘর্মধারা দিয়ে উল্লিখিত শিশিটি ভর্তি করা হল। উল্লেখ্য যে, হযরত সোলায়মান (আ) কর্তৃক দাসদাসী ও ঘোটক-ঘোটকী নির্ণীত হওয়ার পর তাদের বাহ্যিক আবরণ উন্মোচন করে দেখা গেল, তার নির্ণয়কাজ সম্পূর্ণ সঠিক হয়েছে। কোন ভুল-ভ্রান্তি হয়নি।
এ ঘটনা নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করে কাসেদ হযরত সোলায়মান (আ)-এর নিকট হতে বিদায় গ্রহণ করে রাণী বিলকীসের দরবারে প্রত্যাবর্তন করল এবং তার নিকট আদ্যন্ত ঘটনা খুলে বলল, রাণী বিলকীস ঘটনা শুনে আর কালদেরি না করে হযরত সোলায়মান (আ)-এব দরবারে উপস্থিত হবার উদ্দেশ্যে নিজের দলবলসহ রওয়ানা হলেন। রওয়ানা হবার কালে তিনি তাঁর মূল্যবান সুরম্য সিংহাসনখানি সুরক্ষিত কক্ষে আবদ্ধ করে তার হেফাজতের ভার তাঁর প্রধান মন্ত্রীর কাছে সোপর্দ করে গেলেন। তাছাড়া তিনি তাঁর অনুপস্থিতিতে দেশের শাসনকাজ সুচারুরূপে পরিচালনার দায়িত্বও তার নিকট ন্যস্ত করে গেলেন।
হযরত সোলায়মান (আ)-এর দরবারে রাণী বিলকীসের সিংহাসন আনয়ন এবং রাণী বিলকীসকে নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ব্যবস্থা করলেন।
রাণী বিলকীস তাঁর সঙ্গী-সাথীগণসহ যখন হযরত সোলায়মান (আ)-এর রাজধানীর উপকণ্ঠে গিয়ে উপনীত হলেন, তখন বায়ু দ্রুতগতিতে হযরত সোলায়মান (আ)-কে রাণী বিলকীসের আগমনবার্তা জানালেন।
উল্লেখ্য যে, রাণী বিলকীস অত্যন্ত রূপসী মহিলা ছিলেন। তদুপরি জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিভিন্ন গুণেও সেকালে পৃথিবীতে তার সাথে তুলনীয় কোন মহিলা ছিল না। হযরত সোলায়মান (আ)-এর স্ত্রীগণ নিশ্চিতরূপে ভেবে নিয়েছিলেন যে, তাঁদের স্বামী নবী সোলায়মান (আ) রাণী বিলকীসকে দেখলে এবং তার গুণাবলীর খবর জানতে পারলে অবশ্যই তার রূপে ও গুণে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিবাহ করবেন এবং তার মত মহিলাকে বিবাহ করতে পারলে তার নিকট তাদের কদর ও মূল্য একেবারেই কমে যাবে। এই আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে তারা কতিপয় দেওকে আদেশ করলেন যে, তোমরা হযরত সোলায়মান (আ)-এর কাছে রাণী বিলকিস সম্পর্কিত কিছু বিরক্তিকর তথ্য ও সংবাদ আগে-ভাগে জানিয়ে দিবে। তারা তাতে সম্মতি জানিয়ে হযরত সোলায়মান (আ)-এর স্ত্রীগণকে আশ্বস্ত করল।
আসফ নামক দেও ছিল হযরত সোলায়মান (আ)-এর প্রধান উজীর। সে শুনে বলল, হে বাদশাহ নামদার! চিন্তার কোনই কারণ নেই। আমাকে অনুমতি দিলে চোখের পলকে আমি রাণী বিলকীসের সিংহাসন আপনার সামনে পৌঁছে দিব।
আসফ দেওয়ের এসমে আজম জানা ছিল এবং সে অসীম শক্তিসম্পন্ন মহাপবিত্র এসমে আজমের বদৌলতেই সে এরূপ অসাধ্য সাধনে সক্ষম ছিল।
রাণী বিলকীস কিন্তু তার জন্য নির্দিষ্ট আসনে না বসে অপলক দৃষ্টিতে উক্ত আসনের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
এরপর তিনি নিজের আসনে উপবিষ্ট হলেন এবং হযরত সোলায়মান (আ)-এর সাথে কথোপকথন শুরু করলেন। কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলার পর হযরত সোলায়মান (আ)-এর নিযুক্ত লোক এসে রাণী বিলকীসকে বলল, রাণী। এবার আপনার জন্য নির্দিষ্ট বিশ্রামকক্ষে আরাম করতে চলুন। হযরত সোলায়মান (আ) ও তাঁকে তার সাথে বিশ্রামকক্ষে যেতে বললেন।
রাণী বিলকীস পানিপূর্ণ চৌবাচ্চার তীরে পৌঁছে থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। চৌবাচ্চার উপরস্থ আয়না তার নজরে পড়ল না তিনি থমকে দাঁড়াবামাত্র সঙ্গীয় লোকটি পিছন হতে বলে উঠল যে, এ পথেই অগ্রসর হন, অন্য কোন পথ নেই। রাণী বিলকীস পানি হতে কাপড় বাঁচার জন্য বাধ্য হয়ে দু'পায়ের কাপড় কিছুটা উপরে তুলে নিলেন। তাতে উভয় পায়ের গোছা উন্মুক্ত হয়ে গেল।
বলা-বাহুল্য যে, হযরত সোলায়মান (আ) সুকৌশলে কাজ সিদ্ধি করার জন্য ঐ ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। সুতরাং রাণী বিলকীসকে বিশ্রামকক্ষে পাঠিয়ে দিয়েই গোপনে তিনি তাঁর পথের দিকে তাকিয়ে রয়েছিলেন। রাণী চৌবাচ্চার উপরে পৌঁছে যখন তাঁর কাপড় উত্তোলন করলেন তখন তার উন্মোচিত পায়ের গোছার প্রতি দৃষ্টি ফেলে হযরত সোলায়মান (আ) দেখলেন যে, তাতে কোন পশমের লেষমাত্র নেই। ফলে তাঁর আর বুঝতে বাকী রইল না যে, দেওগণ তাঁর নিকট সম্পূর্ণ মিথ্যা সংবাদ দিয়েছে। হযরত সোলায়মান (আ) নিজের চোখেই প্রত্যক্ষ্য করলেন। অবশ্য তিনি সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ দিয়ে রাণী বিলকীসকে বললেন, আহা রাণী! তোমার কাপড় জাগানোর প্রয়োজন নেই। তুমি কি দেখতে পাচ্ছ না, চৌবাচ্চার উপরে যে আয়নার পাত বিছানো রয়েছে, তার উপর দিয়ে স্বাভাবিকভাবে হেঁটে যাও। কোন অসুবিধার কারণ নেই।
এরপর রাণী বিলকীস অনায়াসে আয়নার পাত পেরিয়ে বিশ্রামকক্ষে উপনীত হলেন। কিন্তু তিনি এ ঘটনায় খুবই লজ্জিত হয়ে পড়লেন এবং নিজেকে হযরত সোলায়মান (আ)-এর কাছে অত্যন্ত দীনা ও হীনা বলে তাঁর মনে হতে লাগল। আল্লাহর দ্বীন এবং তাঁর নবীর প্রতি তার মনে পরম শ্রদ্ধার ভাব উদয় হল। তখন তিনি আর কালদেরি না করে আনুষ্ঠানিকভাবেই আল্লাহর নবী হযরত সোলায়মান (আ)-এর কাছে খাঁটি ধর্মে দীক্ষিত হলেন।
আরো পড়ুন: হযরত শোয়ায়েব (আ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
পার্থিব সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে হযরত সোলায়মান (আ)-এর নামায বিস্মৃত
সাত সমুদ্রের সমগ্র দ্বীপ দেখিয়ে অবশেষে হযরত সোলায়মান (আ)-এর আসন এমন এক দ্বীপে নামাল যার অপূর্ব সৌন্দর্যের সাথে আর কোন স্থানের সৌন্দর্যের তুলনা চলে না। ঐ দ্বীপের নানা রকম সৌন্দর্যের সেরা আকর্ষণ ছিল সামুদ্রিক ঘোড়া। ঘোড়াগুলোকে আল্লাহ এমন নিখুঁত আকৃতি দিয়েছিলেন, পৃথিবীর বুকে তার তুলনা মিলবে না। প্রত্যেকটি ঘোড়ার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাথে অতিরিক্ত দুটি পাখা তাদের সৌন্দর্যকে আরও বৃদ্ধি করেছিল। ঘোড়াগুলো সামুদ্রিক দ্বীপে ছুটাছুটি করত এবং উক্ত পাখার সাহায্যে শূন্যে উড়ে বেড়াত।
সোলায়মান (আ) দূর হতে যে ঘোড়াগুলোকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন, এবার নিকটে পেয়ে সেগুলোর সৌন্দর্য তিনি রাণী বিলকীসসহ প্রাণ ভরে দেখে চক্ষু জুড়ালেন। তিনি ছিলেন মানব, জ্বিন-পরী, দেও-দানব এবং সকল পশু-পাখীরই শাসক তথা একচ্ছত্র সম্রাট। সে হিসেবে তাঁর নিকট সকল পশু-পাখীর আনা-গোনা ছিল, সর্বপ্রকার জীব-জন্তুই তাঁর পক্ষে দেখার সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু এ ঘোড়াগুলোর মত এত সুন্দর জন্তু তিনি আর কোনদিনই দেখেননি। তাই সেগুলোকে তিনি যতই দেখছিলেন, ততই দেখতে ইচ্ছা হচ্ছিল। কিছুতেই যেন তাঁর দেখার তৃপ্তি হচ্ছিল না। মোটকথা, সে সুন্দর ঘোড়াগুলোর অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করে তিনি নিজের প্রয়োজনীয় কর্তব্য ভুলে গেলেন। তখন আছরের নামাযের শেষ ওয়াক্ত ছিল। ঘোড়ার সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে তাঁর নামায আদায় করাও হল না। ওদিকে সূর্য অস্তমিত হবার উপক্রম হয়েছিল। এমনই মুহূর্তে হঠাৎ নবী সোলায়মান (আ)-এর মনে নামাযের কথা স্মরণ হল এবং তিনি চমকে উঠে আল্লাহর দরবারে তাওবা করে বলতে লাগলেন, হে মাবুদ! আমি না বুঝে মোহজালে আবদ্ধ হয়ে তোমার ইবাদাত বিস্মৃত হয়েছি। তুমি নিজের গুণবলে আমার এ অপরাধ ক্ষমা কর। দু'চোখের অশ্রু বয়ে দিয়ে তিনি আল্লাহর দরবারে শুধু ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলেন।
করুণাময় আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীর করুণ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ)-কে ইঙ্গিত করলেন। তিনি আল্লাহর ইঙ্গিতানুযায়ী প্রায় অস্তমিত সূর্যকে ধরে রাখলেন। যার ফলে সেদিন সূর্য যথাসময়ে অস্ত যেতে সক্ষম হল না। ইত্যবসরে হযরত সোলায়মান (আ) তাড়াতাড়ি আছরের নামায আদায় করে ফেললেন। বলা-বাহুল্য, তার নামায আদায় হওয়ামাত্র সূর্য অস্ত গেল।
নামায আদায়ের পরও কিন্তু হযরত সোলায়মান (আ)-এর নিজের কৃতকর্মজনিত মনের দুঃখ গেল না। তিনি শুধই অনুতাপানলে দগ্ধীভূত হতে লাগলেন যে, হায়! আমি একি করলাম, কেন এরূপ পার্থিব মোহে মুগ্ধ হয়ে আল্লাহর ইবাদাতের প্রতি উদাসী হলাম! না জানি আমার এ গুরুতর অপরাধ আল্লাহ মাফ করবেন কিনা। যে ঘোড়াগুলোর সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে তিনি সমস্ত কিছু বিস্মৃত হয়েছিলেন, এবার সেগুলোর প্রতিই তার মনে দারুণ ক্রোধের উদয় হল। সঙ্গে সঙ্গে কতিপয় দেওকে আদেশ দিলেন, তোমরা ঘোড়াগুলোকে আমার নিকটে নিয়ে আস। দেওগণ আদেশ পালন করল। হযরত সোলায়মান (আ) সবগুলো ঘোড়ার অঙ্গ হতে তাদের মূল সৌন্দর্য ডানা দুটি কেটে ফেললেন। জনশ্রুতি এই যে, সেদিন আল্লাহ পৃথিবীতে যেখানে যত ডানাবিশিষ্ট ঘোড়া ছিল, তাদের সকলেরই ডানা বিলোপ করলেন। আর এ ঘটনার পর হতেই পৃথিবীতে ডানাবিশিষ্ট ঘোড়ার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হল।
হযরত সোলায়মান (আ)-এর বিপদের ঘটনা
হযরত সোলায়মান (আ) ছাইদুন দ্বীপ হতে দেশে প্রত্যাবর্তন করে ছাইদুনের কন্যাকে বললেন, তুমি আমার প্রচারিত খাঁটি ধর্ম গ্রহণ কর। জবাবে ছাইদুনের কন্যা বলল, আমি তোমার ধর্ম গ্রহণ করতে পারি, কিন্তু শর্ত হল, তুমি আমার পিতাকে এনে আমার সঙ্গে সাক্ষাত করাবে।
নবী হযরত সোলায়মান (আ) বললেন, তোমার পিতাকে তো আমি হত্যা করেছি। তাকে তোমার সাথে কিভাবে সাক্ষাত করাব বল? একথা বলে তিনি নিহত বাদশাহ ছাইদুনের খণ্ডিত মাথা তার কন্যার সামনে উপস্থিত করলেন।
পিতার মাথা দেখে ছাইদুনের কন্যা শোকের আঘাত সইতে না পেরে বেহুঁশ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে তার হুঁশ ফিরে আসলে সে আবার কাঁদতে কাঁদতে ভেঙ্গে পড়ল। তার এরূপ অস্থিরতা দেখে নবী হযরত সোলায়মান (আ) তাকে বহু ধন-সম্পদ দিয়ে ও নানাভাবে বুঝিয়ে কোনরূপে কিছুটা শান্ত করলেন। এরপর সে নবীর ধর্মে দীক্ষা নিল এবং নবীর সাথে তার শুভ বিবাহ হল।
ছাইদুনের কন্যার রূপে-গুণে সোলায়মান (আ) তার প্রতি এত আকৃষ্ট ছিলেন যে, বিবিদের মধ্যে তাকেই সবচেয়ে বেশী ভালবাসতেন। দিন একরূপ নির্ঝঞ্ঝাটে কটছিল। শীঘ্রই কিন্তু হযরত সোলায়মান (আ)-এর বিপদ ঘনিয়ে আসল।
ছাইদুনের কন্যা ইবলীসের কথামত পিতার মূর্তি বানিয়ে গোপনে পূজা করতে লাগল।
ভিন্ন রাওয়ায়েতে আছে, হযরত সোলায়মান (আ) ছাইদুনের কন্যাকে ধর্মগ্রহণ করতে ও বিবাহের প্রস্তাব দিলে তখন সে বলল, হে জাঁহাপনা। পিতার মৃত্যুজনিত কারণে আমি নিদারুণ মানসিক অশান্তিতে জর্জরিত। যে পিতাকে আমি প্রতিদিন দেখতাম, এখন তার ছবিও আমার দেখার নছীব হচ্ছে না। এ দুঃখের আগুনে আমি অহর্নিশি জ্বলছি। যদি আপনি অনুমতি দেন, তবে আমি পিতার একটি মূর্তি তৈরি করে সর্বদা আমার নিকটে রেখে দেব। যখন পিতার মৃত্যুশোক অনেকটা লাঘব করতাম তখন স্বাভাবিকভাবেই মনের অবস্থার পরিবর্তন ঘটত এবং আমি আপনার দুটি প্রস্তাবই গ্রহণ করতে পারতাম।
তৎকালীন শরীয়তে নিছক উল্লিখিত উদ্দেশ্যে মূর্তি তৈরি করে ঘরে বা নিজের কাছে রাখা নিষিদ্ধ ছিল না; সুতরাং হযরত সোলায়মান (আ) তাকে মূর্তি তৈরি করতে নির্দেশও অনুমতি দিলেন। ছাইদুনের কন্যা তার পিতার মূর্তি বানিয়ে ক্রমে ক্রমে পূজা করতে আরম্ভ করল। অবশ্য এ কাজ সে এত গোপনে করত যে, হযরত সোলায়মান (আ) তার কিছুই জানতেন না।
হযরত সোলায়মান (আ)-এর বিপদমুক্তির বিবরণ
একদিকে ছখরা দেওয়ের পরিণতি আর অন্যদিকে নবী সোলায়মান (আ) জেলের চাকরী করে জীবনযাপন এবং রাতভর আল্লাহর ইবাদাত করে কাটছিলেন। ক্রমে আল্লাহর রহমও ঘনিয়ে আসছিল।
একদিন তিনি মুনিবের কাজে অত্যধিক শ্রান্ত এবং ক্লান্ত হয়ে নদীতীরে গাছের ছায়ায় শুয়ে একটু বিশ্রাম করছিলেন।
আল্লাহর কুদরতে একটি বিষধর অজগর হঠাৎ সেখানে হাজির হয়ে তাঁকে একখানা পত্রযুক্ত গাছের ডাল দিয়ে বাতাস করতে লাগল।
হযরত সোলায়মান (আ) যে জেলে লোকটির চাকরী করতেন তার একটি সুন্দরী কন্যা ছিল। সে পিতার জন্য খানা নিয়ে ঐ পথে গমন করছিল। সে উল্লিখিত দৃশ্য দেখে অদূরে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। হযরত সোলায়মান (আ)-এর চেহারাতে নবুওতী নূর তার নজরে প্রতিভাত হল। তাতে তার হৃদয়ের মধ্যে এক অনির্বচনীয় ভাবের সৃষ্টি হল। সে মুহূর্তে হযরত সোলায়মান (আ)-এর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ল। তার মনে প্রবল আশা জাগল, যেমন করে হোক এ ব্যক্তির পদতলে দেহ-মন সমর্পণ করতেই হবে। তার আর দেরি সইল না, সে সেদিনই পিতাকে বলল, পিতা! আমি বয়স্কা হয়েছি, আমাকে তো তুমি বিবাহ দিবেই, তবে সে ব্যাপারে আমার অনুরোধ এই যে, যে লোকটি তোমার চাকুরি করছে, আমাকে তার হাতে সোপর্দ করো।
কন্যার মুখে এ আশ্চর্য বাক্য শুনে জেলে বলল, হায় হায়! তুমি একি কথা বললে! চাকরের কাছে কন্যা বিবাহ দিলে লোকে আমাকে কি বলবে তা একবারও ভেবেছ? সবমানুষ আমাকে ধিক্কার দিবে। তোমার ত নানা প্রকার কুৎসা রটনা করবে। আমি আশা করেছি তোমাকে বাদশাহর পুত্রের সাথে বিবাহ দিব। তাতে আমারও সুনাম হবে, তোমার জীবনও সার্থক হবে।
পিতার কথার জবাবে কন্যা বলল, পিতা! আমি এ সম্পর্কে তোমার কোন কথাই শুনব না। তুমি যদি আমাকে তার নিকট বিবাহ না-দাও, তবে আমি আর অন্য কারও সাথে বিবাহে আবদ্ধ হব না। চিরজীবনই আইবুড়ো থাকব।
জেলে বুঝতে পারল যে, কন্যা যেরূপ কঠিন পণ করেছে তাতে এ লোকটির কাছে তাকে বিবাহ না দিলে সে জীবনে শান্তি পাবে না। অগত্যা বাধ্য হয়ে সে তখনই কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে হযরত সোলায়মান (আ)-এর কাছে আসল। তিনি তখন ঘুম হতে জাগরিত হয়েছিলেন। মুনিবকে দেখে উঠে বসলেন।
জেলে এসে কোন ভূমিকা না করে সরাসরি প্রথমেই হযরত সোলায়মান (আ)-কে বললেন, বাবা! আমি আমার এ কন্যাকে তোমার নিকট বিবাহ দিতে চাই। এ ব্যাপারে তুমি তোমার মতামত ব্যক্ত কর।
হযরত সোলায়মান (আ) জবাব দিলেন, জনাব! আমি আপনার অধীনে চাকুরি করে জীবিকা নির্বাহ করি। তাতে আমার নিকট আপনার কন্যা বিবাহ দিবেন তা অবিশ্বাস্য বৈকি!
জেলে বলল, না বাবা, এতে অবিশ্বাসের কি আছে? চাকুরি করে তো অনেকেই জীবিকা অর্জন করে, তাতে কি সে অপাংক্তেয় হয়ে যায়?
সোলায়মান (আ) বললেন, জনাব। আমি তো এমন চাকুরি করি যে, সারাদিন কাজ করে মাত্র দুটি মাছ পাই। তা দ্বারাই আমার ভরণ-পোষণ চালাচ্ছি। আমার নিকট অবশিষ্ট কিছুই থাকে না। তা ছাড়া আমার কোন কিছুই নেই যে, তা দ্বারা আপনার কন্যার বিবাহের মোহর আদায় করব।
তাঁর কথায় জেলে বলল, বাবা। তোমার নিকট আমার কন্যা মোহরানা চাইছে না। আর তোমাদের খোরাক বাবত যা কিছু লাগবে তার জিম্মা আমিই। সে ব্যাপারে তোমার মোটেই ভাবতে হবে না।
জেলের মুখে এসব কথা শুনে হযরত সোলায়মান (আ) এবার জেলে-কন্যাকে বিবাহ করতে সম্মত হলেন। জেলে তখনই তাঁকে সঙ্গে করে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন, নিজের কন্যার সাথে তাঁকে পরিণয়াবদ্ধ করে দিলেন।
এরপর স্ত্রীকে নিয়ে হযরত সোলায়মান (আ)-এর দিনগুলো মোটামুটি সুখেই কাটছিল। কিন্তু তিনি তার শ্বশুরের অধীনে চাকুরিটি এখনও করতে লাগলেন এবং প্রতি রাতেই পূর্বকৃত অপরাধ এবং ভুলের জন্য আল্লাহর দরবারে মাফী তলব করে চললেন। আল্লাহর দয়া তখন তাঁর জন্য আরও আসন্ন হল।
এরপর দেও ছখরা যেদিন হযরত সোলায়মান (আ)-এর আংটিটি নদীতে নিক্ষেপ করল ও তা একটি মাছ গিলে ফেলল, সেদিনও সোলায়মান (আ)-এর শ্বশুর তাকে সঙ্গে নিয়ে নদীতে জাল ফেলল। আল্লাহর রহমতে যে মাছটি আংটিটি গিলেছিল, সে মাছটিও তাদের জালে ধরা পড়ল।
সারাদিন মাছ ধরার পর সন্ধ্যায় জেলে আজ তার জামাতাকে দুটি মৎস্যের স্থলে তিনটি মাছ দিল। হযরত সোলায়মান তার একটি মাছ স্ত্রীর কাছে রান্না করতে দিয়ে বাকী দুটি মাছ বিক্রয় করে বাজার হতে রুটি ক্রয় করে আনলেন।
এদিকে তাঁর স্ত্রী মাছ কুটতে বসল। যখন সে মাছটির পেট চিরে ফেলল, সহসা তার পেট হতে উজ্জ্বল একটি আংটি বের হল। আংটির উজ্জ্বল আলোকে রাতের অন্ধকার দূরীভূত হল। এ অবাক কাণ্ড দেখে হযরত সোলায়মান (আ)-এর স্ত্রী আশ্চর্য হয়ে তার স্বামীকে ডাকল। হযরত সোলায়মান (আ) ছুটে গেলেন এবং দেখলেন যে, তাঁর সে অপহৃত আংটিটি হাতে দিয়ে তাঁর স্ত্রী বলল, হে স্বামী। এই মাছটির পেটে পাওয়া গেল।
এ আশ্চর্য ঘটনায় নবী সোলায়মান (আ) অভিভূত হয়ে গেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে সিজদায় পতিত হয়ে আল্লাহর দরবারে শোকর আদায় করলেন।
এরপর সিজদাহ হতে মাথা উত্তোলন করে তিনি আংটিটি নিজ আঙ্গুলে পরলেন। তা আঙ্গুলে পরিধান করামাত্রই আংটির ঐশীশক্তি প্রকাশ হতে লাগল। চারদিক হতে দেও-দানব ও জ্বিন-পরীগণ দলে দলে হাজির হয়ে জোড় হাতে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে গেল। বায়ুও তাঁর আসন নিয়ে জলদি এসে পৌছল।
এসব দৃশ্য দেখে হযরত সোলায়মান (আ)-এর স্ত্রী কোন কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তখন হযরত সোলায়মান (আ) তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, তুমি ভয় পেও না। আমি স্বয়ং নবী ও বাদশাহ সোলায়মান।
ইতোমধ্যেই আল্লাহ তাঁকে অহীযোগে সমস্ত ঘটনা জানিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি তা সবকিছু নিজের স্ত্রীর কাছে বর্ণনা করলেন। স্ত্রী সে সব ঘটনা শুনে একাধারে বিস্ময়বোধ করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজের জীবনকে সার্থক মনে করে আল্লাহর দরবারে লাখো শোকরিয়া জ্ঞাপন করলেন।
হযরত সোলায়মান (আ)-এর শ্বশুর পরিবারে আনন্দের ঢল নামল।
এরপর হযরত সোলায়মান (আ) বায়ুকে নির্দেশ করলেন, তুমি এবার আমাদেরকে নিয়ে স্বদেশের দিকে চল। স্ত্রীকে নিয়ে তিনি আসনে আরোহণমাত্র বায়ু আসন নিয়ে হযরত সোলায়মান (আ)-এর দেশে রওয়ানা হল।
এভাবে হযরত সোলায়মান (আ)-এর প্রত্যাবর্তনের পর তাঁর রাজ্যে খুশীর বন্যা বইতে লাগল। তাঁর পাত্র-মিত্র, উজীর-নাজীর সকলে এসে হাজির হল এবং তাঁকে অভিবাদন জানাল।
হযরত সোলায়মান (আ) এতদিন পর আবার সিংহাসনে বসলেন। শাহী দরবার এবং শাহী মহলের সকলেই যেন নূতন জীবন ফিরে পেল এবং খুশীতে সবাই আল্লাহর দরবারে লাখো লাখো শোকর আদায় করতে লাগল।
বলাবাহুল্য যে, এতদিনে সোলায়মান (আ)-এর নিকট তাঁর এত দিনকার দুঃখ ও বিপদসমূহের মূল কারণের সংবাদ পৌঁছে গিয়েছিল। তিনি জানতে পারলেন ইতোপূর্বে যে তিনি বাদশাহ ছাইদুনের কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন, সে তাঁরই মহলে বসে পিতার মূর্তি বানিয়ে গোপনে তার পূজা করছে। আর তার সাথে ছাইদুন দ্বীপ হতে আগত চার সহস্র দাসী-বাঁদী প্রত্যেকেই তারই মহলে থেকে গোপনে গোপনে তাদের বাপ-দাদাদের কুফরী কার্যাবলি করে চলেছে।
এ সংবাদ হযরত সোলায়মান (আ)-এর নিকট প্রকাশ হওয়ামাত্র তিনি তাঁর সে স্ত্রী ও তার উক্ত দাসী-বাঁদীদের উপর রাগে এবং ঘৃণায় অস্থির হয়ে পড়লেন। মনে মনে ভাবলেন, আল্লাহ তায়ালা ন্যায় বিচারক বলেই তো আমার উপর বিগত বিপদসমূহ নাযিল করেছিলেন। তিনি যে নবীকে তাঁর ধর্ম প্রচারের জন্য প্রেরণ করেছেন, তার নিজের ঘরেই যদি অধর্ম চলতে থাকে তবে তা আল্লাহ তায়ালা সহ্য করবেন কেন? আল্লাহ আমাকে যে শাস্তি দিয়েছেন তা তিনি ঠিকই করেছেন। সত্যিই আমি শাস্তি পাওয়ার যোগ্যই ছিলাম।
হযরত সোলায়মান (আ) তাঁর উক্ত স্ত্রী এবং তার চার সহস্র বাঁদীর বিষয় নিখুঁতভাবে তদন্ত করে জানলেন যে, তখনও গোপনে তারা তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করছে ও তাদের মনোভাব এতটুকুমাত্র পরিবর্তিত হয়নি। বাহ্যিকভাবে শুধু সাময়িক স্বার্থ সিদ্ধির জন্য যদিও তারা নবীর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করছে, আসলে তারা তাঁর প্রতিও শত্রুতা পোষণ করছে। তখন তিনি নিজের মন অত্যন্ত কঠিন করে কর্তব্য সাধনে স্থির প্রতিজ্ঞ হলেন এবং তাঁর স্ত্রী ছাইদুনের কন্যা ও তার সমস্ত বাঁদীকে হত্যা করে ফেললেন।
এভাবে হযরত সোলায়মান (আ) তাঁর মহল অভ্যন্তরস্থ অপবিত্রতা মোচন করে তাঁর প্রধান শত্রু ছখরা দেওয়ের দিকে মনোনিবেশ করলেন। তাঁর অনুগত দেও-দানবগণের প্রতি আদেশ দেয়া হল যে, ছখরা কোথায় আছে, তোমরা খুঁজে বের কর। আদেশ অনুযায়ী সারা দুনিয়ায় তার অনুসন্ধান শুরু করল। বহু তালাশের পর কতিপয় দেও এসে নবী হযরত সোলায়মান (আ)-কে জানাল যে, সে পৃথিবীর সীমান্ত এলাকায় কোন এক মহাসমুদ্রের দ্বীপে অবস্থান করছে। তার সাথে তার কিছুসংখ্যক অনুসারীও রয়েছে, আদেশ পেলে যে কোন কৌশল অবলম্বন করে আমরা তাকে জাঁহাপনার দরবারে গ্রেফতারপূর্বক হাজির করতে পারি।
হযরত সোলায়মান (আ) আদেশ করলেন, হাঁ, তোমরা যে কোনভাবে পার, তাকে বন্দী করে আমার দরবারে হাজির কর।
হযরত সোলায়মান (আ)-এর নির্দেশ পেয়ে কতিপয় দেও উক্ত মহাসমুদ্রের দ্বীপে উপস্থিত হল। কিন্তু সেখানে বহু অনুসন্ধান করেও ছখরা দেওয়ের খোঁজ না পেয়ে অবশেষে তারা সমগ্র দ্বীপে ঢোল-শহরত যোগে এরূপ প্রচার আরম্ভ করল যে, আমরা নবী সোলায়মান (আ)-এর রাজ্য হতে ছখরা দেওয়ের জন্য একটি সুসংবাদ নিয়ে এসেছি-কিছুদিন হয় নবী সোলায়মান (আ)-এর মৃত্যু হওয়ায় তাঁর পরিত্যক্ত সিংহাসন খালি পড়ে রয়েছে। এখন যোগ্যপাত্র হিসেবে আমরা ছখরাকেই পছন্দ করেছি। তাকে আমরা ঐ সিংহাসনে বসাতে চাই। কিছুক্ষণ এভাবে প্রচারণা চালাবার পর উক্ত দ্বীপের এক গুপ্তস্থান হতে উৎফুল্ল বদনে ছখরা বের হয়ে আসল। তাকে দেখে আগত দেও-দানবগণ সকলেই তাকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললঃ ওহে আমাদের আগামী দিনের শাহানশাহ। তুমি এত দূরদেশে আছ বলে কোন খবর জানতে পারনি। কয়েকদিন হল নবী হযরত সোলায়মান (আ) পরলোক গমন করেছেন। এখন তাঁর পরিত্যক্ত সিংহাসনে বসার জন্য আমরা একমাত্র তোমাকেই যোগ্যতম বলে মনে করি এবং এজন্যই আমরা তোমার সন্ধানে এসেছি। অতএব তুমি দেরি না করে আমাদের সঙ্গে চল।
তাদের কথা শুনে ছখরা মনে মনে ভাবল যে, সে একবার ইতোপূর্বে এই তখতেই আসন গ্রহণ করেছিল, কিন্তু তা সম্ভব হয়েছিল তার কৌশল এবং প্রতারণার মাধ্যমে। কিন্তু আজ সে সিংহাসনের অধিকারীরূপে বরণ করে নিতে সেখানকার অধিবাসীগণই তার নিকট এসেছে, এ অপেক্ষা সৌভাগ্যের বিষয় আর কি হতে পারে।
ছখরা আনন্দে অধীর হয়ে তক্ষণি আগত দেও-দানবদের সাথে রওয়ানা হল। পথের মধ্যে সুযোগ মত সহসা দেওগণ ছখরাকে বেঁধে বন্দী করে ফেলল এবং তাকে হযরত সোলায়মান (আ)-এর দরবারে হাজির করল।
হযরত সোলায়মান (আ) তাঁর এত বড় বিশ্বাসঘাতক শত্রুকে বাগে পেয়ে তাকে একটি বাক্সে বন্দী করে সমুদ্রে নিক্ষেপ করলেন, ফলে সে সহসা মৃত্যুব মাধ্যমে ত্রাণ লাভ না করে কিয়ামত পর্যন্ত বন্দী থেকে তার অমার্জিত অপরাধের ফল ভোগ করতে থাকবে।
আরো পড়ুন: হযরত ইয়াকুব (আ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
হযরত সোলায়মান (আ)-এর ইন্তেকাল
কুরআন মাজীদের উদ্দেশ্য, যেমন হযরত সুলায়মান (আ) এর ইন্তেকালের ঘটনা বর্ণনা করা, তদ্রূপ বনী ইসরাঈলদেরকে তাদের বোকামি সম্পর্কে অবহিত করাও এ অন্যমত উদ্দেশ্য। কেননা, তাদের আকীদা অনুযায়ী যদি জ্বিনের গায়েবী জ্ঞানসম্পন্ন হত, তবে তারা দীর্ঘকাল পর্যন্ত হযরত সুলায়মানস (আ)-এর ভয়ে বাইতুল মুক্বাদ্দাসের কিংবা মতান্তরে অন্য কোন শহরের নির্মাণ কাজের কঠিন পরিশ্রমে লিপ্ত থাকত না।
অর্থঃ যখন আমি সূলায়মানের মৃত্যুর ফায়ছালা করে দিলাম, তখন (কমরত) জ্বিনাদেরকে কেউ তাঁর মৃত্যুর কোন সংবাদ প্রদান করেনি উপইপোকা ছাড়া যারা হযরত সুলায়ামান এর লাঠিটি খেয়ে ফেলছিল। যখন পড়ল যে কি ভাল হত যদি তারা, গায়েবী ইলম জানত। তবে এ কঠিন মুছিবতে পতিত থাকতাম না। (সূরা নাবা-১৪)
ফলত যেভাবে তারা হযরত সুলায়মান (আ)-এর মৃত্যু সংবাদ জানতে পেরেছে তারপর স্বসং শয়তানেরা অর্থাৎ, জ্বিনেরাও একথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে, আমরা যে গায়েবী ইল্ম জানি বলে দাবি করতাম, তা সম্পূর্ণ ভুল সাব্যস্ত হল।
ইস্রাঈলী রেওয়ায়েত সমূহ হতে গৃহীত একটি বেযায়েতে বর্ণিত আছে যে, যখন মালাকুল মউত (আ) এমে হযরত সুলায়মাস (আ) তে এ পয়ড়া, শুনালেন, "আপনার মৃত্যুর মাত্র আর কয়েক ঘন্টা বাকী আছে।" তখন তিনি একথা বিবেচনা করে যে, পাছে জ্বিনেরা আমার এ ইমারত নির্মাণের কাজ অসম্পূর্ণ রেখে না দেয়, সাথে সাথে জ্বিনদেরকে আদেশ করে কাঁচ দ্বাবা একটি হুজরা নির্মাণ করালেন। এতে দরজা রাখলেন না। নিজে এর ভিতর আবদ্ধ অবস্থায় লাঠির উপর ভর করে দণ্ডায়মান হয়ে ইবাদতে মশগুল হয়ে গেলেন। এ অবস্থায়ই মালাকুল মইত নিজের কাজ সমাধা করে ফেললেন। প্রায় এক বৎসর পর্যন্ত হযরত সুলায়মান (আ) এ অবস্থায়াই দণ্ডায়মান ছিলে। এদিকে জ্বিনেরা নির্মাণ কাজে মশগুল রইল। যখন তারা নির্মাণ কাজ সমাধা করে ফেলল, তখন হযরত সুলায়মান (আ)-এর নাঠিতে উইপোকার জন্ম হল এবং লাঠিটি খেয়ে নিষ্ক্রিয় করে ফেলল। ফলে তা হযরত সুলায়মান (আ)-এর ভার বহন করতে অক্ষম হয়ে গেল এবং হযরত সুলায়মান (আ) পড়ে গেলেন। তখন জ্বিনেরা বুঝতে পারল যে, বহুকাল পূর্বেই হযরত সুলায়মান (আ)-এর ইন্তেকাল হয়েছে এবং নিজেদের অজ্ঞতার জন্য আফসুস করতে লাগল।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url