মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জীবনাদর্শ

এই আর্টিকেলটিতে (স)-এর জন্ম ও পরিচয়, আরবের অবস্থা, শৈশব ও কৈশোর, হাজরে আসওয়াদ স্থাপন, হযরত খাদিজার ব্যবসায়ের দায়িত্ব গ্রহণ ও বিবাহ, নবুয়ত লাভ, ইমানের দাওয়াত, ইসলাম প্রচারে তায়েফ গমন, মিরাজে গমন, মদিনায় হিজরত, মদিনা সনদ, বদর ও অন্যান্য যুদ্ধ, হুদাইবিয়ার সন্ধি, মক্কা বিজয়, ক্ষমা, বিদায় হজ সর্ম্পকে বিস্তারিত জানতে পারবেন।

ভূমিকা 

আমরা আগেই জেনেছি, আল্লাহ তায়ালা মানুষের হিদায়াতের জন্য যুগে যুগে নর্বি-রাসুল পাঠিয়েছেন। তাঁরা নিজেরা আল্লাহর হুকুম পালন করে মানুষদের হাতে-কলমে শিক্ষা দিতেন। তাঁরা ছিলেন মানুষের মহান ও আদর্শ শিক্ষক। নবি-রাসুলগণ ছিলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী। তাঁরা ছিলেন সত্যবাদী, নির্লোভ ও নিষ্পাপ। তাঁরা ছিলেন দয়ালু ও মানব-দরদী। তাঁরা আজীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। তাঁরা আল্লাহ তায়ালার দীন প্রচারে সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করেছেন। পৃথিবীতে অনেক নবি-রাসুল এসেছেন। তাঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম নবি হযরত আদম (আ) আর সর্বশেষ নবি হযরত মুহাম্মদ (স)। এ অধ্যায়ে আমরা মহানবি হয়রত মুহাম্মদ (স) এর জীবনাদর্শ সম্পর্কে জানবো।

মহানবি (স)-এর জন্ম ও পরিচয়

মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স) ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ২০ এপ্রিল এবং রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল্লাহ, মাতার নাম আমিনা। তাঁর দাদার নাম ছিল আব্দুল মুত্তালিব। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয় মুহাম্মদ এবং আহমাদ। তাঁর জন্মের পূর্বেই পিতা আব্দুল্লাহ মারা যান।

আরবের অবস্থা

মহানবি (স)-এর জন্মের সময় আরবের লোকেরা নানা পাপের কাজে লিপ্ত ছিল। মারামারি, কাটাকাটি, ঝগড়া-ফেসাদ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, চুরি, ডাকাতি, হত্যা, লুণ্ঠন, মদ, জুয়া ইত্যাদি নিয়েই তারা মেতে ছিল। এক আল্লাহকে ভুলে তারা নানা দেব-দেবীর মূর্তি বানিয়ে পূজা করত। পবিত্র কাবা তারা মূর্তিতে ভরে রেখে ছিল। কাবা প্রাঙ্গণে তারা ৩৬০টি মূর্তি স্থাপন করেছিল। তখন বাজারে পণ্যের মতো মানুষ বেচাকেনা হতো।

মনিবরা দাস-দাসীদের প্রতি অমানবিক নির্যাতন করত। পরিবারে ও সমাজে নারীদের কোনো মান-সম্মান বা অধিকার ছিল না। সে সময় কন্যা শিশু জন্মগ্রহণ করা পিতা- মাতার জন্য খুবই অপমানের বিষয় ছিল। মেয়ে শিশুদের নিষ্ঠুরভাবে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে রাখা হতো। তাদের আচার-আচরণ ছিল বর্বর ও মানবতাবিরোধী। এ সময়ে মানুষের জানমালের কোনো নিরাপত্তা ছিল না। মদপান, জুয়াখেলা, সুদ, ব্যভিচার ছিল তখনকার লোকদের নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। কুসংস্কার ও পাপ-পঙ্কিলতার অতলতলে নিমজ্জিত ছিল তারা। সে সময়কে বলা হয় 'আইয়ামে জাহিলিয়া' বা মূর্খতার যুগ। মানবতার এ চরম দুর্দিনে আল্লাহ তায়ালা তাঁর বন্ধু সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানব হযরত মুহাম্মদ (স) কে পাঠালেন বিশ্বমানবতার শান্তিদূত হিসেবে। পথহারা মানুষকে সত্য, সুন্দর, ধর্ম ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করার জন্য।

আরো পড়ুন: হযরত ইদরিস ( আ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

শৈশব ও কৈশোর

হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জন্মের পর চাচা আবু লাহাবের দাসী সোয়েবা তাঁকে মাতৃস্নেহে লালন-পালন করেন। তারপর তখনকার সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশের প্রথা অনুসারে বানু সাদ গোত্রের বেদুঈন মহিলা হালিমার হাতে তাঁর লালনপালনের ভার দেওয়া হয়। সোয়েবা যদিও তাঁকে অল্পদিন লালন-পালন করেছেন, তবুও তিনি প্রথম দুধমাতা ও তাঁর পরিবারের প্রতি খুব কৃতজ্ঞ ছিলেন। অনেকদিন পরেও তাঁদের খোঁজ-খবর নিয়েছেন এবং উপহার উপঢৌকন দিয়েছেন। পাঁচ বছর পর্যন্ত বিবি হালিমা নিজের সন্তানের মতো শিশু মুহাম্মদ (স) কে লালনপালন করেন। এ সময় শিশু মুহাম্মদ (স)-এর চরিত্রে ইনসাফ ও ত্যাগের একটি অনুপম দৃষ্টান্ত ফুটে ওঠে। তিনি হালিমার একটি স্তন থেকে দুধ পান 'করতেন, অন্যটি দুধ ভাই আবদুল্লাহর জন্য রেখে দিতেন। তিনি বেদুঈন পরিবারে থেকে বিশুদ্ধ আরবি ভাষা শিখেন ও মরুভূমির মুক্ত পরিবেশে সু- স্বাস্থ্যের অধিকারী হন।

পাঁচ বছর বয়সে তিনি মা আমিনার কোলে ফিরে আসেন। আদর-সোহাগে মা তাঁকে লালনপালন করতে থাকেন। কিন্তু মায়ের আদর তাঁর কপালে বেশি দিন স্থায়ী হলো না। তাঁর ছয় বছর বয়সে মাও ইন্তিকাল করেন। এবার তিনি পিতা-মাতা দুজনকেই হারিয়ে এতিম হয়ে যান। এরপর তিনি দাদা আব্দুল মুত্তালিবের আদর-স্নেহে লালিত-পালিত হতে থাকেন। কিন্তু আট বছর বয়সের সময় তাঁর দাদাও মারা যান। এরপর তিনি চাচা আবু তালিবের আশ্রয়ে বড় হতে থাকেন।

আবু তালিবের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলো না। কিশোর মুহাম্মদ (স) ছিলেন কর্মঠ। কারও গলগ্রহ হয়ে থাকা তিনি পছন্দ করতেন না। তিনি চাচার অসচ্ছল পরিবারে নানাভাবে সাহায্য করতেন। বাড়তি আয়ের জন্য রাখালদের সাথে ছাগল-মেষ চরাতেন। রাখাল বালকদের জন্য তিনি ছিলেন আদর্শ। তাদের সাথে তিনি সৌহার্দ্য সম্প্রীতি বজায় রাখতেন। রাখালদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ হলে তিনি বিচারকের ভূমিকা পালন করতেন। তিনি চাচার ব্যবসা-বাণিজ্যেও সাহায্য করতেন। একবার চাচার সাথে ব্যবসা উপলক্ষে সিরিয়ায়ও গিয়েছিলেন। এ সময় বহিরা নামক এক পাদ্রির সাথে তাঁর দেখা হয়। বহিরা তাঁকে অসাধারণ বালক বলে মন্তব্য করেন এবং শেষ নবি বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেন। তিনি আবু তালিবকে তাঁর ব্যাপারে সাবধানও করেন। কারণ শত্রুরা তাঁর অনিষ্ট করতে পারে।

সিরিয়া থেকে ফেরার পর বালক মুহাম্মদ (স) ফিজার যুদ্ধের বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করে আঁতকে ওঠেন। ওকায মেলায় জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে এ যুদ্ধ হয়েছিল। কায়স গোত্র অন্যায়ভাবে এ যুদ্ধ কুরাইশদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। এজন্য একে 'হারবুল ফিজার' বা অন্যায় সমর বলা হয়। এ যুদ্ধ চলে একটানা পাঁচ বছর। অনেক মানুষ আহত-নিহত হলো। যুদ্ধের বিভীষিকাময় করুণ দৃশ্য দেখে, আহতদের করুণ আর্তনাদে তাঁর কোমল হৃদয় কেঁদে উঠল। তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন।

তিনি শান্তিকামী উৎসাহী যুবক বন্ধুদের নিয়ে 'হিলফুল ফুযূল' নামে একটি শান্তি সংঘ গঠন করলেন। এ সংঘের উদ্দেশ্য ছিল আর্তের সেবা করা, অত্যাচারীকে প্রতিরোধ করা, অত্যাচারিতকে সাহায্য করা, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা এবং গোত্রে গোত্রে সম্প্রীতি বজায় রাখা ইত্যাদি। তিনি তাঁর প্রচেষ্টায় অনেক সফলতা লাভ করেন। সেদিনকার শান্তি সংঘের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আজও আমাদের কিশোর ও যুব সমাজ নিজেদের এ ধরনের মহৎ কাজে নিয়োজিত করতে পারে।

ইতোমধ্যেই সত্যবাদী, বিশ্বাসী, আমানতদার, বিচক্ষণ, পরোপকারী, শান্তিকামী যুবক হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আপন-পর সকলেই তাঁকে "আস সাদিক' মানে সত্যবাদী, 'আল-আমীন' মানে বিশ্বাসী উপাধিতে ভূষিত করল। তাঁর কাছে ধন-সম্পদ আমানত রাখতে লাগল।

হাজরে আসওয়াদ স্থাপন

বহুদিন পূর্বের নির্মিত পুরাতন কাবাঘর সংস্কারের কাজ হাতে নিল কুরাইশরা। যথারীতি কাবাঘর সংস্কার করল তারা। কিন্তু পবিত্র হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর স্থাপন নিয়ে বিবাদ লেগে গেল। প্রত্যেক গোত্রই এ পাথর কাবাঘরের দেয়ালে স্থাপনের সম্মান নিতে চাইল। যুদ্ধের সাজ সাজ রব পড়ে গেল। অবশেষে প্রবীণতম গোত্র প্রধান উমাইয়া বিন মুগীরার প্রস্তাব অনুসারে সিদ্ধান্ত হলো, আগামীকাল প্রত্যুষে যে ব্যক্তি সবার আগে কাবাঘরে আসবেন তাঁর ওপরই বিবাদ মীমাংসার ভার অর্পিত হবে। তাঁর সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নিবে। প্রত্যুষে দেখা গেল হযরত মুহাম্মদ (স) কাবাঘরে প্রবেশ করছেন। সবাই আনন্দে চিৎকার করে বলল 'আল-আমীন' আসছেন, আমরা তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। সঠিক মীমাংসাই হবে। মুহাম্মদ (স) একখানা চাদর বিছিয়ে দিলেন। তারপর চাদরে নিজ হাতে পাথরখানা রাখলেন। গোত্র সরদারগণকে ডেকে চাদর ধরতে বললেন। তারা ধরে তা যথাস্থানে বহন করে নিয়ে গেল। 'আল-আমীন' নিজের হাতে পাথরখানা কাবাঘরের দেয়ালে বসিয়ে দিলেন। একটি অনিবার্য যুদ্ধ থেকে সবাই বেঁচে গেল। পাথর উঠাবার সম্মান পেয়ে সবাই খুশিও হলো। বিচার ফয়সালায় বিচক্ষণতা ও নিরপেক্ষতা অবলম্বন করলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়। অনেক অনিবার্য সংঘাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

হযরত খাদিজার ব্যবসায়ের দায়িত্ব গ্রহণ ও বিবাহ

তখনকার দিনে আরবে একজন বিখ্যাত ধনী ও বিদুষী মহিলা ছিলেন। তাঁর নাম খাদিজা। তিনি তাঁর বিশাল বাণিজ্য দেখাশোনা করার জন্য একজন বিশ্বাসী বিচক্ষণ লোক খুঁজছিলেন। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সুন্দর চরিত্রের সুনাম শুনে তিনি তাঁর ওপর ব্যবসায়ের দায়িত্ব অর্পণ করেন। মুহাম্মদ (স) খাদিজার ব্যবসায়ের দায়িত্ব নিয়ে সিরিয়া যান। সাথে খাদিজার বিশ্বস্ত কর্মচারী মাইসারাও ছিলেন। ব্যবসায়ে আশাতীত লাভ করে তিনি মক্কায় ফিরে আসেন। মাইসারার কাছে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সততা, বিচক্ষণতা ও কর্মদক্ষতার কথা শুনে খাদিজা অত্যন্ত মুগ্ধ হন। তিনি তাঁর সাথে নিজের বিয়ের প্রস্তাব দেন। মুহাম্মদ (স)-এর চাচা আবু তালিব হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সাথে খাদিজার বিয়ের সকল ব্যবস্থা করে দেন। শুভ বিবাহ সম্পন্ন হলো, তখন মুহাম্মদ (স)- এর বয়স পঁচিশ বছর। আর খাদিজার বয়স চল্লিশ বছর। তাঁদের দাম্পত্য জীবন অত্যন্ত সুখের হয়েছিল। হযরত খাদিজা বেঁচে থাকতে তিনি অন্য কোনো বিয়ে করেন নি। বিয়ের পরে খাদিজার আন্তরিকতায় তিনি প্রচুর সম্পদের মালিক হন। কিন্তু তিনি এ সম্পদ ভোগ-বিলাস ও আরাম-আয়েশে ব্যয় না করে গরিব-দুঃখী ও আর্ত-পীড়িতদের সেবায় অকাতরে ব্যয় করেন।

নবুয়ত লাভ

হযরত মুহাম্মদ (স) শিশু বয়স থেকেই মানুষের মুক্তির জন্য, শান্তির জন্য ভাবতেন। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তাঁর এ ভাবনা আরও গভীর হয়। মূর্তি পূজা ও কুসংস্কারে লিপ্ত এবং নানা দুঃখকষ্টে জর্জরিত মানুষের মুক্তির জন্য তাঁর সব ভাবনা। মানুষ তাঁর স্রষ্টাকে ভুলে যাবে, হাতে বানানো মূর্তির সামনে মাথা নত করবে, এটা হয় না। কী করা যায়, কীভাবে মানুষের হৃদয়ে এক আল্লাহর ভাবনা জাগানো যায়। কী করে কুফর শিরক থেকে তাদের মুক্ত করা যায়। এ সকল বিষয়ের চিন্তা-ভাবনায় তিনি মগ্ন। বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরে নির্জন হেরা পর্বতের গুহায় নির্জনে ধ্যান করতেন। কখনো কখনো একাধারে দুই-তিন দিনও সেখানে ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। এভাবে দীর্ঘদিন ধ্যানমগ্ন থাকার পর অবশেষে চল্লিশ বছর বয়সে রমযান মাসের কদরের রাতে আঁধার গৃহা আলোকিত হয়ে উঠল।

আল্লাহর ফেরেশতা জিবরাঈল (আ) আল্লাহর মহান বাণী ওহি নিয়ে আসলেন। মহানবি (স) কে লক্ষ্য করে বললেন- 'ইকরা' (পড়ুন)। তিনি মহানবি (স) কে সুরা আলাক-এর প্রথম পাঁচটি আয়াত পাঠ করে শোনালেন-

বাংলা উচ্চারণ:

ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাযী খালাক। খালাকাল ইনসানা মিন আলাক। ইকরা ওয়া রাব্বুকাল আকরাম। আল্লাযি আল্লামা বিল কালাম। আল্লামাল ইনসানা মা-লাম ইয়ালাম।

অর্থ:

১. পাঠ করুন আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।

২. যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে আলাক (এঁটে থাকা বস্তু। থেকে।

৩. পাঠ করুন, আপনার প্রতিপালক তো মহিমান্বিত।

৪. যিনি শিক্ষা দিয়েছেন কলমের সাহায্যে।

৫. শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে- যা সে জানত না। 

(সূরা আলাক, আয়াত: ১-৫)

নবিজি ঘরে ফিরে খাদিজার কাছে সব ঘটনা প্রকাশ করলেন এবং বললেন, "আমাকে বস্ত্রাবৃত করো, আমি আমার জীবনের আশঙ্কা করছি।" তখন খাদিজা নবিজিকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, "না, কখনও না। আল্লাহর কসম। তিনি কখনও আপনার অনিষ্ট করবেন না। কারণ আপনি আত্মীয় স্বজনের সাথে ভালো ব্যবহার করেন, আর্ত-পীড়িত ও দুস্থদের সাহায্য করেন, মেহমানদের সেবা-যত্ন করেন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাহায্য করেন।" হযরত খাদিজার এই উক্তি দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, নবুয়ত লাভের আগেও মহানবি (স) নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে মানবিক মহৎ গুণাবলির অনুশীলন করতেন, মানবতার সেবায় নিয়োজিত থাকতেন। বর্বর আরবদের মধ্যে থেকেও তিনি নির্মল ও সুন্দর জীবনযাপন করতেন। তিনি ছিলেন সমগ্র মানবজাতির জন্য আদর্শ।

আরো পড়ুন:  হযরত আইউব (আ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী 

ইমানের দাওয়াত

নবুয়ত লাভের পর হযরত মুহাম্মদ (স) আল্লাহর নির্দেশে প্রথমে নিকট আত্মীয়-স্বজনের কাছে গোপনে ইমানের দাওয়াত দিতে থাকেন। তাঁর দাওয়াতে সর্ব প্রথমে ইসলাম গ্রহণ। করেন তাঁর সুখ-দুঃখের অংশীদার সতী-সাধ্বী স্ত্রী হযরত খাদিজা (রা)। এরপর তাঁদের পরিবারভুক্ত হযরত আলী (রা) ও হযরত যায়দ ইবন হারিসা (রা) ইসলাম গ্রহণ করেন। পরিবারের বাইরে এবং বয়ঃপ্রাপ্ত পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন হযরত আবুবকর (রা)। তিনি ছিলেন রাসুল (স)-এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এরপর আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ পেয়ে তিনি প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করেন। এতে মূর্তি পূজারিরা তাঁর ঘোর বিরোধিতা শুরু করে। মহানবি (স) ও তাঁর সাহাবিদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালাতে থাকে। তারা মহানবি (স) কে নানা রকম প্রলোভনও দেখাতে থাকে। নেতৃত্ব ও ধন-সম্পদ দেওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। রাসুল (স) স্পষ্টভাবে তাদেরকে জানিয়ে দেন, "আমার এক হাতে সূর্য, আর এক হাতে চাঁদ এনে দিলেও আমি এ সত্য প্রচার থেকে বিরত হব না।"

তিনি বললেন, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। ইবাদত করতে হবে একমাত্র তাঁরই। তিনি এক, অদ্বিতীয়। তাঁর কোনো শরিক নেই। তিনি আরও বললেন, তোমাদের হাতে বানানো দেবদেবীর ও প্রতিমার কোনো ক্ষমতা নেই। এদের ভালোমন্দ করার কোনো শক্তিই নেই। আসমান-জমিন, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র সবকিছুর মালিক একমাত্র আল্লাহ। তিনিই সবকিছুর স্রষ্টা, পালনকারী ও রিজিকদাতা। তিনিই আমাদের জীবন-মৃত্যুর মালিক। সুতরাং দাসত্ব, আনুগত্য ও ইবাদত করতে হবে একমাত্র তাঁরই।

তিনি আরও বললেন, তোমরা সত্য, ন্যায় ও সুন্দরের পথে ফিরে এসো। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, জুয়া, ব্যভিচার, মিথ্যা, প্রতারণা এসবই পাপের কাজ। সুতরাং এগুলো পরিহার করো। কারো প্রতি অন্যায়-অবিচার করবে না। অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করবে না। অন্যায়ভাবে কারো সম্পদ হরণ করবে না। কারো প্রতি জুলুম করবে না।

মহানবি (স) আরও বোঝালেন, তোমাদের দুনিয়ার জীবনই শেষ নয়। মৃত্যুর পরে আরও এক জীবন আছে, তাকে বলে পরকাল। সে জীবন অনন্তকালের। পরকালে আল্লাহর দরবারে দুনিয়ার ভালোমন্দ সব কাজের জন্য হিসাব দিতে হবে।

দুনিয়ার জীবনে যারা আল্লাহ ও রাসুলের কথা মানবে, ভালো কাজ করবে, পরকালে তারা মুক্তি পাবে। চিরসুখের স্থান জান্নাত লাভ করবে। আর যারা আল্লাহ ও রাসুলের কথা মানবে না, মন্দ কাজ করবে, তারা চরম শাস্তির স্থান জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।

ইসলাম প্রচারে তায়েফ গমন

নবুয়তের দশম বছরে মহানবি (স)-এর প্রিয়তমা সহধর্মিনী হযরত খাদিজা (রা) ও তাঁর স্নেহপরায়ণ চাচা আবু তালিব ইন্তিকাল করেন। এতে তিনি শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। সীমাহীন শোক ও কাফেরদের অকথ্য অত্যাচারের মুখেও তিনি দীন প্রচার করতে থাকেন। তিনি মক্কাবাসীদের থেকে এক রকম নিরাশ হয়েই দীন প্রচারের জন্য তায়েফ গমন করেন। সেখানকার লোকেরা ইসলাম গ্রহণতো করলই না, বরং তারা, প্রস্তুরাঘাতে মহানবি (স)-এর পবিত্র শরীর ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত করে ছাড়ল। মহানবি (স) এমন সময়ও তায়েফবাসীদের জন্য বদদোয়া করলেন না। বরং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলেন। ইতিহাসে এমন ক্ষমার দৃষ্টান্ত বিরল।

মিরাজে গমন

মক্কার কাফেরদের সীমাহীন অত্যাচার ও তায়েফবাসীর দুর্ব্যবহারে মহানবি (স) অত্যন্ত মর্মাহত ও ব্যথিত হলেন। তখন আল্লাহ তায়ালা তাঁকে নিজের সান্নিধ্যে নিয়ে গেলেন। তিনি মিরাজে গমন করলেন। তিনি আল্লাহ পাকের দিদারে ধন্য হলেন। নবুয়তের একাদশ সনে রজব মাসের ২৭ তারিখে আল্লাহ তায়ালা মহানবি (স)-কে মসজিদে হারাম থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস এবং সেখান থেকে ঊর্ধ্বলোকে ভ্রমণ করিয়ে আনেন। একেই বলে মিরাজ।

এই ভ্রমণে বায়তুল মুকাদ্দাসে তিনি পূর্ববর্তী নবিগণের সান্নিধ্য লাভ করেন এবং তাঁদের ইমাম হয়ে সালাত আদায় করেন। সেখান থেকে সাত আসমান অতিক্রম করে আল্লাহ তাযালার দিদার লাভ করেন। তিনি আল্লাহর নিকট থেকে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের নির্দেশ পান। মিরাজ মহানবি (স)-এর জীবনে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এতে তিনি নতুন প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে পূর্ণ উদ্যমে দীন প্রচার করতে থাকেন। এই সফরে জান্নাত- জাহান্নাম দর্শন করে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করেন।

মদিনায় হিজরত

৬২১ খ্রিস্টাব্দে হজের মৌসুমে মদিনা থেকে ১২ জন লোকের একটি দল মক্কায় আসেন এবং গোপনে মহানবি (স)-এর সাথে সাক্ষাৎকরে ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তী বছর ঐ সময় মদিনা থেকে ২ জন মহিলাসহ ৭৫ জনের একটি দল মক্কায় আসেন এবং আকাবায় মহানবি (স)-এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁরা মহানবি (স) ও সাহাবিদের মদিনায় হিজরতের আহ্বান জানান এবং সব রকম সাহায্য সহযোগিতা দেওয়ার অঙ্গীকার করেন।

মক্কার কাফিরদের বিরোধিতা ও নির্যাতনের মাত্রা যখন বেড়ে গেল এবং মক্কায় ইসলাম প্রচার বাঁধাগ্রস্ত হলো, তখন মহানবি (স) সাহাবিগণকে মদিনায় হিজরতের নির্দেশ দিলেন এবং নিজে আল্লাহর আদেশের অপেক্ষায় রইলেন।

আল্লাহর ওপর মহানবি (স)-এর গভীর আস্থা ও অটল বিশ্বাস।

কাফেররা দেখল যে, মুসলমানরা মক্কা ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যাচ্ছে। নবি করিম (স) হয়তো এক ফাঁকে দেশ ছেড়ে চলে যাবেন, তাদের শিকার হাত ছাড়া হয়ে যাবে। সকল গোত্র সম্মিলিতভাবে মহানবি (স) কে হত্যার সিদ্ধান্ত নিল। এক রাতে তারা নবি করিম (স) - এর ঘর অবরোধ করল এবং প্রত্যুষে তাঁকে হত্যা করার অপেক্ষায় থাকল। আল্লাহ তায়ালা নবিকে কাফেরদের চক্রান্তের কথা জানিয়ে দিলেন এবং মদিনায় হিজরতের নির্দেশ দিলেন। হিজরত অর্থ 'দেশ ত্যাগ'। মহানবি (স) হযরত আবু বকর (রা) কে সঙ্গে নিয়ে মদিনায় রওয়ানা হলেন। গচ্ছিত সম্পদ মালিকদের ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য মহানবি (স) হযরত আলী (রা) কে তাঁর ঘরে রেখে যান। কাফেররা ঘরে ঢুকে নবি করিম (স)কে না পেয়ে এবং তাঁর বিছানায় আলীকে দেখতে পেয়ে ক্রোধে অধীর হলো। কিন্তু নবি করিম (স)-এর আমানতদারি দেখে তারা মনে মনে লজ্জিত হলো। মহানবি (স) ও আবু বকর সিদ্দীক (রা) কিছুদূর অগ্রসর হয়ে মক্কার সাওর পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিলেন। কাফেররা তাঁদের খুঁজতে খুঁজতে একেবারে গুহার মুখে হাজির হলো। আবু বকর (রা) গুহার মুখে কাফেরদের গতিবিধি লক্ষ্য করে বিচলিত হলেন। মহানবি (স) বললেন, "আবু বকর। চিন্তা করো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন"।

তিনদিন গুহায় অবস্থানের পর মহানবি (স) ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর মদিনায় পৌঁছান। মদিনার আবাল বৃদ্ধ বনিতা পরম আগ্রহ ও ভালোবাসায় মহানবি (স) কে গ্রহণ করলেন, মদিনার ঘরে ঘরে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। নবিজির হিজরত ইসলামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর মাধ্যমে ইসলাম নতুন গতি ও নতুন শক্তি লাভ করে।

মহানবি (স) মুহাজির ও আনসারদের ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করেন। মুহাজির মানে- হিজরতকারী। মক্কা থেকে হিজরত করে যাঁরা মদিনায় যান তাঁদেরকে বলা হয় মুহাজির। আর মুহাজিরদের মদিনায় যাঁরা আশ্রয় ও সাহায্য সহযোগিতা দিলেন, তাঁরা হলেন আনসার। আনসার মানে-সাহায্যকারী।

মদিনা সনদ

মহানবি (স) মদিনায় হিজরত করে একটি আদর্শ সমাজ ও আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হলেন। এখানে মুহাজির, আনসারসহ সকল মুসলমান এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী-ইহুদি, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য মতাদর্শের লোক একত্রে মিলেমিশে সুখে-শান্তিতে নিরাপদে বাস করবে। তাদের মধ্যে শান্তি, সম্প্রীতি বজায় থাকবে এবং স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্মকর্ম পালন করতে পারবে। সঙ্গে সঙ্গে মদিনার নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে এই উদ্দেশ্যে, তিনি সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি লিখিত চুক্তি সম্পাদন করেন। এটিই মদিনা সনদ নামে খ্যাত এবং এটিই পৃথিবীর সর্বপ্রথম লিখিত সনদ। এই সনদে ৪৭টি ধারা ছিল। যেমন-

১. সকল সম্প্রদায় স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। ধর্মীয় ব্যাপারে কেউ কারও ওপর হস্তক্ষেপ করবে না।

২. সনদে স্বাক্ষরকারী সকল সম্প্রদায়কে নিয়ে একটি সাধারণ জাতি গঠিত হবে এবং সকলে সমান নাগরিক সুবিধা ভোগ করবে।

৩. কেউ অপরাধ করলে তা তার ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, সে জন্য গোত্র বা সম্প্রদায় দায়ী হবে না।

৪. হত্যাঁ, রক্তারক্তি, ব্যভিচার ইত্যাদি পাপকর্ম নিষিদ্ধ করা হলো, মদিনা শহরকে পবিত্র বলে ঘোষণা করা হলো।

৫. হযরত মুহাম্মদ (স)-এর পূর্ব অনুমতি ব্যতীত কেউ কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে না।

৬. সম্পদ্রায়গুলোর মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে মহানবি (স) তা মীমাংসা করে দিবেন ইত্যাদি।

মদিনার সনদ হযরত মুহাম্মদ (স)-এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, কুটনৈতিক দূরদর্শিতা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং সুন্দর সমাজ গঠনের এক জ্বলন্ত স্বাক্ষর বহন করে। এতে বিভিন্ন জাতির ধর্মীয় স্বাধীনতা ও আর্থ-সামাজিক অধিকার নিশ্চিত হয়।

বদর ও অন্যান্য যুদ্ধ

মক্কার কাফির-মুশরিকরা চেয়েছিল ইসলাম ও মুসলিমদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে। মদিনায় ইসলামের উত্তরোত্তর উন্নতি দেখে তারা হিংসায় জ্বলে ওঠে। মদিনার ইহুদিরা তাদের প্ররোচিত করছিল। আবার আবু সুফিয়ানের বাণিজ্য কাফেলা মুসলমানদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার গুজব উঠেছিল।

কাফেররা মদিনা আক্রমণের জন্য রওয়ানা হলো। সংবাদ পেয়ে রাসুল (স) ৩১৩ জন সাহাবিসহ মদিনা থেকে প্রায় ৮০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে বদর নামক স্থানে উপস্থিত হন। দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমযান (৬২৪ খ্রিস্টাব্দ) বদর প্রান্তরে দুই পক্ষ পরস্পর মুখোমুখী হলো। কুরাইশ বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা এক হাজার। অস্ত্রশস্ত্র বেশুমার। মুসলিমদের সংখ্যা নগণ্য। অস্ত্রশস্ত্র তেমন কিছু নেই। কিন্তু তাঁরা ইমানের বলে বলীয়ান। তাঁদের আল্লাহর ওপর অকৃত্রিম বিশ্বাস ও ভরসা। তুমুল যুদ্ধ হলো। মুসলিম বাহিনী বিজয়ী হলো।

বদর যুদ্ধে কুরাইশ নেতা আবু জাহেল, ওলীদ, উৎবা ও শায়বাসহ ৭০ জন মারা যায় এবং ৭০ জন বন্দি হয়। মুসলিম পক্ষে ১৪ জন শহিদ হন, কেউ বন্দি হন নি। রাসুল (স) ও মুসলিমগণ যুদ্ধ বন্দিদের সাথে উদার ও মানবিক আচরণ করেছিলেন। নিজেরা না খেয়ে বন্দিদের খাওয়াতেন। নিজেরা পায়ে হেঁটে বন্দিদের বাহনের ব্যবস্থা করতেন। বন্দি মুক্তির চমৎকার ব্যবস্থা করেছিলেন। শিক্ষিত বন্দিদের মুক্তিপণ নির্ধারণ করা হয়েছিল ১০ জন করে নিরক্ষর মুসলিম বালক-বালিকাদের শিক্ষিত করা। এটি শিক্ষাবিস্তারে রসুল (স)-এর প্রচেষ্টারই অংশ। এ যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। স্বল্পসংখ্যক মুসলিম বাহিনীর হাতে কাফেরদের বিরাট বাহিনী পরাজিত হয়। এতে কাফেরদের মনে ভীতির সঞ্চার হয়।

বদর যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের পরেও কাফেররা দমে গেল না। তারা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মুসলমানদের বিরুদ্ধে বারবার আক্রমণ চালাতে লাগল। এরমধ্যে ওহ্রদ ও খন্দকের যুদ্ধ ছিল ভয়াবহ। এসব যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় হলেও ওহুদ যুদ্ধে সামান্য ভুলের জন্য মুসলমানদের অনেক ক্ষতি হয়েছিল। ৭০ জন সাহাবা শাহাদত বরণ করেন। মহানবি (স)-এর পবিত্র দাঁত ভেঙে যায়।

হুদাইবিয়ার সন্ধি

হিজরী ৬ সনে (৬২৮ খ্রিস্টাব্দে) রাসুল (স) উমরা পালনের উদ্দেশ্যে ১৪০০ জন সাহাবিসহ মক্কা যাত্রা করেন এবং মক্কার ৯ মাইল দূরে হুদাইবিয়া নামক স্থানে উপনীত হন। কুরাইশরা উমরা পালনে বাধা দেয়। রাসুল (স) জানালেন আমরা যুদ্ধের জন্য আসিনি, শুধু উমরা করেই চলে যাব। কিন্তু কুরাইশরা তাতেও রাজি হলো না। রাসুল (স) মক্কাবাসীদের কাছে উসমান (রা) কে দূত হিসেবে পাঠান। তাঁর ফিরে আসতে বিলম্ব হওয়ায় তিনি শহিদ হয়েছেন বলে রব ওঠে। রাসুল (স) মুসলমানদের থেকে এই হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার শপথ নেন। কাফেররা ভীত হয়ে উসমান (রা) কে ফেরত দেয় এবং সুহাইল আমরকে সন্ধির প্রস্তাবসহ পাঠায়। দশ বছরের জন্য সন্ধি হয়। এটিই হুদাইবিয়ার সন্ধি নামে খ্যাত।

সন্ধির শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম শর্ত ছিল:

১. মুসলমানগণ এ বছর উমরা না করেই ফিরে যাবেন, আগামী বছর নিরস্ত্রভাবে ৩ দিনের জন্য আসবেন,

২. কোনো মক্কাবাসী মদিনায় আশ্রয় নিলে তাকে মক্কায় ফেরত দিতে বাধ্য থাকবেন, কিন্তু কেউ মদিনা থেকে মক্কায় আসলে তাকে ফেরত দেওয়া হবে না। আরবের যে কোনো গোত্র দুপক্ষের যে কারো সাথে মিত্রতা করতে পারবে ইত্যাদি।

আপাতদৃষ্টিতে এই সন্ধির শর্তগুলো মুসলমানদের জন্য অপমানজনক মনে হলেও প্রকৃত পক্ষে সুফল বয়ে এনেছিল। এতে কাফেররা মুসলমানদের একটি শক্তিধর স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে মেনে নেয়। দেশ-বিদেশে ইসলাম প্রচারের সুযোগ হয়। দলে দলে লোক ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। একে কুরআনে 'প্রকাশ্য বিজয়' বলা হয়েছে।

আরো পড়ুন: হযরত ইয়াকুব (আ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী 

মক্কা বিজয়

কুরাইশ ও তাদের মিত্র বনু বকর হুদাইবিয়ার সন্ধি ভঙ্গ করে মুসলমানদের মিত্র খুযআ গোত্রকে আক্রমণ করে, তাদের মালামাল লুট করে এবং অনেককে আহত ও নিহত করে। রাসুল (স)-এর শান্তি প্রস্তাব গ্রহণ না করে তারা সন্ধি বাতিল করে।

৮ম হিজরির রমযান মাসে মহানবি (স) দশ হাজার সাহাবি নিয়ে মক্কা বিজয়ের জন্য যাত্রা করেন। হঠাৎ এতো বড় মুসলিম বাহিনী দেখে কুরাইশরা ভয় পেয়ে গেল। অবস্থা বেগতিক দেখে কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান মহানবি (স) কে মক্কায় স্বাগত জানায়। মহানবি (স) প্রায় বিনাবাধায় একেবারে বিনা রক্তপাতে মক্কা জয় করেন।

ক্ষমা

যে মক্কাবাসী একদিন মহানবি (স) ও মুসলমানদের নির্মম নির্যাতন করেছিল, মহানবি (স) কে হত্যা করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল, যাঁকে জন্মভূমি মক্কা ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল, মদিনায়ও তাকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। সেই মক্কায় তিনি বিজয়ীর বেশে হাজির হন। তিনি এখন মক্কার একচ্ছত্র অধিপতি। আর মক্কাবাসী তাঁর সামনে অপরাধীর বেশে দণ্ডায়মান।

মহানবি (স) জিজ্ঞেস করলেন, "তোমরা আমার কাছে কেমন ব্যবহার প্রত্যাশা করছ?"

তারা বলল, "আজ আপনি আমাদের যে কোনো শান্তি দিতে পারেন, তবে আপনি তো আমাদের দয়ালু ভাই ও দয়ালু ভাইয়ের পুত্র, আপনার কাছে আমরা দয়াপূর্ণ ব্যবহারই প্রত্যাশা করছি।"

রাসুল (স) বললেন, "আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই, যাও তোমরা মুক্ত, স্বাধীন।"

মহানবি (স) সবাইকে ক্ষমা করেছিলেন। কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানকেও ক্ষমা করেছিলেন। এই আবু সুফিয়ান উহুদ যুদ্ধে কাফেরদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এতে মহানবি (স)-এর দাঁত শহিদ হয়েছিল। তাঁর প্রিয় চাচা হযরত হামযা (রা) শহিদ হয়েছিলেন। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তাঁর কলিজা চর্বন করেছিল। তিনি তাকেও ক্ষমা করেছিলেন। ক্ষমার এ এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত।

বিদায় হজ

মহানবি (স) দশম হিজরিতে হজ পালনের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। এটা ছিল তাঁর জীবনের শেষ হজ। তিনি এরপর আর হজ করার সুযোগ পাননি। তাই একে বিদায় হজ বলে।

মহানবি (স) লক্ষাধিক সাহাবি নিয়ে হজ আদায় করেন। এই হজেই তিনি আরাফাত ময়দানে জাবালে রহমতে দাঁড়িয়ে উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে এক মর্মস্পর্শী ভাষণ দেন। এটিই ইসলামের ইতিহাসে বিদায় হজের ভাষণ নামে খ্যাত।

এই ভাষণে মহানবি (স) সমবেত লোকদের উদ্দেশ্যে অনেক মূল্যবান কথা বলেছেন।

যেমন-

১. সকল মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই।

২. আজকের এদিন, এস্থান, এমাস যেমন পবিত্র, তেমনি তোমাদের পরস্পরের জানমাল ও ইজ্জত-আবরু পরস্পরের নিকট পবিত্র।

৩. অধীনস্থদের সাথে ভালো ব্যবহার করবে। তোমরা যা খাবে, তাদেরও তা খাওয়াবে। তোমরা যা পরবে তাদেরও তাই পরাবে।

৪. একের অপরাধে অন্যকে শাস্তি দেবে না।

৫. ঋণ পরিশোধ করতে হবে। সর্বপ্রকার সুদ হারাম করা হলো। সকল সুদের পাওনা বাতিল করা হলো।

৬. নারীর ওপর পুরুষের যেমন অধিকার আছে, পুরুষের ওপর নারীরও তেমন অধিকার আছে।

৭. জাহেলি যুগের সকল কুসংস্কার ও হত্যার প্রতিশোধ বাতিল করা হলো।

৮. আমানতের খিয়ানত করবে না, গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকবে। মনে রাখবে একদিন সকলকে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হতে হবে এবং তাঁর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।

৯. আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর বাণী (আল কুরআন) এবং তাঁর রাসুলের আদর্শ (হাদিস) রেখে যাচ্ছি, তোমরা এই দুইটি যতদিন আঁকড়ে থাকবে, ততোদিন তোমরা বিপথগামী হবে না।

তিনি আরও অনেক মূল্যবান কথা বললেন।

এরপর মহানবি (স) আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, "হে আল্লাহ! তোমার বাণীকে আমি যথাযথভাবে মানুষের নিকট পৌঁছাতে পেরেছি?"

উপস্থিত লক্ষ জনতা সমস্বরে জবাব দিলেন, "হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।"

মহানবি (স) বললেন, "হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাকো।"

এরপর অবতীর্ণ হলো "আমি আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। ইসলামকে তোমাদের জন্য একমাত্র জীবন বাবস্থা হিসেবে মনোনীত করলাম।" (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ৩)

বিদায় হজ থেকে ফেরার পর মহানবি (স) অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবশেষে হিজরি একাদশ সালের ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ রাসুল (স) ইন্তিকাল করেন।

মদিনা শরিফে মসজিদে নববির এক পাশে তাঁকে কবর দেওয়া হয়। বিশ্বের মুসলমানগণ ভক্তিভরে নবির রওজা জিয়ারত করেন।

মহানবি (স) ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের মানুষ। ক্ষমা, উদারতা, ধৈর্য-সহিষ্ণুতা, সততা, সত্যবাদিতা, দয়া, দানে, কাজে-কর্মে, আচার-আচরণে, মানবতা ও মহত্ত্বে তিনি ছিলেন সর্বকালের সকল মানুষের জন্য উত্তম আদর্শ। আল্লাহ তায়ালা বলেন:

বাংলা উচ্চারণ: লাক্বাদ কানা লাকুম ফী রাসুলিল্লাহি উসওয়াতুন হাসানাতুন। অর্থ 'রাসুলুল্লাহ (স)-এর জীবনে তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ রয়েছে।'

 (সূরা আহযাব, আয়াত: ২১)

আমরা মহানবি (স)-এর জীবনাদর্শ মেনে চলব।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url