রেনেসাঁ কি রেনেসাঁর রাজনৈতিক গুরুত্ব ও ব্যাখ্যা
আজ এই আর্টিকেলটিতে রেনেসাঁ সম্পর্কে বলতে পারবেন, রেনেসাঁর রাজনৈতিক গুরুত্ব ও ব্যাখ্যা করতে সর্ম্পকে বিস্তারিত জানতে পারবেন।
ভূমিকা
মধ্যযুগীয় অবস্থা থেকে আধুনিক ইউরোপের অভ্যুদয়ের পেছনে রেনেসাঁর প্রভাব অপরিসীম। রেনেসাঁর কালপর্বকে চিহ্নিত করা হয় পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ কয়েক দশক থেকে ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম তিন দশক পর্যন্ত বিস্তৃত সময়কে। ১৪৫৩ সালে তুর্কীদের হাতে কনস্টান্টিনোপল ও পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর অনেক পন্ডিত পশ্চিম ইউরোপে পাড়ি জমান এবং সেখানকার চলমান প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের পুনরুজ্জীবনের ধারায় আত্মনিয়োগ করেন। প্রথমে ইটালীকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয় এই আন্দোলন। যা পরবর্তীতে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, স্পেনসহ ইউরোপের অপরাপর দেশেও বিস্তৃত হয়। অবশ্য, ১৮৩৫ সালের পূর্বে 'রেনেসাঁ' শব্দটিকে ব্যাপকতর আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করে ব্যবহার করতে দেখা যায় না।
আভিধানিক অর্থে রেনেসাঁর অর্থ হল নব জাগরণ বা প্রাচীন বিশেষত: গ্রীসীয় যুক্তিবাদের ও বিদ্যাচর্চার পুনর্জন্ম। অভিধানে রেনেসাঁর এই অর্থ দেয়া হলেও একে কেবল পুনর্জন্ম বলে ধরে নেয়া যায় না। ব্যাপক ও গভীর অর্থে রেনেসাঁ বলতে বুঝায় পুরনোকে ভিত্তি করে নব নির্মাণ বা নতুন সৃষ্টি। কেবল অতীতে প্রত্যাবর্তনের নাম যেমন রেনেসাঁ নয়; আবার অতীতকে পুরোপুরিভাবে বর্জনের কর্মসূচীও রেনেসাঁয় নেই। অতীতের যা কিছু কল্যাণকর ও স্থায়ী তা- ই রেনেসাঁর বিষয়বস্তু। সে দিক থেকে রেনেসাঁ বলতে প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সাহিত্য, দর্শন, শিল্পকলা সম্পর্কে চর্চার এক অদম্য উৎসাহকে বুঝায়। অতীতের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে বর্তমানের অভিজ্ঞতার আলোকে রেনেসাঁ ভবিষ্যৎকে ধারণ করে।
আরো পড়ুন: নাগরিকের কর্তব্য এবং অধিকার ও কর্তব্যের সম্পর্ক
রেনেসাঁ একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের নাম। মনের মুক্তি তথা চিন্তার স্বাধীনতা অর্জিত হয় রেনেসাঁর মাধ্যমে। মানুষের মধ্যে এক নতুন, স্বাধীন, সাহসী চেতনা ও অনুসন্ধিৎসার মনোবৃত্তিকে জাগিয়ে তোলে রেনেসাঁ। এটি মানুষের চিন্তারাজ্যে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। জাতীয় মানসলোকে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন সংঘটিত হয় এই রেনেসাঁর মাধ্যমে। উল্লেখ্য যে, ইউরোপীয় রেনেসাঁর মূলে আরবীয় মুসলমানদের প্রচুর অবদান ছিল। ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ ইউরোপীয়রা মুসলমানদের সংস্পর্শে এসে গ্রীক-ল্যাটিন ক্লাসিক্যাল চিন্তাধারা ও উন্নত মুসলিম সভ্যতার পরিচয় লাভ করে। এ পরিচয়ের ফলে ইউরোপে রেনেসাঁর উন্মেষ ঘটে। ঐতিহাসিক টয়নবি যথার্থই বলেছেন, 'ক্রুসেড বা ধর্ম যুদ্ধের ফলেই আধুনিক ইউরোপ জন্মলাভ করেছে।' (Modern Europe was born out of the sprit of the Crusade)
এক অর্থে রেনেসাঁ একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এই আন্দোলন জীবন, স্বাধীনতা, রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম প্রভৃতি সম্পর্কে মানুষের মধ্যযুগীয় ধর্মভিত্তিক ধারণাকে পুরোপুরিভাবে পাল্টে ফেলে। রেনেসাঁর মাধ্যমে সংঘটিত পরিবর্তন খন্ডিত বা বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তার প্রতিফলন নয়; বরং এতে মানব সমাজের সামগ্রিক সর্বজনীনতা ফুটে উঠে। দেহের কোন একটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ভালো থাকা দিয়ে যেমন দৈহিক সুস্থতা বুঝায় না, তেমনি রেনেসাঁ বলতে একটি জাতির মানসিক ক্রিয়াকর্মের বিশেষ কোন দিক নয় বরং সার্বিক উৎকর্ষতা ও সাংস্কৃতিক বিকাশকে বুঝায়। এখানে শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, চিত্রকলা, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত। রেনেসাঁকে তাই কেউ কেউ মননশীল সাংস্কৃতিক চেতনা আর তার বিচিত্র সম্প্রসারণের নামান্তর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
রেনেসাঁ আন্দোলনের ফলে সূচিত হয় বিজ্ঞানে নব নব আবিস্কার। কম্পাস ও সমুদ্রপথ আবিষ্কারের ফলে আমেরিকাসহ (১৪৯২ সালে) নতুন নতুন ভূ-খন্ডের সন্ধান ঘটে এ পর্বে। গোলাবারুদের আবিষ্কার এ যুগের অপর একটি অসাধারণ ঘটনা যা বিশ্বব্যাপী ইউরোপীয় আধিপত্য স্থাপনে ও বিস্তারে সহায়তা করে। এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে ব্যাপক বাণিজ্যিক প্রসার ঘটে এ সময়। ছাপাখানা স্থাপনের প্রযুক্তিও আবিষ্কৃত হয় একই সময়ে। মোটকথা, রেনেসাঁ এমন একটি আন্দোলন হিসেবে সূচিত হয় যার ফলে মধ্যযুগীয় শৃঙ্খল থেকে ইউরোপীয় মনন আত্মনির্ভরশীল ও যুক্তিবাদী মনোভাব অর্জনের মাধ্যমে বিজ্ঞান মনস্কতা চিরতরে স্বাধীনতা লাভ করে। ভ্রূনো, কোপার্নিকাস ও গ্যালিলিও'র অসমাপ্ত সংগ্রাম রেনেসাঁর মাধ্যমে সফল পরিসমাপ্তি লাভ করে।
মধ্যযুগীয় পৃথিবীতে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তা ও কর্ম ধর্মীয় বিশ্বাসের দ্বারা পরিচালিত হত। সমুদয় কর্তৃত্ব ছিল ঈশ্বরতান্ত্রিকভাবে সাজানো। কতকটা হিন্দু ধর্মের বর্ণ প্রথার মতোই বিন্যস্ত ছিল খ্রিস্টীয় সমাজ। সৌরজগতের গ্রহ-নক্ষত্রের প্রতীক হিসেবে কৃষকদের তুলনা করা হত চাঁদের সাথে, ব্যবসায়ীদের বুধ গ্রহ, ধনিক গোষ্ঠীকে শুক্র, অভিজাতদের মঙ্গল, পুরনো অভিজাতদের শনি, রাজাকে বৃহস্পতি এবং গীর্জার পুরোহিতকে সূর্যের সাথে। এভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের সবকিছুতেই ছিল খ্রিস্টীয় যাজকতন্ত্রের অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা। ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে পার্থিব ও পারমার্থিক নানা সুবিধাদি ভোগ করছিল যাজক শ্রেণী। রেনেসাঁ মানুষের মননশীলতাকে পরিশীলিত করে গীর্জার যাজকদের কঠোর ধর্মীয় অনুশাসন থেকে মুক্ত করে। রেনেসাঁর কল্যাণে পুরোহিতদের যাজকীয় কর্তৃত্বকে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনের মাধ্যমে মানুষ স্বয়ং অধিষ্ঠিত হয় মর্যাদার আসনে। এতে করে চূড়ান্তড়ভাবে যাজকদের 'ঈশ্বরের দোহাই' মানুষের ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা ও যুক্তির দ্বারা স্থানান্তরিত হয়।
আরো পড়ুন: জাতীয়তাবাদ কি তীয়তাবাদের বিভিন্ন উপাদানের বর্ণনা
এভাবে ইতালীতে গড়ে উঠা নব জাগরণের আন্দোলন প্রবাহ ক্রমশঃ সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। রেনেসাঁর দীক্ষায় দীক্ষিত ইউরোপবাসীরা এ সময় খ্রিস্টধর্মের মধ্যযুগীয় কুসংস্কারের হাত থেকে মুক্তি লাভ করে মানুষের আত্মশক্তিকে অবিষ্কারে সক্ষম হয়। ইউরোপীয় রেনেসাঁ কালক্রমে মনের ইতিহাসের সকল পর্বে যুগান্তকারী মাইল ফলক হিসেবে দেখা দেয়।
রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে রেনেসাঁর প্রথম শুভ সূচনা ঘটে ইতালীয় চিন্তাবিদ নিকোলো মেকিয়াভেলী (১৪৬৯ ১৫২৯) এর নেতৃত্বে। নব জাগরণে উদ্বুদ্ধ মেকিয়াভেলী যাজকদের অতিন্দ্রীয় শক্তিতে বিশ্বাস করতেন না। তিনি ছিলেন রেনেসাঁ জাতক; রাজনৈতিক নবজাগরণের মূর্ত প্রতীক। তাঁর কাছে সাফল্যই ছিল মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি এবং তা যে-কোন উপায়েই অর্জিত হোক না কেন। তাঁর মতে, সাফল্য যেখানে উদ্দেশ্য সেখানে প্রয়োজন প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস আর নির্মমভাবে তা অর্জনের উপায় নির্ধারণ। মধ্যযুগীয় পন্ডিতদের গীর্জাকেন্দ্রিক স্থান রাষ্ট্রচিন্তাকে অবমুক্ত করে মেকিয়াভেলী নতুন এক অভিনব কৌশল বিজ্ঞানের জন্ম দেন, যেখানে সাফল্যই শাসকের নৈতিকতার মাপকাঠি হিসেবে স্বীকৃত হয়। পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে ধর্ম ও নৈতিকতার বন্ধন থেকে রাজনীতিকে পৃথকভাবে উপস্থাপন করেন মেকিয়াভেলী। যুগের চাহিদাকে পূরণ করতে গিয়ে মেকিয়াভেলী রাষ্ট্র চিন্তাকে প্যাপাসির কুসংস্কার ও দুর্নীতি থেকে মুক্ত করে রাজনৈতিক বাস্তবতার দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করেন। বাস্তবে রাজনৈতিক জগৎ যেভাবে পরিচালিত হয়, তারই আলোকে রাজনীতির কৌশল বিশ্লেষণ করেন মেকিয়াভেলী।
সারকথা
একটি সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের নাম। আধুনিক ইউরোপের অভ্যুদয়ের পেছনে রেনেসাঁর গুরুত্ব অপরিসীম। রেনেসাঁ আন্দোলন কেবল যাজকতন্ত্রের হাত থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করেই ক্ষান্ত হয়নি। রেনেসাঁ ইউরোপের সমাজের সামন্ততান্ত্রিক ধারা অবসান ঘটিয়ে আধুনিক জাতি রাষ্ট্র গঠনের সোপান তৈরী করে। ইউরোপের ইতিহাসে রেনেসাঁর প্রভাব ছিল সুদূর প্রসারী।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url