হযরত লুত (আ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
আজ এই আর্টিকেলটিতে লুত (আ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
হযরত লুত (আ)-এর পরিচয়
হযরত ইব্রাহীম (আ)-এর এক সহোদর ভাইয়ের নাম ছিল হারান। লুত উক্ত হারানের ছেলে ছিলেন। লুত এবং আরও কতিপয় ব্যক্তিকে নিয়ে হযরত ইব্রাহীম (আ) কসবায় হারান নামক একটি দেশে গিয়ে উপস্থিত হলেন এবং কিছুদিনের জন্য সেখানে তিনি বসতি স্থাপন করলেন। সেখানে থাকাকালে আল্লাহ তায়ালা অহীর মাধ্যমে হযরত লুত (আ)-কে নবুয়ত দান করলেন। নবুয়ত প্রাপ্তির পরে তিনি দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্যে চাচা হযরত ইব্রাহীম (আ)-এর নিকট হতে বিদায় নিয়ে সদুম নামক এলাকায় চলে গেলেন এবং সেখানে গিয়ে সত্যধর্ম প্রচার করতে শুরু করলেন।
এদিকে হযরত ইব্রাহীম (আ) এ সফরেই স্থানীয় রাজকন্যার স্বয়ম্বর অনুষ্ঠানে যোগ দান করে বিবি সারা নামের সে রাজকন্যাকে কিভাবে বিবাহ করলেন, তারপর উক্ত সারা বিবিকে নিয়ে শামদেশে যাবার পথে মিসরের লম্পট বাদশাহর হাতে বন্দী হয়ে কি ভয়ানক দুর্যোগে পতিত হয়েছিলেন এবং আবার কিভাবে তারা মুক্তিলাভ করেছিলেন, সে ঘটনাগুলো আমরা আগের অধ্যায়ে বর্ণনা করেছি।
আরো পড়ুন:
হযরত ইব্রাহীম (আ)-এর মেহমান: কওমে লুতের ঘটনা
হযরত লুত (আ)-এর কিছু পরিচয় আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। তিনি ছিলেন হযরত ইব্রাহীম (আ)-এর ভাই হারানের ছেলে। তাকে নিয়ে হযরত ইব্রাহীম (আ) শামদেশে গমনকালে পথে এক দেশে সাময়িকভাবে অবস্থান করার কালে হযরত লুত (আ)-কে আল্লাহ নবুয়ত দান করেন এবং আল্লাহ তায়ালারই আদেশে তিনি সদুম নামক একটি জায়গায় গিয়ে আল্লাহর ধর্ম প্রচার শুরু করেন।
ঐ এলাকার অধিবাসীগণ অত্যন্ত অসৎ প্রকৃতিবিশিষ্ট এবং কদাচারলিপ্ত ছিল। তারা ডাকাতী, লুণ্ঠন, পরদ্রব্য অপহরণ এবং দেবদেবীর পূজা-অর্চনায় অভ্যস্ত ছিল। তাদের মধ্যে সবচেয়ে ঘৃণিত এবং কদর্য্য কাজ ছিল লাওয়াতাত তথা পুরুষের সাথে পুরুষের সঙ্গম। লোকগুলোর প্রকৃতি এমন ছিল যে, তারা নারী অপেক্ষা পুরুষের সাথে যৌন মিলনে অধিক আসক্ত ছিল। শুধু সদুমের লোকই নয়, তার পার্শ্ববর্তী আরও কয়েকটি স্থানের লোকও এ ধরনের কাজে লিপ্ত ছিল। যেসব জায়গাগুলোর নাম হল ১। সদুম ২। আমুরা ৩। চাবুরাত ৪। ছউদা এবং ৫। দুয়ামাত।
হযরত লুত (আ) আল্লাহর নির্দেশে ঐ দেশে গিয়ে লাওয়াতাতসহ সকল খারাপ কাজগুলো হতে মানুষকে বিরত রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। একাধারে ঊনত্রিশ বছর পর্যন্ত বিরামহীনভাবে তাঁর চেষ্টা চলল; কিন্তু কোন ফলই দেখা গেল না, রবং তিনি যতই চেষ্টা করলেন লোকগুলো যেন তত আরও বেশি খারাপ হতে লাগল।
এদের অবস্থা দেখে হযরত লুত (আ) আল্লাহর দরবারে হাত তুলে দোয়া করলেন, হে মাবুদ! আপনি সকল কিছুই দেখেন। আপনি এদের অসৎ কর্মও দেখতেছেন ও আমার চেষ্টা-সাধ্যও লক্ষ্য করেছেন। এখন এ এলাকার লোকদের ক্ষেত্রে যা করা দরকার তা আপনিই করুন।
আল্লাহ তায়ালা হযরত লুত (আ)-এর ফরিয়াদের পরিপ্রেক্ষিতে নিজের কর্তব্য নির্ধারণ করলেন এবং ফেরেশতা জিব্রাইল (আ) কে ডেকে আদেশ করলেন: কতিপয় ফেরেশতা সঙ্গে নিয়ে তোমাকে দুনিয়ায় যেতে হবে এবং সেখানে গিয়ে তোমাদের দুটি কাজ সমাধা করতে হবে। তার একটি এ যে, তোমরা আমার নবী ইব্রাহীমকে বিবি সারার গর্ভে তার একটি ছেলেসন্তান জন্মের শুভ সংবাদ দিবে। আর একটি হল, নবী লুত এর কওমের লোকদের দুষ্কৃতির প্রতিফলস্বরূপ তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়ে আসতে হবে।
হযরত লুত (আ) ঐ দেশে গিয়ে সেখানকার অয়েলা নামের এক রমণীকে বিবাহ করেছিলেন; কিন্তু ঘটনাক্রমে সে মহিলাও সত্যধর্মের প্রতি আস্থাশীল ছিল না। সেও ছিল তার স্বামী আল্লাহর নবীর অবাধ্যাচারণী।
হযরত লুত (আ)-এর কতকগুলো গুণ এবং স্বভাব ছিল তাঁর চাচা হযরত ইব্রাহীম (আ)-এর অবিকল অনুরূপ। হযরত ইব্রাহীম (আ) যেমন অত্যন্ত অতিথি বছল ব্যক্তি ছিলেন, হযরত লুতও তেমনি মেহমানদের আদর, আপ্যায়ন ও সেবা-যত্নে আগ্রহী ও অভ্যস্ত ছিলেন।
আরো পড়ুন:
হযরত লুত (আ)-এর সমীপে:
হযরত ইব্রাহীম (আ)-এর দরবারের কাজ সমাধা করে ফেরেশতাগণ হযরত লুত (আ)-এর এলাকায় রওয়ানা করতে উদ্যোগী হলেন। তখন হযরত ইব্রাহীম (আ) ফেরেশতাগণকে বললেন, আমিও আপনাদের সফর সঙ্গী হতে চাই।
ফেরেশতাগণ হযরত ইব্রাহিম (আ)-কে বললেন, দেখুন, আমরা যে কঠিন কাজ সাধন করতে এসেছি আপনি তা দেখে সহ্য করতে পারবেন না। তা আপনার সাধ্যের বাইরে।
তবুও হযরত ইব্রাহীম (আ) তাঁদের সাথে যাওয়ার জন্য জেদ ধরলেন। তাঁরা তাঁকে সঙ্গে নিয়ে চললেন, তবে কিছুদূর গমন করে ফেরেশতাগণ তাঁকে বললেন, আপনি এখানেই অপেক্ষা করবেন। কেননা এর পর আর কাউকেও সাথে নিয়ে যাওয়ার আমাদের জন্য অনুমতি নেই। তাছাড়া সামনে গেলে আপনার বিপদের কারণ রয়েছে। হযরত ইব্রাহীম (আ)-কে ফেরেশতাগণ সেখানে রেখে গেলেন। সেখানে তিনি ইবাদাতে মগ্ন হয়ে গেলেন, আর ফেরেশতাগণ গিয়ে হযরত লুত (আ)-এর বাড়ীতে উপস্থিত হলেন। তার পরবর্তী বিবরণ পবিত্র কোরআনের বর্ণনায় এরূপঃ
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
অর্থঃ অতপর যখন পেরিত (ফেরেশতা) গণ লুত-এর পরিবার বর্গের নিকট আসল তখন দূত বললেন, তোমরা নবগত বোট হচ্ছে। ফেরেশতারা বললেন, না, একথা নয় বরং আমরা আপনার নিকট সে বিষয়টি নিয়ে এসেছি। কতো লোক সন্দেহ পোষন করত। আমাদের আগমন একটি সত্য বিষয়ের জন্য। আমরা নিজেদের বর্ণনায় সত্যবাদী।
"এরপর যখন সে ফেরেশতাগণ হযরত লুত (আ)-এর পরিবারবর্গের নিকট আগমন করল, তখন লুত (আ) বলতে লাগল, তোমরাতো অপরিচিত লোক। ফেরেস্তারা বলল, না, তা নয়, বরং আমরা। আপনার নিকট বস্তু (অর্থাৎ সে শাস্তি) নিয়ে এসেছি, যাতে এ লোকগুলো (লুতের কওমের লোকেরা) সন্দেহ করছিল। আর আমরা আপনার নিকট অবশ্যম্ভাবী জিনিস (আযাব) নিয়ে এসেছি এবং আমরা সম্পূর্ণ সত্যবাদী। অতএব আপনি রাতের কোন অংশে নিজের পরিজনকে নিয়ে সরে পড়ুন এবং আপনি সকলের পিছনে থাকুন (যেন কেউ থেকে না যায় কিংবা গিয়ে ফিরে না আসে) আর তোমাদের মধ্যে কেউ যেন পিছন ফিরে না তাকায় এবং যে জায়গায় যাবার জন্য তোমাদের প্রতি আদেশ হয়েছে, সেদিকে চলে যাও। আর আমি লুত (আ)-এর নিকট এ আদেশ পাঠালাম যে, প্রভাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের একেবারে মূলই কর্তিত হয়ে যাবে। (অর্থাৎ সমূলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।)"
ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি, হযরত লুত (আ)-এর কওমের লোকজন বেশি দুষ্কৃতিকারী ও অত্যাচারি ছিল। আসলে তৎকালীন যমানায় তারা দুনিয়ার মধ্যে সর্বাধিক জঘন্যাচারী ছিল এবং তৎকালীন নবী হযরত লুত (আ) তাদের জন্য সংশোধনের সকল প্রকার চেষ্টা তারা অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তাদের এ অপরাধের ফলে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা তাদের সারা দেশবাসীকেই ধ্বংস করে দেয়ার মনস্থ করে ফেরেশতাগণকে প্রেরণ করলেন।
আরো পড়ুন:
ফেরেশতাগণ যখন লুত (আ)-এর বাড়ীতে উপস্থিত হলেন, তাঁরা তাঁর কন্যাদেরকে বললেন, এ শহরে কি এমন কোন লোক আছে, যারা আমাদেরকে আজকের একটি রাতের জন্য মেহমান হিসেবে আশ্রয় দিতে পারে?
তারা উত্তর করল, না, একমাত্র আমাদের পিতা ছাড়া এ শহরে এমন কোন লোক নেই, যারা আপনাদেরকে আশ্রয় দিতে পারে। আপনারা একটু অপেক্ষা করুন, আমরা আমাদের পিতাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
হযরত লুত (আ) খবর শুনে বাইরে এসে দেখলেন যে, বারজন পরম সুশ্রী যুবক মেহমান এসেছেন। এতে তিনি মনে মনে অতিশয় শঙ্কিত হলেন যে, এরা যেমন পরম সুশ্রী যুবক, তাতে আমার কওমের লোকেরা এদেরকে পেলে এদের সাথে দুষ্কার্য্য করতে চেষ্টা করবে। তিনি মেহমানদেরকে নিজ ঘরের মধ্যে নিয়ে গেলেন, যাতে শহরের কোন লোক এসে তাদের প্রতি কোন রূপ অত্যাচার করতে না পারে; কিন্তু হযরত লুত (আ)-এর স্ত্রী ছিল জনৈকা কাফের এবং অসতী রমণী। সে স্বামীর অবাধ্যাচারণী ও দূষ্কৃতিকারিণী ছিল। ঐ রমণী তখনই শহরের দুরন্ত বদমায়েশদেরকে সংবাদ দিল যে, আমাদের বাড়ীতে পরম সুন্দর বারজন বিদেশী মেহমান এসেছে। তোমাদের ইচ্ছা হলে তাদেরকে উপভোগ করতে পার। এ সংবাদ পেয়ে শহরের বহু বদমায়েশ কাফের হযরত লুত (আ)-এর বাড়ীতে এসে বলল, তোমার বাড়ীতে নাকি বারজন মেহমান এসেছে, তাদেরকে আমাদের হাতে দিয়ে দাও- আমরা ভোগ করব।
হযরত লুত (আ) বললেন, তোমাদের সাথে আমার লড়ার ক্ষমতা থাকলে আমি প্রাণপণে তোমাদেরকে বাধা প্রদান করতাম; কিন্তু আমার সে ক্ষমতা নেই। অতএব আল্লাহ তায়ালাই এদেরকে তোমাদের কবল হতে রক্ষা করবেন। এরপর তিনি মেহমানদেরকে ঘরের মধ্যে রেখে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন।
ফেরেশতাগণ বললেন, হে আল্লাহর নবী! আপনি আমাদের জন্য কোন চিন্তা করবেন না। আমরা আল্লাহর পাঠানো ফেরেশতা এবং আল্লাহর আদেশেই এদেরকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করতে এসেছি। আপনি শেষ রাতে আপনার কন্যাদেরকে ও আপনার ঈমানদার উম্মতদেরকে সঙ্গে নিয়ে এ শহর ছেড়ে বহুদূরে চলে যাবেন, কিন্তু আপনার স্ত্রীকে সঙ্গে নিবেন না আর যাবার সময় কেউই পিছনের দিকে তাকাবেন না।
কিন্তু হযরত লুত যখন মেহমানদেরকে তাদের হাতে সমর্পণ করলেন না, তখন তারা ঘরের দরজা ভেঙ্গে ঘরে প্রবেশ করে মেহমানদেরকে ছিনিয়ে নিতে উদ্যত হল। তখন ফেরেশতা জিব্রাইল তাদের দিকে একটা ফুঁক দিলেন। সংগে সংগে বদমায়েশগণ সকলই অন্ধ হয়ে গেল এবং তাদের সারা শরীরে বেশি যন্ত্রণা শুরু হল। তাছাড়া সারা শরীর কদাকার হয়ে গেল। তারা তখন চীৎকার করতে করতে সেখান হতে পলায়ন করতে লাগল।
হযরত লুত (আ) জিব্রাঈল (আ)-এর নির্দেশমত তাঁর পরিবারবর্গ ও বিশ্বস্ত লোকজনসহ যেখানে চাচা ইব্রাহীম (আ) অবস্থান করছিলেন, সেখানে চলে গেলেন। রাত্রির অবসানে ভোর হওয়ামাত্র ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ) চল্লিশ গজ মাটির নিচে তার সত্তর হাজার পাখা প্রবেশ করিয়ে দিয়ে সারা দেশটাকে এমনভাবে উল্টিয়ে ফেললেন যে, চল্লিশ গজ নীচের মাটি উপরে উঠে আসল আর উপরের মাটি চল্লিশ গজ নীচে চলে গেল। যাতে সমগ্র দেশের লোকজন, বাড়ীঘর, গাছপালা প্রভৃতি সবকিছু ভূগর্ভে মাটির নিচে চাপা পড়ে গেল। এ ব্যাপার ঘটার সময় এমন এক ভীষণ আওয়াজ হল যে, হযরত ইব্রাহীম (আ) ও হযরত লুত (আ) আল্লাহর বেশি গজবের ভয়ে থর থর করে কাঁপছিলেন।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url